বিএসএফের নির্যাতন-কেবলই বিকৃত মানসিকতা?
ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কবলে পড়া বাংলাদেশি নাগরিকদের মাঝে মধ্যেই কী বীভৎস নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, বুধবার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হওয়া ভিডিওচিত্রটি তার খণ্ডচিত্র মাত্র। আমরা জানি, গত দুই দশকে বন্ধুপ্রতিম হিসেবে স্বীকৃত দুই দেশের অভিন্ন সীমান্তে যতসংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিক বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছে, তা যুদ্ধরত বৈরী রাষ্ট্রের মধ্যেও বিরল। আহতও কম হয় না।
প্রশ্নটি কেবল রাষ্ট্রীয় বৈরিতারও নয়, মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের একটি বিএসএফ ক্যাম্পে আলোচ্য তরুণকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের মধ্য দিয়ে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর অভিযুক্ত সদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে বিকৃত মানসিকতারও পরিচয় দিয়েছে। ঘটনাক্রমে ফাঁস হয়ে যাওয়া ভিডিওচিত্র যদিও জবাবদিহিতা চাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে কিন্তু পৈশাচিক ঘটনাকে এভাবে চিত্রায়িত করা এর কুশীলবদের মানসিক সুস্থতার লক্ষণ হতে পারে না। কেবল ঘুষের লোভে কাউকে এমন নির্যাতনের দৃশ্য আমাদের কাছে অবিশ্বাস্যই মনে হয়। সীমান্ত সুরক্ষায় পাঠানোর আগে তাদের কী ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, সে প্রশ্নও আমরা নো-ম্যান্স ল্যান্ডের এপার থেকে তুলতে চাই। গত মাসের মাঝামাঝি মেঘালয়ের শিলংয়ে অনুষ্ঠিত বিজিবি-বিএসএফ বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশির ওপর গুলিবর্ষণ বন্ধের দাবি জানানো হয়েছিল। অপরপক্ষ পাল্টা অভিযোগ করেছিল যে, বাংলাদেশিরাই বিএসএফের ওপর চড়াও হয়। সীমান্তে গুলি বন্ধ করার ফলে তারা আক্রান্ত হচ্ছে। বুধবার ফাঁস হওয়া ভিডিওচিত্র প্রকৃত সত্য বলে দিয়েছে। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। অবশ্য এও স্বীকার করতে হবে যে, বিএসএফ কর্তৃপক্ষ স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সক্রিয় হয়েছে। অভিযুক্ত আট জওয়ান ইতিমধ্যে বরখাস্ত এবং কমান্ডার পর্যায়ে সরেজমিন তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে আমরা ধন্যবাদ দিতে চাই। তথাকথিত 'রাষ্ট্রীয় ভাবমূর্তি' নষ্ট হওয়ার দোহাই না দিয়ে তারা ঘটনাটি প্রচার করেছে। যে ব্যক্তি ঝুঁকি নিয়ে ভিডিওটি ফাঁস করেছে, তিনিই সত্যিকার সুনাগরিক। 'সিটিজেন জার্নালিজম' নামে তাত্তি্বক ধারণাটি প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কতটা কাজে আসতে পারে, এই ঘটনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হলো। আমরা আশা করি, ব্যক্তিবিশেষের শাস্তিই এই ঘটনার শেষ দৃশ্য হবে না। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে জবাবদিহিমূলক, দায়িত্বশীল ও মানবিক করে গড়ে তোলার ওপর জোর দিলেই কেবল এখনও অজ্ঞাত ওই তরুণের যন্ত্রণার প্রতিটি কণা খানিকটা সার্থক হবে। বস্তুত সীমান্তে বিএসএফের স্বেচ্ছাচারিতা কোনো মানদণ্ডেই গ্রহণযোগ্য নয়। নাগরিকদের অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নে আমাদেরও আপস করার নূ্যনতম অবকাশ নেই। এটা প্রত্যাশিত যে বাংলাদেশ সরকার অবিলম্বে এই ঘটনার কড়া প্রতিবাদ জানাবে। আমাদের মনে আছে, গত বছর সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় অনুষ্ঠিত শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে বিএসএফ প্রধান সীমান্ত হত্যার ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলোর জন্য দুঃখও প্রকাশ করেছিলেন। তারও আগে বাংলাদেশ সফরে এসে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর হাতে অ-প্রাণঘাতী অস্ত্র দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বাস্তবে হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি। আমরা মনে করি, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ চাইলে সীমান্তে সব ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বন্ধ কঠিন কাজ নয়। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আমরা সবসময় অগ্রাধিকার দেই। কিন্তু তাই বলে নিজের নাগরিকের রক্তের বিনিময়ে নয়।
No comments