শেকড়ের ডাক-তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলেই কি সমাধান আসবে by ফরহাদ মাহমুদ

র্তমান জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার পর প্রধান বিরোধী দলের পক্ষ থেকে তা পুনর্বহালের জোর দাবি জানানো হচ্ছে। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে হরতাল, রোডমার্চসহ নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। বিএনপি ছাড়াও বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল একই দাবি জানিয়েছে। দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের অনেকেই উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী আরো দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন।


অবশ্য কেউ কেউ ভিন্নমতও পোষণ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, নির্বাচন কমিশনকেই স্বাধীন ও শক্তিশালী করা হোক। কিন্তু বিএনপির এক কথা, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে না। ফলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভাগ্যে কী আছে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর এই দাবির যৌক্তিকতা আমরা বুঝি। প্রশাসনকে দলীয়করণ করাটা এ দেশে দুই দশকের গণতান্ত্রিক শাসনে একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ফলে নির্বাচন কমিশনে যত ভালো লোকই বসানো হোক না কেন, তাদের পক্ষে দলীয়করণকৃত প্রশাসন দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদের সুষ্ঠু নির্বাচন করাটা রীতিমতো দুরূহ ব্যাপার। সে কারণেই উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করেও আরো দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা যেতে পারে বলে অভিমত দিয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল রায়ের প্রথম অংশটি মেনে নিলেও দ্বিতীয় অংশটির প্রতি যথার্থ সম্মান দেখায়নি। বলা হয়, মাত্র চার মিনিটে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিলটি পাস করিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিলটি সংসদে উত্থাপনের আগে সরকারি দলের পক্ষ থেকে বারবার বিএনপিকে আহ্বান জানানো হয়েছিল, তাদের কোনো বিকল্প প্রস্তাব থাকলে তা সংসদে উপস্থাপন করার জন্য। কিন্তু বিএনপি সংসদে যায়নি এবং কোনো বিকল্প প্রস্তাবও উত্থাপন করেনি। ফলে বিরোধিতাহীন সংসদে তারা সহজেই বিলটি পাস করিয়ে নিয়েছে।
এ পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ থেকে আমাদের কাছে যে বিষয়টি পরিষ্কার তা হলো, ক্ষমতাসীন ও প্রধান বিরোধী দল_কেউ কাউকে মেনে নিতে নারাজ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে তো বিএনপি সংসদে যাবে না। কোনো উন্নয়নকাজে কিংবা কোনো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ব্যাপারেও সরকারকে সহযোগিতা করবে না। আবার বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগও একই কৌশল অবলম্বন করবে। সরকারের কোনো ভালো উদ্যোগকেও সমর্থন দেওয়া যাবে না। আবার ক্ষমতাসীনদের মধ্যে বিরোধী দলকে বশ্যতা স্বীকার করানোর মতো একধরনের প্রবণতা কাজ করে। এই যে মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ আমরা দুই দশক ধরে দেখে আসছি, তা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি কোনো সুফল বয়ে আনতে পারবে?
মুশকিল হলো, আমাদের এখানে কোনো ভালো নিয়মই বেশি দিন ভালো থাকে না। মানুষ নিয়মের ফাঁকফোকর বের করে ফেলে। প্রথম তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার মোটামুটি সফল হলেও ২০০৬ সালে এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়েই শুরু হয়ে যায় ইঞ্জিনিয়ারিং। সে সময়ের জোট সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারটাকেই তাদের মতো করে পেতে চেয়েছিল। এ জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার লক্ষ্যে বিচারপতিদের বয়স দুই বছর বাড়ানো হয়েছিল। আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলো তার প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। তখন সেই বিচারপতি আত্মসম্মান রক্ষায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে অসম্মতি জানান। এরপর কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ হয়ে যান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান। বিচারপতি আজিজের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন কমিশন আরেক প্রহসনের জন্ম দেয়। ফলে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, আন্দোলন ক্রমশ সংঘাতে রূপ নেয়। এরপর আসে ওয়ান-ইলেভেন বা দুই বছর মেয়াদি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এখন আমরা কোন তত্ত্বাবধায়কে ফিরে যাব? ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারে নাকি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারে। কারণ, আমাদের রাজনৈতিক মানসিকতার যে পরিবর্তন ঘটেনি, তা আমাদের আচরণই বলে দেয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবিতে বিএনপি হরতাল দিচ্ছে, রোডমার্চ করছে। হরতালের আগের রাতে কয়েক ডজন গাড়ি পোড়ানো হচ্ছে। কিন্তু তারা সংসদে যেতে পারছে না। গত মাসেই আমরা দেখেছি, বিএনপির ডাকা মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে পুলিশি বাধার অভিযোগে সারা দেশে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গিয়েছিল। ঢাকায় বোমায় একজন এবং সিলেটে আগুনে পুড়িয়ে একজনকে হত্যা করা হয়েছিল। বিএনপির অন্যতম সহযোগী জামায়াতে ইসলামী এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার পুলিশের ওপর অতর্কিত হামলা করেছে। পুলিশের অস্ত্র লুট করে নিয়েছে, তাদের গাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। নিকট ভবিষ্যতে এ রকম আরো অনেক কর্মসূচিই হয়তো আমরা দেখতে পাব।
ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের বিষয়ে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছেন। সেই সংলাপে বিএনপিও যোগ দিয়েছিল। কিন্তু বিএনপি প্রতিনিধিরা নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে মতামত না দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি জানিয়ে এসেছেন। কেন? তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমাদের প্রয়োজন। কিন্তু স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজন কি আমাদের নেই? এখানেও সেই একই রহস্য কাজ করে। অপ্রিয় হলেও সত্য, আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলেরই মানসিকতায় পুনরায় ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে কিছু অসৎ উদ্দেশ্য কাজ করে। পৃথিবীর অনেক দেশেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন হয় এবং তা করে থাকে স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল গত চার মেয়াদে পালা করে ক্ষমতায় এলেও তারা কখনো নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। যদিও বারবারই নির্বাচনের আগে তারা প্রতিশ্রুতি দেয় যে ক্ষমতায় গেলে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করা হবে। তাদের এ অনীহার কারণ কী, তা বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
আর শাবাশ আওয়ামী লীগ! শাবাশ মহাজোট সরকার! বিরোধী শিবিরের রাজনৈতিক নেতাদের কথা না হয় বাদই দিলাম, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ ও মতামতগুলো কি তারা দেখছেন না? টিভি চ্যানেলগুলোর আলোচনা কি তাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে না? প্রায় সবাই আরো দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে তাদের মতামত দিচ্ছেন। কিন্তু সরকার এমন গোঁ ধরে বসে আছে কেন? তত্ত্বাবধায়ক সরকার না দিলেই তারা আবার ক্ষমতায় আসতে পারবে_এমন নিশ্চয়তা তাদের কে দিয়েছে? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তাদের শুভবুদ্ধি দিনে দিনে লোপ পাচ্ছে। বরং মহাজোট সরকারের প্রথম দিকের অবস্থানই তুলনামূলকভাবে ভালো বলে মনে হয়েছিল। সংসদীয় কমিটি আদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত যে খসড়া তৈরি করেছিল, যত দূর জানা যায় তাতেও আরো দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষেই মতামত দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আচমকাই যেন সব কিছু পাল্টে গেল। আশ্রয় নেওয়া হলো নানা ধরনের কৌশলের। বলা হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার দায় আওয়ামী লীগ নেবে না, বিএনপি সেই দায় নিতে চাইলে সংসদে এসে তা বলুক। আরো বলা হলো, বল এখন বিএনপির কোর্টে। কিন্তু বিএনপি সংসদেও আসেনি, বিকল্প প্রস্তাবও দেয়নি। কিন্তু বিএনপি তো দেশজুড়ে সভা-সমাবেশ করে বলছে, সংলাপে গিয়ে রাষ্ট্রপতিকেও বলেছে_তার পরও কি দায় আওয়ামী লীগের কাঁধে আসবে? এখনো তো তারা এ ব্যাপারে পুনরায় উদ্যোগ নিতে পারে।
রাজনীতি বড়ই অদ্ভুত! আওয়ামী লীগের আন্দোলনের কারণে এ দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য হয়েছিল তৎকালীন বিএনপি সরকার। আজ আওয়ামী লীগ বাতিল করছে এবং বিএনপি পুনর্বহালের জন্য আন্দোলন করছে। যুক্তির পর যুক্তি দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন থাকলেও দলীয় সরকারের অধীন সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। 'লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড' তৈরি ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার লাগবেই। কিন্তু আসলেই কি এ দুটি দল কখনো মনেপ্রাণে একটি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়েছে? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি সত্যিই কি তাদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ আছে? নির্বাচনে হেরে গিয়ে তারা কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দোষারোপ করেনি? তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের প্রতি কি তারা অসম্মানজনক কথাবার্তা কম বলেছে? তাহলে তাদের এসব দাবিদাওয়া ও আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী? কেবল ক্ষমতাপ্রাপ্তি নয় কি? তারা কি কখনো এ দেশে গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশ চেয়েছে? সবগুলো প্রশ্নের উত্তরই নেতিবাচক, বিবেকবান মানুষদের কষ্ট দেয়।
গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। আমাদের দুই নেত্রী কি কখনো তা দেখাতে পেরেছেন? কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান থাকলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে_এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। ক্রমাগত সংসদ বর্জন করা গণতন্ত্র নয়, সংসদীয় রাজনীতি নয়। সংসদে যাওয়ার চেয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী কর্মসূচি দেওয়াটাও দেশপ্রেম নয়, কল্যাণমুখী রাজনীতি নয়। আমাদের বিরোধী দলকে এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সংসদকে কেবল ব্যক্তিগত স্বার্থ আদায়ের কেন্দ্র না করে দাবি আদায়েরও প্রধান কেন্দ্র ভাবতে হবে। আর ক্ষমতাসীন দলকেও তাদের হাবভাব বদলাতে হবে। পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় আসা মানে দেশের মালিকানা অর্জন করা নয়। সরকারি দল ও বিরোধী দল মিলেই সরকার_এ সত্যটি উপলব্ধি করতে হবে। বিরোধী দলকে অগ্রাহ্য করার মানসিকতা বজায় থাকলে বিরোধী দলের কাছ থেকেও সহযোগিতা আশা করা অবাস্তব হবে। কাজেই আমাদের সমস্যা সরকার পদ্ধতির কতটুকু, আর অগণতান্ত্রিক মানসিকতার কতটুকু_তা আমাদের আগে নির্ণয় বা উপলব্ধি করতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে এই অগণতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে আমাদের রাজনীতিকে মুক্ত করতে হবে। আর তা না হলে দেশ যেভাবে চলছে সেভাবেই চলতে থাকবে। শুধু তত্ত্বাবধায়ক নয়, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারও কোনো কাজে আসবে না।

No comments

Powered by Blogger.