মানবাধিকার ও গণতন্ত্র by হায়দার আকবর খান রনো
গত বছরে মানবাধিকার পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। আইন সালিশ কেন্দ্র এবং অধিকার সম্প্রতি দুটি ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবেদনে যেসব তথ্য ও গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তা রীতিমতো ভয়াবহ। যে ক্রসফায়ার শুরু হয়েছিল গত বিএনপি সরকারের আমলে তা বিএনপি আমল, দুই বছরের সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের আমল এবং বর্তমান সরকারের তিন বছরে ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত থেকেছে।
এমনকি এর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্রসফায়ারের বিষয়টি বহির্বিশ্বেও ব্যাপকভাবে আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে। ক্রসফায়ার কেবল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসই নয়, একে রাষ্ট্রীয় মিথ্যাচারও বলা চলে। প্রধানত র্যাব এই জঘন্য বেআইনি কাজটি করে আসছে। ক্রসফায়ারের আভিধানিক অর্থ হলো দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময়ের সময় কোনো এক তৃতীয় পক্ষ, যে এই সংঘর্ষের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নয়, অকস্মাৎ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। অর্থাৎ এটি একটি দুর্ঘটনা মাত্র। কিন্তু এখন ক্রসফায়ারের অর্থ পাল্টে গেছে। ক্রসফায়ার কথাটি এখন যেভাবে চালু আছে, তার মানে দাঁড়ায় এ রকম_কোনো ব্যক্তিকে র্যাব বা পুলিশ ধরে নিয়ে বিচারের জন্য হাজির না করে হত্যা করে। অর্থাৎ বিচারবহির্ভূত হত্যা। কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় কোনো ব্যক্তিকে বন্দি অবস্থায় হত্যাকে জায়েজ করার জন্য একটা মনগড়া কাহিনী বলা হয়। পুলিশ হেফাজতে কোনো আসামিকে নিয়ে আসা হলে তার আত্মীয়স্বজন আগে ঘুষ দিত, যাতে জামিন দেওয়া যায়। তারপর এলো আরেক যুগ, এখন ঘুষ দিতে হয়, যাতে পুলিশ দৈহিক প্রহার না করে। এগুলো ঔপনিবেশিক আমল থেকে চলে আসছে। কিন্তু এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন আরেক ধরনের বিষয়। এখন র্যাব বা পুলিশকে ঘুষ দিতে হয়, অনুরোধ জানাতে হয় যাতে আসামিকে খুন না করা হয় সে জন্য। অবৈধভাবে টাকা লেনদেনের সঙ্গে যে কাতর-মিনতি করতে হয় তার ভাষাটি হলো এ রকম_'দয়া করে ক্রসফায়ারে দেবেন না'। অর্থাৎ র্যাবের ধারাবাহিক আচরণের কারণে 'ক্রসফায়ার' শব্দটি চলতি ভাষায় অভিধানে নতুন অর্থ পেয়েছে।
ক্রসফায়ার মানে কী, তা এখন সবাই বোঝে। এমনকি সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকরাও বিচলিত হয়ে উঠছেন। একবার হাইকোর্টের এক বিচারক খবরের কাগজের মাধ্যমে ক্রসফায়ারের ঘটনা জানতে পেরে সুয়োমোটাভাবে বিষয়টি আমলে নিয়েছিলেন এবং মামলার প্রয়োজনে সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর নোটিশ জারি করেছিলেন। কিন্তু আমরা জানি যে সেই বিচার আর কখনো হয়নি। পুলিশ, র্যাব ও সরকারি কর্মকর্তাদের আর জবাবদিহি করতে হয়নি। কারণ কিছুদিন পর হাইকোর্টের সেই বেঞ্চ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল।
ক্রসফায়ার মানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। ক্রসফায়ার মানে রাষ্ট্রীয় মিথ্যাচার। ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে এক মিথ্যা গল্প সাজিয়ে পরিবেশন করা। রাষ্ট্র যখন মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয়, তখন আমরা সত্যিই বড় অসহায় বোধ করি। এ রকম ক্ষেত্রে বাস্তবিকই 'বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে।'
'অধিকার' যে রিপোর্ট প্রদান করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, 'ক্রসফায়ারের' জায়গায় এখন 'গুম' হচ্ছে। ক্রসফায়ারের বানোয়াট কাহিনী কেউ বিশ্বাস করে না। সর্বোচ্চ বিচারালয়ও প্রশ্ন তুলেছে। সরকারের জন্য এটি বেশ বিব্রতকর। এমনকি বিদেশেও কথা উঠেছে। বহু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশের 'ক্রসফায়ার' নিয়ে সমালোচনার ঝড় তুলেছে। তাই সম্প্রতি ক্রসফায়ারের জায়গায় এসেছে 'গুম'। গুম হলে কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। ক্রসফায়ার হলে পরিবার ও আত্মীয়স্বজন অন্তত লাশটি ফেরত পেত। এখন তাও হয় না। আমার জানা একটি ঘটনার কথা বলি। শামিম নামে এক যুবক। নয়াপল্টনের এক ভাড়া করা বাসায় বাস করতেন। একদা ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। একদিন সকালে তিনি ফ্ল্যাট বাড়ির নিচে গেছেন কিছু তরিতরকারি কিনতে এবং রাস্তার পাশের দোকান থেকে চা খেতে। এটি তার নিয়মিত অভ্যাস ছিল। একদিন কয়েকজন সাদা পোশাক পরা গুণ্ডা তাকে ঘেরাও করে জোর করে কাছে অবস্থিত এক গাড়িতে তুলেছিল। তারপর তার আর কোনো খোঁজ নেই। সাদা টয়োটা গাড়িতে তুলে নিয়ে গুম হওয়ার অনেক ঘটনা আমরা দেখেছি সত্তরের দশকে। এখন আবার সেই সরকারি কৌশল ফিরে এসেছে। বহু খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি যে শামিমের নাম ছিল খুলনা র্যাবের খাতায়। ক্রসফায়ারের জন্য তৈরি তালিকায়। এটি তৈরি হয়েছিল বিগত খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে। তখন শামিম চলে যান মালয়েশিয়ায়। সরকার পরিবর্তিত হলে তিনি দেশে ফিরে এসেছিলেন। ভরসা ছিল নতুন সরকারের ওপর। কিন্তু সেই আমলের ক্রসফায়ারের সিদ্ধান্ত র্যাব এই আমলে কার্যকর করল। না, এবার আর ক্রসফায়ার নয়। একেবারে হদিসবিহীন করে দেওয়া। যাকে বলে গুম। মানবাধিকার পরিস্থিতির কী ভয়াবহ পরিণতি!
গত বছর যখন গার্মেন্ট শিল্পের শ্রমিকরা পাঁচ হাজার টাকার নূ্যনতম মজুরির দাবি নিয়ে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করেছিলেন, সেই সময়ের একটা ঘটনা। গুলিস্তানের মোড় থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল আশুলিয়া অঞ্চলের শ্রমিক নেতা তুহিন চৌধুরীকে। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। তাঁর সঙ্গে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা তুহিন চৌধুরীর গ্রেপ্তারের খবরটি কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে এসে পেঁৗছে দিয়েছিলেন। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, তাঁকে ধামরাই থানায় রাখা হয়েছে। কিন্তু তাঁর গ্রেপ্তারের খবরটি বেমালুম চেপে গেল পুলিশ। আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলাম। যোগাযোগ করা হয়েছিল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে। তারা লন্ডন থেকে ফোন করেছিল ধামরাই থানায় এবং সরকারের অন্যান্য অফিসে। খুব সম্ভবত সে কারণে শ্রমিক নেতা তুহিন চৌধুরী তখন বেঁচে গিয়েছিলেন। গ্রেপ্তারের দুই দিন পরই পুলিশ তাঁকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করে। ইতিমধ্যে টেলিভিশনে তুহিন চৌধুরীকে চোখ বাঁধা অবস্থায় দেখানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল, তাঁকে নাকি সশস্ত্র অবস্থায় ধরা হয়েছে এবং তাঁর দেখানো জায়গা থেকে নাকি গ্রেনেড ইত্যাদি উদ্ধার করা হয়েছে। এমনকি তাঁকে যে গুলিস্তানের মোড় থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেটাও অস্বীকার করা হয়েছে। টেলিভিশনে যখন তাঁকে দেখানো হয়, তখনো তাঁর দেহে ছিল নির্যাতনের চিহ্ন। পুলিশ সম্পূর্ণ বানোয়াট কাহিনী শোনাল দেশবাসীকে। এত বড় মিথ্যা যখন পুলিশ বলে, তখন দেশে কি আইনের শাসন বা গণতন্ত্র বলে কিছু থাকে? এ ক্ষেত্রে পুলিশ গার্মেন্ট মালিকদের পক্ষ হয়ে কাজ করেছে। নিশ্চিতভাবেই এ রকম ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়েছিল।
পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু কোনো নতুন খবর নয়। আর কথায় কথায় রিমান্ড আবেদন এবং আদালত কর্তৃক রিমান্ড মঞ্জুর করা হচ্ছে হরহামেশা। রিমান্ড মানেই টর্চার চেম্বার। রিমান্ডে রেখে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা চলছেই। বিএনপি আমলেও হয়েছে। ২০০৭-০৮-এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খুব বেশি হয়েছে। বর্তমান সরকার সম্ভবত আগের সরকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রিমান্ডের ঘটনা এবং নির্যাতনের পরিধি আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
'অধিকার' গত তিন বছরে কারাগারে মৃত্যুর একটা সংখ্যা তুলে ধরেছে। ২০০৯, ২০১০ এবং ২০১১ সালে যথাক্রমে ৫০, ৬০ ও ১০৫ জন বন্দি কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন। অবশ্য অধিকারের তথ্যানুযায়ী বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা এখন কিছুটা কমের দিকে। ২০০৯, ২০১০ এবং ২০১১ সালে যথাক্রমে এ সংখ্যাটি হচ্ছে ১৫৪, ১২৭ এবং ৮৪। কিন্তু বিপজ্জনক যেটা সেটা হলো গুমের সংখ্যা বেড়েছে। উপরিউক্ত তিন বছরে গুমের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২, ১৮ এবং ৩০। প্রবণতা হিসেবে ক্রসফায়ারের চেয়ে গুম এখন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সম্প্রতি পুলিশের আরেক ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। খুব সম্প্রতি খবরের কাগজে প্রকাশিত এক খবরে জানা যায় যে পুলিশ মিথ্যা কথা বলে মানুষ লেলিয়ে দিয়ে গণপিটুনির দ্বারা হত্যা সংঘটিত করেছে। যেখানে পুলিশের কাজ হলো গণপিটুনি থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে রক্ষা করা। কারণ আইন নিজ হাতে তুলে নেওয়া বেআইনি। সেখানে পুলিশই গণপিটুনির জন্য 'উৎসাহী' করছে। এটা একেবারে নতুন কৌশল।
বেআইনিভাবে খুন করতে করতে র্যাব হাত পাকিয়েছে। যখন কোনো রাষ্ট্রীয় সংস্থা নিজেই সন্ত্রাসী সংস্থায় পরিণত হয়, তখন দেশের গণতন্ত্র শূন্যের কোঠায় নেমে দাঁড়ায়। র্যাব-পুলিশ সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এমন কাজ করে থাকে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তখন সেই সরকার র্যাবকে নিজস্ব দলীয় ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। ফলে যেটা দাঁড়িয়েছে তা হলো, র্যাব ও পুলিশ আবার তুলনামূলক স্বাধীনতা লাভ করেছে। অর্থাৎ সব হত্যাকাণ্ডই যে তারা রাজনৈতিক নির্দেশে করে, এমনটা না-ও হতে পারে। সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা নিজেরাও বিচারবহির্ভূত হত্যা বা নির্যাতন চালানোর কাজটি করে থাকে। সে ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত শত্রুতা ও শত্রু নিধনের কাজে রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে ব্যবহার করা এবং তার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেনের অভিযোগও শোনা যাচ্ছে।
সব মিলিয়ে যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে গণতন্ত্রের আর কিছুই থাকছে না। রাষ্ট্র একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ফ্যাসিবাদের বিভিন্ন লক্ষণ বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, গুপ্তহত্যা ইত্যাদি ফ্যাসিবাদেরই বৈশিষ্ট্য।
এ প্রসঙ্গে সংবিধানের ১৫ সংশোধনীর একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। সংবিধানের সাম্প্রদায়িক চরিত্র অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানের বিলোপ সাধন এসব বিষয়ে আমি আপাতত আলোচনা করছি না। এসব প্রশ্নে আমার বক্তব্য অতীতে স্পষ্ট করেই বলেছি। আমি এখানে প্রাসঙ্গিক নতুন করে সংযোজিত যে ধারাটির কথা উল্লেখ করতে চাই তা হলো ৭(ক) এবং ৭(খ) ধারা। এই দুই ধারা ফ্যাসিস্ট বৈশিষ্ট্যের লক্ষণ। উপরিউক্ত ধারায় বলা হয়েছে, অর্ধশতাধিক ধারা-উপধারা চিরন্তনভাবে অপরিবর্তনীয়। সংসদের ৩০০ সদস্য একমত হলেও নাকি তা পরিবর্তন করা যায় না। এমনকি গণভোটের দ্বারাও পরিবর্তন সম্ভব নয়। শুধু তাই-ই নয়, ওইসব ধারা-উপধারার কোনো একটির বিরুদ্ধে মন্তব্য করলেও তা রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে গণ্য হবে এবং সেই অপরাধের জন্য শাস্তিও পেতে হবে।
এমন সংবিধান কেবল ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রেই সম্ভব। ১৫তম সংশোধনী দ্বারা সেই পথের দিকনির্দেশ করা হয়েছে। আর বাস্তবে গণতন্ত্র পূরণ, গুম, খুন, রিমান্ডে নির্যাতন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন ফ্যাসিস্ট প্রবণতার জোরালো সাক্ষ্য বহন করছে। এ এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতি গণতন্ত্রের সংগ্রামে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। প্রতিটি শান্তিপ্রিয় গণতান্ত্রিক মানুষের জন্য এই সংগ্রাম সবচেয়ে জরুরি জাতীয় কর্তব্য হিসেবে উপস্থিত হয়েছে।
লেখক : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
ক্রসফায়ার মানে কী, তা এখন সবাই বোঝে। এমনকি সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকরাও বিচলিত হয়ে উঠছেন। একবার হাইকোর্টের এক বিচারক খবরের কাগজের মাধ্যমে ক্রসফায়ারের ঘটনা জানতে পেরে সুয়োমোটাভাবে বিষয়টি আমলে নিয়েছিলেন এবং মামলার প্রয়োজনে সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর নোটিশ জারি করেছিলেন। কিন্তু আমরা জানি যে সেই বিচার আর কখনো হয়নি। পুলিশ, র্যাব ও সরকারি কর্মকর্তাদের আর জবাবদিহি করতে হয়নি। কারণ কিছুদিন পর হাইকোর্টের সেই বেঞ্চ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল।
ক্রসফায়ার মানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। ক্রসফায়ার মানে রাষ্ট্রীয় মিথ্যাচার। ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে এক মিথ্যা গল্প সাজিয়ে পরিবেশন করা। রাষ্ট্র যখন মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয়, তখন আমরা সত্যিই বড় অসহায় বোধ করি। এ রকম ক্ষেত্রে বাস্তবিকই 'বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে।'
'অধিকার' যে রিপোর্ট প্রদান করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, 'ক্রসফায়ারের' জায়গায় এখন 'গুম' হচ্ছে। ক্রসফায়ারের বানোয়াট কাহিনী কেউ বিশ্বাস করে না। সর্বোচ্চ বিচারালয়ও প্রশ্ন তুলেছে। সরকারের জন্য এটি বেশ বিব্রতকর। এমনকি বিদেশেও কথা উঠেছে। বহু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশের 'ক্রসফায়ার' নিয়ে সমালোচনার ঝড় তুলেছে। তাই সম্প্রতি ক্রসফায়ারের জায়গায় এসেছে 'গুম'। গুম হলে কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। ক্রসফায়ার হলে পরিবার ও আত্মীয়স্বজন অন্তত লাশটি ফেরত পেত। এখন তাও হয় না। আমার জানা একটি ঘটনার কথা বলি। শামিম নামে এক যুবক। নয়াপল্টনের এক ভাড়া করা বাসায় বাস করতেন। একদা ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। একদিন সকালে তিনি ফ্ল্যাট বাড়ির নিচে গেছেন কিছু তরিতরকারি কিনতে এবং রাস্তার পাশের দোকান থেকে চা খেতে। এটি তার নিয়মিত অভ্যাস ছিল। একদিন কয়েকজন সাদা পোশাক পরা গুণ্ডা তাকে ঘেরাও করে জোর করে কাছে অবস্থিত এক গাড়িতে তুলেছিল। তারপর তার আর কোনো খোঁজ নেই। সাদা টয়োটা গাড়িতে তুলে নিয়ে গুম হওয়ার অনেক ঘটনা আমরা দেখেছি সত্তরের দশকে। এখন আবার সেই সরকারি কৌশল ফিরে এসেছে। বহু খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি যে শামিমের নাম ছিল খুলনা র্যাবের খাতায়। ক্রসফায়ারের জন্য তৈরি তালিকায়। এটি তৈরি হয়েছিল বিগত খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে। তখন শামিম চলে যান মালয়েশিয়ায়। সরকার পরিবর্তিত হলে তিনি দেশে ফিরে এসেছিলেন। ভরসা ছিল নতুন সরকারের ওপর। কিন্তু সেই আমলের ক্রসফায়ারের সিদ্ধান্ত র্যাব এই আমলে কার্যকর করল। না, এবার আর ক্রসফায়ার নয়। একেবারে হদিসবিহীন করে দেওয়া। যাকে বলে গুম। মানবাধিকার পরিস্থিতির কী ভয়াবহ পরিণতি!
গত বছর যখন গার্মেন্ট শিল্পের শ্রমিকরা পাঁচ হাজার টাকার নূ্যনতম মজুরির দাবি নিয়ে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করেছিলেন, সেই সময়ের একটা ঘটনা। গুলিস্তানের মোড় থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল আশুলিয়া অঞ্চলের শ্রমিক নেতা তুহিন চৌধুরীকে। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। তাঁর সঙ্গে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা তুহিন চৌধুরীর গ্রেপ্তারের খবরটি কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে এসে পেঁৗছে দিয়েছিলেন। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, তাঁকে ধামরাই থানায় রাখা হয়েছে। কিন্তু তাঁর গ্রেপ্তারের খবরটি বেমালুম চেপে গেল পুলিশ। আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলাম। যোগাযোগ করা হয়েছিল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে। তারা লন্ডন থেকে ফোন করেছিল ধামরাই থানায় এবং সরকারের অন্যান্য অফিসে। খুব সম্ভবত সে কারণে শ্রমিক নেতা তুহিন চৌধুরী তখন বেঁচে গিয়েছিলেন। গ্রেপ্তারের দুই দিন পরই পুলিশ তাঁকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করে। ইতিমধ্যে টেলিভিশনে তুহিন চৌধুরীকে চোখ বাঁধা অবস্থায় দেখানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল, তাঁকে নাকি সশস্ত্র অবস্থায় ধরা হয়েছে এবং তাঁর দেখানো জায়গা থেকে নাকি গ্রেনেড ইত্যাদি উদ্ধার করা হয়েছে। এমনকি তাঁকে যে গুলিস্তানের মোড় থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেটাও অস্বীকার করা হয়েছে। টেলিভিশনে যখন তাঁকে দেখানো হয়, তখনো তাঁর দেহে ছিল নির্যাতনের চিহ্ন। পুলিশ সম্পূর্ণ বানোয়াট কাহিনী শোনাল দেশবাসীকে। এত বড় মিথ্যা যখন পুলিশ বলে, তখন দেশে কি আইনের শাসন বা গণতন্ত্র বলে কিছু থাকে? এ ক্ষেত্রে পুলিশ গার্মেন্ট মালিকদের পক্ষ হয়ে কাজ করেছে। নিশ্চিতভাবেই এ রকম ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়েছিল।
পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু কোনো নতুন খবর নয়। আর কথায় কথায় রিমান্ড আবেদন এবং আদালত কর্তৃক রিমান্ড মঞ্জুর করা হচ্ছে হরহামেশা। রিমান্ড মানেই টর্চার চেম্বার। রিমান্ডে রেখে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা চলছেই। বিএনপি আমলেও হয়েছে। ২০০৭-০৮-এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খুব বেশি হয়েছে। বর্তমান সরকার সম্ভবত আগের সরকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রিমান্ডের ঘটনা এবং নির্যাতনের পরিধি আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
'অধিকার' গত তিন বছরে কারাগারে মৃত্যুর একটা সংখ্যা তুলে ধরেছে। ২০০৯, ২০১০ এবং ২০১১ সালে যথাক্রমে ৫০, ৬০ ও ১০৫ জন বন্দি কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন। অবশ্য অধিকারের তথ্যানুযায়ী বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা এখন কিছুটা কমের দিকে। ২০০৯, ২০১০ এবং ২০১১ সালে যথাক্রমে এ সংখ্যাটি হচ্ছে ১৫৪, ১২৭ এবং ৮৪। কিন্তু বিপজ্জনক যেটা সেটা হলো গুমের সংখ্যা বেড়েছে। উপরিউক্ত তিন বছরে গুমের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২, ১৮ এবং ৩০। প্রবণতা হিসেবে ক্রসফায়ারের চেয়ে গুম এখন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সম্প্রতি পুলিশের আরেক ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। খুব সম্প্রতি খবরের কাগজে প্রকাশিত এক খবরে জানা যায় যে পুলিশ মিথ্যা কথা বলে মানুষ লেলিয়ে দিয়ে গণপিটুনির দ্বারা হত্যা সংঘটিত করেছে। যেখানে পুলিশের কাজ হলো গণপিটুনি থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে রক্ষা করা। কারণ আইন নিজ হাতে তুলে নেওয়া বেআইনি। সেখানে পুলিশই গণপিটুনির জন্য 'উৎসাহী' করছে। এটা একেবারে নতুন কৌশল।
বেআইনিভাবে খুন করতে করতে র্যাব হাত পাকিয়েছে। যখন কোনো রাষ্ট্রীয় সংস্থা নিজেই সন্ত্রাসী সংস্থায় পরিণত হয়, তখন দেশের গণতন্ত্র শূন্যের কোঠায় নেমে দাঁড়ায়। র্যাব-পুলিশ সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এমন কাজ করে থাকে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তখন সেই সরকার র্যাবকে নিজস্ব দলীয় ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। ফলে যেটা দাঁড়িয়েছে তা হলো, র্যাব ও পুলিশ আবার তুলনামূলক স্বাধীনতা লাভ করেছে। অর্থাৎ সব হত্যাকাণ্ডই যে তারা রাজনৈতিক নির্দেশে করে, এমনটা না-ও হতে পারে। সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা নিজেরাও বিচারবহির্ভূত হত্যা বা নির্যাতন চালানোর কাজটি করে থাকে। সে ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত শত্রুতা ও শত্রু নিধনের কাজে রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে ব্যবহার করা এবং তার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেনের অভিযোগও শোনা যাচ্ছে।
সব মিলিয়ে যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে গণতন্ত্রের আর কিছুই থাকছে না। রাষ্ট্র একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ফ্যাসিবাদের বিভিন্ন লক্ষণ বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, গুপ্তহত্যা ইত্যাদি ফ্যাসিবাদেরই বৈশিষ্ট্য।
এ প্রসঙ্গে সংবিধানের ১৫ সংশোধনীর একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। সংবিধানের সাম্প্রদায়িক চরিত্র অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানের বিলোপ সাধন এসব বিষয়ে আমি আপাতত আলোচনা করছি না। এসব প্রশ্নে আমার বক্তব্য অতীতে স্পষ্ট করেই বলেছি। আমি এখানে প্রাসঙ্গিক নতুন করে সংযোজিত যে ধারাটির কথা উল্লেখ করতে চাই তা হলো ৭(ক) এবং ৭(খ) ধারা। এই দুই ধারা ফ্যাসিস্ট বৈশিষ্ট্যের লক্ষণ। উপরিউক্ত ধারায় বলা হয়েছে, অর্ধশতাধিক ধারা-উপধারা চিরন্তনভাবে অপরিবর্তনীয়। সংসদের ৩০০ সদস্য একমত হলেও নাকি তা পরিবর্তন করা যায় না। এমনকি গণভোটের দ্বারাও পরিবর্তন সম্ভব নয়। শুধু তাই-ই নয়, ওইসব ধারা-উপধারার কোনো একটির বিরুদ্ধে মন্তব্য করলেও তা রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে গণ্য হবে এবং সেই অপরাধের জন্য শাস্তিও পেতে হবে।
এমন সংবিধান কেবল ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রেই সম্ভব। ১৫তম সংশোধনী দ্বারা সেই পথের দিকনির্দেশ করা হয়েছে। আর বাস্তবে গণতন্ত্র পূরণ, গুম, খুন, রিমান্ডে নির্যাতন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন ফ্যাসিস্ট প্রবণতার জোরালো সাক্ষ্য বহন করছে। এ এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতি গণতন্ত্রের সংগ্রামে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। প্রতিটি শান্তিপ্রিয় গণতান্ত্রিক মানুষের জন্য এই সংগ্রাম সবচেয়ে জরুরি জাতীয় কর্তব্য হিসেবে উপস্থিত হয়েছে।
লেখক : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
No comments