আসাদ দিবস-ইতিহাসের রক্তাক্ত অধ্যায় by মো. জাহাঙ্গীর হোসেন

রণে ক্ষতি নেই, যদি সে মরণ হয় বীরের মরণ। যে বুলেটে চেপে মৃত্যুদূত আসবে সে বুলেটের ঠিকানা যেন লেখা থাকে বুকে, পিঠে নয়। আর সে মরণে যদি বীজ বোনা হয় একটি পরাধীন দেশের স্বাধীনতার ,তাহলে তাকে কী মরণ বলব? বলছি আসাদের কথা।


ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের নায়ক শহীদ আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ১৯৪২ সালের ১০ জুন সাবেক ঢাকা (বর্তমানে নরসিংদী) জেলার শিবপুর থানার ধানুয়া গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আসাদের বাবা এতদঞ্চলের প্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট এবং আরবি শিক্ষায় পারদর্শী একজন কিংবদন্তি ছিলেন। আসাদের বাবা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন, তাঁর নাম আলহাজ মাওলানা মোহাম্মদ আবু তাহের বিএবিটি। এমনকি আসাদের মা ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। মা-বাবার চারিত্রিক গুণাবলির সব ভালো দিক পেয়েছিলেন আসাদ। লম্বা ও হালকা গড়নের আসাদ ছিলেন বিনয়ী ও সদালাপী। ছয় ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আসাদ ছিলেন চতুর্থ। আসাদের পরিবারের সবাই ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আসাদ ভালো সংগঠক হওয়ার কারণে তিনি খুব সহজেই ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ছাত্রনেতা আসাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা হল শাখার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আসাদ ছিলেন ছাত্রনেতা রাশেদ খান মেননের ঘনিষ্ঠ সহচর। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র কমিটি তাদের ১১ দফা আন্দোলন শুরু করে। ১৯৬৯-এ যা চরম রূপ নেয়। ১৭ জানুয়ারি ঢাকা ইউনিভার্সিটির বটতলায় সিদ্ধান্ত হয় ২০ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। তখন গভর্নর মোনায়েম খান ১৪৪ ধারা জারি করেন ঢাকা শহরে। এর পরও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে মিছিল শুরু করেন। মিছিলের একটি অংশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে দিয়ে চানখাঁর পুলের দিকে অগ্রসর হয়। পুলিশ ও ইপিআর বাহিনী তখন মিছিলে বাধা দেয়। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের প্রায় এক ঘণ্টা পর আসাদসহ কিছু ছাত্রনেতা আবার মিছিল শুরু করে ঢাকা হলের পাশ দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এমন এক পরিস্থিতিতে দুপুর আনুমানিক দেড়টার দিকে মূল ঘটনাস্থলের অনতিদূরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পূর্বদিকের প্রধান ফটকের পাশে ফুটপাতে পুলিশ বেয়োনেটের আঘাতে আসাদকে রাস্তায় ফেলে দেয় এবং বাহাউদ্দিন নামের জনৈক পুলিশ অফিসার তখন খুব কাছ থেকে গুলি করেন আসাদের বুকে। পিস্তলের গুলি আসাদের হৃৎপিণ্ডের বাম নিলয় বিদীর্ণ করে, যা ডাক্তারদের সম্মিলিত চেষ্টায়ও কিছু হয়নি। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন এই বীর। পরদিন ২১ জানুয়ারি নিজ গ্রামে তাঁর লাশ সমাহিত করা হয়। সেদিন ঢাকায় সকাল-সন্ধ্যা এক অবিস্মরণীয় হরতাল পালিত হয় এবং পল্টন ময়দানে বিশাল এক গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে লক্ষাধিক মানুষ নগ্নপদে এক মৌন মিছিল বের করে। আসাদের মৃত্যু এতটা ক্ষোভে পরিণত হয় যে এরপর মাত্র দুই মাসের মধ্যে স্বৈরাচার আইয়ুব খানের ১০ বছরের শোষণের সমাপ্তি হয়। আইয়ুবের নামে যত ফলক ছিল সব কিছু আসাদের নামে রূপান্তর করা হয়। যেমন_আইয়ুব গেট হয়ে গেল আসাদ গেট, আইয়ুব এভিনিউ হয়ে গেল আসাদ এভিনিউ, আইয়ুব পার্ক হয়ে গেল আসাদ পার্ক ইত্যাদি। আর এর পথ ধরেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। এ পথ ধরেই আমরা পাই জননী-জন্মভূমি স্বাধীন বাংলাদেশকে; পাই দুটি অমর কবিতা শামসুর রাহমানের আসাদের শার্ট উড়ছে হাওয়ার নীলিমায়_'আসাদের শার্ট' এবং হেলাল হাফিজের এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়_'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়।'
মো. জাহাঙ্গীর হোসেন

No comments

Powered by Blogger.