বিশেষ সাক্ষাৎকার-গুপ্তহত্যার তদন্ত করবে মানবাধিকার কমিশন by মিজানুর রহমান
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান এই দায়িত্ব গ্রহণের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে অধ্যাপনা করতেন। বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন ছাড়াও তিনি সুইডেনের উমিও বিশ্ববিদ্যালয় ও নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১০ সালে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ আইনের অধ্যাপক পদকে ভূষিত মিজানুর রহমান দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে যুক্ত।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলো মানবাধিকারের ক্ষেত্রে দেশে এখন বড় বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে গুপ্তহত্যা। আশঙ্কাজনকভাবে এ ধরনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। অনেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ধরনের ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহ করছেন। মানবাধিকার কমিশনের প্রধান হিসেবে আপনি এই বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
মিজানুর রহমান বেশ কিছুদিন ধরে এ ধরনের ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। আমরা মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে বলে আসছি যে কোনো নাগরিক নিখোঁজ হলে বা পরবর্তী সময়ে লাশ হিসেবে তার সন্ধান পাওয়া গেলে তার বিহিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্র ও সরকারের। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা নেই। এটা বলেই তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব শেষ করতে পারেন না। একজন নাগরিক নিখোঁজ হবেন, এরপর তাঁর লাশ পাওয়া যাবে, তিনি কীভাবে মারা গেলেন তা জানা যাবে না—এমনটি হতে পারে না। আমরা মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি লিখেছি। ঘটনাগুলো তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা বলেছি।
প্রথম আলো আপনারা কমিশন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন, কিন্তু নিখোঁজ হওয়া, গুম হয়ে যাওয়া বা পরবর্তী সময়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে লাশ উদ্ধারের ঘটনাগুলো তো থামছে না। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ধরনের ঘটনাগুলোর সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করছে। তাহলে কি এসব ঘটনা ঘটতেই থাকবে?
মিজানুর রহমান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, এ ধরনের কাজের সঙ্গে তাঁরা জড়িত নন। আমার কথা হচ্ছে, শুধু অস্বীকার করে বসে থাকার সুযোগ নেই। যদি এর সঙ্গে তাঁদের কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকে তবে তাঁদের দায়িত্ব হচ্ছে, কারা এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে তা খুঁজে বের করা এবং এ ধরনের ঘটনাগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে কেউ কোনো দায়িত্ব নিচ্ছেন না। যারা এ ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে তারা কি এতই শক্তিশালী যে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেউ তাদের কিছু করতে পারছে না? কিন্তু একটি রাষ্ট্রে কোনো একটি গোষ্ঠী এত শক্তিশালী হয়ে উঠবে, এটা কি সম্ভব? বিষয়টি এখন খুবই উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে গেছে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেই এ ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িতদের, এর হোতা ও মদদদাতাদের খুঁজে বের করতে হবে। এবং কাজটি দ্রুত করতে হবে।
প্রথম আলো আপনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের দায়িত্বের কথা বলছেন, কিন্তু মানবাধিকার কমিশন এ ক্ষেত্রে কী করতে পারে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়ার মধ্যেই কি আপনাদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ থাকবে?
মিজানুর রহমান মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা এ ব্যাপারে একটি উদ্যোগ নিতে যাচ্ছি। আগামী ৪ জানুয়ারি আমাদের পূর্ণাঙ্গ কমিশনের সভা রয়েছে। সেখানে নানা বিষয়ের মধ্যে এসব গুপ্তহত্যা, নিখোঁজ ও গুম হওয়ার বিষয়টি হবে অন্যতম আলোচনার বিষয়। আমরা নয়টি অভিযোগ পেয়েছি। সেখানে আমরা সিদ্ধান্ত নেব এ ব্যাপারে আর কী সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সব অস্বীকার করবে আর কমিশন শুধু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রতিবেদন চেয়ে বসে থাকবে—সেখানে আমরা আটকে থাকতে চাই না। আমাদের যতটুকু শক্তি আছে তা নিয়েই আমরা একটি তদন্ত কমিটি করার কথা ভাবছি। এক বা একাধিক ঘটনা বেছে নিয়ে আমরা এ কাজটি করতে চাই। বর্তমান অবস্থায় মানবাধিকার কমিশন চুপচাপ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে বসে থাকবে না। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাই যে কারা ও কীভাবে এই কাজ চলছে।
প্রথম আলো স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, একটি সংঘবদ্ধ চক্র এ কাজ করছে।
মিজানুর রহমান আমি বলতে চাই, সে কারণেই সরকারের ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাড়তি দায়িত্ব এটা প্রমাণ করা যে এ ধরনের গুম বা গুপ্তহত্যার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা বা সায় নেই। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এটাও বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে, সেটা যদি সত্যি হয় তবে আমরা এ ব্যাপারে তথ্য-প্রমাণ প্রত্যাশা করছি। কোন চক্র এ কাজটি করছে, তা জনগণের জানা উচিত। সে ক্ষেত্রে জনগণও এই চক্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারবে।
প্রথম আলো জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদে আপনি বছর খানেক দায়িত্ব পালন করলেন। মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে এই কমিশনের ক্ষমতার কোনো ঘাটতি রয়েছে কি না? আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?
মিজানুর রহমান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ক্ষমতার কোনো ঘটতি রয়েছে এমন কথা আমি মনে করি না। কমিশনকে কোনো নির্বাহী ক্ষমতা দিলেই তাতে কাজ হবে, তা আমি মনে করি না। আর এ ধরনের কমিশনের ক্ষেত্রে তা থাকেও না। আমি মনে করি, জনগণের আস্থাভাজন হয়ে ওঠাই সবচেয়ে বড় কথা। আমরা জনগণ ও মানবাধিকারের স্বার্থে কাজ করছি। তবে আমাদের সামর্থ্যের যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তা আমি উল্লেখ করতে চাই। আমাদের বর্তমানে ২৮ জন লোকবল রয়েছে। অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় আমরা তুলনামূলকভাবে কম সময়ে এই সংখ্যক লোকবল পেয়েছি। কিন্তু এর পরও বলব, মানবাধিকার কমিশনকে কার্যকর করে তুলতে দুটি শক্তিশালী ও কার্যকর সেল দরকার। একটি গবেষণা সেল ও অন্যটি তদন্ত সেল। মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অপরাধের ঘটনাগুলো কেন ঘটছে, কোন ধারাবাহিকতায় ঘটছে, তা যেমন গবেষণা করে বের করা দরকার, তেমনি ঘটনা তদন্তে প্রশিক্ষিত তদন্ত দল থাকা প্রয়োজন। আমাদের এখানে পরিচালক, ডেপুটি পরিচালক ও সহকারী পরিচালক মিলিয়ে মোট পাঁচজন রয়েছেন। তাঁদের যদি তদন্তকাজে লাগাতে হয় তবে তাঁদের সেভাবে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। কারণ, তদন্তের কাজটি জটিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে কেউ যোগ দিয়েই এই কঠিন কাজ করতে পারে না। যদি একটি প্রশিক্ষিত ও যোগ্য তদন্ত দল থাকে, তবে দু-একটি ঘটনা তদন্ত করে দায়ীদের মুখোশ খুলে দিতে পারলে কাজের কাজ হবে বলে আমি মনে করি। এ জন্য দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়টিই আমাদের এখন সবচেয়ে দরকারি বিষয়।
প্রথম আলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রাষ্ট্র কিংবা সরকারের বিরুদ্ধেই বেশি ওঠে। এবং সে ক্ষেত্রে জনগণ সত্যিই অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে। কারণ, এই শক্তির সঙ্গে পেরে ওঠা একজন নাগরিকের পক্ষে অসম্ভব। সরকার যদি এ ক্ষেত্রে আন্তরিক না হয় এবং মানবাধিকারের বিষয়টিকে বিবেচনায় না নেয় তবে কমিশনের পক্ষে আসলে মানবাধিকার রক্ষায় কী করা সম্ভব?
মিজানুর রহমান আসলে মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের কোথাও কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই। কমিশন সরকারের কাছে মানবাধিকারসংক্রান্ত নানা দিক তুলে ধরতে পারে, সুপারিশ করতে পারে। কমিশনের পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হলে সরকার তা মানবে, এটাই প্রত্যাশিত। সরকার যদি মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশ ও উদ্বেগের বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয় তবে কোথায় কী ভুলত্রুটি হচ্ছে, তা শোধরানো সম্ভব। আমরা কী কাজ করি, সরকারের কাছে কী কী সুপারিশ করি, তা লোকানোর কিছু নেই। ওয়েবসাইটে সব রয়েছে। আমরা আসলে চাই যে কমিশনের কাজে জনগণের আস্থা আসুক। সেটা যদি আমরা অর্জন করতে পারি তবে যেকোনো সরকারের পক্ষে আমাদের সুপারিশ বা পরামর্শগুলো উপেক্ষা করা কঠিন হবে।
প্রথম আলো পরামর্শ বা সুপারিশের বাইরে সরকারকে মানবাধিকারের ব্যাপারে সচেতন করার আর কোনো উদ্যোগ কি আপনাদের নেই?
মিজানুর রহমান আসলে মানবাধিকারের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির বিষয়টি একটি দীর্ঘ এবং অব্যাহত প্রক্রিয়া। আমরা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে নানা পর্যায়ে নিয়মিত আলাপ-আলোচনা করে থাকি। মন্ত্রী পর্যায়েও আমাদের আলাপ-আলোচনা হয়। আমরা বর্তমানে এমন পৃথিবীতে বাস করি যে এখানে মানবাধিকারকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। কোনো রাষ্ট্র যদি তা উপেক্ষা করে, তবে রাষ্ট্রকে এর মাশুল দিতে হয়। সরকার যদি মানবাধিকারের ব্যাপারে ইতিবাচক অবস্থান নেয়, তবে চূড়ান্ত বিচারে এতে সরকারই লাভবান হয়। জনগণকে উপেক্ষা করে বা তাদের অধিকারকে লঙ্ঘন করে কোনো সরকার উপকৃত হতে পারে না। মানবাধিকারের ক্ষেত্রে মনমানসিকতা পরিবর্তনের জন্য অব্যাহত আলাপ-আলোচনার কাজটি আমরা করে যাচ্ছি। আমি মনে করি, এই বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত পক্ষপাত রয়েছে মানবাধিকারের ব্যাপারে। সাধারণ মানুষের ক্ষতি হয় এমন কিছু তিনি চান না। কিন্তু একটি সরকারের সবকিছু যে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় সব সময় বাস্তবায়িত হয়, বিষয়টি তেমন নয়। সরকারের ভেতরেও সরকার থাকে, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী থাকে। ক্ষুদ্র স্বার্থে তারা নানা ঘটনা ঘটায়। তবে তার দায় কিন্তু সরকারের ওপর গিয়েই পড়ে।
প্রথম আলো মানবাধিকারের ক্ষেত্রে কমিশন ইতিবাচক কিছু করতে পেরেছে? আপনি কি সন্তুষ্ট?
মিজানুর রহমান একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের যেমন সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিশাল জনগোষ্ঠী। এমন একটি দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আত্মতৃপ্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে কিছু না কিছু উন্নতি নিশ্চয়ই হয়েছে। মানবাধিকারের ব্যাপারে সচেতনতা ও বিভিন্ন মহলের সরব অবস্থানের কারণে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে যা ছিল তা এখন কমেছে। তবে এর রূপান্তর ঘটে, অন্যভাবে তা ঘটছে কি, সেটা অবশ্য দেখার বিষয়। আসলে মানবাধিকার একটি ব্যাপক বিষয়। এর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক রয়েছে। আমরা এখন দেখছি যে সরকার সামাজিক নিরাপত্তাবলয় বাড়ানোর চেষ্টা করছে। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা বা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়াকে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। আমি বলব, এ ক্ষেত্রে শুধু মানবাধিকার কমিশন নয়, অনেক মানবাধিকার সংস্থা কাজ করছে। সবকিছু মিলিয়েই সাফল্য আছে। এখন মানবাধিকারের বিষয়টি উপেক্ষা করা সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
মিজানুর রহমান ধন্যবাদ।
মিজানুর রহমান বেশ কিছুদিন ধরে এ ধরনের ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। আমরা মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে বলে আসছি যে কোনো নাগরিক নিখোঁজ হলে বা পরবর্তী সময়ে লাশ হিসেবে তার সন্ধান পাওয়া গেলে তার বিহিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্র ও সরকারের। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা নেই। এটা বলেই তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব শেষ করতে পারেন না। একজন নাগরিক নিখোঁজ হবেন, এরপর তাঁর লাশ পাওয়া যাবে, তিনি কীভাবে মারা গেলেন তা জানা যাবে না—এমনটি হতে পারে না। আমরা মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি লিখেছি। ঘটনাগুলো তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা বলেছি।
প্রথম আলো আপনারা কমিশন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন, কিন্তু নিখোঁজ হওয়া, গুম হয়ে যাওয়া বা পরবর্তী সময়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে লাশ উদ্ধারের ঘটনাগুলো তো থামছে না। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ধরনের ঘটনাগুলোর সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করছে। তাহলে কি এসব ঘটনা ঘটতেই থাকবে?
মিজানুর রহমান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, এ ধরনের কাজের সঙ্গে তাঁরা জড়িত নন। আমার কথা হচ্ছে, শুধু অস্বীকার করে বসে থাকার সুযোগ নেই। যদি এর সঙ্গে তাঁদের কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকে তবে তাঁদের দায়িত্ব হচ্ছে, কারা এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে তা খুঁজে বের করা এবং এ ধরনের ঘটনাগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে কেউ কোনো দায়িত্ব নিচ্ছেন না। যারা এ ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে তারা কি এতই শক্তিশালী যে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেউ তাদের কিছু করতে পারছে না? কিন্তু একটি রাষ্ট্রে কোনো একটি গোষ্ঠী এত শক্তিশালী হয়ে উঠবে, এটা কি সম্ভব? বিষয়টি এখন খুবই উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে গেছে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেই এ ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িতদের, এর হোতা ও মদদদাতাদের খুঁজে বের করতে হবে। এবং কাজটি দ্রুত করতে হবে।
প্রথম আলো আপনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের দায়িত্বের কথা বলছেন, কিন্তু মানবাধিকার কমিশন এ ক্ষেত্রে কী করতে পারে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়ার মধ্যেই কি আপনাদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ থাকবে?
মিজানুর রহমান মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা এ ব্যাপারে একটি উদ্যোগ নিতে যাচ্ছি। আগামী ৪ জানুয়ারি আমাদের পূর্ণাঙ্গ কমিশনের সভা রয়েছে। সেখানে নানা বিষয়ের মধ্যে এসব গুপ্তহত্যা, নিখোঁজ ও গুম হওয়ার বিষয়টি হবে অন্যতম আলোচনার বিষয়। আমরা নয়টি অভিযোগ পেয়েছি। সেখানে আমরা সিদ্ধান্ত নেব এ ব্যাপারে আর কী সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সব অস্বীকার করবে আর কমিশন শুধু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রতিবেদন চেয়ে বসে থাকবে—সেখানে আমরা আটকে থাকতে চাই না। আমাদের যতটুকু শক্তি আছে তা নিয়েই আমরা একটি তদন্ত কমিটি করার কথা ভাবছি। এক বা একাধিক ঘটনা বেছে নিয়ে আমরা এ কাজটি করতে চাই। বর্তমান অবস্থায় মানবাধিকার কমিশন চুপচাপ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে বসে থাকবে না। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাই যে কারা ও কীভাবে এই কাজ চলছে।
প্রথম আলো স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, একটি সংঘবদ্ধ চক্র এ কাজ করছে।
মিজানুর রহমান আমি বলতে চাই, সে কারণেই সরকারের ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাড়তি দায়িত্ব এটা প্রমাণ করা যে এ ধরনের গুম বা গুপ্তহত্যার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা বা সায় নেই। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এটাও বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে, সেটা যদি সত্যি হয় তবে আমরা এ ব্যাপারে তথ্য-প্রমাণ প্রত্যাশা করছি। কোন চক্র এ কাজটি করছে, তা জনগণের জানা উচিত। সে ক্ষেত্রে জনগণও এই চক্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারবে।
প্রথম আলো জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদে আপনি বছর খানেক দায়িত্ব পালন করলেন। মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে এই কমিশনের ক্ষমতার কোনো ঘাটতি রয়েছে কি না? আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?
মিজানুর রহমান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ক্ষমতার কোনো ঘটতি রয়েছে এমন কথা আমি মনে করি না। কমিশনকে কোনো নির্বাহী ক্ষমতা দিলেই তাতে কাজ হবে, তা আমি মনে করি না। আর এ ধরনের কমিশনের ক্ষেত্রে তা থাকেও না। আমি মনে করি, জনগণের আস্থাভাজন হয়ে ওঠাই সবচেয়ে বড় কথা। আমরা জনগণ ও মানবাধিকারের স্বার্থে কাজ করছি। তবে আমাদের সামর্থ্যের যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তা আমি উল্লেখ করতে চাই। আমাদের বর্তমানে ২৮ জন লোকবল রয়েছে। অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় আমরা তুলনামূলকভাবে কম সময়ে এই সংখ্যক লোকবল পেয়েছি। কিন্তু এর পরও বলব, মানবাধিকার কমিশনকে কার্যকর করে তুলতে দুটি শক্তিশালী ও কার্যকর সেল দরকার। একটি গবেষণা সেল ও অন্যটি তদন্ত সেল। মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অপরাধের ঘটনাগুলো কেন ঘটছে, কোন ধারাবাহিকতায় ঘটছে, তা যেমন গবেষণা করে বের করা দরকার, তেমনি ঘটনা তদন্তে প্রশিক্ষিত তদন্ত দল থাকা প্রয়োজন। আমাদের এখানে পরিচালক, ডেপুটি পরিচালক ও সহকারী পরিচালক মিলিয়ে মোট পাঁচজন রয়েছেন। তাঁদের যদি তদন্তকাজে লাগাতে হয় তবে তাঁদের সেভাবে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। কারণ, তদন্তের কাজটি জটিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে কেউ যোগ দিয়েই এই কঠিন কাজ করতে পারে না। যদি একটি প্রশিক্ষিত ও যোগ্য তদন্ত দল থাকে, তবে দু-একটি ঘটনা তদন্ত করে দায়ীদের মুখোশ খুলে দিতে পারলে কাজের কাজ হবে বলে আমি মনে করি। এ জন্য দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়টিই আমাদের এখন সবচেয়ে দরকারি বিষয়।
প্রথম আলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রাষ্ট্র কিংবা সরকারের বিরুদ্ধেই বেশি ওঠে। এবং সে ক্ষেত্রে জনগণ সত্যিই অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে। কারণ, এই শক্তির সঙ্গে পেরে ওঠা একজন নাগরিকের পক্ষে অসম্ভব। সরকার যদি এ ক্ষেত্রে আন্তরিক না হয় এবং মানবাধিকারের বিষয়টিকে বিবেচনায় না নেয় তবে কমিশনের পক্ষে আসলে মানবাধিকার রক্ষায় কী করা সম্ভব?
মিজানুর রহমান আসলে মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের কোথাও কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই। কমিশন সরকারের কাছে মানবাধিকারসংক্রান্ত নানা দিক তুলে ধরতে পারে, সুপারিশ করতে পারে। কমিশনের পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হলে সরকার তা মানবে, এটাই প্রত্যাশিত। সরকার যদি মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশ ও উদ্বেগের বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয় তবে কোথায় কী ভুলত্রুটি হচ্ছে, তা শোধরানো সম্ভব। আমরা কী কাজ করি, সরকারের কাছে কী কী সুপারিশ করি, তা লোকানোর কিছু নেই। ওয়েবসাইটে সব রয়েছে। আমরা আসলে চাই যে কমিশনের কাজে জনগণের আস্থা আসুক। সেটা যদি আমরা অর্জন করতে পারি তবে যেকোনো সরকারের পক্ষে আমাদের সুপারিশ বা পরামর্শগুলো উপেক্ষা করা কঠিন হবে।
প্রথম আলো পরামর্শ বা সুপারিশের বাইরে সরকারকে মানবাধিকারের ব্যাপারে সচেতন করার আর কোনো উদ্যোগ কি আপনাদের নেই?
মিজানুর রহমান আসলে মানবাধিকারের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির বিষয়টি একটি দীর্ঘ এবং অব্যাহত প্রক্রিয়া। আমরা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে নানা পর্যায়ে নিয়মিত আলাপ-আলোচনা করে থাকি। মন্ত্রী পর্যায়েও আমাদের আলাপ-আলোচনা হয়। আমরা বর্তমানে এমন পৃথিবীতে বাস করি যে এখানে মানবাধিকারকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। কোনো রাষ্ট্র যদি তা উপেক্ষা করে, তবে রাষ্ট্রকে এর মাশুল দিতে হয়। সরকার যদি মানবাধিকারের ব্যাপারে ইতিবাচক অবস্থান নেয়, তবে চূড়ান্ত বিচারে এতে সরকারই লাভবান হয়। জনগণকে উপেক্ষা করে বা তাদের অধিকারকে লঙ্ঘন করে কোনো সরকার উপকৃত হতে পারে না। মানবাধিকারের ক্ষেত্রে মনমানসিকতা পরিবর্তনের জন্য অব্যাহত আলাপ-আলোচনার কাজটি আমরা করে যাচ্ছি। আমি মনে করি, এই বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত পক্ষপাত রয়েছে মানবাধিকারের ব্যাপারে। সাধারণ মানুষের ক্ষতি হয় এমন কিছু তিনি চান না। কিন্তু একটি সরকারের সবকিছু যে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় সব সময় বাস্তবায়িত হয়, বিষয়টি তেমন নয়। সরকারের ভেতরেও সরকার থাকে, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী থাকে। ক্ষুদ্র স্বার্থে তারা নানা ঘটনা ঘটায়। তবে তার দায় কিন্তু সরকারের ওপর গিয়েই পড়ে।
প্রথম আলো মানবাধিকারের ক্ষেত্রে কমিশন ইতিবাচক কিছু করতে পেরেছে? আপনি কি সন্তুষ্ট?
মিজানুর রহমান একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের যেমন সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিশাল জনগোষ্ঠী। এমন একটি দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আত্মতৃপ্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে কিছু না কিছু উন্নতি নিশ্চয়ই হয়েছে। মানবাধিকারের ব্যাপারে সচেতনতা ও বিভিন্ন মহলের সরব অবস্থানের কারণে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে যা ছিল তা এখন কমেছে। তবে এর রূপান্তর ঘটে, অন্যভাবে তা ঘটছে কি, সেটা অবশ্য দেখার বিষয়। আসলে মানবাধিকার একটি ব্যাপক বিষয়। এর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক রয়েছে। আমরা এখন দেখছি যে সরকার সামাজিক নিরাপত্তাবলয় বাড়ানোর চেষ্টা করছে। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা বা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়াকে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। আমি বলব, এ ক্ষেত্রে শুধু মানবাধিকার কমিশন নয়, অনেক মানবাধিকার সংস্থা কাজ করছে। সবকিছু মিলিয়েই সাফল্য আছে। এখন মানবাধিকারের বিষয়টি উপেক্ষা করা সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
মিজানুর রহমান ধন্যবাদ।
No comments