স্মরণ-শচীন দেববর্মণ : সুর ও সংগীতের একনিষ্ঠ সাধক by জাহাঙ্গীর হোসেন অরুণ

শোনো গো দখিন হাওয়া, প্রেম করেছি আমি।' প্রেম তিনি করেছিলেন সুর ও সংগীতের সঙ্গে। আর যিনি এই গীত রচনা করেছিলেন, তাঁর সঙ্গে সম্পর্কটা প্রেম থেকেই পরিণয় পর্যন্ত গড়িয়েছিল। এই মানুষটির জন্ম আমাদের কুমিল্লায় (তখনকার ত্রিপুরা) আর তিনি অমর হয়ে আছেন সংগীতপ্রেমী সবার হৃদয়ে। তিনি কারো কাছে শচীন দেববর্মণ, কারো কাছে এস ডি বর্মণ। আবার কেউ কেউ তাঁকে শচীন কর্তা বা সচীকর্তা বলেই যেন বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।


মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্যের অর্থায়নে কুমিল্লার চর্তায় ৬০ একর জমিতে প্রাসাদ নির্মাণ করেন মাণিক্য রাজপরিবারের কুমারবাহাদুর নবদ্বীপচন্দ্র। আর এ প্রাসাদেই নবদ্বীপের কনিষ্ঠ পুত্র শচীন দেবের জন্ম হয় ১৯০৬ সালের পয়লা অক্টোবর। তাঁর ছেলে রাহুল দেববর্মণ, যিনি আর ডি বর্মণ নামে পরিচিত, তিনিও সংগীতের অঙ্গনে খ্যাতিমান। ১৯২০ সালের দিকে শচীন দেবের বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, হিমাংশু দত্ত, অজয় ভট্টাচার্যের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা। মহারাজার তৈরি টাউন হল, নাট্যশালা_এই সব জায়গায় তখন বসত তাঁদের আড্ডা। আর আড্ডা থেকে ভেসে আসত শচীন ও নজরুলের সুরেলা কণ্ঠের গান। গানের ধরন ছিল প্রধানত ভোরকীর্তন, নগরকীর্তন, কবিগান ইত্যাদি। ১৯২৩ সালে শচীন দেব প্রথম গান করেন আকাশবাণী কলকাতায়। আর ১৯২৫ সালে তিনি একেবারে চলে আসেন কলকাতায়। শচীন দেব তাঁর আত্মজীবনী সরগমের নিখাদে লিখেছেন, রাজপরিবারের সব সুবিধা ভোগ করে তিনি কুমিল্লায় থাকতে পারতেন; কিন্তু গানের টানে সব ত্যাগ করে ছোট একটি ঘর ভাড়া নিলেন কলকাতায়। ১৯৩০-এর দশকে তিনি রেডিওতে পল্লীগীতি গেয়ে বেশ জনপ্রিয়তা পেলেন। কিন্তু ১৯৩২ সালে এইচএমভিতে অডিশন দিয়ে ফেল করেন। পরে অবশ্য হিন্দুস্তান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস থেকে তাঁর প্রথম রেকর্ড বের করেন। ১৯৩৭ সালে শচীন দেব গিয়েছিলেন এলাহাবাদের এক অনুষ্ঠানে। আর সেখানেই তিনি দেখা পান মীরা দাসগুপ্তের। মীরা তখন শান্তিনিকেতনের ছাত্রী। তাঁর দাদার বাড়ি ঢাকায়, নাম বিচারপতি রায়বাহাদুর কমলনাথ দাসগুপ্ত। ১৯৩৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি শচীন দেব তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত ছাত্রী মীরা দাসগুপ্তকে বিয়ে করেন। যেহেতু মীরা দাসগুপ্ত বড় জাত ও পরিবারের কেউ নন, তাই এমন একটি মেয়েকে বিয়ে করায় ত্রিপুরার রাজপরিবার শচীনের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে। এই মীরা দেবীর লেখা অনেক গান শচীনের গায়কজীবনে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। মীরার লেখা বিখ্যাত কিছু গানের মধ্যে আছে_'শোনো গো দখিন হাওয়া, প্রেম করেছি আমি', 'কে যাস রে ভাটির গাঙ বাইয়া', 'বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে' এবং ১৯৭১ সালে মীরা লেখেন 'তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল'। এই গান গোটা বাংলাদেশের বোল হয়ে আছে এবং থাকবে সহস্র বছর। শচীন দেব গানের মান নিয়ে কখনো ছাড় দিতেন না। একবার লতা মুঙ্গেশকরকে দিয়ে গান গাওয়ালেন, কিন্তু পছন্দ হলো না তাঁর। একবার, দুইবার গাওয়ালেন, তবু পছন্দ হলো না। লতাজির তখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা, অনেক ব্যস্ত তিনি। তৃতীয়বার গাইতে বলায় লতাজির পক্ষে সময় দেওয়া সম্ভব হলো না। এতে খেপে গেলেন শচীন। সিদ্ধান্ত নিলেন, লতাকে দিয়ে আর গান করাবেন না তিনি। কর্তা এই সিদ্ধান্তে অনেক দিন অনড় ছিলেন। আর এ ফাঁকেই আশা ভোঁসলে স্বর্ণালি সুযোগ পেলেন কর্তার গান গাওয়ার এবং তৈরি করলেন নিজের শক্ত অবস্থান। শিল্পী কিশোর কুমারকে নিজের হাতে গড়ে তুলেছিলেন শচীন দেব। শেষ করব একটা কথা বলে_শচীন টেন্ডুলকার নামে আমরা ক্রিকেটের যে বরপুত্রকে জানি, তাঁর বাবা রমেশ টেন্ডুলকার ছিলেন শচীন দেববর্মণের একনিষ্ঠ ভক্ত। শচীন দেববর্মণকে ভালোবেসেই তিনি ছেলের নাম রেখেছিলেন শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। প্রথম শচীন অমর সংগীতে আর দ্বিতীয় শচীন অমর ক্রিকেটে। শচীন দেববর্মণ_ভারতীয় উপমহাদেশের এই কিংবদন্তি ১৯৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর ৬৯ বছর বয়সে ভারতের মুম্বাইয়ে পরলোকগমন করেন।
জাহাঙ্গীর হোসেন অরুণ

No comments

Powered by Blogger.