সুচির ক্ষমতা যাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না by মোহাম্মদ আবুল হোসেন
হাজার
হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে পাশ্ববর্তী বায়লাদেশে আশ্রয় নেয়ায় বিশ্ব
সমালোচনা, পর্যবেক্ষণ, তিরস্কার ও নিন্দার মুখে রয়েছেন অং সান সুচি।
রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতাকে জাতি নিধনের এক ন্যক্কারজনক উদাহরণ হিসেবে
আখ্যায়িত করেছেন জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান জায়েদ রাদ আল হোসেইন।
কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী যেভাবে নৃশংসতা
চালিয়ে যাচ্ছে তাতে দেশের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সেনাবাহিনীর হাতে। দেশের নেত্রী,
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সুচির হাতে নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই
চলে। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, ২৫ আগস্টে রোহিঙ্গা
উগ্রপন্থিরা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ৩০টি পোস্টে হামলা চালায়। এতে ১২
নিরাপত্তারক্ষী নিহত হন। তারপর থেকে সেনাবাহিনী ও তাদের সঙ্গ নেয়া বৌদ্ধরা
রাখাইন রাজ্যজুড়ে অভিযান চালাচ্ছে। তারা টার্গেট করছে রোহিঙ্গা মুসলিমদের।
এটাকে নাম দেয়া হয়েছে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশনস’। দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয়
নেয়া অথবা পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলেছেন, তাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে
দেয়া হয়েছে। আত্মীয়-স্বজনদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। বহু নিকটজনকে ধরে
নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যাদেরকে আর কখনও ফেরত দেয়া হয়নি। এমনকি তাদের সঙ্গে
সাক্ষাৎও হয়নি। অনলাইন সিএনএন-এ এ কথা লিখেছেন সাংবাদিক জেমস তারাবে। তিনি
আরো লিখেছেন, ১৯৬২ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মিয়ানমার শাসন করে সামরিক
জান্তা। এ সময় তারা গণতন্ত্রের পক্ষে আন্দোলন করায় গ্রেপ্তার করে ন্যাশনাল
লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নেত্রী অং সান সুচিকে। জারি করে সামরিক আইন।
প্রতিবাদীদের হত্যা করতে থাকে। সেই সামরিক বাহিনী এখনও দেশের নিরাপত্তা
রক্ষাকারী বাহিনী, পুলিশ ও সরকারের মন্ত্রিসভার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
বিভাগগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এর ফলে করার মতো কিছুই আসলে নেই
সুচির হাতে। সিডনিতে লোউয়ি ইন্সটিটিউটের ইস্ট এশিয়া প্রোগ্রাম বিষয়ক
রিসার্চ ফেলো আরোন কোনলি বলেন, মিয়ানমারের সংবিধানের অধীনে কমান্ডার ইন
চার্জ (মিয়ানমার সেনাবাহিনীর) নিজেই নিজের বস। তিনি অং সান সুচির কাছে
রিপোর্ট করেন না। দেশের নিয়ন্ত্রণ এবং আন্তর্জাতিক সম্মানের মধ্যে পছন্দ
বেছে নিতে বলা হয় যদি সেনাবাহিনীকে তাহলে তারা নিয়ন্ত্রণকেই বেছে নেবে। তবে
এখানে প্রশ্ন হলো, তারা স্বেচ্ছায় (বেসামরিক প্রশাসনের হাতে) কতটুকু
ক্ষমতা ছেড়ে দেবে। আরোন কোনলি বলেন, ২০০৮ সালে মিয়ানমারে যে সংবিধান প্রণীত
হয়েছে তার বাইরে একদানাও তারা স্বেচ্ছায় ছাড় দেবে এমন কোনো প্রমাণ আমি
দেখতে পাইনি।
কি আছে ২০০৮ সালের সংবিধানে
২০০৮ সালে মিয়ানমারে নতুন সংবিধান প্রণীত হয়। তাতে জাতীয় পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর জন্য এক-চতুর্থাংশ আসন বরাদ্দ রাখা হয়। এটা ছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর একটি কৌশল। এর মধ্যমে তারা অচল অবস্থায় পড়ে যাওয়া রাষ্ট্রকে সাংবিধানিক সংস্কার, বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা এবং সুচিকে সাধারণ্যে নিয়ে এসে মিয়ানমারকে অচলায়তন থেকে বের করে আনে। কিন্তু সংবিধানের অধীনে সেনাবাহিনীকে পেশীশক্তি প্রদর্শনের সক্ষমতা দেয়া হয়। সেটা করা হয়েছে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে তাদের স্বাধীনতা দিয়ে। এই সংবিধানেই রাখা হয়েছে সংঘাতময় কিছু ধারা। তাতে বলা হয়েছে, কোনো দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে এমন ব্যক্তি (হতে পারে সেটা পিতামাতা বা সন্তান) মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। অং সান সুচির প্রয়াত স্বামী ছিলেন একজন বৃটিশ। তাই তাদের দু’সন্তানও বৃটিশ নাগরিক। এ কারণে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি সুচি। কিন্তু তিনি যাতে মূল দায়িত্ব পালন করতে পারেন, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন সে জন্য একটি বিশেষ পদ সৃষ্টি করা হয়। তা হলো স্টেট কাউন্সেলর। ২০১৫ সালে মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচন হয়। তখন তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, তার দল যদি বিজয়ী হয় তাহলে তিনি এমন একটি সরকার গঠন করবেন, যেখানে তিনি থাকবেন প্রেসিডেন্টের ওপরে। এটা একটি অতি সাধারণ বিষয়। কিন্তু সংবিধানের অধীনে কমান্ডার ইন চিফ, যিনি সেনা কর্তৃপক্ষেরও প্রধান, তিনি প্রেসিডেন্টেরও ওপরে। তার মধ্যে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে সেনাবাহিনীর জন্য নির্ধারিত আসনে কাকে কাকে মনোনয়ন দেয়া হবে সেটা নির্ধারণ করেন তিনি। এ ছাড়া সংবিধানের অধীনে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণার কর্তৃত্বও কমান্ডার ইন চিফের হাতে। এটাকে বলা হয় রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তি। এ ছাড়া সংবিধানে বাতিল করা হয়েছে অতীতের দণ্ডবিধি আইন। এর অধীনে সেনাবাহিনী অতীতে অং সান সুচিকে গৃহবন্দি রেখে, ১৯৯০ সালের নির্বাচনকে বাতিল করে দিয়ে যেসব অপরাধ করেছে সেই অপরাধের বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ১৯৯০ সালের নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে সেনাবাহিনী কার্যত তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে।
১৯শে সেপ্টেম্বর মিয়ানমারে কূটনীতিকদের সামনে রেখে জাতির উদ্দেশে ভাষণ রেখেছেন অং সান সুচি। এ সময় তিনি বলেছেন, এখনও তার সরকার তরুণ। মাত্র ১৮ মাস ক্ষমতার বাইরে ছিলো। এখনও দেশে গণতন্ত্র ফেরানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। তিনি বলেছেন, অর্ধ শতাব্দী বা তারও বেশি সময় স্বৈরাচারের শাসনের পর আমরা এখন আমাদের জাতি গঠনের পথে রয়েছি। আমাদের সরকার তরুণ, নাজুক (ফ্রাজিল)। অনেক সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তবু আমরা সেগুলোর সঙ্গে লড়াই করছি। আমরা মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের বিষয়ে আবদ্ধ থাকতে পারি না।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী যে নির্মমতা চালাচ্ছে তাতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গণতন্ত্রের পক্ষের মানুষরা ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। কিন্তু সুচির শাসনের অংশীদার কমান্ডার ইন চিফ সিনেটর জেনারেল মিন অং হ্লাইং যথারীতি তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। অং সান সুচি যখন জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সফর বাতিলের ঘোষণা দিলেন, তখন মিন অং হ্লাইং দেশে পররাষ্ট্র বিষয়ক কূটনীতিকদের আপ্যায়ন করছিলেন, সেনা কর্মকর্তাদের সামনে বক্তব্য রাখছিলেন এবং ডোনেশন গ্রহণ করছিলেন রাখাইনে বিদ্রোহীদের কারণে সৃষ্ট বিশৃংখলায় বাস্তুচ্যুত মানুষকে সহায়তার জন্য। তার আনুষ্ঠানিক সব কর্মকাণ্ডের কথা নিত্যদিনই ফেসবুক পেজে পোস্ট করা হচ্ছে। এটি ফেসবুক কর্তৃপক্ষের ভেরিফাই করা পেজ। সেখানে তার অনুসারীর সংখ্যা ১২ লাখ ৮০ হাজার। ১৫ই সেপ্টেম্বরে সেখানে তিনি ইংরেজিতে একটি পোস্ট দিয়েছেন। তাতে বলেছেন, ২৫শে আগস্ট থেকে ‘এক্সট্রিমিস্ট বাঙালি’দের সঙ্গে ৯৩ টি সংঘর্ষ হয়েছে। তিনি এক্সট্রিমিস্ট বাঙালি বলতে বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসীদের বুঝিয়ে থাকেন, যারা উগ্রপন্থায় লিপ্ত। ওই পোস্টে তিনি আরো দাবি করেছেন, এসব উগ্রপন্থি রাখাইন রাজ্যে তাদের শক্ত ঘাঁটি গাড়তে চায়। তারা রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি চায়। মিয়ানমারে কোনোদিনও রোহিঙ্গা নামের কোনো জাতিগোষ্ঠী নেই। বাঙালি ইস্যুটি জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে সত্য তুলে ধরতে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এর আগে ১লা সেপ্টেম্বরে আরেকটি পোস্ট দেন তিনি। তাতে তিনি ১৯৪২ সালে রাখাইন রাজ্যে রাখাইনদের প্রাণহানীর দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, বাঙালিরা হামলা চালিয়েছিল। মানুষ হত্যা করেছিল। তাদের বাড়িঘর ছেড়েছিল। আমরা সেই ভয়াবহতা আবার ঘটতে দিতে পারি না কখনো। অং সান সুচি ও সেনাবাহিনী উভয় পক্ষই দাবি করছে রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা করেছে রোহিঙ্গা উগ্রপন্থিরা। সুচি প্রকাশ্যে রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেননি। তিনি বলেছেন, সহিংসতা ও বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনায় অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। মিয়ানমারের জনগণের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কুসংস্কার বা ঘৃণা কাজ করে। ১৮২৪ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত বৃটিশ শাসনের সময়ে কিছু রোহিঙ্গাকে শ্রমিক হিসেবে নেয়া হয়েছিল রাখাইনে। ওই সময় আরাকান ছিল বৃটিশ শাসিত ভারতের অংশ। তাই রোহিঙ্গা শ্রমিকদের স্থানান্তরকে বৃটিশরা দেখতো আভ্যন্তরীণভাবে একস্থান থেকে আরেক স্থানে চলে যাওয়া হিসে। বহু রোহিঙ্গা বলেছেন, ঊনবিংশ শতাব্দীতে বহু মুসলিম ব্যবসায়ী রোহিঙ্গা ছিলেন রাখাইনে এবং তারা তাদের পূর্বসুরি। এমন অনেক প্রমাণ পাওয়া যাবে। বাস্তবে সেখানে জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে মিশ্রণ ঘটেছে। ১৯৮২ সালে মিয়ানমার সরকার নাগরিকত্ব আইন পাস করে। তাতে বলা হয়, রোহিঙ্গারা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবে যদি তারা সরকারিভাবে স্বীকৃত ভাষায় কথা বলতে পারে, প্রমাণ দেখাতে পারে তাদের পূর্ব-পুরুষরা মিয়ানমারের স্বাধীনতা অর্জনের আগে থেকে সেখানে বসবাস করছে। কিন্তু বেশির ভাগ রোহিঙ্গা তাদের অতীতের রেকর্ডপত্র দেখাতে পারেননি এবং তার ফলে তারা কার্যত হয়ে পড়েন রাষ্ট্রহীন। মিয়ানমারে স্বীকৃত ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠী আছে। এ তালিকায় রোহিঙ্গা নেই। সরকারি বিবৃতিতে তাই মিন অং হ্লাইয় রোহিঙ্গা শব্দ উচ্চারণ করেননি। এর পরিবর্তে তিনি উচ্চারণ করেছেন ‘বাঙালি’।
অস্ত্র বিক্রি ও নিষেধাজ্ঞা
পশ্চিমা দুনিয়ার সমালোচনা, নিন্দাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এর কারণ কি? কারণ, তাদের বিরুদ্ধে অবরোধ দিলে কিছুই হবে না এমনটা মনে করে তারা। দশকের পর দশক যুক্তরাষ্ট্রের মতো আরো অনেক দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক সীমিত আকারে রেখেছিল। মিয়ানমারে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করার পরিবর্তে সেখানে প্রতিরক্ষা বিষয়ক এটাচেকে দায়িত্ব দেয়া হয় এবং তাদেরকে যোগাযোগ রক্ষা করতে বলা হয় মিয়ানমারের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসনের অধীনে দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্কে জোর দেয়া হয় আইনের অধীনে থেকে সেনা প্রশিক্ষণ, মানবাধিকার ও বিপর্যয়ে থ্রাণ, বহুপক্ষের মহড়ায় অংশগ্রহণ বিষয়ে। আরোন কোনলি বলেছেন, কোথায় ওই সম্পর্ক বিদ্যমান। এখনও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তা সত্ত্বেও চীন, ভারত, রাশিয়া এমনকি ইসরাইলের মতো মিত্ররা তাদেরকে অস্ত্র দিয়ে যাচ্ছে। প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সেনাবাহিনীকে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অস্ত্র ও সামরিক ব্যয় বিষয়ক সিনিয়র গবেষক সিমোন ওয়েজেম্যান বলেছেন, এশিয়ায় সবচেয়ে কম স্বচ্ছতার দেশগুলোর মধ্যে মিয়ানমার অন্যতম। আপনি যদি দেখেন তাহলে মিয়ানমারে অস্ত্র সরবরাহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হলো চীন। আমরা যেসব অস্ত্র মিয়ানমারের হাতে দেখতে পাচ্ছি তার বেশির ভাগই চীনের। হোক সেটা স্থল, আকাশ বা সমুদ্রে ব্যবহারের অস্ত্র। তিনি বলেন, মিয়ানমারকে রাশিয়া সরবরাহ দিয়ে যাচ্ছে হেলিকপ্টার ও হালকা যুদ্ধবিমান। ভারত সরবরাহ দিয়ে যাচ্ছে নৌবাহিনীর জন্য অস্ত্র। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও অনেক ইউরোপিয়ান দেশ অস্ত্র দিয়ে যাচ্ছে।
যুদ্ধকে কোন চোখে দেখে মিয়ানমার
মিয়ানমারের জাতীয় বাজেটের শতকরা ১৪ ভাগই বরাদ্দ রাখা হয় প্রতিরক্ষাখাতে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়ার পরেও মিয়ানমার অস্ত্র কিনতে ও হার্ডওয়্যার কিনতে সক্ষম হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে সামরিক জান্তা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ব্যবসায় তাদের যে সম্পদ রয়েছে তার অন্যতম মিয়ানমার ইকোনমিক করপোরেশন। এখান থেকে কলকারখানায় উৎপাদন, টেলিযোগাযোগ, পরিবহন এমন কি অন্যান্য খাতও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সিগারেট ও জ্বালানি আমদানিতে ক্ষমতাসীন জেনারেলদের লোভ দেখানো হয় মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিংস লিমিটেড। দেশের অর্থনীতিতে বিভিন্ন অংশে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে, এমনকি শেয়ারহোল্ডারও হয়ে ওঠে। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে এ কথা বলেছেন ইয়েশুয়া মোসের পুয়াংসুওয়ান। তিনি বলেন, মিয়ানমারে রাজনৈতিক পরিবর্তন সত্ত্বেও নিরেট নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে সেনাবাহিনী। বিশ্বনেতারা এখন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবরোধ বাস্তবায়নের জোর আহ্বান জানাচ্ছেন, যাতে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর তাদের নৃশংসতা বন্ধ করে।
কি আছে ২০০৮ সালের সংবিধানে
২০০৮ সালে মিয়ানমারে নতুন সংবিধান প্রণীত হয়। তাতে জাতীয় পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর জন্য এক-চতুর্থাংশ আসন বরাদ্দ রাখা হয়। এটা ছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর একটি কৌশল। এর মধ্যমে তারা অচল অবস্থায় পড়ে যাওয়া রাষ্ট্রকে সাংবিধানিক সংস্কার, বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা এবং সুচিকে সাধারণ্যে নিয়ে এসে মিয়ানমারকে অচলায়তন থেকে বের করে আনে। কিন্তু সংবিধানের অধীনে সেনাবাহিনীকে পেশীশক্তি প্রদর্শনের সক্ষমতা দেয়া হয়। সেটা করা হয়েছে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে তাদের স্বাধীনতা দিয়ে। এই সংবিধানেই রাখা হয়েছে সংঘাতময় কিছু ধারা। তাতে বলা হয়েছে, কোনো দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে এমন ব্যক্তি (হতে পারে সেটা পিতামাতা বা সন্তান) মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। অং সান সুচির প্রয়াত স্বামী ছিলেন একজন বৃটিশ। তাই তাদের দু’সন্তানও বৃটিশ নাগরিক। এ কারণে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি সুচি। কিন্তু তিনি যাতে মূল দায়িত্ব পালন করতে পারেন, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন সে জন্য একটি বিশেষ পদ সৃষ্টি করা হয়। তা হলো স্টেট কাউন্সেলর। ২০১৫ সালে মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচন হয়। তখন তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, তার দল যদি বিজয়ী হয় তাহলে তিনি এমন একটি সরকার গঠন করবেন, যেখানে তিনি থাকবেন প্রেসিডেন্টের ওপরে। এটা একটি অতি সাধারণ বিষয়। কিন্তু সংবিধানের অধীনে কমান্ডার ইন চিফ, যিনি সেনা কর্তৃপক্ষেরও প্রধান, তিনি প্রেসিডেন্টেরও ওপরে। তার মধ্যে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে সেনাবাহিনীর জন্য নির্ধারিত আসনে কাকে কাকে মনোনয়ন দেয়া হবে সেটা নির্ধারণ করেন তিনি। এ ছাড়া সংবিধানের অধীনে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণার কর্তৃত্বও কমান্ডার ইন চিফের হাতে। এটাকে বলা হয় রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তি। এ ছাড়া সংবিধানে বাতিল করা হয়েছে অতীতের দণ্ডবিধি আইন। এর অধীনে সেনাবাহিনী অতীতে অং সান সুচিকে গৃহবন্দি রেখে, ১৯৯০ সালের নির্বাচনকে বাতিল করে দিয়ে যেসব অপরাধ করেছে সেই অপরাধের বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ১৯৯০ সালের নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে সেনাবাহিনী কার্যত তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে।
১৯শে সেপ্টেম্বর মিয়ানমারে কূটনীতিকদের সামনে রেখে জাতির উদ্দেশে ভাষণ রেখেছেন অং সান সুচি। এ সময় তিনি বলেছেন, এখনও তার সরকার তরুণ। মাত্র ১৮ মাস ক্ষমতার বাইরে ছিলো। এখনও দেশে গণতন্ত্র ফেরানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। তিনি বলেছেন, অর্ধ শতাব্দী বা তারও বেশি সময় স্বৈরাচারের শাসনের পর আমরা এখন আমাদের জাতি গঠনের পথে রয়েছি। আমাদের সরকার তরুণ, নাজুক (ফ্রাজিল)। অনেক সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তবু আমরা সেগুলোর সঙ্গে লড়াই করছি। আমরা মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের বিষয়ে আবদ্ধ থাকতে পারি না।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী যে নির্মমতা চালাচ্ছে তাতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গণতন্ত্রের পক্ষের মানুষরা ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। কিন্তু সুচির শাসনের অংশীদার কমান্ডার ইন চিফ সিনেটর জেনারেল মিন অং হ্লাইং যথারীতি তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। অং সান সুচি যখন জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সফর বাতিলের ঘোষণা দিলেন, তখন মিন অং হ্লাইং দেশে পররাষ্ট্র বিষয়ক কূটনীতিকদের আপ্যায়ন করছিলেন, সেনা কর্মকর্তাদের সামনে বক্তব্য রাখছিলেন এবং ডোনেশন গ্রহণ করছিলেন রাখাইনে বিদ্রোহীদের কারণে সৃষ্ট বিশৃংখলায় বাস্তুচ্যুত মানুষকে সহায়তার জন্য। তার আনুষ্ঠানিক সব কর্মকাণ্ডের কথা নিত্যদিনই ফেসবুক পেজে পোস্ট করা হচ্ছে। এটি ফেসবুক কর্তৃপক্ষের ভেরিফাই করা পেজ। সেখানে তার অনুসারীর সংখ্যা ১২ লাখ ৮০ হাজার। ১৫ই সেপ্টেম্বরে সেখানে তিনি ইংরেজিতে একটি পোস্ট দিয়েছেন। তাতে বলেছেন, ২৫শে আগস্ট থেকে ‘এক্সট্রিমিস্ট বাঙালি’দের সঙ্গে ৯৩ টি সংঘর্ষ হয়েছে। তিনি এক্সট্রিমিস্ট বাঙালি বলতে বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসীদের বুঝিয়ে থাকেন, যারা উগ্রপন্থায় লিপ্ত। ওই পোস্টে তিনি আরো দাবি করেছেন, এসব উগ্রপন্থি রাখাইন রাজ্যে তাদের শক্ত ঘাঁটি গাড়তে চায়। তারা রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি চায়। মিয়ানমারে কোনোদিনও রোহিঙ্গা নামের কোনো জাতিগোষ্ঠী নেই। বাঙালি ইস্যুটি জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে সত্য তুলে ধরতে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এর আগে ১লা সেপ্টেম্বরে আরেকটি পোস্ট দেন তিনি। তাতে তিনি ১৯৪২ সালে রাখাইন রাজ্যে রাখাইনদের প্রাণহানীর দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, বাঙালিরা হামলা চালিয়েছিল। মানুষ হত্যা করেছিল। তাদের বাড়িঘর ছেড়েছিল। আমরা সেই ভয়াবহতা আবার ঘটতে দিতে পারি না কখনো। অং সান সুচি ও সেনাবাহিনী উভয় পক্ষই দাবি করছে রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা করেছে রোহিঙ্গা উগ্রপন্থিরা। সুচি প্রকাশ্যে রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেননি। তিনি বলেছেন, সহিংসতা ও বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনায় অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। মিয়ানমারের জনগণের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কুসংস্কার বা ঘৃণা কাজ করে। ১৮২৪ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত বৃটিশ শাসনের সময়ে কিছু রোহিঙ্গাকে শ্রমিক হিসেবে নেয়া হয়েছিল রাখাইনে। ওই সময় আরাকান ছিল বৃটিশ শাসিত ভারতের অংশ। তাই রোহিঙ্গা শ্রমিকদের স্থানান্তরকে বৃটিশরা দেখতো আভ্যন্তরীণভাবে একস্থান থেকে আরেক স্থানে চলে যাওয়া হিসে। বহু রোহিঙ্গা বলেছেন, ঊনবিংশ শতাব্দীতে বহু মুসলিম ব্যবসায়ী রোহিঙ্গা ছিলেন রাখাইনে এবং তারা তাদের পূর্বসুরি। এমন অনেক প্রমাণ পাওয়া যাবে। বাস্তবে সেখানে জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে মিশ্রণ ঘটেছে। ১৯৮২ সালে মিয়ানমার সরকার নাগরিকত্ব আইন পাস করে। তাতে বলা হয়, রোহিঙ্গারা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবে যদি তারা সরকারিভাবে স্বীকৃত ভাষায় কথা বলতে পারে, প্রমাণ দেখাতে পারে তাদের পূর্ব-পুরুষরা মিয়ানমারের স্বাধীনতা অর্জনের আগে থেকে সেখানে বসবাস করছে। কিন্তু বেশির ভাগ রোহিঙ্গা তাদের অতীতের রেকর্ডপত্র দেখাতে পারেননি এবং তার ফলে তারা কার্যত হয়ে পড়েন রাষ্ট্রহীন। মিয়ানমারে স্বীকৃত ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠী আছে। এ তালিকায় রোহিঙ্গা নেই। সরকারি বিবৃতিতে তাই মিন অং হ্লাইয় রোহিঙ্গা শব্দ উচ্চারণ করেননি। এর পরিবর্তে তিনি উচ্চারণ করেছেন ‘বাঙালি’।
অস্ত্র বিক্রি ও নিষেধাজ্ঞা
পশ্চিমা দুনিয়ার সমালোচনা, নিন্দাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এর কারণ কি? কারণ, তাদের বিরুদ্ধে অবরোধ দিলে কিছুই হবে না এমনটা মনে করে তারা। দশকের পর দশক যুক্তরাষ্ট্রের মতো আরো অনেক দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক সীমিত আকারে রেখেছিল। মিয়ানমারে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করার পরিবর্তে সেখানে প্রতিরক্ষা বিষয়ক এটাচেকে দায়িত্ব দেয়া হয় এবং তাদেরকে যোগাযোগ রক্ষা করতে বলা হয় মিয়ানমারের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসনের অধীনে দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্কে জোর দেয়া হয় আইনের অধীনে থেকে সেনা প্রশিক্ষণ, মানবাধিকার ও বিপর্যয়ে থ্রাণ, বহুপক্ষের মহড়ায় অংশগ্রহণ বিষয়ে। আরোন কোনলি বলেছেন, কোথায় ওই সম্পর্ক বিদ্যমান। এখনও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তা সত্ত্বেও চীন, ভারত, রাশিয়া এমনকি ইসরাইলের মতো মিত্ররা তাদেরকে অস্ত্র দিয়ে যাচ্ছে। প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সেনাবাহিনীকে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অস্ত্র ও সামরিক ব্যয় বিষয়ক সিনিয়র গবেষক সিমোন ওয়েজেম্যান বলেছেন, এশিয়ায় সবচেয়ে কম স্বচ্ছতার দেশগুলোর মধ্যে মিয়ানমার অন্যতম। আপনি যদি দেখেন তাহলে মিয়ানমারে অস্ত্র সরবরাহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হলো চীন। আমরা যেসব অস্ত্র মিয়ানমারের হাতে দেখতে পাচ্ছি তার বেশির ভাগই চীনের। হোক সেটা স্থল, আকাশ বা সমুদ্রে ব্যবহারের অস্ত্র। তিনি বলেন, মিয়ানমারকে রাশিয়া সরবরাহ দিয়ে যাচ্ছে হেলিকপ্টার ও হালকা যুদ্ধবিমান। ভারত সরবরাহ দিয়ে যাচ্ছে নৌবাহিনীর জন্য অস্ত্র। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও অনেক ইউরোপিয়ান দেশ অস্ত্র দিয়ে যাচ্ছে।
যুদ্ধকে কোন চোখে দেখে মিয়ানমার
মিয়ানমারের জাতীয় বাজেটের শতকরা ১৪ ভাগই বরাদ্দ রাখা হয় প্রতিরক্ষাখাতে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়ার পরেও মিয়ানমার অস্ত্র কিনতে ও হার্ডওয়্যার কিনতে সক্ষম হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে সামরিক জান্তা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ব্যবসায় তাদের যে সম্পদ রয়েছে তার অন্যতম মিয়ানমার ইকোনমিক করপোরেশন। এখান থেকে কলকারখানায় উৎপাদন, টেলিযোগাযোগ, পরিবহন এমন কি অন্যান্য খাতও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সিগারেট ও জ্বালানি আমদানিতে ক্ষমতাসীন জেনারেলদের লোভ দেখানো হয় মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিংস লিমিটেড। দেশের অর্থনীতিতে বিভিন্ন অংশে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে, এমনকি শেয়ারহোল্ডারও হয়ে ওঠে। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে এ কথা বলেছেন ইয়েশুয়া মোসের পুয়াংসুওয়ান। তিনি বলেন, মিয়ানমারে রাজনৈতিক পরিবর্তন সত্ত্বেও নিরেট নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে সেনাবাহিনী। বিশ্বনেতারা এখন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবরোধ বাস্তবায়নের জোর আহ্বান জানাচ্ছেন, যাতে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর তাদের নৃশংসতা বন্ধ করে।
No comments