বাংলাদেশকে শিক্ষকের ভূমিকায় দেখছেন মুন: জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় বিশ্বসম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনের বিস্তৃতি এবং এর প্রভাব প্রশমনে নিজেদের
সক্রিয় উদ্যোগ সম্পর্কে আরো সচেতন হতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান
জানিয়েছেন। বলেছেন, আমি আপনাদের সকলকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব
মোকাবিলায় সচেতন থাকতে এবং নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের অনুরোধ করছি। তিনি
বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায়
দু’দিনব্যাপী জলবায়ু বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন ‘ গ্লোবাল কমিশন অন
অ্যাডাপটেশন’র (জিসিএ) ঢাকা বৈঠকে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন। সরকার
প্রধান বলেন, বর্তমান বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-উদ্ভাবন ও অর্থায়নের যুগে জলবায়ুর
প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের অনেক সুযোগ রয়েছে যা সকলে সহজে কাজে লাগাতে পারি।
তথাপি আমি বলতে চাই, অভিযোজনের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেজন্য সুষ্ঠু
প্রশমন ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে অভিযোজন প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠা
সম্ভব হবে না। মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের প্রেসিডেন্ট হিলদা সি. হেইন, গ্লোবাল
কমিশন অন এডাপটেশন’র চেয়ারম্যান ও জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি-মুন,
সম্মেলনের কো-চেয়ার এবং বিশ্বব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড.
ক্রিস্টালিনা জর্জিওভা সম্মেলনে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় সামনের
সারিতে থেকে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনন্য
নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের গৃহীত পদক্ষেপ ও কৌশল সম্পর্কে বান-কি-মুন বলেন, অবশ্যই আমরা এখানে বাংলাদেশের কাছে শিখতে এসেছি।
অভিযোজনের বিষয়ে শেখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশই হচ্ছে সবচেয়ে ভাল শিক্ষক। অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাবউদ্দিন বক্তৃতা করেন। প্রধানমন্ত্রী তার দীর্ঘ বক্তৃতায় বলেন, গ্লোবাল কমিশন অব এডাপটেশন’র সহযোগিতায় আমরা জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় সঠিক অভিযোজন কৌশলের পাশাপাশি সাশ্রয়ী পন্থা ও ঝুঁকি নিরসন ব্যবস্থার সুবিধা পেতে চাই। তিনি বলেন, আমরা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছি আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ মহাসচিবের আহ্বানে অনুষ্ঠিতব্য ক্লাইমেট চেঞ্জ সামিটের প্রতিবেদনের সুপারিশগুলোর জন্য। ওই সম্মেলনে এলডিসিভুক্ত দেশসমূহ ও বাংলাদেশর পক্ষ থেকে আমাকে বক্তব্য দেয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বাংলাদেশে একটি ‘রিজিওনাল অ্যাডাপটেশন সেন্টার স্থাপনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অভিযোজন প্রক্রিয়ায় অগ্রগামী দেশ হিসেবে বাংলাদেশে একটি আঞ্চলিক অভিযোজন কেন্দ্র স্থাপনের দাবী রাখে। আমি বাংলাদেশে একটি আঞ্চলিক অভিযোজন কেন্দ্র স্থাপনের বিষয় বিবেচনা করতে আপনাদের অনুরোধ জানাচ্ছি। তিনি এ ব্যাপারে সহযোগিতার আশ্বাস দেয়ায় বান-কি মুনকে ধন্যবাদ জানান। প্রধানমন্ত্রী গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপটেশন ঢাকা সম্মেলনের সার্বিক সাফল্য কামনা করে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব অনুমিত সময়ের আগেই আমাদের প্রত্যেকের ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। সেজন্য, এর প্রভাব মোকাবিলায় বিশ্বকে বিনিয়োগে আরও বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেন, আমি শুধু নিজের দেশ নিয়ে ভাবি না। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে অনেক ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জ হারিয়ে যাবে। তখন সেখানকার মানুষ কোথায় যাবে, সেটিও আমাদের ভাবতে হবে।
শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে বলেন, তাদের আমরা মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু তাদের কারণে আমাদের ওই অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। ওখানে আমাদের যত পাহাড়ি এলাকা বা জঙ্গল ছিল সেগুলো কেটে-ছেঁটে বসতি স্থাপন করা হচ্ছে। এর ফলে এলাকাটি অনেকটা অনিরাপদ এবং ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। সরকার প্রধান বলেন, এজন্য আমরা চাই দ্রুততম সময়ে তারা নিজ দেশে ফেরত যাক। তারা যত তাড়াতাড়ি নিজেদের দেশে ফিরে যাবে, ততই বাংলাদেশের জন্য মঙ্গল। জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বড় হুমকি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী পৃথিবীর উষ্ণতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ইতোমধ্যে প্রাক-শিল্প স্তরের চেয়ে প্রায় এক ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড উপরে পৌঁছেছে। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল মানব ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণ বছর ছিল। তিনি বলেন,‘জার্মান ওয়াচ’র ক্লাইমেট চেঞ্জ ভার্নাবিলিটি ইনডেক্স- ২০১৮ অনুসারে, ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৬ সময়ে বাংলাদেশ বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে ছিল ৬ষ্ঠতম।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এডিবি’র জলবায়ু এবং অর্থনীতি বিষয়ক প্রতিবেদনের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আমাদের বার্ষিক জিডিপি ২ শতাংশ কমে যাবে। যদি বর্তমান হারে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে আমাদের ১৯টি উপকূলীয় জেলা স্থায়ীভাবে ডুবে যাবে। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সমুদ্রতল বৃদ্ধি এবং লবণাক্ততা বাড়ার ফলে বাংলাদেশের বিস্তৃত এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ বলছে, বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ৬০ লাখ জলবায়ু অভিবাসী রয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এটি বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে। যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। তিনি বলেন, তাঁর সরকারের অক্লান্ত পরিশ্রমে গত এক দশকে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক খাতে যে বিশাল উন্নতি হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাবে আজ তা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। জনগণের জন্য অভিযোজন ব্যবস্থা তৈরি করতে তাঁর সরকারের নিরলসভাবে কাজ করা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, গত এক দশকে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসমূহ অভিযোজনের মাধ্যমে নিরসনের জন্য বছরে প্রায় একশো কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করছি। এ সময় তিনি জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড গঠন এবং বাংলাদেশের নিজস্ব তহবিল থেকে জলবায়ু অভিযোজন কর্মসূচির জন্য ৪২ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি এই ফান্ডে বরাদ্দের কথাও উল্লেখ করেন। সরকার প্রধান তার বক্তৃতায় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জীব বৈচিত্র রক্ষায় সরকারর বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে এক্ষেত্রে ব্যাপক গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
জলবায়ু অভিযোজনে ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষক’ বাংলাদেশ: এদিকে জলবায়ু অভিযোজনে বাংলাদেশকে ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি-মুন। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশকে ‘অলৌকিক’ হিসেবেও বর্ণনা করেন তিনি। ‘গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপটেশন’ বিষয়ে ঢাকা সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তৃতায় কোরীয়ান ওই কূটনীতিক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্যানেল (আইপিসিসি) বলছে, সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা আর যদি এক মিটারও বাড়ে তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যাবে। সামপ্রতিক ঘূর্ণিঝড় ফণীতে ১২ জনের প্রাণহানির সঙ্গে পাঁচ লাখ মানুষের প্রাণ নেয়া ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের তুলনা করেন বান কি-মুন। তিনি বলেন, যথার্থ আবহাওয়ার পূর্বাভাস, কমিউনিটিভিত্তিক পূর্ব সতর্কীকরণ ব্যবস্থা ও সাইক্লোন সেন্টার থাকার ফলে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগেই ১৬ লাখ মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, অভিযোজন অনুশীলনে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার যে নেতৃত্ব অর্জন করেছে তা অলৌকিকের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
ঢাকায় অভিযোজন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব মুনের: এদিকে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ও গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপ্টেশন-এর চেয়ারম্যান বান কি-মুন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক একটি বৈশ্বিক অভিযোজন কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিনি এই প্রস্তাব দেন। রাজধানীর একটি হোটেলে দু’ব্যাপী ঢাকা বৈঠকের যোগদানের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে মার্শাল আইল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট ড. হিলদা সি. হেইনে বান কি-মুনের সঙ্গে ছিলেন বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সেক্রেটারি ইহ্সানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব জলবায়ূ পরিবর্তনের অভিযোজনের জন্য বাংলাদেশকে একটি মডেল হিসেবে বর্ননা করে বলেন, জলবায়ূ পরিবর্তনের অভিযোজনে বাংলাদেশ সেরা শিক্ষক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করে তিনি বলেন, আপনি (শেখ হাসিনা) বিশ্ব নেতাদের মধ্যে অন্যতম যিনি জলবায়ূ পরিবর্তনের সমস্যাটি নিয়ে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বান কি-মুন প্রধানমন্ত্রী উদ্দেশে বলেন, আমি আপনার অব্যাহত প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থাবান। ওদিকে ওই বৈঠক শেষে বান কি মুন কক্সবাজারস্থ রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং জলবায়ু উদবাস্তুদের আশ্রয়ণ প্রকল্প পরিদর্শন করেন।
জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের গৃহীত পদক্ষেপ ও কৌশল সম্পর্কে বান-কি-মুন বলেন, অবশ্যই আমরা এখানে বাংলাদেশের কাছে শিখতে এসেছি।
অভিযোজনের বিষয়ে শেখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশই হচ্ছে সবচেয়ে ভাল শিক্ষক। অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাবউদ্দিন বক্তৃতা করেন। প্রধানমন্ত্রী তার দীর্ঘ বক্তৃতায় বলেন, গ্লোবাল কমিশন অব এডাপটেশন’র সহযোগিতায় আমরা জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় সঠিক অভিযোজন কৌশলের পাশাপাশি সাশ্রয়ী পন্থা ও ঝুঁকি নিরসন ব্যবস্থার সুবিধা পেতে চাই। তিনি বলেন, আমরা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছি আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ মহাসচিবের আহ্বানে অনুষ্ঠিতব্য ক্লাইমেট চেঞ্জ সামিটের প্রতিবেদনের সুপারিশগুলোর জন্য। ওই সম্মেলনে এলডিসিভুক্ত দেশসমূহ ও বাংলাদেশর পক্ষ থেকে আমাকে বক্তব্য দেয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বাংলাদেশে একটি ‘রিজিওনাল অ্যাডাপটেশন সেন্টার স্থাপনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অভিযোজন প্রক্রিয়ায় অগ্রগামী দেশ হিসেবে বাংলাদেশে একটি আঞ্চলিক অভিযোজন কেন্দ্র স্থাপনের দাবী রাখে। আমি বাংলাদেশে একটি আঞ্চলিক অভিযোজন কেন্দ্র স্থাপনের বিষয় বিবেচনা করতে আপনাদের অনুরোধ জানাচ্ছি। তিনি এ ব্যাপারে সহযোগিতার আশ্বাস দেয়ায় বান-কি মুনকে ধন্যবাদ জানান। প্রধানমন্ত্রী গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপটেশন ঢাকা সম্মেলনের সার্বিক সাফল্য কামনা করে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব অনুমিত সময়ের আগেই আমাদের প্রত্যেকের ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। সেজন্য, এর প্রভাব মোকাবিলায় বিশ্বকে বিনিয়োগে আরও বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেন, আমি শুধু নিজের দেশ নিয়ে ভাবি না। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে অনেক ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জ হারিয়ে যাবে। তখন সেখানকার মানুষ কোথায় যাবে, সেটিও আমাদের ভাবতে হবে।
শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে বলেন, তাদের আমরা মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু তাদের কারণে আমাদের ওই অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। ওখানে আমাদের যত পাহাড়ি এলাকা বা জঙ্গল ছিল সেগুলো কেটে-ছেঁটে বসতি স্থাপন করা হচ্ছে। এর ফলে এলাকাটি অনেকটা অনিরাপদ এবং ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। সরকার প্রধান বলেন, এজন্য আমরা চাই দ্রুততম সময়ে তারা নিজ দেশে ফেরত যাক। তারা যত তাড়াতাড়ি নিজেদের দেশে ফিরে যাবে, ততই বাংলাদেশের জন্য মঙ্গল। জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বড় হুমকি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী পৃথিবীর উষ্ণতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ইতোমধ্যে প্রাক-শিল্প স্তরের চেয়ে প্রায় এক ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড উপরে পৌঁছেছে। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল মানব ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণ বছর ছিল। তিনি বলেন,‘জার্মান ওয়াচ’র ক্লাইমেট চেঞ্জ ভার্নাবিলিটি ইনডেক্স- ২০১৮ অনুসারে, ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৬ সময়ে বাংলাদেশ বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে ছিল ৬ষ্ঠতম।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এডিবি’র জলবায়ু এবং অর্থনীতি বিষয়ক প্রতিবেদনের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আমাদের বার্ষিক জিডিপি ২ শতাংশ কমে যাবে। যদি বর্তমান হারে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে আমাদের ১৯টি উপকূলীয় জেলা স্থায়ীভাবে ডুবে যাবে। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সমুদ্রতল বৃদ্ধি এবং লবণাক্ততা বাড়ার ফলে বাংলাদেশের বিস্তৃত এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ বলছে, বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ৬০ লাখ জলবায়ু অভিবাসী রয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এটি বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে। যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। তিনি বলেন, তাঁর সরকারের অক্লান্ত পরিশ্রমে গত এক দশকে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক খাতে যে বিশাল উন্নতি হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাবে আজ তা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। জনগণের জন্য অভিযোজন ব্যবস্থা তৈরি করতে তাঁর সরকারের নিরলসভাবে কাজ করা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, গত এক দশকে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসমূহ অভিযোজনের মাধ্যমে নিরসনের জন্য বছরে প্রায় একশো কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করছি। এ সময় তিনি জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড গঠন এবং বাংলাদেশের নিজস্ব তহবিল থেকে জলবায়ু অভিযোজন কর্মসূচির জন্য ৪২ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি এই ফান্ডে বরাদ্দের কথাও উল্লেখ করেন। সরকার প্রধান তার বক্তৃতায় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জীব বৈচিত্র রক্ষায় সরকারর বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে এক্ষেত্রে ব্যাপক গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
জলবায়ু অভিযোজনে ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষক’ বাংলাদেশ: এদিকে জলবায়ু অভিযোজনে বাংলাদেশকে ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি-মুন। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশকে ‘অলৌকিক’ হিসেবেও বর্ণনা করেন তিনি। ‘গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপটেশন’ বিষয়ে ঢাকা সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তৃতায় কোরীয়ান ওই কূটনীতিক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্যানেল (আইপিসিসি) বলছে, সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা আর যদি এক মিটারও বাড়ে তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যাবে। সামপ্রতিক ঘূর্ণিঝড় ফণীতে ১২ জনের প্রাণহানির সঙ্গে পাঁচ লাখ মানুষের প্রাণ নেয়া ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের তুলনা করেন বান কি-মুন। তিনি বলেন, যথার্থ আবহাওয়ার পূর্বাভাস, কমিউনিটিভিত্তিক পূর্ব সতর্কীকরণ ব্যবস্থা ও সাইক্লোন সেন্টার থাকার ফলে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগেই ১৬ লাখ মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, অভিযোজন অনুশীলনে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার যে নেতৃত্ব অর্জন করেছে তা অলৌকিকের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
ঢাকায় অভিযোজন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব মুনের: এদিকে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ও গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপ্টেশন-এর চেয়ারম্যান বান কি-মুন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক একটি বৈশ্বিক অভিযোজন কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিনি এই প্রস্তাব দেন। রাজধানীর একটি হোটেলে দু’ব্যাপী ঢাকা বৈঠকের যোগদানের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে মার্শাল আইল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট ড. হিলদা সি. হেইনে বান কি-মুনের সঙ্গে ছিলেন বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সেক্রেটারি ইহ্সানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব জলবায়ূ পরিবর্তনের অভিযোজনের জন্য বাংলাদেশকে একটি মডেল হিসেবে বর্ননা করে বলেন, জলবায়ূ পরিবর্তনের অভিযোজনে বাংলাদেশ সেরা শিক্ষক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করে তিনি বলেন, আপনি (শেখ হাসিনা) বিশ্ব নেতাদের মধ্যে অন্যতম যিনি জলবায়ূ পরিবর্তনের সমস্যাটি নিয়ে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বান কি-মুন প্রধানমন্ত্রী উদ্দেশে বলেন, আমি আপনার অব্যাহত প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থাবান। ওদিকে ওই বৈঠক শেষে বান কি মুন কক্সবাজারস্থ রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং জলবায়ু উদবাস্তুদের আশ্রয়ণ প্রকল্প পরিদর্শন করেন।
No comments