যে কথা বলেননি অং সান সুচি by মোহাম্মদ আবুল হোসেন
যেন
রাজনীতির দাবা। ঘোড়ার চাল দিয়ে আড়াই কোর্ট অতিক্রম করতে চেয়েছেন অং সান
সুচি। আটকাতে চেয়েছেন ‘বিশ্ববিবেক’ নামের রাজাকে। কিন্তু পারেননি তিনি।
উল্টো তার ঘোড়াই এখন দৌড়ের মুখে। বিশ্ববিবেক তাই সমালোচনায় মশগুল। জাতির
উদ্দেশে দেয়া তার ভাষণ নিয়ে কটাক্ষ হচ্ছে জনে জনে। কেন? উত্তর খুব সোজা।
তিনি অনেক আশা দিয়েছেন ওই ভাষণে। কিন্তু সেইসব কথার মাঝে রয়েছে চোরাবালির
মতো ফাঁদ। সেগুলোকে অতিক্রম করে রাখাইনে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা সম্ভব
নয়। তিনি তার ভাষণে অনেক কিছুই এড়িয়ে গেছেন। তিনি সব মানবাধিকার লঙ্ঘনের
নিন্দা জানিয়েছেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন্স’ নিয়ে কোনো
কথা বলেননি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে যে লোমহর্ষক ভিডিও ক্লিপ দেখা
যাচ্ছে তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। ওইসব ভিডিও ক্লিপে দেখা যাচ্ছে সেনা
সদস্যরা, বৌদ্ধরা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে। হত্যারও তো একটি রকমফের
আছে। শুধু গলা কেটে, ধর্ষণ করেই তারা ক্ষান্ত হচ্ছে না। ধর্ষিতা নারীর স্তন
পর্যন্ত কেটে ফেলছে। তার হাত-পা কেটে ফেলছে। তারপর গলা কেটে মাথা আলাদা
করছে। নগ্ন যুবতীকে গাছে বেঁধে রাখা হয়েছে। জীবন্ত মানুষকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে
হত্যা করা হচ্ছে। চোখের ভেতর লম্বা ধারালো ছোরা দিয়ে খুঁচিয়ে গলিয়ে দেয়া
হচ্ছে। পিতামাতার সামনে টিনেজ, যুবতী মেয়েকে, সন্তানের সামনে মাকে ধর্ষণ
করা হচ্ছে। মানবাধিকারের কথা বলেছেন সুচি। কিন্তু এসব বিষয়ে তিনি কোনো কথা
বলেন নি। তিনি বলেননি, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের স্যাটেলাইটে ধরা পড়া গ্রামের
পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার প্রমাণের বিষয়টি। তিনি রাখাইনে রোহিঙ্গা সমস্যা
সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। আশ্বাস দিয়েছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান
কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন। এখানে একটি তবে আছে। তা হলো,
তার ভাষায়- যেসব রোহিঙ্গা ফিরে যেতে চান তাদের শরণার্থী হিসেবে মর্যাদা
(রিফিউজি স্ট্যাটাস) যাচাই করতে প্রস্তুত মিয়ানমার। এর অর্থ হলো, তিনি
বুঝাতে চেয়েছেন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নয়, শরণার্থী মর্যাদা দেয়া হতে পারে।
কিন্তু রোহিঙ্গারা কি শরণার্থীর মর্যাদার দাবিদার তার জন্মভিটায়, যেখানে
তার পূর্বপুরুষরা যুগের পর যুগ ধরে বসবাস করে আসছেন। তাদের যে নাগরিকত্বের
সুপারিশ করেছে কফি আনান কমিশন, এর মাধ্যমে সুচি তা একদিকে বাস্তবায়ন
অন্যদিকে প্রত্যাখ্যানের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা মুসলিমদের
বেশির ভাগই এখনো রাখাইনে রয়েছেন। নিরাপদে রয়েছেন। তাদের বাড়িঘরে কোনো
স্পর্শ লাগেনি সহিংসতার। খুবই ভালো কথা। এমনটাই শুনতে চায় বিশ্ববিবেক।
এখানেও একটি কিন্তু আছে। তাহলো, যদি তা-ই হবে, যদি বেশির ভাগ রোহিঙ্গা
তাদের ভিটেমাটিতে থেকেই থাকেন, তাদের বাড়িঘর অক্ষত থাকে, তাহলে কি কারণে
চার লাখ ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে! কি কারণে উত্তর
নাফ নদ, বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিতে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন! কি কারণে কোনো
মানুষ তার জন্মভিটা ছেড়ে পঙ্গপালের মতো! কেন ২৫শে আগস্ট সহিংসতা শুরু
হওয়ার পর আক্রান্ত এলাকায় জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংগঠন, নিরপেক্ষ সাংবাদিকদের
প্রবেশ করতে দেয়া হয় নি। ২৫শে আগস্ট থেকে ১৯শে সেপ্টেম্বর প্রায় এক মাস
সময় পেরিয়ে গেছে। এ সময়ে কেন কোনো পর্যবেক্ষককে ওই এলাকায় যেতে দেয়া হলো
না! এর কোনো ব্যাখ্যা দেননি সুচি। তিনি জানেন এর কোনো উত্তর তার কাছে নেই।
তিনি জানেন, এমন সব প্রশ্নের মুখোমুখি হবেন। তাই তিনি জাতিসংঘের সাধারণ
অধিবেশনে যোগ দেয়া থেকে বিরত রয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি গা বাঁচাতে
চেয়েছেন। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যে নৃশংসতার বর্ণনা
দিয়েছেন, যেসব ভিডিও তারা দেখাচ্ছেন মোবাইলে সে সবই কি মিথ্যা! এপারে নাফ
নদের ধার থেকে ওপারে রাখাইনে গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার যে দৃশ্য দেখা গেছে,
কালো ধোঁয়া আকাশকে গ্রাস করতে দেখা গেছে- সে সব কি মিথ্যা! সুচি জানেন ওই
এলাকায় সাংবাদিক, পর্যবেক্ষকদের প্রবেশ করতে দিলে তার সরকারের মুখোশ
উন্মোচিত হয়ে যাবে। আর এই এক মাস নিশ্চয় হত্যা করা মানুষগুলোর লাশ গুম করে
দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তবে কি এটা ধরে নিতে হবে, গত প্রায় এক মাস ওই এলাকায়
কোনো সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক প্রবেশ করতে না দেয়ার অর্থ হলো ওই লাশগুলো গায়েব
করে দেয়া, যাতে তাদের কোনো নাম-নিশানা না থাকে! পুড়িয়ে দেয়া গ্রামগুলোর
ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে ফেলার জন্য এ সময় নেয়া হচ্ছে! সুচি আন্তর্জাতিক
পর্যবেক্ষণকে তোয়াক্কা করেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। হ্যাঁ, এমন কথা
রাজনীতির ভাষায় কার মুখে মানায় তা নিশ্চয়ই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত অং সান
সুচির জানার কথা। কারণ, তিনি জীবনে ১৫ বছর জেলে কাটিয়েছেন। তিনি জানবেন না
তো কে জানবে! সুচি তার বক্তব্যে একটিবারের জন্য ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ
করেন নি। এর অর্থ কি! তিনি তাহলে কাদের নিয়ে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস
দিয়েছেন! তিনি ও তার সরকার, সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক
হিসেবে দেখে না। তারা রোহিঙ্গাদের দেখে বাঙালি অথবা সন্ত্রাসী হিসেবে। তিনি
যে, এখনো সেই অবস্থানেই আছেন, ভাষণের মধ্যে একটিবার রোহিঙ্গা শব্দটি
উচ্চারণ না করে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন এবং তার সরকার দেশত্যাগীদের শরণার্থী
মর্যাদার প্রক্রিয়াটি যাচাই করতে প্রস্তুত বলে জানানো হয়েছে। রোহিঙ্গারা
যদি শরণার্থী হন তাহলে তাদের দেশ কোন্টি! তার যাচাই বাছাই প্রক্রিয়া কি
হবে সে বিষয়ে তিনি স্পষ্ট করেন নি। কি পরিমাণ ‘শরণার্থী’ ফেরত নেবেন তাও
তিনি বলেন নি। যদি তার যাচাই বাছাই প্রক্রিয়ায় দুই হাজার রোহিঙ্গা টেকেন
তাহলে তাদেরকেই তিনি নেবেন! বাকিদের কি হবে! মনে রাখার কথা, ১৯৮২ সালে
মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বাইরে রাখা হয়। তাদের
কোনো স্বাধীনতা নেই। এমন কি নিজের গ্রাম থেকে বাইরে বের হওয়ার অনুমতি নেই। এ
নিয়ে বিশ্ব দরবারে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা, সমালোচনা। এবার যে পরিমাণে
বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে এর আগে এতটা হয়নি। দৃশ্যত রোহিঙ্গা সংকট সমাধান একটি
দীর্ঘ প্রক্রিয়া বা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। এ অবস্থায় সচেতন অনেকেই বলছেন,
রাখাইন ও রোহিঙ্গা সংকট কি তবে ফিলিস্তিন, কাশ্মীরের মতো রূপ নিতে যাচ্ছে!
যেখানে বহুপক্ষ জড়িত। মাঝখান দিয়ে দুর্ভোগে বাংলাদেশ। অং সান সুচি ভাষণ
দেয়ার পরে আবার মুখ খুলেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টনিও গুতেরাঁ, বৃটিশ
প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোন,
নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ বুহারি। তারা অবিলম্বে রাখাইনে সেনা
অভিযান বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। আর মিয়ানমারের সেনাদের প্রশিক্ষণ আপাতত
বন্ধ করে দিয়েছে বৃটেন। এবারের জাতিসংঘ অধিবেশনে এই রোহিঙ্গা, রাখাইন ইস্যু
বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে কথা বলছেন বিশ্ব নেতারা। সেখানে বাংলাদেশের
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সোচ্চার রয়েছেন। বিশ্বের অনেকের টনক নড়েছে।
কিন্তু টনক নড়েনি চীন ও ভারতের। মিয়ানমারকে সমর্থন দেয়ার কথা প্রকাশ্যে বলে
দিয়েছে চীন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রোহিঙ্গা সংকটের ভেতরে
মিয়ানমার সফরে গিয়ে সুচির সঙ্গে অভিন্ন অবস্থান জানিয়ে এসেছেন। মিয়ানমার
হলো চীন, রাশিয়া, ইসরাইল, বৃটেন সহ আরো অনেক দেশের অস্ত্রের বাজার। তাছাড়া
আঞ্চলিক রাজনীতির কৌশলে কেউ কাউকে নাহি ছাড়ি অবস্থা। এতে সংকট ঘনীভূত
হচ্ছে। কক্সবাজার উপকূলে আর্তনাদ ভারি হচ্ছে। রাখাইনের বাতাসে পোড়া গন্ধ
ছড়াচ্ছে। সে গন্ধ সুচির নাকে লাগছে না। তাই তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে মঙ্গলবার
কূটনীতিকদের জড়ো করে তার অবস্থান প্রকাশ করলেন। কিন্তু কেবলই বিশ্বকবি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের দুটো লাইন মনে পড়ছে- ‘অনেক কথা যাও যে বলে কোনো
কথা না বলি, তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি’।
No comments