আন্তর্জাতিক-গাদ্দাফির পতনে আফ্রিকায় কী প্রতিক্রিয়া হবে? by মাহমুদ মামদানি

শ্চিমা শক্তি বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের তুলনায় চীন বা ভারতের অবস্থান ততটা জোরালো হবে না। এখানে পশ্চিমা হস্তক্ষেপের নমুনাটা সামরিক পর্যন্ত হতে পারে। ফ্রান্স প্রথমে তিউনিসিয়ায় হস্তক্ষেপের মওকা খুঁজেছিল। সর্বশেষ তাদের হস্তক্ষেপের নমুনা হলো লিবিয়া, এ ধরনের আরও হস্তক্ষেপের বিষয় আলোচনায় রয়েছে 'গাদ্দাফির পতনে কাম্পালা নীরব'_ বিরোধীদের পত্রিকাগুলো লৌহমানবের মৃত্যুর পর রাজধানীর পরিস্থিতি সম্পর্কে এ ধরনের উপসংহার টানে।


তবে তারা শোক প্রকাশ করুক বা উৎসব উদযাপনই করুক, গাদ্দাফির এই পতন কিন্তু আফ্রিকায় সুস্পষ্ট দুঃখবোধের কারণ হবে। শাসনের দীর্ঘ স্থায়িত্ব ও সরকার পরিচালনার স্টাইলের দিক থেকে গাদ্দাফি চরমপন্থা অনুসরণ করে থাকতে পারেন। তবে তিনি এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমহীন ছিলেন না। আফ্রিকার নেতাদের অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, তাদের ক্ষমতার স্থায়িত্ব যত বেশি হয়েছে, ততই তারা ক্ষমতাকে ব্যক্তিকৃত করে নিয়েছেন। তাদের এ ক্ষেত্রে সাফল্য রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিকে ক্ষয়ে ফেলে। ক্যারিবীয় চিন্তাবিদ সিএলআর জেমস নায়ারে এবং নত্রুক্রমার সঙ্গে পার্থক্য টানতে গিয়ে কেন নায়ারে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগের আগ পর্যন্ত টিকে ছিলেন এবং নত্রুক্রমা কেন সে সুযোগ পাননি তা তুলে ধরেছেন। তার মতে, ড. জুলিয়াস নায়ারে তাত্তি্বক ও প্রায়োগিকভাবে একটি আফ্রিকি রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়েছিলেন; কিন্তু নত্রুক্রমা তা করতে ব্যর্থ হন।
আফ্রিকার লৌহমানবরা নত্রুক্রমার পথই গ্রহণ করেন, এর জ্বলন্ত উদাহরণ গাদ্দাফি। তারা যেসব দেশের নেতৃত্ব দেন সেগুলোর অভ্যন্তরীণ বিরোধ চরমে। মোবারকের নেতৃত্বে পরিচালিত মিসর বা বেন আলির নেতৃত্বাধীন তিউনিসিয়ার চেয়েও লিবিয়ায় এই বিভক্তিটা প্রকট।
তবে মোবারক ও বেন আলির পতনে অভ্যন্তরীণ সামাজিক শক্তিগুলো কাজ করে বলে আমরা দেখতে পাই। কিন্তু গাদ্দাফির পতনের ক্ষেত্রে আমরা নতুন সমীকরণ দেখতে পাই। এখানে অভ্যন্তরীণ বিরোধী শক্তি ও বিদেশি সরকারগুলোর মধ্যে একটি সংযোগ দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি যারা গাদ্দাফির মৃত্যুতে উৎসবমুখর বা যারা এর জন্য শোক প্রকাশ করছে, তারা উভয়েই অস্বীকার করতে পারেন না যে, বৈদেশিক হস্তক্ষেপ ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের সম্মিলিত তৎপরতা না থাকলে ত্রিপোলিতে পরিবর্তন সাধন সম্ভব হতো না।
আগামী দিনে আরও হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটবে আফ্রিকায় বৈদেশিক হস্তক্ষেপের পরিস্থিতি কমছে না, বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই মহাদেশ অধুনা বিশ্বের প্রধান প্রধান শক্তি এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরোধের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। আফ্রিকায় চীনের ভূমিকা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুদান, জিম্বাবুয়ে বা ইথিওপিয়া, কেনিয়া ও নাইজেরিয়ায় তাদের ভূমিকাটা প্রধানত অর্থনৈতিক। অবকাঠামো নির্মাণ ও খনিজসম্পদ আহরণ_ এই দুটি ক্ষেত্রেই প্রধানত তাদের কর্মকাণ্ড সীমিত। ভারত তাদের বৃহৎ করপোরেশনগুলোকে এখানে কাজের ব্যাপারে সহায়তা দিতে প্রস্তুত। তবে তাদের এ ব্যাপারে এখনও কোনো কোনো সমন্বিত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অবশ্য ভারতীয়দের ফোকাসটাও প্রধানত অর্থনৈতিক।
পশ্চিমা শক্তি বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের তুলনায় চীন বা ভারতের অবস্থান ততটা জোরালো হবে না। এখানে পশ্চিমা হস্তক্ষেপের নমুনাটা সামরিক পর্যন্ত হতে পারে। ফ্রান্স প্রথমে তিউনিসিয়ায় হস্তক্ষেপের মওকা খুঁজেছিল। সর্বশেষ তাদের হস্তক্ষেপের নমুনা হলো লিবিয়া, এ ধরনের আরও হস্তক্ষেপের বিষয় আলোচনায় রয়েছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আফ্রিকানদের শক্তি বৃদ্ধি। এই প্রাতিষ্ঠানিক অস্ত্রটা আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের প্রধান সামরিক উপায়।
এই প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিয়ে আফ্রিকার লৌহমানব এবং তাদের বিরোধীরা নিজেদের পথ অনুসন্ধান করছে। শীতল যুদ্ধের মতো না হলেও আফ্রিকার লৌহমানবরা আফ্রিকার নতুন বিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে কে কোন দিকে যাবে তা নির্ধারণ করছে। এ ক্ষেত্রে উগান্ডার প্রেসিডেন্ট মুসাভেনির প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যায়। তিনি একদিকে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার জন্য চীন ও ভারতকে তার দেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আবার অন্যদিকে আফ্রিকায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তাদানের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
তবে এর বিপরীতে বিরোধীদের কথা বলতে গেলে তারা সামরিক ও আর্থিক উভয় ক্ষেত্রেই পশ্চিমা সমর্থন চায়। এটা এখন আর গোপন নেই যে, গাদ্দাফির এভাবে পতনের পর আফ্রিকার প্রত্যেক দেশেই বিরোধীরা এখন পশ্চিমা হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা দেখতে পায়।
ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে, একশ' বছরেরও আগে বহির্শক্তিগুলো কীভাবে আফ্রিকাকে ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছিল। আজ আবার একই প্র্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আফ্রিকার দেশগুলো কি অভ্যন্তরীণ দুঃশাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য পুনরায় বৈদেশিক হস্তক্ষেপেই আলিঙ্গন করবে!
পশ্চিমা শক্তিগুলো স্বাধীন কোনো দেশে হস্তক্ষেপের জন্য দুটি রাজনৈতিক ও অবকাঠামোগত ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এর একটি হলো জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিল, অন্যটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। এই উভয় ব্যবস্থাই রাজনৈতিকভাবে, বেছে বেছে কাজ করে। এই প্রক্রিয়ায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় না।
নিরাপত্তা পরিষদ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য রাষ্ট্রগুলোকে অভিযুক্ত করে এবং বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষার নামে সেখানে হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেয়। তখন তৃতীয় শক্তির হস্তক্ষেপের পথ প্রশস্ত হয়। এ জন্য তাদের কারও কাছে এমনকি নিরাপত্তা পরিষদের কাছেও জবাবদিহি করতে হয় না। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতও নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে। অপরাধ তদন্ত ও বিচারের কথা বলে তখন নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের নেতাদের আটকের ব্যবস্থা করে।
আফ্রিকানরা এই দুষ্কর্মে বুঝে হোক আর না বুঝেই হোক সহযোগী হয়ে উঠেছে। লিবিয়া ও নাইজেরিয়ায় ভোট দেওয়া ছাড়া লিবিয়ায় হস্তক্ষেপের প্রস্তাবটি নিরাপত্তা পরিষদে পাস হতে পারত না।
নিকষ অন্ধকার সামনে। আরও বেশি বেশি আফ্রিকি দেশ অভ্যন্তরীণভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। আফ্রিকানদের গাদ্দাফির পতনের গুরুত্ব উপলব্ধি করা দরকার। এটা কি এখানে বৈদেশিক হস্তক্ষেপের এক নতুন যুগের সূচনা করছে না! একের পর এক দেশে হস্তক্ষেপ হবে, আর রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবর্তনের জন্য তাকে সমর্থন করবে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহীরা!
একটি বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কার :যারা এ ধরনের বৈদেশিক হস্তক্ষেপকে দূরে সরিয়ে রাখতে চান, তাদের উচিত হবে অভ্যন্তরীণ সংস্করণটা জোরেশোরে করা।

মাহমুদ মামদানি : অধ্যাপক ও ম্যাকেরি বিশ্ব্ববিদ্যালয়ে ম্যাকেরি ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চের পরিচালক
আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর সুভাষ সাহা
 

No comments

Powered by Blogger.