তাহলে কে যুদ্ধাপরাধী? by শহিদুল ইসলাম
এক. সম্প্রতি রোডমার্চে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্যে দল হিসেবে বিএনপি বেশ সংকটের মধ্যেই পড়ে গেছে। গত শনিবার ২২ সেপ্টেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন সে সংকটের বহিঃপ্রকাশ বলে অনেকে মনে করছেন। সেখানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম সে সংকট থেকে উত্তরণের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি সংকট আরো ঘনীভূত করে তুলেছেন।
অভিযুক্ত জামায়াত নেতারা মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত কি না তিনি সে বিষয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, নিজামী সাহেব কোথায় লুণ্ঠন করেছেন, হত্যা করেছেন, তা সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগে আনতে হবে। এ পর্যন্ত তাঁদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে কি? না, এখনো প্রমাণ হয়নি। তবে তিনি ও তাঁর দল জামায়াতে ইসলামীর বহু নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে একাত্তরের সংবাদপত্রগুলোর সচিত্র প্রতিবেদন তাঁদের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করে। এগুলো প্রাথমিক উপাত্ত। এগুলোর ভিত্তিতে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তা ছাড়া তাঁদের এলাকার মানুষজনের সাক্ষ্যও বড় প্রমাণ। সেসব অভিযোগ প্রমাণের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হলেই তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রমাণের জন্য বিএনপিকে বিচার সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এখনই এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলা একাত্তরে তাঁদের সঙ্গে বিএনপির নেতাদের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করে। মতিউর রহমান নিজামীসহ জামায়াত নেতাদের 'যুদ্ধাপরাধী' বলে মনে করেন কি না জানতে চাইলে মির্জা সাহেব বলেন, 'এ ব্যাপারে ইয়েস-নো কিছুই বলব না, কারণ আমি রাজনীতি করি।' এ ধরনের উদ্ভট কথা তো আগে কখনো শোনা যায়নি। রাজনীতি করলে সত্য কথা বলা যাবে না_এ কথা মির্জা সাহেবকে কে শেখালেন? তারপর যা বলেছেন তা আরো মারাত্মক_'জামায়াতের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক ঐক্য রয়েছে।' এ সত্য তো দেশবাসী জানে_এটা নতুন কথা নয়। প্রশ্ন জাগে, সেই রাজনৈতিক ঐক্য কত দিনের? একানব্বইয়ের নির্বাচন থেকে? জিয়াউর রহমানের অবৈধ ক্ষমতা দখল থেকে? নাকি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে? এটাই আসল প্রশ্ন_প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অন্য আওয়ামী লীগ নেতারা বারবার বলছেন, 'খালেদা জিয়া বর্তমান আন্দোলন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে শুরু করেছেন।' এই সংবাদ সম্মেলনে মির্জা সাহেব স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, 'না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে খালেদা জিয়া যুদ্ধ ঘোষণা করেননি।' মির্জা সাহেবের যে একটু ভুল হয়ে গেল। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা মারাত্মক অপরাধ, সে কথা কি জানেন না মির্জা ফখরুল ইসলাম? ২০ অক্টোবর চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে হাসান শিমুল ও আমিনুল ইসলাম জানান, খালেদা জিয়া প্রকাশ্য জনসভায় কেবল এ কথাই বলেননি যে 'নিজামী-মুজাহিদ-সাঈদী স্বাধীনতাবিরোধী নন', তিনি অবিলম্বে তাঁদের মুক্তিও দাবি করেন। মাত্র দুই দিন পর মির্জা সাহেব বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে খালেদা জিয়া যুদ্ধ ঘোষণা করেননি।' খালেদা জিয়ার নিজের মুখের কথা বিশ্বাস করব, নাকি মির্জা ফখরুলের? আসলে খালেদা জিয়া দলকে এক মারাত্মক সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। মুখ ফসকে হোক কিংবা যেভাবেই হোক, সত্যি কথাটা তাঁর মুখ থেকে বের হয়ে গেছে। সেই সত্যটা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করছে বিএনপি। ফলে আরো সত্য বেরিয়ে পড়ছে, যা বিএনপির জন্য সুখকর নয়।
দুই. মির্জা সাহেব ওই দিনের সংবাদ সম্মেলনে আরো বলেন, 'জামায়াত নেতাদের বিচারের ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। আইনি সহায়তা থেকে তাঁদের বঞ্চিত করা হয়েছে। যে প্রক্রিয়ায় বিচার করা হচ্ছে, তা স্বচ্ছ নয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাঁদের বিচার হচ্ছে।' মানবাধিকার লঙ্ঘন করা, আইনি সহায়তা থেকে বঞ্চিত করা, বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। আন্তর্জাতিক মহলও এসব কথা বলেছে। আমরাও তা চাই। কিন্তু 'রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাঁদের বিচার হচ্ছে'_এটা দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মানুষ মানতে পারে না। তারা চায়, একাত্তরের ঘাতক বাহিনীর বিচার হোক। তারা তাদের কৃতকর্মের ফল ভোগ করুক। এটা জনগণের দাবি। এর মধ্যে কোনো ধরনের 'রাজনৈতিক উদ্দেশ্য' খুঁজতে যাওয়া দেশদ্রোহের শামিল। এ ছাড়া প্রশ্ন ওঠে, আপনারাও তো এ দেশের মানুষ। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে আপনারাও তো শঙ্কিত। একটা প্রশ্নের জবাব দেবেন? আপনারাও তো দীর্ঘকাল এ দেশ শাসন করেছেন, তখন কেন 'মানবাধিকার লঙ্ঘন না করে', তাঁদের আইনি সহায়তা প্রদান করে এবং যথেষ্ট 'স্বচ্ছতার' সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করলেন না? আপনাদের কাজ কি শুধু ওই সব খুনির সঙ্গে 'রাজনৈতিক ঐক্য' স্থাপন করা এবং তাঁদের বাঁচানো? আপনারা তাঁদের বিচার করলেন না কেন? এ প্রশ্নের উত্তর জনগণ চায়। যদি না দেন, তাহলে বোঝা যাবে, আপনারাও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি। লরেন্স লিফশুল্জ সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, পঁচাত্তরের প্রতিবিপ্লবের পশ্চাতে ছিলেন জিয়াউর রহমান। তাঁর সম্মতি এবং মাঠ-খুনিদের প্রতি সমর্থন না থাকলে শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের ১৭ জন সদস্যকে ওইভাবে মৃত্যুবরণ করতে হতো না। জিয়াউর রহমান প্রধান ব্যক্তি। তাই তিনি মাঠ-খুনিদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরি দিয়েছিলেন। কেননা তাঁর ক্ষমতা দখলের রাস্তা পরিষ্কার করে দিয়েছিল খুনিরা। শুধু তা-ই নয়, খুনিদের বিচার করা যাবে না বলে সংসদে আইন করে তাদের বিচারের পথ বন্ধ করে চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিলেন। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে সংসদে সে আইন বাতিল করে বিচারের রুদ্ধ-দরজা খুলে দেয় ও বিচার করে এবং এবার ক্ষমতায় গিয়ে সে রায় কার্যকর করে, এটা কি রাজনৈতিক কারণে? বরং আপনাদের নেতা 'রাজনৈতিক কারণে' শেখ মুজিবকে খুন করেছিলেন এবং বিচারের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পৃথিবীতে ওই জঘন্য নজির কি আর দেখাতে পারবেন? আপনারা এত বছর ক্ষমতায় থেকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেননি, পঁচাত্তরের হত্যার বিচার করেননি, জেলহত্যার বিচার করেননি, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচার করেননি, ১০ ট্রাক অবৈধ অস্ত্র আমদানির বিচার করেননি। কেন? আপনারা একটা অপরাধের বিচার করবেন না আর অন্যে যখন সে বিচার করবে তখন বলবেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে, বিচার স্বচ্ছ হচ্ছে না_এসব অভিযোগের কোনো নৈতিক অধিকার আপনাদের নেই। জামায়াত ও রাজাকারদের সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্যের জন্য আপনারা তাদের বিচার করার ক্ষমতা হারিয়েছেন। ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গিয়েও আপনারা তাদের বিচার করতে পারবেন না। কারণ তারা আপনাদের 'রাজনৈতিক বন্ধু'। তাই বিচারের দায়িত্ব আওয়ামী লীগ বা অন্য কাউকেই নিতে হবে। আওয়ামী লীগ শেখ মুজিব হত্যার বিচার করেছে, ২১ আগস্টের বিচার শুরু করেছে, ১০ ট্রাক অবৈধ অস্ত্র আমদানির বিচারও অগ্রসর হচ্ছে। আপনারা তাতে বাধার সৃষ্টি করছেন বলে আওয়ামী লীগ সরকারের মুখপাত্ররা অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। সে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করা আপনাদের দায়িত্ব। ক্ষমতায় গিয়ে যদি এসব বিচার বন্ধ করে দেন অতীতের মতো, তখন প্রমাণ হয়ে যাবে যে এসব হত্যা-অস্ত্র আমদানির সঙ্গে আপনারাও জড়িত।
তিন. আপনাদের নেত্রী খালেদা জিয়া চাঁপাইনবাবগঞ্জের রোডমার্চের জনসভায় বলেছেন, 'আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ করেনি।' এত বড় মিথ্যা কথা দু-দুবার যিনি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তাঁর মুখ থেকে বের হবে, দেশবাসী তা বুঝতে পারেনি। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ মুজিবনগরে যে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়, তার সব সদস্য আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও নেতা। খালেদা জিয়ার স্বামী মেজর জিয়াউর রহমান সেই সরকারের অধীনে শপথ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সারা পৃথিবীর মানুষ জানে যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিল আওয়ামী লীগ, অন্য কোনো দল নয়। এ কথা সবাই জানলেও একমাত্র বিএনপির 'স্বশিক্ষিত' চেয়ারপারসন জানেন না। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের ১৬৭টিতে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ সে যোগ্যতা অর্জন করেছিল। এ দেশে ৯৮ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগের কথায় মুক্তিযুদ্ধের সেই দায়িত্ব নিয়েছিল। সক্রেটিস হত্যা থেকে আজ পর্যন্ত সব মিথ্যাই শেষ পর্যন্ত পরিত্যক্ত হয়েছে। খালেদা জিয়ার এ মিথ্যা ভাষণ প্রমাণের দরকার হয় না। দেশের সব মানুষই জানে, কার বা কোন দলের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। আরেকটি কথা খালেদা জিয়া প্রায়ই বলেন, তা হলো_জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বিষয়টা কুরুচির পরিচায়ক। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ যাঁর নাম দেশের কোনো মানুষ জানত না, সেই ব্যক্তি ওই ২৪টি বছর কোথায় কী করেছিলেন, তার কোনো ইতিহাস জানা নেই। তিনি ডাক দিলেন, আর দেশের মানুষ সুড়সুড় করে মুক্তিযুদ্ধে নেমে পড়ল_এর চেয়ে বড় হাসির বিষয় আর কী হতে পারে? খালেদা জিয়া আরো বলেছেন, 'পাকিস্তানের শৃঙ্খল থেকে দেশ স্বাধীন করেছি, ভারতের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়ার জন্য নয়।' ভারতের শৃঙ্খলে আবদ্ধ না হওয়ার আন্দোলন শুরু করলে এ দেশের মানুষ তাঁকে সমর্থন করবে। শুধু ভারত কেন, পুনরায় যদি পাকিস্তান এ দেশ দখল করতে যায়, তাহলে এ দেশের মানুষ আরেকটি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবে। কিন্তু তিনি পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টে ১৯টি মাস বহাল তবিয়তে কাটালেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেন কিভাবে_এটা একটা বিরাট প্রশ্ন। দেশের মানুষ তা জানতে চায়। তিনি চট্টগ্রাম থেকে স্বামীর সঙ্গে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার অপূর্ব সুযোগ ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় ক্যান্টনমেন্টে এসে পাকিস্তানি জেনারেলদের মধ্যে থাকতে পছন্দ করেছিলেন। কেন? এ প্রশ্নেরও উত্তর চায় দেশবাসী।
২২ অক্টোবরের সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি এ সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে। এ সংকট থেকে বিএনপির উত্তরণের একটাই পথ আছে বলে আমার মনে হয়_তা হলো, বিএনপির শরীর থেকে একাত্তরের খুনি ও যুদ্ধাপরাধীদের দুর্গন্ধ দূর করা। প্রমাণ করা যে তারা আসলেই স্বাধীনতার পক্ষের দল। এ দেশের ৯৮ শতাংশ মানুষ যখন মুক্তিযুদ্ধ করেছে, তাদের মধ্যে বহু মানুষ এখন বিএনপি করে। তাদের সামনে নিয়ে আসা বিএনপির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। রাজাকার-আলবদরদের শরীরে শরীর ঘষে বিএনপির কোনো লাভ হবে না বলে অনেকেই মনে করছেন।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ ও রাজনীতির বিশ্লেষক
দুই. মির্জা সাহেব ওই দিনের সংবাদ সম্মেলনে আরো বলেন, 'জামায়াত নেতাদের বিচারের ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। আইনি সহায়তা থেকে তাঁদের বঞ্চিত করা হয়েছে। যে প্রক্রিয়ায় বিচার করা হচ্ছে, তা স্বচ্ছ নয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাঁদের বিচার হচ্ছে।' মানবাধিকার লঙ্ঘন করা, আইনি সহায়তা থেকে বঞ্চিত করা, বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। আন্তর্জাতিক মহলও এসব কথা বলেছে। আমরাও তা চাই। কিন্তু 'রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাঁদের বিচার হচ্ছে'_এটা দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মানুষ মানতে পারে না। তারা চায়, একাত্তরের ঘাতক বাহিনীর বিচার হোক। তারা তাদের কৃতকর্মের ফল ভোগ করুক। এটা জনগণের দাবি। এর মধ্যে কোনো ধরনের 'রাজনৈতিক উদ্দেশ্য' খুঁজতে যাওয়া দেশদ্রোহের শামিল। এ ছাড়া প্রশ্ন ওঠে, আপনারাও তো এ দেশের মানুষ। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে আপনারাও তো শঙ্কিত। একটা প্রশ্নের জবাব দেবেন? আপনারাও তো দীর্ঘকাল এ দেশ শাসন করেছেন, তখন কেন 'মানবাধিকার লঙ্ঘন না করে', তাঁদের আইনি সহায়তা প্রদান করে এবং যথেষ্ট 'স্বচ্ছতার' সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করলেন না? আপনাদের কাজ কি শুধু ওই সব খুনির সঙ্গে 'রাজনৈতিক ঐক্য' স্থাপন করা এবং তাঁদের বাঁচানো? আপনারা তাঁদের বিচার করলেন না কেন? এ প্রশ্নের উত্তর জনগণ চায়। যদি না দেন, তাহলে বোঝা যাবে, আপনারাও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি। লরেন্স লিফশুল্জ সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, পঁচাত্তরের প্রতিবিপ্লবের পশ্চাতে ছিলেন জিয়াউর রহমান। তাঁর সম্মতি এবং মাঠ-খুনিদের প্রতি সমর্থন না থাকলে শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের ১৭ জন সদস্যকে ওইভাবে মৃত্যুবরণ করতে হতো না। জিয়াউর রহমান প্রধান ব্যক্তি। তাই তিনি মাঠ-খুনিদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরি দিয়েছিলেন। কেননা তাঁর ক্ষমতা দখলের রাস্তা পরিষ্কার করে দিয়েছিল খুনিরা। শুধু তা-ই নয়, খুনিদের বিচার করা যাবে না বলে সংসদে আইন করে তাদের বিচারের পথ বন্ধ করে চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিলেন। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে সংসদে সে আইন বাতিল করে বিচারের রুদ্ধ-দরজা খুলে দেয় ও বিচার করে এবং এবার ক্ষমতায় গিয়ে সে রায় কার্যকর করে, এটা কি রাজনৈতিক কারণে? বরং আপনাদের নেতা 'রাজনৈতিক কারণে' শেখ মুজিবকে খুন করেছিলেন এবং বিচারের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পৃথিবীতে ওই জঘন্য নজির কি আর দেখাতে পারবেন? আপনারা এত বছর ক্ষমতায় থেকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেননি, পঁচাত্তরের হত্যার বিচার করেননি, জেলহত্যার বিচার করেননি, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচার করেননি, ১০ ট্রাক অবৈধ অস্ত্র আমদানির বিচার করেননি। কেন? আপনারা একটা অপরাধের বিচার করবেন না আর অন্যে যখন সে বিচার করবে তখন বলবেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে, বিচার স্বচ্ছ হচ্ছে না_এসব অভিযোগের কোনো নৈতিক অধিকার আপনাদের নেই। জামায়াত ও রাজাকারদের সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্যের জন্য আপনারা তাদের বিচার করার ক্ষমতা হারিয়েছেন। ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গিয়েও আপনারা তাদের বিচার করতে পারবেন না। কারণ তারা আপনাদের 'রাজনৈতিক বন্ধু'। তাই বিচারের দায়িত্ব আওয়ামী লীগ বা অন্য কাউকেই নিতে হবে। আওয়ামী লীগ শেখ মুজিব হত্যার বিচার করেছে, ২১ আগস্টের বিচার শুরু করেছে, ১০ ট্রাক অবৈধ অস্ত্র আমদানির বিচারও অগ্রসর হচ্ছে। আপনারা তাতে বাধার সৃষ্টি করছেন বলে আওয়ামী লীগ সরকারের মুখপাত্ররা অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। সে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করা আপনাদের দায়িত্ব। ক্ষমতায় গিয়ে যদি এসব বিচার বন্ধ করে দেন অতীতের মতো, তখন প্রমাণ হয়ে যাবে যে এসব হত্যা-অস্ত্র আমদানির সঙ্গে আপনারাও জড়িত।
তিন. আপনাদের নেত্রী খালেদা জিয়া চাঁপাইনবাবগঞ্জের রোডমার্চের জনসভায় বলেছেন, 'আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ করেনি।' এত বড় মিথ্যা কথা দু-দুবার যিনি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তাঁর মুখ থেকে বের হবে, দেশবাসী তা বুঝতে পারেনি। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ মুজিবনগরে যে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়, তার সব সদস্য আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও নেতা। খালেদা জিয়ার স্বামী মেজর জিয়াউর রহমান সেই সরকারের অধীনে শপথ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সারা পৃথিবীর মানুষ জানে যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিল আওয়ামী লীগ, অন্য কোনো দল নয়। এ কথা সবাই জানলেও একমাত্র বিএনপির 'স্বশিক্ষিত' চেয়ারপারসন জানেন না। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের ১৬৭টিতে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ সে যোগ্যতা অর্জন করেছিল। এ দেশে ৯৮ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগের কথায় মুক্তিযুদ্ধের সেই দায়িত্ব নিয়েছিল। সক্রেটিস হত্যা থেকে আজ পর্যন্ত সব মিথ্যাই শেষ পর্যন্ত পরিত্যক্ত হয়েছে। খালেদা জিয়ার এ মিথ্যা ভাষণ প্রমাণের দরকার হয় না। দেশের সব মানুষই জানে, কার বা কোন দলের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। আরেকটি কথা খালেদা জিয়া প্রায়ই বলেন, তা হলো_জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বিষয়টা কুরুচির পরিচায়ক। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ যাঁর নাম দেশের কোনো মানুষ জানত না, সেই ব্যক্তি ওই ২৪টি বছর কোথায় কী করেছিলেন, তার কোনো ইতিহাস জানা নেই। তিনি ডাক দিলেন, আর দেশের মানুষ সুড়সুড় করে মুক্তিযুদ্ধে নেমে পড়ল_এর চেয়ে বড় হাসির বিষয় আর কী হতে পারে? খালেদা জিয়া আরো বলেছেন, 'পাকিস্তানের শৃঙ্খল থেকে দেশ স্বাধীন করেছি, ভারতের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়ার জন্য নয়।' ভারতের শৃঙ্খলে আবদ্ধ না হওয়ার আন্দোলন শুরু করলে এ দেশের মানুষ তাঁকে সমর্থন করবে। শুধু ভারত কেন, পুনরায় যদি পাকিস্তান এ দেশ দখল করতে যায়, তাহলে এ দেশের মানুষ আরেকটি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবে। কিন্তু তিনি পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টে ১৯টি মাস বহাল তবিয়তে কাটালেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেন কিভাবে_এটা একটা বিরাট প্রশ্ন। দেশের মানুষ তা জানতে চায়। তিনি চট্টগ্রাম থেকে স্বামীর সঙ্গে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার অপূর্ব সুযোগ ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় ক্যান্টনমেন্টে এসে পাকিস্তানি জেনারেলদের মধ্যে থাকতে পছন্দ করেছিলেন। কেন? এ প্রশ্নেরও উত্তর চায় দেশবাসী।
২২ অক্টোবরের সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি এ সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে। এ সংকট থেকে বিএনপির উত্তরণের একটাই পথ আছে বলে আমার মনে হয়_তা হলো, বিএনপির শরীর থেকে একাত্তরের খুনি ও যুদ্ধাপরাধীদের দুর্গন্ধ দূর করা। প্রমাণ করা যে তারা আসলেই স্বাধীনতার পক্ষের দল। এ দেশের ৯৮ শতাংশ মানুষ যখন মুক্তিযুদ্ধ করেছে, তাদের মধ্যে বহু মানুষ এখন বিএনপি করে। তাদের সামনে নিয়ে আসা বিএনপির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। রাজাকার-আলবদরদের শরীরে শরীর ঘষে বিএনপির কোনো লাভ হবে না বলে অনেকেই মনে করছেন।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ ও রাজনীতির বিশ্লেষক
No comments