‘সুচির পতন’
২৫শে
আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সেনাবাহিনীর পোস্টে হামলা চালায় বেশ কিছু
রোহিঙ্গা বিদ্রোহী। ওইদিনই প্রথমবারের মতো স্যাটেলাইটে রাখাইনের গ্রামগুলো
জ্বলতে দেখা যায়। হামলার কয়েক ঘণ্টা পর থেকেই একটি একটি করে মিয়ানমারের
পশ্চিমাঞ্চলজুড়ে শহরতলীগুলো দাউ দাউ করে জ্বলছিল। এরপর থেকে শুরু হয়
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পালিয়ে আসা। বিদ্রোহীদের হামলার জবাবে
সেনাবাহিনীর শুরু করা সামরিক অভিযান থেকে বাঁচতে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটি
থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা দলে দলে প্রবেশ করতে থাকে বাংলাদেশে। শরণার্থীরা
ত্রাণকর্মীদের জানান, সেনারা তাদের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। তাদের
পালিয়ে আসার পথে পেতে রেখেছে স্থলবোমা। পলায়নরত নারী- শিশুদের উদ্দেশ্য করে
ছুড়েছে গুলি। মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনা এটাই
প্রথম নয়। তবে অন্যবারের চেয়ে এবার নির্যাতনের মাত্রার পার্থক্য বিশাল। তিন
সপ্তাহে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে ২০০ গ্রাম। ৪ লাখ ২০ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা
প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। এদের দুই-তৃতীয়াংশই হচ্ছে শিশু।
ইউনিসেফ ও মেডসান সন ফ্রন্টিয়ারের মতন মানবাধিকার সংস্থাকে সংঘর্ষ-
আক্রান্ত এলাকাগুলোতে ঢুকতে দেয়া হয়নি। জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান সামরিক
অভিযানটিকে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞের একটি পরিষ্কার উদাহরণ’ হিসেবে আখ্যায়িত
করেছেন। তবে এতকিছুর মধ্যেও মিয়ানমারে একজন ব্যক্তি এ নিয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে
চুপ ছিলেন। তিনি হচ্ছেন, মানবাধিকার আইকন ও নোবেলজয়ী দেশটির সামরিক
সরকারের কার্যত নেত্রী অং সান সুচি। এই নির্যাতনের প্রতি নিন্দা জানাননি
তিনি। সুচির সতীর্থ নোবেলজয়ীরা খুব দ্রুতই এই অসঙ্গতিটি তুলে ধরেন।
পাকিস্তানি মানবাধিকার কর্মী ও নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই বলেন, সুচির কথা
শোনার জন্য পুরো বিশ্ব অপেক্ষা করছে। দক্ষিণ আফ্রিকান যাজক ডেসমন্ড টুটু
পার্থনা করেন, যাতে করে সুচি পুনরায় তার সাহসী ও দৃঢ় হয়ে উঠতে পারেন। তবে
সুচি তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী আচরণ না করে উল্টো সামরিক অভিযান নিয়ে ভুয়া
তথ্য প্রচারের অভিযোগ তোলেন। তিনি ঘোষণা দেন, তিনি জাতিসংঘের সাধারণ
অধিবেশনে যোগ দিবেন না।
রাখাইনের প্রথম গ্রামে আগুন জ্বলার ২৫ দিন পর বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বক্তব্য রাখেন সুচি। সেনা কর্মকর্তা ও বিদেশি কূটনীতিকদের সামনে দেয়া মিয়ানমারের রাজধানী থেকে প্রচারিত ওই ভাষণে সুচি সামরিক বাহিনীর সমালোচনা করেননি। তার জায়গায় এই নির্যাতন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিন্দা প্রকাশ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, তার সরকার রাখাইনে গ্রাম আগুনে জ্বলার খবর নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু এই বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করার আগে সরকারকে এইসব অভিযোগ ও অভিযোগের বিরুদ্ধে দেয়া পাল্টা-অভিযোগ, সবই বিবেচনা করে দেখতে হবে। তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত সংঘর্ষ-আক্রান্ত এলাকার জায়গায় যেসব এলাকায় শান্তি বজায় আছে সেসব এলাকার দিকে বেশি মনযোগ দেয়া। তিনি দাবি করেন রাখাইনের বেশিরভাগ মুসলিমই এখনো সেখানেই রয়ে গেছেন, বাংলাদেশে পালিয়ে আসেননি। তিনি বলেন, এটা খুব কম মানুষেরই জানা যে রাখাইন রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম রোহিঙ্গাই রাখাইন ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। এটা দুঃখজনক যে, আমাদের কূটনৈতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈঠকের সময়, আমি শুধুমাত্র আমাদের অল্পকিছু সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে বাধ্য। তার এই প্রতিক্রিয়া বিশ্বজুড়ে আলোচনার সৃষ্টি করেছে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক কেনেথ রথ বলেন, তার ভাষণের মাধ্যমে জাতিগত নিধনযজ্ঞকে ঢাকা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
এভাবেই আইকনদের পতন ঘটে। যুক্তরাষ্ট্র সুচিকে শুধু মিয়ানমারের মহান উদ্ধারকারীই বানায়নি, একই সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অহিংস প্রতিবাদের একজন আদর্শ হিসেবেও তার নাম প্রতিষ্ঠা করেছে। জাতিসংঘও মিয়ানমার থেকে ভালো কিছু দেখার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিল। কারণ, মিয়ানমার বহুদিন ধরে তার নেতৃত্বের অধীনে রয়েছে। তবে এখন এসে তার অগ্রাধিকার ভিন্ন দিকে ধাবিত হচ্ছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উপ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বেন রোডস বলেন, “তিনি এখন ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে পরিবর্তন ঘটতে থাকা মিয়ানমারের একজন রাজনীতিক হিসেবে দেখেন, মানবাধিকার নিয়ে কথা বলা আইকন হিসেবে না। মিয়ানমারের ভেতর রাজনৈতিক সংস্কার আনার তীব্র ইচ্ছা তার মধ্যে একটি জ্বলজ্বলে ও শোচনীয় ‘ব্লাইন্ড স্পটের’ সৃষ্টি করেছে।” এতে শুধু তার সুনামই ধ্বংস হচ্ছে না। মিয়ানমারের জনসংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস রাজ্যের দ্বিগুণ। চীন, ভারত, থাইল্যান্ডের মাঝখানে অবস্থিত দেশটিতে ভারসাম্যহীনতার কারণে যে কোনো মুহূর্তে সামরিক বাহিনী সরকারের দখল নিয়ে নিতে পারে। এতে করে পণ্ড হয়ে যাবে সকল গণতান্ত্রিক সংস্কার। রোহিঙ্গাদের ওপর এই নির্যাতনকে নিজেদের দলে নতুন লোক ঢুকিয়ে নেয়ার সুযোগ হিসেবে দেখছে অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। জঙ্গি গোষ্ঠী আল-কায়েদা তো ইতিমধ্যে মিয়ানমারকে হুমকিও দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য চাপ দিচ্ছে। অন্যদিকে বঙ্গোপসাঙ্গরে কৌশলগত প্রবেশাধিকার অর্জনের উদ্দেশ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে চীন। সুচির আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার ওপর, সেই বিদ্রোহী সুচি হিসেবে ওই নির্যাতনের বিরুদ্ধে শক্ত, বলিষ্ঠ অবস্থান নেয়ার ওপর লাখ লাখ মানুষের ভাগ্য নির্ভর করছে। গণতন্ত্র অর্জনের পথ প্রায়ই নোংরা থাকে। মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে দেশটির সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর লড়াই বহুদিন ধরে অব্যাহত রয়েছে। সাংবিধানিক পরিবর্তন আনার ক্ষমতা রয়েছে সামরিক বাহিনীর হাতে। এমনকি ক্ষমতা বাড়ছে বৌদ্ধ-জাতীয়তাবাদীদেরও। উভয়পক্ষ থেকেই চাপের মধ্যে রয়েছেন সুচি। এদিকে, আমেরিকা ফার্স্ট পলিসি নিয়ে গিয়ে চলা ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত, তারা এই জাতিগত সংঘর্ষ কিভাবে সামলাবে। ওবামার আমলে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ওপর থেকে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। মার্কিন কংগ্রেসের মধ্যে কোনো কোনো আইনপ্রণেতা পুনরায় তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপাতে চান। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কের পরিধি সীমিত করে দিতে চান। রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নির্যাতন নিয়ে বিরল বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। তবে চীনের বাধার কারণে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে থামানোর মতন প্রস্তাব এখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আর এসবের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের পালানো অব্যাহত রয়ে গেছে।
বিশ্ব হতাশা থেকে ওঠে আসা নায়কদের মাথায় মুকুট পরিয়ে দিতে ভালোবাসে। ৭২ বছর বয়সী সুচির জন্ম মিয়ানমারের সবচেয়ে আলোচিত পরিবারগুলোর একটিতে। তার বাবা জেনারেল অং সান দেশের আধুনিক সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৪০’র দশকে মিয়ানমারের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তিনি। বৃটেন থেকে মিয়ানমারকে স্বাধীনতা এনে দেন তিনি। সুচির শিশুকালেই তাকে হত্যা করা হয়। শহীদের মর্যাদা পান তিনি। গৃহযুদ্ধে বিভক্ত হয়ে যায় দেশ। পরবর্তীতে সুচির মা’কে ভারত ও নেপালে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বড় হয়ে সুচি বিদেশে বসবাস শুরু করেন। রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন। জাতিসংঘের হয়ে নিউ ইয়র্ক শহরে কাজ করেন। ১৯৮৮ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন তিনি। পশ্চিমা ধ্যান-ধারণা তখনই তার মাথায় ঢুকে যায়। প্রতিষ্ঠা করেন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি। গৃহবন্দি হয়ে কাটান পরবর্তী ১৫ বছর। গৃহবন্দি থাকার সময়ে ১৯৯০ সালে তার দল ব্যাপক ব্যবধানে নির্বাচনে জয় লাভ করে। কিন্তু সেনাবাহিনী সেই জয় মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তিনি লড়ে যান। বাড়ির ভেতর থেকেই গণতন্ত্র নিয়ে ভাষণ দিতে থাকেন। এই দীর্ঘ গৃহবন্দি থাকাকালে একবার তাকে সাময়িক মুক্তি দেয়া হয়েছিল। তার স্বামী বৃটেনে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়ছিলেন তখন। কিন্তু তিনি তার স্বামীকে দেখতে যাননি। তিনি জানতেন, একবার তিনি মিয়ানমার ছেড়ে গেলে, সামরিক জান্তারা পুনরায় তাকে আর সেখানে ঢুকতে দেবে না। ২০১০ সালে তাকে মুক্ত করে দেয়া হয়। মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে পারে এমন আশার জন্ম হয়। ওবামা তাকে ‘এ হিরো অফ মাইন’(আমার একজন হিরো) বলে আখ্যায়িত করেন। সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন তার প্রশংসায় বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা ও সাহসী প্রিজনার অফ কনসায়েন্স। উল্লেখ্য, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিশ্বাস পোষণের কারণে কাউকে আটক করে রাখা হলে তাকে প্রিজনার অফ কনসায়েন্স বলা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র তাকে কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল দিয়ে সম্মান জানায়। তিনি গৃহবন্দি থাকাকালীন সময়েই তার নামে এ পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট থেকে পান সাখারোভ প্রাইজ ফর ফ্রিডম অফ থট। ২১ বছর পর ১৯৯১ সালে ঘোষিত নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেন নরওয়ের রাজধানী অসলো থেকে। সে সময় ইউনিভার্সাল ডিক্লিয়ারেশন অফ হিউম্যান রাইটস থেকে তার প্রিয় বাক্যগুলো উচ্চারণ করে শোনান। তিনি বলেন, “যখন নোবেল কমিটি আমাকে ‘পিস প্রাইজ’ দিয়ে পুরস্কৃত করছে, তারা তখন বার্মার (মিয়ানমার) নিপীড়িত ও বিচ্ছিন্ন মানুষগুলোকে বিশ্বের একটা অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ‘দ্য নোবেল পিস প্রাইজ’ আমার অন্তরে একটি দ্বার খুলে দিয়েছে।” এসব সুখবরের ভেতরে চাপা পড়েছিল একটি কুৎসিত বাস্তবতা।
কয়েক দশক ধরে রাখাইন রাজ্যের মুসলিমরা সহিংসতার শিকার হচ্ছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে। পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। দেখা গেছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এই নির্যাতনের কারণ খুঁজে বের করা বেশ কঠিন। ধর্মীয়, জাতিগত ও অর্থনৈতিক কারণ-সব কিছুর জন্যেই তারা নিপীড়নের শিকার। রোহিঙ্গা-সুন্নি মুসলিমদের সংখ্যালঘু একটি গোষ্ঠী। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির রাখাইন প্রদেশের উত্তরাঞ্চলে তারা কয়েক প্রজন্ম ধরে বাস করে আসছে। সে দেশের সরকার তাদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। অস্বীকার জানিয়েছে, দেশটির ১৩৫টি স্বীকৃত জাতিগোষ্ঠীর তালিকায় স্থান দিতেও। এমনকি মিয়ানমারের বাসিন্দাদের অনেকের ধারণা রোহিঙ্গারা অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী। রাখাইন, মিয়ানমারের দরিদ্র রাজ্যগুলোর একটি। আর সেখানে কয়েক দশক ধরে চলছে বহিষ্কার নীতি। এই নীতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, রোহিঙ্গাদের ভোট দেয়ার অধিকার, সরকারি অনুমতি ছাড়া ভ্রমণের অধিকার বাতিল করে দেয়া। এসব বহিষ্কার নীতি রোহিঙ্গা ও রাখাইনের অন্যান্য গোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা আরো গভীর করে তুলেছে।
বিশেষ করে সুচি তার নোবেল পুরস্কার গ্রহণের আগের সময়টুকু বেশি নির্মম ছিল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অনুসারে, ২০১২ সালে মুসলিম গ্রামগুলোতে সরকারি বাহিনী সমন্বিতভাবে হামলা চালিয়েছে। গণগ্রেপ্তার চালিয়েছে, ত্রাণ অবরোধ করে রেখছে। তৎকালীন সময়ে সরকারি বাহিনীর এসব কর্মকাণ্ডকে অনেকে রোহিঙ্গাদের উৎখাত করার চেষ্টা ছিল বলে আখ্যায়িত করেছেন। সুচি কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল গ্রহণের সময়ে পুনরায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাধ্য হয়ে পালিয়ে যায় রাখাইন থেকে। ওই সময়ে ইউরোপে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, রোহিঙ্গারা কি বর্মী (মিয়ানমারের বাসিন্দা) কি না! তিনি উত্তর দেন, আমি জানি না। তার এমন প্রতিক্রিয়া সমালোচনার সৃষ্টি করে। ওবামার আমলে মিয়ানমারে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেরেক মিচেল বলেন, সবাই অবাক হয়েছিল। তিনি কখনোই বহির্দেশে রোহিঙ্গা ইস্যুটি নিয়ে মানুষকে সন্তুষ্ট করতে পারেন নি।
২০১৫ সালে সুচি মিয়ানমারের একজন আইন প্রণেতা হিসেবে নির্বাচিত হন। মিয়ানমারে ২৫ বছরের মধ্যে প্রথম স্বাধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তার দল ব্যাপক ব্যবধানে জয় লাভ করে। প্রধানমন্ত্রীর আদলে সুচির জন্যে নতুন পদ তৈরি করা হয়। তিনি হয়ে যান নতুন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর। তবে তার ক্ষমতা সীমিত হয়ে যায়। কেউ স্বীকার করতে না চাইলেও, গণতন্ত্রও হয়ে যায় আরো ভঙ্গুর। ২০০৮ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তাদের লেখা সংবিধান অনুসারে, পার্লামেন্টের ২৫ শতাংশ আসন দেশের সেনাবাহিনীর অধীনেই থাকবে। পাশাপাশি, তারা যেকোনো সাংবিধানিক পরিবর্তনেও বাধা দিতে পারবে। সুচির সন্তানরা বৃটিশ নাগরিক হওয়ায় তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। আর হতে পারলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সীমান্ত বিষয়ক ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সহ প্রধান মন্ত্রণালয়গুলো সেনাবাহিনীই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এই সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাহিনীটির কমান্ডার ইন চিফ, জেনারেল মিন অং হ্লাইং। মিয়ানমারের মানবাধিকার কর্মী চেরি জাহাও বলেন, এনএলডি ২০১৫ সালে করা নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তাদেরটাই হচ্ছে একমাত্র রাজনৈতিক দল যেটি সামরিক বাহিনীর মোকাবিলা করতে পারে। তাদের সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজও করতে হবে। ২০১৬ সালের মে মাসে সুচি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে বলেন যে, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কথা বলার জন্যে তার দেশের কিছু সময় প্রয়োজন। তিনি তার কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার না করার জন্যে। তিনি জাতিসংঘের কাছে এ নিয়ে যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, ওই শব্দ ব্যবহার না করাটা সংহতির প্রচারণা করবে। কেরি বলেন, তিনি সবসময় এটা অনুভব করতেন যে, মিয়ানমারের বাইরের লোকেরা বিষয়টার জটিলতা বোঝে না। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করতেন কিন্তু এখন পর্যন্ত এরকম কৌশলগত যোগাযোগে সে খুব একটা ফলপ্রসূ প্রমাণিত হননি।
ওবামা প্রশাসন চেষ্টা চালিয়েছিল যাতে সুচি রাখাইনে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে সহায়তা করার সুযোগ দেয়। এ বিষয়ে ওবামা বা তার জ্যেষ্ঠ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েক ডজন বৈঠকে বসেন সুচি। ওবামার ডেপুটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার রোডস জানান, বৈঠকগুলোতে সাধারণত সঠিক বিষয়গুলোই উল্লেখ করত যেমন- মানবাধিকার রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা, সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা ও নাগরিকত্ব বিষয়ক সমাধান বের করার প্রয়োজোনীয়তা নিয়ে কথা বলতেন তিনি। তবে তিনি প্রতিবার এটাও বলতেন যে, তিনি এ বিষয়ে খুব কমই করতে পারবেন। রোডস বলেন, তিনি যুক্তি দেখাতেন যে, যদি তিনি আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের কাছে সাহায্য করার দরজাটি খুলে দেন তাহলে, সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা কমে যাবে। রোডস বলেন, আমরাও বিশেষ করে আমাদের দূতাবাস এই ইস্যুটির দিকেই বেশি নজর দিতাম। আর মাঝে মাঝে তা নিয়ে অগ্রগতিও দেখা দিত, যেমন- আরো ভালো মানবাধিকার প্রবেশ। কিন্তু তাদের বিভক্ত রাজনীতির প্রেক্ষাপটে আমরা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার মতো আরো নিরাপদ কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছি।
২০১৬ সালে ওবামা ও সুচি ওভাল অফিসে এক বৈঠকে বসেন। মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সংস্কারের বার্তা বেশ ভালোভাবেই পৌঁছেছে, এমন প্রত্যাশা করে দুই দশক ধরে চলমান মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেন। রোডস বলেন, মূলত মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের কাছে নিয়ে যেতে পারে এমন ধরনের বিনিয়োগ আটকে রাখা হচ্ছিল (ওই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে)। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম যে, তিনি ও তার সরকার তাদের অবস্থান নিয়ে আরো স্থিতিশীল ও আত্মবিশ্বাসী ছিল। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম যে, এতে করে তারা রোহিঙ্গাদের পক্ষে ঝুঁকি নেয়ার মতো আরো শক্ত অবস্থানে থাকবে। তবে মানবাধিকার কর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপ পরিস্থিতি আরো খারাপ করে তুলেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক রথ বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছে এই পদক্ষেপ যে বার্তা পাঠিয়েছে তা হলো, তারা গণতান্ত্রিক ত্যাগের একটি নিদর্শন দিয়ে পার পেয়ে যেতে পারে। তারা পুনরায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। অং সান সুচিকে নামমাত্র নেত্রী হোক কিন্তু জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর ওপর নির্যাতন থামানোর কোনো প্রয়োজন নেই। আর নিষেধাজ্ঞাগুলো সব ওঠে গেছে। তিনি বলেন, ওবামা প্রশাসন খুব জলদি নিজেদের জয়ী ভেবে বসেছিল। তাই এখন যা ঘটেছে তার কিছুটা দায় ওই প্রশাসনের ওপরেও পড়ে।
এদিকে, ইস্যুটির সঙ্গে ট্রামপ প্রশাসন অনেক কম জড়িত। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের (এনএসসি) এক মুখপাত্র জানান, অফিস গ্রহণের পর থেকে এখন পর্যন্ত সুচির সঙ্গে কথাও বলেননি ডনাল্ড ট্রামপ। উত্তর কোরিয়া পলিসির জন্যে নিয়োজিত বিশেষ রাষ্ট্রদূত জোসেফ ইয়ুন জুলাই মাসে মিয়ানমার সফরে যান। সে সময় তিনি সুচি ও সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, তার সফরে তিনি শুধুমাত্র উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সমপর্ক নিয়েই মনোনিবেশ করেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মনযোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে ওই সফর করা হয়নি। এখন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামপ্রতিক সহিংসতার মাত্রা হয়তো ট্রামপকে বাধ্য করতে পারে এদিকে নজর ঘুরাতে। সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট নাজিব রাজাক যুক্তরাষ্ট্র সফরে আসেন। তখন রাজাকের সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন ট্রামপ। সে আলোচনায় তারা দুজনেই সম্মত হন যে, মিয়ানমারকে এই সহিংসতা বন্ধ করতে হবে ও সেখানে মানবিক সাহায্য ঢুকতে দিতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন সুচিকে ফোন করে, মিয়ানমার সরকার ও সামরিক বাহিনীকে দেশটিতে মানবিক সাহায্য নিয়ে প্রবেশাধিকার দেবার জন্যে আহ্বান জানান। পরবর্তী দিনই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রোহিঙ্গাদের সাহায্যার্থে ৩ কোটি ২০ লাখ ডলারের অতিরিক্ত ত্রাণ প্রদানের ঘোষণা দেয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি প্যাট্রিক মার্ফি সুচির ভাষণে যোগ দিতে নেপিড’তে সফর করেন। সেখানে তিনি রাখাইনের রাজধানী সিত্তুয়ি শহর পরিদর্শন করেন। কিন্তু স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তারা তাকে বলেন যে, নিরাপত্তাজনিত কারণে তিনি সংঘর্ষ-আক্রান্ত এলাকাগুলো পরিদর্শন করতে পারবেন না।
এনএসসি’র এক মুখপাত্র বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও মিয়ানমারের মধ্যে সামরিক সমপর্ক এখন পর্যন্ত একেবারে শুরুর পর্যায়ে। আর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী এই নির্যাতন ও বাস্ত্যচুত করার ঘটনা না থামায় তাহলে এ সমপর্ক সামনে এগিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জাস্টিন হিগিনস বলেন, ‘আমরা অং সান সুচির প্রতিশ্রুতিকে স্বাগতম জানাই। যে প্রতিশ্রুতিতে তিনি বলেছেন যে, যখন নিরাপদ মনে হবে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া হবে। আমরা মিয়ানমারকে নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করার অনুমোদন দেয়ার আহবান যাচাই। এ বিষয়ে কংগ্রেসের বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। সিনেট মেজরিটি লিডার মিচ ম্যাককন্নেল কয়েক দশক ধরে সুচিকে সমরথন করে আসছেন। সুচির ভাষণের আগে তিনি তাকে ফোন দিয়েছেন। এমনকি সিনেটে তাকে প্রতিরক্ষা করে কথাও বলেছেন। তিনি বলেছেন, সুচি আগে যে মানুষ ছিলেন, এখনই সেই মানুষই আছেন। তিনি শুধু তার অবস্থার উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা করছেন। রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদকে ত্রাণ নিয়ে ঢুকতে না দেওয়ায় সুচির এই সমর্থনকারী সিনেটর তাকে তার সিদ্ধান্ত পাল্টাতে একটি চিঠি লিখেছিলেন। ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর ডিয়ানে ফেইন্সটেইন চান, কংগ্রেস মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সুচির সরকারের সঙ্গে সমপর্ক পুনরায় বিবেচনা করুক। উল্লেখ্য, ফেইন্সটেইন সুচিকে কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল প্রদানের অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, অন্ততপক্ষে যে নেতারা জাতিগত নিধনযজ্ঞের এই অভিযানের পরিকল্পনা করেছেন ও এর কার্যক্রম চালিয়েছেন তাদের সবাইকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা উচিত। দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সকল প্রকার যোগাযোগ স্থগিত রাখা উচিৎ। আর মিয়ানমারের সঙ্গে পক্ষপাতমূলক সুবিধাও শেষ করা উচিত।
পোপ ফ্রান্সিস কতৃক নিয়োজিত মিয়ানমারের শীর্ষ ক্যাথলিক কর্মকর্তা কার্ডিনাল চার্লস মাওং বো বলেন, বর্তমানে পরিস্থিতি যে মোড় নিয়েছে, তাতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সামলানো অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, অং সান সুচি শক্ত রশির ওপর দিয়ে হাটছে। ইতিমধ্যেই পুনরায় সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে কালো শক্তির আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে ।
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গাদের সাহায্য করাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো। বিশ্ব নেতারা, জাতিসংঘ মহাসচিব থেকে শুরু করে মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স, ইউরোপীয়, এশীয় মন্ত্রীরা বিভিন্ন বৈঠক ও ভাষণে এ সংকট নিয়ে আলোচনা করেন। তবে ট্রামপ ব্যতিক্রম ছিলেন। জাতিসংঘের কাছে এ বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি। এদিকে নিজ দেশে অবস্থান করা সুচি চান যে পুরো বিশ্ব একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা বুঝুক। তিনি তার এক বক্তব্যে বলেন, এটা (মিয়ানমার) নতুন এক গণতন্ত্র। বিশ্ব এমনটা প্রত্যাশা করতে পাওে না যে, এটি মাত্র ১৮ মাসেই এর সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে ফেলবে। উল্লেখ্য, সুচি স্টেট কাউন্সেলর হয়েছেন ১৮ মাস হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনের জবাবে তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, রাখাইনের মুসলিমরা সমানভাবে ও বৈষম্যহীনভাবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা ভোগ করে থাকে। তিনি বৈদেশিক কূটনীতিকদের রাখাইন পরিদর্শনের প্রস্তাব দেন। কিন্তু শুধুমাত্র সে অংশগুলোই পরিদর্শন করার সুযোগ দেয়া হয় যে অংশগুলো থেকে, মুসলিমরা এখনো পালিয়ে যায়নি। এর পেছনে কারণ ছিলো, এত করে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় এটা শিখতে পারবে যে, কেন এই মুসলিমরা তাদের গ্রাম ছেড়ে পালায়নি। তিনি ভাষণ দেয়ার আগে তার সমর্থকরা রাজধানীতে তাকে সমর্থন জানিয়ে বিভিন্ন ব্যানার ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে হাজির হয়। কিন্তু অন্যরা হতাশ। মিয়ানমারের সাবেক রাজনৈতিক বন্দি, একজন গণতান্ত্রিক কর্মী চিত মিন ল্যা বলেন, তিনি ছিলেন আমাদের পথ প্রদর্শক ছিলেন, আমাদের আইকন, আমাদের নেত্রী। আমরা তাকে ভালোবেসেছিলাম তার মূল্যবোধের কারণে। কেউ কেউ বলেন তিনি প্রয়োগবাদী আচরণ করছেন। কিন্তু আমি জানি না, কেন তিনি এমন করছেন।
এখন থেকে দুই মাস পরে নতুন এক নৈতিক নেতা বিশ্বের দৃষ্টি রোহিঙ্গাদের দিকে নিয়ে যাবেন। পোপ ফ্রান্সিস নভেম্বরে মিয়ানমার সফর করবেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশও সফর করবেন তিনি। মিয়ানমারের সঙ্গে ভ্যাটিকানের সমপর্কের বয়স মাত্র চার মাস। তিনি সবসময় রোহিঙ্গাদের প্রতিরক্ষা করে আসছেন। যেমনটা সুচি করেননি। পোপের এই সফর নিয়ে দেশ-বিদেশে প্রত্যাশা যত বেশি তেমনি প্রতিবন্ধকতাও তত বেশি। বলেন, ‘আমি আশা করি তিনি মিয়ানমারের মানুষদের কাছে সবকিছু নিয়ে এমনভাবে কথা বলবেন যাতে করে সমাধান আসবে, ঘৃণা নয়। এটাও একটা বাধা, কারণ এখানের একটা গোষ্ঠী সত্যিকারের শান্তি দেখতে চায় না।’ এইসবের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গারা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেই। ওই অঞ্চলে থাকা মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলেছে, রাখাইনে সামরিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যদিও সুচি দাবি করেন, রাখাইনে সামরিক অভিযান ৫ই সেপ্টেম্বরে বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্যে ১৪০০০ আশ্রয়ণ সহ নতুন একটি শিবির তৈরির পরিকল্পনা করছে। গত মাস থেকে এখন পর্যন্ত ৪ লাখ ২০ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। বাংলাদেশে নিয়োজিত জাতিসংঘের নাগরিক সমন্বয়ক রবার্ট ওয়াটকিনসের ধারণা, সব মিলিয়ে মিয়ানমার থেকে আরও ১ লাখ মানুষ বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, তাদের সবার কাহিনী একই। তাদের গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ধর্ষণ করা হয়েছে। পরিবারের সদস্যের হত্যা করা হয়েছে। দুঃখজনকভাবে, এক পরিবারের চেয়ে অন্য পরিবারের দুর্দশার কাহিনী বেশি শোচনীয়।
(মূল প্রতিবেদনটি আমেরিকান সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘টাইম’-এর অনলাইন ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনটি লিখেছেন এলিজাবেথ ডিয়াস। অনুবাদ করেছেন রিফাত আহমাদ)।
রাখাইনের প্রথম গ্রামে আগুন জ্বলার ২৫ দিন পর বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বক্তব্য রাখেন সুচি। সেনা কর্মকর্তা ও বিদেশি কূটনীতিকদের সামনে দেয়া মিয়ানমারের রাজধানী থেকে প্রচারিত ওই ভাষণে সুচি সামরিক বাহিনীর সমালোচনা করেননি। তার জায়গায় এই নির্যাতন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিন্দা প্রকাশ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, তার সরকার রাখাইনে গ্রাম আগুনে জ্বলার খবর নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু এই বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করার আগে সরকারকে এইসব অভিযোগ ও অভিযোগের বিরুদ্ধে দেয়া পাল্টা-অভিযোগ, সবই বিবেচনা করে দেখতে হবে। তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত সংঘর্ষ-আক্রান্ত এলাকার জায়গায় যেসব এলাকায় শান্তি বজায় আছে সেসব এলাকার দিকে বেশি মনযোগ দেয়া। তিনি দাবি করেন রাখাইনের বেশিরভাগ মুসলিমই এখনো সেখানেই রয়ে গেছেন, বাংলাদেশে পালিয়ে আসেননি। তিনি বলেন, এটা খুব কম মানুষেরই জানা যে রাখাইন রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম রোহিঙ্গাই রাখাইন ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। এটা দুঃখজনক যে, আমাদের কূটনৈতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈঠকের সময়, আমি শুধুমাত্র আমাদের অল্পকিছু সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে বাধ্য। তার এই প্রতিক্রিয়া বিশ্বজুড়ে আলোচনার সৃষ্টি করেছে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক কেনেথ রথ বলেন, তার ভাষণের মাধ্যমে জাতিগত নিধনযজ্ঞকে ঢাকা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
এভাবেই আইকনদের পতন ঘটে। যুক্তরাষ্ট্র সুচিকে শুধু মিয়ানমারের মহান উদ্ধারকারীই বানায়নি, একই সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অহিংস প্রতিবাদের একজন আদর্শ হিসেবেও তার নাম প্রতিষ্ঠা করেছে। জাতিসংঘও মিয়ানমার থেকে ভালো কিছু দেখার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিল। কারণ, মিয়ানমার বহুদিন ধরে তার নেতৃত্বের অধীনে রয়েছে। তবে এখন এসে তার অগ্রাধিকার ভিন্ন দিকে ধাবিত হচ্ছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উপ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বেন রোডস বলেন, “তিনি এখন ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে পরিবর্তন ঘটতে থাকা মিয়ানমারের একজন রাজনীতিক হিসেবে দেখেন, মানবাধিকার নিয়ে কথা বলা আইকন হিসেবে না। মিয়ানমারের ভেতর রাজনৈতিক সংস্কার আনার তীব্র ইচ্ছা তার মধ্যে একটি জ্বলজ্বলে ও শোচনীয় ‘ব্লাইন্ড স্পটের’ সৃষ্টি করেছে।” এতে শুধু তার সুনামই ধ্বংস হচ্ছে না। মিয়ানমারের জনসংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস রাজ্যের দ্বিগুণ। চীন, ভারত, থাইল্যান্ডের মাঝখানে অবস্থিত দেশটিতে ভারসাম্যহীনতার কারণে যে কোনো মুহূর্তে সামরিক বাহিনী সরকারের দখল নিয়ে নিতে পারে। এতে করে পণ্ড হয়ে যাবে সকল গণতান্ত্রিক সংস্কার। রোহিঙ্গাদের ওপর এই নির্যাতনকে নিজেদের দলে নতুন লোক ঢুকিয়ে নেয়ার সুযোগ হিসেবে দেখছে অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। জঙ্গি গোষ্ঠী আল-কায়েদা তো ইতিমধ্যে মিয়ানমারকে হুমকিও দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য চাপ দিচ্ছে। অন্যদিকে বঙ্গোপসাঙ্গরে কৌশলগত প্রবেশাধিকার অর্জনের উদ্দেশ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে চীন। সুচির আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার ওপর, সেই বিদ্রোহী সুচি হিসেবে ওই নির্যাতনের বিরুদ্ধে শক্ত, বলিষ্ঠ অবস্থান নেয়ার ওপর লাখ লাখ মানুষের ভাগ্য নির্ভর করছে। গণতন্ত্র অর্জনের পথ প্রায়ই নোংরা থাকে। মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে দেশটির সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর লড়াই বহুদিন ধরে অব্যাহত রয়েছে। সাংবিধানিক পরিবর্তন আনার ক্ষমতা রয়েছে সামরিক বাহিনীর হাতে। এমনকি ক্ষমতা বাড়ছে বৌদ্ধ-জাতীয়তাবাদীদেরও। উভয়পক্ষ থেকেই চাপের মধ্যে রয়েছেন সুচি। এদিকে, আমেরিকা ফার্স্ট পলিসি নিয়ে গিয়ে চলা ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত, তারা এই জাতিগত সংঘর্ষ কিভাবে সামলাবে। ওবামার আমলে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ওপর থেকে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। মার্কিন কংগ্রেসের মধ্যে কোনো কোনো আইনপ্রণেতা পুনরায় তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপাতে চান। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কের পরিধি সীমিত করে দিতে চান। রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নির্যাতন নিয়ে বিরল বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। তবে চীনের বাধার কারণে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে থামানোর মতন প্রস্তাব এখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আর এসবের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের পালানো অব্যাহত রয়ে গেছে।
বিশ্ব হতাশা থেকে ওঠে আসা নায়কদের মাথায় মুকুট পরিয়ে দিতে ভালোবাসে। ৭২ বছর বয়সী সুচির জন্ম মিয়ানমারের সবচেয়ে আলোচিত পরিবারগুলোর একটিতে। তার বাবা জেনারেল অং সান দেশের আধুনিক সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৪০’র দশকে মিয়ানমারের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তিনি। বৃটেন থেকে মিয়ানমারকে স্বাধীনতা এনে দেন তিনি। সুচির শিশুকালেই তাকে হত্যা করা হয়। শহীদের মর্যাদা পান তিনি। গৃহযুদ্ধে বিভক্ত হয়ে যায় দেশ। পরবর্তীতে সুচির মা’কে ভারত ও নেপালে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বড় হয়ে সুচি বিদেশে বসবাস শুরু করেন। রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন। জাতিসংঘের হয়ে নিউ ইয়র্ক শহরে কাজ করেন। ১৯৮৮ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন তিনি। পশ্চিমা ধ্যান-ধারণা তখনই তার মাথায় ঢুকে যায়। প্রতিষ্ঠা করেন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি। গৃহবন্দি হয়ে কাটান পরবর্তী ১৫ বছর। গৃহবন্দি থাকার সময়ে ১৯৯০ সালে তার দল ব্যাপক ব্যবধানে নির্বাচনে জয় লাভ করে। কিন্তু সেনাবাহিনী সেই জয় মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তিনি লড়ে যান। বাড়ির ভেতর থেকেই গণতন্ত্র নিয়ে ভাষণ দিতে থাকেন। এই দীর্ঘ গৃহবন্দি থাকাকালে একবার তাকে সাময়িক মুক্তি দেয়া হয়েছিল। তার স্বামী বৃটেনে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়ছিলেন তখন। কিন্তু তিনি তার স্বামীকে দেখতে যাননি। তিনি জানতেন, একবার তিনি মিয়ানমার ছেড়ে গেলে, সামরিক জান্তারা পুনরায় তাকে আর সেখানে ঢুকতে দেবে না। ২০১০ সালে তাকে মুক্ত করে দেয়া হয়। মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে পারে এমন আশার জন্ম হয়। ওবামা তাকে ‘এ হিরো অফ মাইন’(আমার একজন হিরো) বলে আখ্যায়িত করেন। সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন তার প্রশংসায় বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা ও সাহসী প্রিজনার অফ কনসায়েন্স। উল্লেখ্য, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিশ্বাস পোষণের কারণে কাউকে আটক করে রাখা হলে তাকে প্রিজনার অফ কনসায়েন্স বলা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র তাকে কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল দিয়ে সম্মান জানায়। তিনি গৃহবন্দি থাকাকালীন সময়েই তার নামে এ পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট থেকে পান সাখারোভ প্রাইজ ফর ফ্রিডম অফ থট। ২১ বছর পর ১৯৯১ সালে ঘোষিত নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেন নরওয়ের রাজধানী অসলো থেকে। সে সময় ইউনিভার্সাল ডিক্লিয়ারেশন অফ হিউম্যান রাইটস থেকে তার প্রিয় বাক্যগুলো উচ্চারণ করে শোনান। তিনি বলেন, “যখন নোবেল কমিটি আমাকে ‘পিস প্রাইজ’ দিয়ে পুরস্কৃত করছে, তারা তখন বার্মার (মিয়ানমার) নিপীড়িত ও বিচ্ছিন্ন মানুষগুলোকে বিশ্বের একটা অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ‘দ্য নোবেল পিস প্রাইজ’ আমার অন্তরে একটি দ্বার খুলে দিয়েছে।” এসব সুখবরের ভেতরে চাপা পড়েছিল একটি কুৎসিত বাস্তবতা।
কয়েক দশক ধরে রাখাইন রাজ্যের মুসলিমরা সহিংসতার শিকার হচ্ছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে। পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। দেখা গেছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এই নির্যাতনের কারণ খুঁজে বের করা বেশ কঠিন। ধর্মীয়, জাতিগত ও অর্থনৈতিক কারণ-সব কিছুর জন্যেই তারা নিপীড়নের শিকার। রোহিঙ্গা-সুন্নি মুসলিমদের সংখ্যালঘু একটি গোষ্ঠী। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির রাখাইন প্রদেশের উত্তরাঞ্চলে তারা কয়েক প্রজন্ম ধরে বাস করে আসছে। সে দেশের সরকার তাদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। অস্বীকার জানিয়েছে, দেশটির ১৩৫টি স্বীকৃত জাতিগোষ্ঠীর তালিকায় স্থান দিতেও। এমনকি মিয়ানমারের বাসিন্দাদের অনেকের ধারণা রোহিঙ্গারা অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী। রাখাইন, মিয়ানমারের দরিদ্র রাজ্যগুলোর একটি। আর সেখানে কয়েক দশক ধরে চলছে বহিষ্কার নীতি। এই নীতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, রোহিঙ্গাদের ভোট দেয়ার অধিকার, সরকারি অনুমতি ছাড়া ভ্রমণের অধিকার বাতিল করে দেয়া। এসব বহিষ্কার নীতি রোহিঙ্গা ও রাখাইনের অন্যান্য গোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা আরো গভীর করে তুলেছে।
বিশেষ করে সুচি তার নোবেল পুরস্কার গ্রহণের আগের সময়টুকু বেশি নির্মম ছিল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অনুসারে, ২০১২ সালে মুসলিম গ্রামগুলোতে সরকারি বাহিনী সমন্বিতভাবে হামলা চালিয়েছে। গণগ্রেপ্তার চালিয়েছে, ত্রাণ অবরোধ করে রেখছে। তৎকালীন সময়ে সরকারি বাহিনীর এসব কর্মকাণ্ডকে অনেকে রোহিঙ্গাদের উৎখাত করার চেষ্টা ছিল বলে আখ্যায়িত করেছেন। সুচি কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল গ্রহণের সময়ে পুনরায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাধ্য হয়ে পালিয়ে যায় রাখাইন থেকে। ওই সময়ে ইউরোপে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, রোহিঙ্গারা কি বর্মী (মিয়ানমারের বাসিন্দা) কি না! তিনি উত্তর দেন, আমি জানি না। তার এমন প্রতিক্রিয়া সমালোচনার সৃষ্টি করে। ওবামার আমলে মিয়ানমারে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেরেক মিচেল বলেন, সবাই অবাক হয়েছিল। তিনি কখনোই বহির্দেশে রোহিঙ্গা ইস্যুটি নিয়ে মানুষকে সন্তুষ্ট করতে পারেন নি।
২০১৫ সালে সুচি মিয়ানমারের একজন আইন প্রণেতা হিসেবে নির্বাচিত হন। মিয়ানমারে ২৫ বছরের মধ্যে প্রথম স্বাধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তার দল ব্যাপক ব্যবধানে জয় লাভ করে। প্রধানমন্ত্রীর আদলে সুচির জন্যে নতুন পদ তৈরি করা হয়। তিনি হয়ে যান নতুন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর। তবে তার ক্ষমতা সীমিত হয়ে যায়। কেউ স্বীকার করতে না চাইলেও, গণতন্ত্রও হয়ে যায় আরো ভঙ্গুর। ২০০৮ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তাদের লেখা সংবিধান অনুসারে, পার্লামেন্টের ২৫ শতাংশ আসন দেশের সেনাবাহিনীর অধীনেই থাকবে। পাশাপাশি, তারা যেকোনো সাংবিধানিক পরিবর্তনেও বাধা দিতে পারবে। সুচির সন্তানরা বৃটিশ নাগরিক হওয়ায় তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। আর হতে পারলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সীমান্ত বিষয়ক ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সহ প্রধান মন্ত্রণালয়গুলো সেনাবাহিনীই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এই সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাহিনীটির কমান্ডার ইন চিফ, জেনারেল মিন অং হ্লাইং। মিয়ানমারের মানবাধিকার কর্মী চেরি জাহাও বলেন, এনএলডি ২০১৫ সালে করা নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তাদেরটাই হচ্ছে একমাত্র রাজনৈতিক দল যেটি সামরিক বাহিনীর মোকাবিলা করতে পারে। তাদের সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজও করতে হবে। ২০১৬ সালের মে মাসে সুচি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে বলেন যে, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কথা বলার জন্যে তার দেশের কিছু সময় প্রয়োজন। তিনি তার কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার না করার জন্যে। তিনি জাতিসংঘের কাছে এ নিয়ে যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, ওই শব্দ ব্যবহার না করাটা সংহতির প্রচারণা করবে। কেরি বলেন, তিনি সবসময় এটা অনুভব করতেন যে, মিয়ানমারের বাইরের লোকেরা বিষয়টার জটিলতা বোঝে না। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করতেন কিন্তু এখন পর্যন্ত এরকম কৌশলগত যোগাযোগে সে খুব একটা ফলপ্রসূ প্রমাণিত হননি।
ওবামা প্রশাসন চেষ্টা চালিয়েছিল যাতে সুচি রাখাইনে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে সহায়তা করার সুযোগ দেয়। এ বিষয়ে ওবামা বা তার জ্যেষ্ঠ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েক ডজন বৈঠকে বসেন সুচি। ওবামার ডেপুটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার রোডস জানান, বৈঠকগুলোতে সাধারণত সঠিক বিষয়গুলোই উল্লেখ করত যেমন- মানবাধিকার রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা, সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা ও নাগরিকত্ব বিষয়ক সমাধান বের করার প্রয়োজোনীয়তা নিয়ে কথা বলতেন তিনি। তবে তিনি প্রতিবার এটাও বলতেন যে, তিনি এ বিষয়ে খুব কমই করতে পারবেন। রোডস বলেন, তিনি যুক্তি দেখাতেন যে, যদি তিনি আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের কাছে সাহায্য করার দরজাটি খুলে দেন তাহলে, সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা কমে যাবে। রোডস বলেন, আমরাও বিশেষ করে আমাদের দূতাবাস এই ইস্যুটির দিকেই বেশি নজর দিতাম। আর মাঝে মাঝে তা নিয়ে অগ্রগতিও দেখা দিত, যেমন- আরো ভালো মানবাধিকার প্রবেশ। কিন্তু তাদের বিভক্ত রাজনীতির প্রেক্ষাপটে আমরা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার মতো আরো নিরাপদ কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছি।
২০১৬ সালে ওবামা ও সুচি ওভাল অফিসে এক বৈঠকে বসেন। মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সংস্কারের বার্তা বেশ ভালোভাবেই পৌঁছেছে, এমন প্রত্যাশা করে দুই দশক ধরে চলমান মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেন। রোডস বলেন, মূলত মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের কাছে নিয়ে যেতে পারে এমন ধরনের বিনিয়োগ আটকে রাখা হচ্ছিল (ওই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে)। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম যে, তিনি ও তার সরকার তাদের অবস্থান নিয়ে আরো স্থিতিশীল ও আত্মবিশ্বাসী ছিল। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম যে, এতে করে তারা রোহিঙ্গাদের পক্ষে ঝুঁকি নেয়ার মতো আরো শক্ত অবস্থানে থাকবে। তবে মানবাধিকার কর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপ পরিস্থিতি আরো খারাপ করে তুলেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক রথ বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছে এই পদক্ষেপ যে বার্তা পাঠিয়েছে তা হলো, তারা গণতান্ত্রিক ত্যাগের একটি নিদর্শন দিয়ে পার পেয়ে যেতে পারে। তারা পুনরায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। অং সান সুচিকে নামমাত্র নেত্রী হোক কিন্তু জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর ওপর নির্যাতন থামানোর কোনো প্রয়োজন নেই। আর নিষেধাজ্ঞাগুলো সব ওঠে গেছে। তিনি বলেন, ওবামা প্রশাসন খুব জলদি নিজেদের জয়ী ভেবে বসেছিল। তাই এখন যা ঘটেছে তার কিছুটা দায় ওই প্রশাসনের ওপরেও পড়ে।
এদিকে, ইস্যুটির সঙ্গে ট্রামপ প্রশাসন অনেক কম জড়িত। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের (এনএসসি) এক মুখপাত্র জানান, অফিস গ্রহণের পর থেকে এখন পর্যন্ত সুচির সঙ্গে কথাও বলেননি ডনাল্ড ট্রামপ। উত্তর কোরিয়া পলিসির জন্যে নিয়োজিত বিশেষ রাষ্ট্রদূত জোসেফ ইয়ুন জুলাই মাসে মিয়ানমার সফরে যান। সে সময় তিনি সুচি ও সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, তার সফরে তিনি শুধুমাত্র উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সমপর্ক নিয়েই মনোনিবেশ করেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মনযোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে ওই সফর করা হয়নি। এখন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামপ্রতিক সহিংসতার মাত্রা হয়তো ট্রামপকে বাধ্য করতে পারে এদিকে নজর ঘুরাতে। সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট নাজিব রাজাক যুক্তরাষ্ট্র সফরে আসেন। তখন রাজাকের সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন ট্রামপ। সে আলোচনায় তারা দুজনেই সম্মত হন যে, মিয়ানমারকে এই সহিংসতা বন্ধ করতে হবে ও সেখানে মানবিক সাহায্য ঢুকতে দিতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন সুচিকে ফোন করে, মিয়ানমার সরকার ও সামরিক বাহিনীকে দেশটিতে মানবিক সাহায্য নিয়ে প্রবেশাধিকার দেবার জন্যে আহ্বান জানান। পরবর্তী দিনই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রোহিঙ্গাদের সাহায্যার্থে ৩ কোটি ২০ লাখ ডলারের অতিরিক্ত ত্রাণ প্রদানের ঘোষণা দেয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি প্যাট্রিক মার্ফি সুচির ভাষণে যোগ দিতে নেপিড’তে সফর করেন। সেখানে তিনি রাখাইনের রাজধানী সিত্তুয়ি শহর পরিদর্শন করেন। কিন্তু স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তারা তাকে বলেন যে, নিরাপত্তাজনিত কারণে তিনি সংঘর্ষ-আক্রান্ত এলাকাগুলো পরিদর্শন করতে পারবেন না।
এনএসসি’র এক মুখপাত্র বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও মিয়ানমারের মধ্যে সামরিক সমপর্ক এখন পর্যন্ত একেবারে শুরুর পর্যায়ে। আর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী এই নির্যাতন ও বাস্ত্যচুত করার ঘটনা না থামায় তাহলে এ সমপর্ক সামনে এগিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জাস্টিন হিগিনস বলেন, ‘আমরা অং সান সুচির প্রতিশ্রুতিকে স্বাগতম জানাই। যে প্রতিশ্রুতিতে তিনি বলেছেন যে, যখন নিরাপদ মনে হবে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া হবে। আমরা মিয়ানমারকে নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করার অনুমোদন দেয়ার আহবান যাচাই। এ বিষয়ে কংগ্রেসের বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। সিনেট মেজরিটি লিডার মিচ ম্যাককন্নেল কয়েক দশক ধরে সুচিকে সমরথন করে আসছেন। সুচির ভাষণের আগে তিনি তাকে ফোন দিয়েছেন। এমনকি সিনেটে তাকে প্রতিরক্ষা করে কথাও বলেছেন। তিনি বলেছেন, সুচি আগে যে মানুষ ছিলেন, এখনই সেই মানুষই আছেন। তিনি শুধু তার অবস্থার উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা করছেন। রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদকে ত্রাণ নিয়ে ঢুকতে না দেওয়ায় সুচির এই সমর্থনকারী সিনেটর তাকে তার সিদ্ধান্ত পাল্টাতে একটি চিঠি লিখেছিলেন। ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর ডিয়ানে ফেইন্সটেইন চান, কংগ্রেস মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সুচির সরকারের সঙ্গে সমপর্ক পুনরায় বিবেচনা করুক। উল্লেখ্য, ফেইন্সটেইন সুচিকে কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল প্রদানের অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, অন্ততপক্ষে যে নেতারা জাতিগত নিধনযজ্ঞের এই অভিযানের পরিকল্পনা করেছেন ও এর কার্যক্রম চালিয়েছেন তাদের সবাইকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা উচিত। দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সকল প্রকার যোগাযোগ স্থগিত রাখা উচিৎ। আর মিয়ানমারের সঙ্গে পক্ষপাতমূলক সুবিধাও শেষ করা উচিত।
পোপ ফ্রান্সিস কতৃক নিয়োজিত মিয়ানমারের শীর্ষ ক্যাথলিক কর্মকর্তা কার্ডিনাল চার্লস মাওং বো বলেন, বর্তমানে পরিস্থিতি যে মোড় নিয়েছে, তাতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সামলানো অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, অং সান সুচি শক্ত রশির ওপর দিয়ে হাটছে। ইতিমধ্যেই পুনরায় সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে কালো শক্তির আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে ।
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গাদের সাহায্য করাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো। বিশ্ব নেতারা, জাতিসংঘ মহাসচিব থেকে শুরু করে মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স, ইউরোপীয়, এশীয় মন্ত্রীরা বিভিন্ন বৈঠক ও ভাষণে এ সংকট নিয়ে আলোচনা করেন। তবে ট্রামপ ব্যতিক্রম ছিলেন। জাতিসংঘের কাছে এ বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি। এদিকে নিজ দেশে অবস্থান করা সুচি চান যে পুরো বিশ্ব একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা বুঝুক। তিনি তার এক বক্তব্যে বলেন, এটা (মিয়ানমার) নতুন এক গণতন্ত্র। বিশ্ব এমনটা প্রত্যাশা করতে পাওে না যে, এটি মাত্র ১৮ মাসেই এর সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে ফেলবে। উল্লেখ্য, সুচি স্টেট কাউন্সেলর হয়েছেন ১৮ মাস হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনের জবাবে তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, রাখাইনের মুসলিমরা সমানভাবে ও বৈষম্যহীনভাবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা ভোগ করে থাকে। তিনি বৈদেশিক কূটনীতিকদের রাখাইন পরিদর্শনের প্রস্তাব দেন। কিন্তু শুধুমাত্র সে অংশগুলোই পরিদর্শন করার সুযোগ দেয়া হয় যে অংশগুলো থেকে, মুসলিমরা এখনো পালিয়ে যায়নি। এর পেছনে কারণ ছিলো, এত করে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় এটা শিখতে পারবে যে, কেন এই মুসলিমরা তাদের গ্রাম ছেড়ে পালায়নি। তিনি ভাষণ দেয়ার আগে তার সমর্থকরা রাজধানীতে তাকে সমর্থন জানিয়ে বিভিন্ন ব্যানার ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে হাজির হয়। কিন্তু অন্যরা হতাশ। মিয়ানমারের সাবেক রাজনৈতিক বন্দি, একজন গণতান্ত্রিক কর্মী চিত মিন ল্যা বলেন, তিনি ছিলেন আমাদের পথ প্রদর্শক ছিলেন, আমাদের আইকন, আমাদের নেত্রী। আমরা তাকে ভালোবেসেছিলাম তার মূল্যবোধের কারণে। কেউ কেউ বলেন তিনি প্রয়োগবাদী আচরণ করছেন। কিন্তু আমি জানি না, কেন তিনি এমন করছেন।
এখন থেকে দুই মাস পরে নতুন এক নৈতিক নেতা বিশ্বের দৃষ্টি রোহিঙ্গাদের দিকে নিয়ে যাবেন। পোপ ফ্রান্সিস নভেম্বরে মিয়ানমার সফর করবেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশও সফর করবেন তিনি। মিয়ানমারের সঙ্গে ভ্যাটিকানের সমপর্কের বয়স মাত্র চার মাস। তিনি সবসময় রোহিঙ্গাদের প্রতিরক্ষা করে আসছেন। যেমনটা সুচি করেননি। পোপের এই সফর নিয়ে দেশ-বিদেশে প্রত্যাশা যত বেশি তেমনি প্রতিবন্ধকতাও তত বেশি। বলেন, ‘আমি আশা করি তিনি মিয়ানমারের মানুষদের কাছে সবকিছু নিয়ে এমনভাবে কথা বলবেন যাতে করে সমাধান আসবে, ঘৃণা নয়। এটাও একটা বাধা, কারণ এখানের একটা গোষ্ঠী সত্যিকারের শান্তি দেখতে চায় না।’ এইসবের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গারা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেই। ওই অঞ্চলে থাকা মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলেছে, রাখাইনে সামরিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যদিও সুচি দাবি করেন, রাখাইনে সামরিক অভিযান ৫ই সেপ্টেম্বরে বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্যে ১৪০০০ আশ্রয়ণ সহ নতুন একটি শিবির তৈরির পরিকল্পনা করছে। গত মাস থেকে এখন পর্যন্ত ৪ লাখ ২০ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। বাংলাদেশে নিয়োজিত জাতিসংঘের নাগরিক সমন্বয়ক রবার্ট ওয়াটকিনসের ধারণা, সব মিলিয়ে মিয়ানমার থেকে আরও ১ লাখ মানুষ বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, তাদের সবার কাহিনী একই। তাদের গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ধর্ষণ করা হয়েছে। পরিবারের সদস্যের হত্যা করা হয়েছে। দুঃখজনকভাবে, এক পরিবারের চেয়ে অন্য পরিবারের দুর্দশার কাহিনী বেশি শোচনীয়।
(মূল প্রতিবেদনটি আমেরিকান সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘টাইম’-এর অনলাইন ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনটি লিখেছেন এলিজাবেথ ডিয়াস। অনুবাদ করেছেন রিফাত আহমাদ)।
No comments