জলবায়ু সম্মেলন-ডারবান থেকে বাংলাদেশ কী পেল? by শেখ হাফিজুর রহমান ও ফারহানা হেলাল মেহতাব
দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন শেষ হলো ১১ ডিসেম্বর। জাতিসংঘের আবহাওয়া পরিবর্তন-সংক্রান্ত কাঠামো চুক্তির পক্ষগুলোর ১৭তম সম্মেলন এটি। এখন থেকে এ সম্মেলন ডারবান আবহাওয়া সম্মেলন নামে পরিচিতি পাবে। ডারবান সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হ্রাস করার লক্ষ্যে আইনগতভাবে বাধ্যকারী একটি চুক্তি প্রস্তুত করার কাজ আগামী বছর থেকে শুরু হবে। ২০১৫ সালের মধ্যে
চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হবে, যা কার্যকর হবে ২০২০ সাল থেকে। কোপেনহেগেন ও কানকুন জলবায়ু সম্মেলনের ব্যর্থতার পর ডারবান সম্মেলনের প্রাপ্তিকে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ এক সাফল্য হিসেবে দেখছেন। কেননা ডারবানে সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী তিনটি দেশ যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতকে একটি ‘লিগ্যাল রুফ’ বা আইনি ছাদের নিচে একত্র করা সম্ভব হয়েছে। কার্বন নিঃসরণকারী সব দেশ একটি আইনগতভাবে বাধ্যকারী চুক্তির কাঠামোর মধ্যে আসতে সম্মত হয়েছে বা তাদের এমনতরো একটি চুক্তির ব্যাপারে রাজি করানো গেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই তাঁদের আশাবাদ ও উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু বিজ্ঞানীরা, দরিদ্র ও পরিবেশদূষণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এবং পরিবেশবাদীরা ডারবান সম্মেলনের ফলাফলে খুশি হতে পারেননি। তাঁদের কেউ কেউ বলছেন, ‘ডারবান সম্মেলনের ফলাফল এমন—ধরুন, আপনার ঘরে আগুন লেগেছে। কিন্তু আগুন নেভানোর গাড়িটি আপনার ঘরের আগুন নেভাতে ৯ বছর পর হাজির হবে!’
বিজ্ঞানী, পরিবেশবাদী ও পরিবেশদূষণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ খুবই কম। প্রায় ৩০০ বছর ধরে যে হারে সারা বিশ্বে শিল্পায়ন ও নগরায়ণ হয়েছে এবং তাতে কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে নির্গত হয়েছে, এর তথ্য ও পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে যে কারও বুঝতে কোনো কষ্ট হবে না যে আমাদের প্রিয় পৃথিবী এখন দাউদাউ করে জ্বলছে। অবিলম্বে এ আগুন প্রশমনের উদ্যোগ নেওয়া না গেলে ‘সর্বগ্রাসী এ বহ্নি’ ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, গ্রিনহাউস অ্যাফেক্ট, ওজনস্তরের পাতলা হয়ে যাওয়া ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাবে দেশে দেশে বেড়ে যাবে খরা, বন্যা, সুনামি ও জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের মতদ্বৈধতা ও বিরোধিতার কারণে আগের দুটি সম্মেলনের মতো ডারবান সম্মেলনও ফলপ্রসূ কোনো ফলাফল ছাড়াই ব্যর্থ হতে বসেছিল। কিন্তু ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তাদের ‘রোডম্যাপ’ বা পরিকল্পনার প্রতি সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দুই-তৃতীয়াংশ রাষ্ট্রের সমর্থন জড়ো করতে সমর্থ হয়। তাদের চাপে পরিশেষে ২০১৫ সালের মধ্যে একটি আইনগতভাবে বাধ্যকর চুক্তি চূড়ান্ত করা এবং ২০২০ সাল থেকে তা কার্যকর করার ব্যাপারে সব পক্ষ সম্মত হয়।
এবার আসা যাক বিশ্ব আবহাওয়া সম্মেলনে বাংলাদেশের ভূমিকা ও প্রাপ্তি প্রসঙ্গে। বন্যার ঝুঁকিতে প্রথম, সুনামির ঝুঁকিতে তৃতীয়, ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে ষষ্ঠ এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতায় ১৭ শতাংশ ভূমি তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব আবহাওয়া সম্মেলন যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে স্বল্পোন্নত কোনো দেশের পক্ষে এককভাবে এ ধরনের সম্মেলনকে প্রভাবিত করাটা অসম্ভব। এ কারণে তাদের জোট বাঁধতে হয় অন্য স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে। এর পরও তাদের দাবিদাওয়া অধিকাংশ সময় উপেক্ষিতই থেকে যায়। ডারবান সম্মেলনে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে জোট বেঁধে বাংলাদেশ গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) ও জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা-সংক্রান্ত চুক্তির (অ্যাগ্রিমেন্ট অন ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যানস) ব্যাপারে ইতিবাচক ফল বের করে নিয়ে এসেছে। এ ছাড়া ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) আলাপ-আলোচনায়ও বাংলাদেশের ভূমিকা ছিল সক্রিয় ও ইতিবাচক। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এখন ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ ডারবান সম্মেলনে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। সমঝোতা প্রক্রিয়ার আলাপ-আলোচনায় বাংলাদেশের সক্রিয় ভূমিকা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যেমন উজ্জ্বল করবে, তেমনই কূটনৈতিকভাবেও বাংলাদেশ লাভবান হবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু ডারবান থেকে বাংলাদেশ কী পেল? এ প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এত সহজ নয়। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো এবং হালের চীন ও ভারত মিলে বিশ্বের পরিবেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে ভয়াবহ দূষণ; যার অভিঘাত এসে পড়ছে বাংলাদেশের খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষগুলোর ওপর। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো, চীন, ভারত ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো পরিবেশ দূষণ করছে আর এর মাশুল গুনতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। সম্মেলনের পর সম্মেলন হচ্ছে কিন্তু এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। চুক্তি হবে চার বছর পর, তা কার্যকর হবে আরও পাঁচ বছর পরে। বিশ্বের পরিবেশ সুরক্ষিত রাখার জন্য যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ কমানো দরকার, তা কি কমাবে উন্নত বিশ্ব ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো, তাও অনিশ্চিত! এ অবস্থায় একমাত্র সান্ত্বনার মূলা হচ্ছে সবুজ আবহাওয়া তহবিল বা গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড। ওই তহবিল কবে ছাড় হবে এবং কবে বাংলাদেশ তা পাবে, তা-ও অনিশ্চিত। জাতিসংঘ ওই তহবিলের দেখভাল করবে, নাকি বিশ্বব্যাংকের তদারকিতে যাবে ওই তহবিল, তা-ও অনিশ্চিত। তহবিল যদি ছাড়ও হয়, তাহলে তা আমলা, কনসালট্যান্ট ও এনজিওর পেটে যাবে, নাকি জনগণ তার সুফল পাবে—সে ব্যাপারেও আমরা নিশ্চিত নই। তাহলে প্রাপ্তিযোগের বিচারে বাংলাদেশ ডারবান থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কিছুই পায়নি। ভবিষ্যতে কী পাবে, তা-ও প্রশ্নবিদ্ধ। দেশের মধ্যেও আমরা যে বায়ুদূষণ, পানিদূষণ ও শব্দদূষণের মধ্যে বাস করছি, তা কোনো সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের পরিচয় বহন করে না। পরিশেষে একটাই প্রার্থনা করি, সবাই যেন পরিবেশ সুরক্ষার ব্যাপারে সক্রিয় ও সচেতন হয়ে উঠেন। তা না হলে আমাদের প্রিয় পৃথিবী যেমন ধ্বংস হয়ে যাবে, তার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে গাছ-পালা, নদ-নদী ও মানুষ নামের প্রজাতিটি।
শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ফারহানা হেলাল মেহতাব: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments