আমরা পারব না কেন?-যানজট by মোহাম্মদ নুরাল হক
ঢাকা শহরের অযাচিত ট্রাফিক জ্যামের অন্যতম প্রধান কারণ হলো, লেন ভঙ্গ করে গাড়ি চালানোর বদভ্যাস। লেন ভঙ্গ করে গাড়ি চালানো ট্রাফিক আইনে একটি অমার্জনীয় অপরাধ। বিশেষ করে ট্রাফিক সিগন্যালে অথবা ক্রসিং পয়েন্টগুলোতে ডান লেনের গাড়িগুলোকে যদি ডানদিকে ও বাম লেনের গাড়িগুলোকে যদি বামদিকে মোড় নিতে বাধ্য করা হয়, তাহলেই ট্রাফিক জ্যাম অর্ধেক কমে যাবে
যানজটে নিত্যদিনের জনযন্ত্রণা অস্বাভাবিক হারে বেড়েই চলেছে। প্রতিদিনই ভোগান্তির শহর তথাকথিত তিলোত্তমা ঢাকা। দশকের পর দশক ধরে কারণ অনুসন্ধানে ছোট, মাঝারি, বড় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কমিটির পর কমিটি হয়েছে। স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশই কেবল পাওয়া গেছে। দিন শেষে আমরা যেখানে, সেখানেই রয়ে গেলাম।
ঢাকা শহরের অসহনীয় যানজটের মূল কারণ হলো সামাজিক অস্থিরতা, পথ চলতে আমাদের সবার অসহিষ্ণু আচরণ এবং মালিক, যাত্রী, চালক তথা পথচারীদের ধৈর্যের অভাব। আর এহেন অসহিষ্ণুতা ও ধৈর্যচ্যুতির মূল কারণ হলো, আমাদের ছোট-বড় পরিবারগুলোর প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড অকারণেই প্রলম্বিত। যুক্তিবিহীন আশা-আকাঙ্ক্ষায় আমাদের কর্মকাণ্ড আবর্তিত। গ্রামবাংলায় প্রচলিত প্রবাদে যেমন বলা হয়, 'এক হাত বাঙ্গির দুই হাত বিচি'। বিষয়টি খোলাসা করা প্রয়োজন? ঠিক আছে, ছোট দুটি উদাহরণ দিচ্ছি। প্রথমটি, একটি পরিবারে চারজন বয়স্ক মানুষ ও একটি শিশুর জন্য তিনটি গাড়ি। দ্বিতীয়টি, আরেকটি পরিবারে ছয়জনকে দিনের বিভিন্ন সময়ে স্কুল, অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে আনা-নেওয়ার জন্য একটি গাড়ি ও একজন চালক। পাঠকবৃন্দ, এখন হিসাব মেলান, দৈনন্দিন জীবনে কার মানসিক অবস্থা ও ধৈর্য কোন পর্যায়ে? আর এসব মানসিক অবস্থার সমষ্টিগত ফলাফলই তো সামাজিক অস্থিরতা।
ঢাকা শহর এখন বসবাসের অযোগ্য। আমাদের সম্পদ সীমিত। বাড়তি জনসংখ্যার সমস্যায় আমরা জর্জরিত। এখানে সূক্ষ্ম বিচারে উলি্লখিত পরিসংখ্যান শতভাগ সত্য। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এর পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা ও তর্ক-বিতর্ক প্রায়ই অসত্য। কারণ এহেন তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনা আজকাল এক ধরনের বাস্তবতাবর্জিত জীবিকা অর্জনের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা আমাদের সবার জন্য নিদ্বর্িধায় লজ্জাজনক।
ঢাকার অসহনীয় যানজটকে তাই আমাদের দুর্বল মানসিকতা থেকে সামাজিক অস্থিরতার ফসল বলতে বাধ্য হচ্ছি। যেমন ধরুন, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকা। ভোক্তারা একযোগে সবাই বলবেন, ঢাকার ট্রাফিক পুলিশ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। দায়িত্ব পালনে ট্রাফিক পুলিশের ব্যর্থতার দায়ভার অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে সবটুকুই কি আসলেই তাই? নাকি, ট্রাফিক পুলিশকে আমরাও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পাই, দিই না অথবা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী সাহায্য-সহযোগিতা করি না?
বাংলাদেশের পুলিশের ব্যর্থতা সম্পর্কে আমাদের এহেন ঢালাও নেতিবাচক ধারণা আসলে সম্পূর্ণ সত্য নয়। একটি উদাহরণ, ১৯৯৩-৯৪ সালে সুদূর আফ্রিকার মোজাম্বিক ইউএন মিশনে নিয়োজিত বিশ্বের ২৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের পুলিশ সদস্যদের মধ্য থেকেই একজন অফিসারকে আমরা মিশন সদর দফতরের পুলিশের কমান্ডার নির্বাচিত হতে দেখেছি। এহেন সম্মান প্রদানে যোগ্যতাই বিবেচ্য বিষয় ছিল। ওই সময় বাংলাদেশ কন্টিনজেন্টের কমান্ডার হিসেবে গর্বে আমার বুক ভরে গিয়েছিল।
আসল কথা হলো, পুলিশের কাজ পুলিশকেই করতে দিতে হবে। এখানে দলীয়করণ অথবা পক্ষপাতিত্বের কোনো স্থান নেই। মনে রাখতে হবে, পুলিশও রক্তে-মাংসে গড়া আমাদের মতোই মানুষ। আমি প্রায় এক যুগ আগের উদাহরণ টানলাম। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আজকের পুলিশ বাহিনী সবদিক থেকেই আরও উন্নত। শুধুই প্রয়োজন পুলিশের কাজে অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করা। এটুকুতেই আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমাদের ট্রাফিক পুলিশের দক্ষতা কার্যকরভাবে প্রমাণ করতে এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগবে না।
ঢাকা শহরের অযাচিত ট্রাফিক জ্যামের অন্যতম প্রধান কারণ হলো, লেন ভঙ্গ করে গাড়ি চালানোর বদভ্যাস। লেন ভঙ্গ করে গাড়ি চালানো ট্রাফিক আইনে একটি অমার্জনীয় অপরাধ। বিশেষ করে ট্রাফিক সিগন্যালে অথবা ক্রসিং পয়েন্টগুলোতে ডান লেনের গাড়িগুলোকে যদি ডানদিকে ও বাম লেনের গাড়িগুলোকে যদি বামদিকে মোড় নিতে বাধ্য করা হয়, তাহলেই ট্রাফিক জ্যাম অর্ধেক কমে যাবে। মূল কথা হলো, ডান লেনের গাড়ি ডানে, বাম লেনের গাড়ি বামে এবং মাঝখানের এক বা একাধিক লেনের গাড়ি শুধুই সামনে চলবে। এতে কোনোভাবেই অন্যথা করা যাবে না।
ট্রাফিক আইন মান্য করা ও সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আরেকটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে এ রকম_ ট্রাফিক আইন অমান্য ও দুর্ঘটনার দায়ভার যে গাড়ি ও চালকের ওপর বর্তাবে, সেই গাড়ির তাৎক্ষণিক জরিমানাসহ ট্যাক্স টোকেন, রুট পারমিট, ইনকাম ট্যাক্স, ফিটনেসসহ সব রকম নবায়ন কার্যক্রমের ফি পরবর্তী তিন বছরের জন্য দ্বিগুণ অথবা তিনগুণ আদায় করতে হবে। এ সঙ্গে দোষী চালকের তাৎক্ষণিক জরিমানাসহ ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন ফিও পরবর্তী তিন মেয়াদের জন্য দ্বিগুণ অথবা তিনগুণ আদায় করতে হবে। বাস্তবে দেখা গেছে, তাৎক্ষণিক তথা দীর্ঘমেয়াদে মোটা অঙ্কের জরিমানার ভয় কিন্তু প্রচলিত দীর্ঘসূত্রী আইনি প্রক্রিয়ার চেয়ে বেশি কার্যকর।
ট্রাফিক আইন মেনে চলা ও যানজটের ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশ ও চালকের চেয়ে মালিকসহ ভোক্তার সংখ্যাই কিন্তু বেশি। তাই মালিক ও ভোক্তাদের স্বার্থেই এবং সক্রিয় সহযোগিতার মাধ্যমেই এহেন সমস্যার বাস্তব সমাধান সম্ভব। আরেকটি ছোট উদাহরণ না টানলেই নয়। অযথা হর্ন বাজানোর কারণে আমরা সবাই ঢাকা শহরে শব্দদূষণের শিকার এবং এর বিরুদ্ধে যারপরনাই সোচ্চার। অথচ শিক্ষিত মালিক অথবা শিক্ষিত যাত্রীরা গাড়িতে বসে থেকেও চালককে কখনোই লেন ভঙ্গ করা এবং অযথা হর্ন বাজানো থেকে বিরত থাকতে কোনো পদক্ষেপই নেন না। অনেক মালিক আছেন যারা বলেন, তারা চালকদের কাছে জিম্মি। তাই যদি হয়, তাহলে যানজট ও এহেন যন্ত্রণা নিয়ে এত উচ্চবাচ্চ্য কেন? যানজট নিয়ে এত চেঁচামেচির বিষয়টি কি শুধুই লোক দেখানোর মতো একটা কিছু?
যান চলাচলের জন্য ঢাকা শহরের রাস্তার অপ্রশস্ততা ও সংখ্যা কম বলে যে একমাত্র কারণ তুলে ধরা হয়, তাও সঠিক নয়। কারণ পৃথিবীর অনেক দেশের অনেক শহরেই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনপূর্বক এর চেয়ে ছোট ছোট অনেক কমসংখ্যক রাস্তায় তারা যানজট ও শব্দদূষণ এড়িয়ে দিব্যি সুন্দর জীবনযাপন করছে। পথ চলতে সহযোগিতা ও সহমর্মিতায়ই অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে। উন্নত দেশগুলোতে এর ভূরি ভূরি উদাহরণ বিদ্যমান। তা হলে ওরা পারলে আমরা পারব না কেন?
ব্রিগেডিয়ার (অব.) মোহাম্মদ নুরাল হক পিএসসি : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা
No comments