বাজার হঠাৎ ঘুরে গেল

শেয়ারবাজারে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিনিয়োগের বিধিনিষেধকে ঘিরে বুধবার নানা নাটকীয়তার পর গতকাল বৃহস্পতিবার বাজারে বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। গত কয়েক দিনের অব্যাহত দরপতনের বিপরীতে গতকাল দুই শেয়ারবাজারই ছিল ঊর্ধ্বমুখী। দিনশেষে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাধারণ মূল্যসূচক আগের দিনের চেয়ে ২৫১ পয়েন্ট বা ৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক বেড়েছে ৬০১ পয়েন্ট বা সাড়ে ৪ শতাংশ।


দুই স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে ডিএসইতে ৯৮ শতাংশ এবং সিএসইতে ৯৬ শতাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে।
তবে ঢাকার বাজারে গতকাল লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৩৮টি বিক্রেতাশূন্য ছিল। আবার অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম দিনের শুরুতেই দরবৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা (সার্কিট ব্রেকার) স্পর্শ করে। তাই মূল্যসূচক অনেকটা বাড়লেও লেনদেন তেমন বাড়েনি।
গতকালও লেনদেন চলার পুরো সময় বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ ডিএসইর সামনে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে। এ জন্য অবশ্য রাজপথে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়নি।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, লেনদেন চলাকালে ব্যবসায়ীদের একটি সংগঠনের আলোচনা সভায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের একটি বক্তব্য গতকালের বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
গতকাল মেট্রো চেম্বারের এক আলোচনা সভায় অর্থমন্ত্রী তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে নামমাত্র শেয়ার থাকার বিষয়ে সমালোচনা করে বলেন, বিভিন্ন কোম্পানির প্রায় দেড় হাজার পরিচালক রয়েছেন যাঁরা ওই সব কোম্পানিতে নামমাত্র শেয়ারের মালিক। এটা তাঁদের বেশ দায়িত্বহীন আচরণ।
উল্লেখ্য, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে সম্মিলিতভাবে সব সময় ৩০ শতাংশ এবং পরিচালকদের এককভাবে ২ শতাংশ শেয়ার ধারণসংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করে।
ওই নির্দেশনা জারির পর গতকাল প্রথমবারের মতো সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবে একে সমর্থন দেওয়া হলো।
বাজার বিশ্লেষকেরা আরও বলেছেন, বড় ধরনের অস্থিরতার পর গতকালের বাজারের যে আচরণ ছিল, তা স্বাভাবিক। কারণ, অস্বাভাবিক দরপতনের পর যখন কোনো খবরে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব দেখা দেয়, তখন বিনিয়োগকারীরা আর লোকসানে শেয়ার বিক্রি করতে চান না। সবার মধ্যে শেয়ার ধরে রাখার মানসিকতা তৈরি হয়। এতে মূল্যসূচকও বেড়ে যায়।
অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক: বাজারের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল দুপুরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছে এসইসি। এসইসির চেয়ারম্যান ও সব সদস্য বৈঠকে যোগ দেন।
বৈঠকের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেলেও এর আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে মন্ত্রণালয় ও এসইসির পক্ষ থেকে কিছুই জানানো হয়নি।
এদিকে, সম্প্রতি সরকারের আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রাবিনিময় হারসংক্রান্ত সমন্বয় পরিষদের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এসইসিতে একটি চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে ‘পুঁজিবাজারে অধিক পরিমাণ নীতিনির্ধারণী হস্তক্ষেপের পরিবর্তে স্বয়ংক্রিয় এবং যথাযথভাবে পরিচালনার উপযোগী পরিবেশ ও বিধিবদ্ধ কাঠামো তৈরি’তে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে এসইসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের নির্দেশনা জারির পরও এসইসিকে না জানিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী হস্তক্ষেপ বাজারে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে।
গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদের সভায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে বিধিনিষেধের বিষয়টি আলোচিত হয়, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। বড় ধরনের দরপতনের আশঙ্কায় দুই স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ লেনদেন বন্ধ রাখে এবং সরকারের কাছে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দাবি করে।
বুধবার লেনদেন শুরুর আগে এসইসি সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, মন্ত্রিপরিষদের সভায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে ওই দিন বিকেলেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা পরিপত্রে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। আবার একই দিন সন্ধ্যায় পরিপত্র প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়।
এ অবস্থায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে নিজেদের ও সরকারের অবস্থান জানতে গতকাল অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে এসইসি বৈঠকে বসে।
বিশেষ স্কিম কমিটির মতবিনিময়: শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক ধসে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের খুঁজে বের করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এ-সংক্রান্ত বিশেষ স্কিম কমিটির প্রধান ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ফায়েকুজ্জামান।
গতকাল বিকেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এ তথ্য জানান। এ সময় কমিটির সদস্য ও ডিএসইর প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) শুভ্রকান্তি চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন।
ফায়েকুজ্জামান জানান, কাল শনিবার স্কিম কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, তা চূড়ান্ত করা হবে। পরে প্রতিবেদন বা সুপারিশ আকারে তা সরকারের কাছে জমা দেওয়া হবে।
বাজারচিত্র: ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক গতকাল বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৯৪৬ পয়েন্টে। এদিন ঢাকার বাজারে ২৬৩টি কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের শেয়ার লেনদেন হয়। এর মধ্যে ২৫৮টির দাম বেড়েছে, কমেছে মাত্র পাঁচটি কোম্পানির শেয়ারের দাম। দিনশেষে ডিএসইতে ৩২১ কোটি টাকার লেনদেন হয়, যা আগের দিনের চেয়ে পাঁচ কোটি টাকা বেশি।
সিএসইর সার্বিক মূল্যসূচক গতকাল বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ হাজার ২০২ পয়েন্টে। এদিন চট্টগ্রামের বাজারে ১৭৯টি কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের শেয়ার লেনদেন হয়। এর মধ্যে ১৭২টির দাম বেড়েছে, কমেছে ছয়টির আর অপরিবর্তিত ছিল একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম। দিনশেষে সিএসইতে প্রায় ৩৮ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়, যা আগের দিনের চেয়ে ১৪ কোটি টাকা কম।

No comments

Powered by Blogger.