‘তৃতীয় শ্রেণী বা সারি’র নয় বঙ্গবন্ধু বাঙালীর শীর্ষ নেতা by এম. নজরুল ইসলাম
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিশাল জয় নিয়ে
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর
থেকেই একটি চিহ্নিত গোষ্ঠি সরকারের ছিদ্রান্বেষণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
পরাজিত শক্তি দেশে ও বিদেশে সরকারের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালিয়ে
সরকারের জনপ্রিয়তা নষ্ট করতে সচেষ্ট। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঠিক
একই ধরনের অপচেষ্টা হয়েছিল। সেবারও দেশী-বিদেশী চক্র সরকারের জনপ্রিয়তা
নষ্ট করার অপচেষ্টা চালায়। অপশক্তির টার্গেট হয়েছিলেন বাঙালীর প্রিয় নেতা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এবারও মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই
চিহ্নিত অপশক্তি টার্গেট করেছে শেখ হাসিনাকে। কারণ, শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা
মহাজোটকে এতটা পথ অতিক্রম করতে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে। তিনি তাঁর বাবার
মতই দূরদর্শী ও দেশপ্রেমিক। মনেপ্রাণে তিনি খাঁটি স্টেটসম্যান। মহাজোট
সরকারের জনপ্রিয়তার পারদ উর্ধমুখী করে রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ফলে অপশক্তি সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তাকে খাটো করার
অপচেষ্টায় লিপ্ত। এর জন্য দেশে-বিদেশে বুদ্ধিজীবীদের ভাড়া করা হয়েছে।
মিডিয়াকে ব্যবহার করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়াকেও এ বিষয়ে ব্যবহার করা
হচ্ছে।
বাংলাদেশেও অনেকে সরাসরি শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারে বিরুদ্ধে কথা বলে থাকেন। সরকার কিংবা সরকারপ্রধানের গঠনমূলক সমালোচনা সবসময়ই কাম্য; বিশেষ করে সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয়ার জন্য মিডিয়ার ভূমিকাকে সবসময় ইতিবাচকভাবেই দেখা হয়। মানুষ মিডিয়ার ওপর আস্থা রাখতে চায়। কিন্তু অনেক মিডিয়া ও মিডিয়া-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ভাড়াটেদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে চিন্তিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। সাংবাদিক এবিএম মূসা বাংলাদেশের মিডিয়া জগতের এক পরিচিত মুখ। তাঁর ধারালো কলাম একসময় সাড়া জাগিয়েছিল। একজন সাংবাদিক-কলামিস্ট হিসেবে এবিএম মূসার পাঠকপ্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নেই। অবশ্যই তিনি সেই মাপের কলাম লেখক যিনি ‘ক্যারি দ্য রিডার্স’ বা পাঠককে টেনে নিয়ে যাওয়ার দক্ষতা অর্জন করেছেন বা সেই যোগ্যতা রাখেন। সাংবাদিক, বিশেষ করে কলামিস্টদের লেখা তাঁদের ভক্ত-পাঠকদের অনেকেই সত্য বলে জানেন। ফলে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বা এবিএম মূসাদের মতো খ্যাতিমান কলামিস্টদের লেখা নিয়ে আলোচনা হবে। তাঁদের মন্তব্য এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
বেশ কিছুদিন থেকেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে, প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবিএম মূসা তাঁর কলামে ও টেলিভিশনে প্রচারিত ‘টক-শো’তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকার সম্পর্কে যা বলছেন, তা অপপ্রচারের পর্যায়েই পড়ে। তিনি যেন বর্তমান সরকারের বিষোদগার করার কিংবা সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস নামানোর ব্রত নিয়েই মাঠে নেমেছেন। তাঁর কলাম পড়ে, বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত ‘টক-শো’তে তাঁর মন্তব্য শুনলে এমন ধারণা হওয়া একেবারেই অসম্ভব নয়। অনেকের ধারণা, বর্তমান সরকারের আমলে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের লাইসেন্স চেয়ে না পাওয়ায় এবিএম মূসা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এরপর থেকেই তিনি আওয়ামী লীগ, প্রধানমন্ত্রী ও মহাজোট সরকার সম্পর্কে প্রকাশ্য অপপ্রচারে নেমে গেছেন বলে অনেকে মনে করেন। একটা ছোট উদাহরণ দেয়া যাক। গত ৪ সেপ্টেম্বর ২০১২, একটি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত টক-শোতে তিনি বলেন, ‘এই সরকারের যাকে যেখানে দেখা যাবে তাকেই লক্ষ্য করে সেøাগান দিয়ে বলতে হবে, তুই চোর, তুই চোর।’ আশির দশকে বিটিভিতে প্রচারিত প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের দর্শকপ্রিয় একটি ধারাবাহিক নাটকের জনপ্রিয় সংলাপের অনুকরণে তিনি এই সংলাপটি জনপ্রিয় করতে চেয়েছিলেন। সফল হতে না পেরে নতুন উদ্যমে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে নতুন অপপ্রচার চালিয়েছেন। কোনটিই দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি। এবার শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারকে ছেড়ে সরাসরি তিনি আক্রমণ করে বসেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। গত ২৪ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে প্রাক্তন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান দিবসে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক আলোচনায় এবিএম মূসা বলেন, ৬-দফা প্রণয়নের সময় ‘বঙ্গবন্ধু তৃতীয় শ্রেণীর নেতা ছিলেন।’ মিডিয়াতে তাঁর বক্তব্য এভাবেই আসে। সঙ্গে সঙ্গে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে এর প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। সব মহল থেকেই এবিএম মূসার এই উক্তির প্রতিবাদে ধিক্কার জানানো হয়। ২৭ জানুয়ারি এক টেলিভিশন চ্যানেলের টক শোতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এবিএম মূসা বলেন, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এটা বললেও মানতে রাজি, তবে বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী নই। আমি বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী- এ কথা জঘন্যতম গালি দেয়ার চেয়ে বেশি বলা।’ তিনি ওই টক শোতে আরো উল্লেখ করেন, বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী হলে তিনি নাকি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘মুজিব ভাই’ শিরোনামে বই লিখতেন না। বঙ্গবন্ধু আমাকে বিটিভির ডিজি বা সংসদ সদস্য বানাতেন না, এমন কথাও বলেছেন তিনি। এবিএম মূসা বলেন, ‘সেমিনারে বঙ্গবন্ধুকে তৃতীয় শ্রেণীর নয়, তৃতীয় সারির নেতা বলেছিলাম...।’
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে এহেন বক্তব্য এবিএম মূসার মুখ থেকে বেরিয়ে আসায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। তিনি যে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। এবিএম মূসার বর্তমান কিংবা বিগতকালের সামাজিক অবস্থানের কাছে বঙ্গবন্ধু যে কোনোকালেই তৃতীয় শ্রেণীর বা সারির নেতা ছিলেন না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনে প্রথমবারের মতো মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন ১৯৫৪ সালের ১৫ মে। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার কৃষিঋণ, সমবায় ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ, কংগ্রেস, তফসিলী ফেডারেশন ও গণতন্ত্রী পার্টি- এই চার দল মিলে যে সরকার গঠন করে সে সরকারের বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প এবং দুর্নীতি দমন মন্ত্রী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
লাহোরে পাকিস্তানের সম্মিলিত বিরোধী দলের সভায় ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাঙালীর মুক্তিসনদ ৬-দফা প্রস্তাব পেশ করেন। বঙ্গবন্ধুর ৬-দফার প্রতি জনগণের বিপুল সমর্থন লক্ষ্য করে জে. আইয়ুব খানের সরকার তাঁর ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হয় এবং অবশেষে তাঁকে পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের আওতায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারারুদ্ধ করে ১৯৬৬ সালের ৮ মে। তিনি ১৯৫৪ সালে পূর্ণ মন্ত্রী, ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রধান দলের সাধারণ সম্পাদক, তিনি নিশ্চয়ই ছয়দফা আন্দোলনের সময় ‘তৃতীয় শ্রেণী’ বা এবিএম মূসা সংশোধিত ‘তৃতীয় সারি’র নেতা ছিলেন না। তাহলে এবিএম মূসার মুখ ফসকে কথাটি বেরিয়ে গেছে? না। সুবিধা না পেয়েই ক্রোধের আগুনে জ্বলছেন তিনি। সব সরকারের আমলে সব ধরনের সুবিধা ভোগ করে আসা এই সাংবাদিকের কনিষ্ঠ কন্যা আওয়ামী লীগের গত সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধু বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেষ্টারে লেখাপড়া করতে যান। সরকার বদলের পর সেই বৃত্তি বন্ধ হয়ে যায়। তাতে অনেকের উচ্চশিক্ষায় বাধা পড়লেও এবিএম মূসার কন্যার উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বিঘœ ঘটেনি। ঢাকার সাংবাদিক মহলে প্রচলিত গল্প এরকম, এবিএম মূসা মওদুদ আহমদকে হাত করে তারেক জিয়াকে বাংলার ভবিষ্যৎ তরুণ নেতৃত্ব উল্লেখ করে সংবাদপত্রে নিবন্ধ লিখে তাঁর কন্যার বৃত্তি বজায় রাখেন।
দেবতুল্য হৃদয়ের মানুষ বঙ্গবন্ধু অনেকের দোষত্রুটি ক্ষমা করেছেন। অনেককেই কাছে টেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু এবিএম মূসা কি শুরুতে ও শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর অনুসারী ছিলেন বা আছেন? তাঁকে নিয়ে অনেক গল্প চালু আছে বাজারে। কিভাবে সুবিধা আদায় করতে হয়, সে ব্যাপারে এবিএম মূসার দক্ষতা নিয়ে ঢাকার সাংবাদিক মহলে অনেক গল্প চালু আছে। যেমন মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। ১৯৭১ সালের দু-একটি ঘটনা এখানে তুলে ধরা যাক।
২৭ জানুয়ারি টেলিভিশন টক-শোতে এবিএম মূসা বলেছেন, ‘এশিয়ান নিউজ এজেন্সির চাকরি নিয়ে হংকং যাই। সেখানে গিয়ে পাকিস্তানের পাসপোর্ট ফেলে দেই। সমগ্র পূর্ব এশিয়ায় আমি বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার চালাই সে সময়।’ প্রশ্ন উঠতে পারেÑ হংকংয়ে পাসপোর্ট ফেলে দিলে তিনি সেখান থেকে কলকাতা গেলেন কী করে? বিনা পাসপোর্টে কেমন করে তিনি দুটি বিমানবন্দর অতিক্রম করলেন? এমন তো নয় যে, কারও চেহারা দেখে বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন বিভাগ বিমানে উঠতে দেয় বা কোনো দেশে ঢুকতে দেয়। তিনি আরো বলেছেন, বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার চালিয়েছেন। ঐ সময়ে তাঁর পাঠানো প্রতিবেদনই প্রমাণ করে তিনি কোন্ পক্ষ নিয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের ১৬ জুন লন্ডনের ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকায় এশিয়ান নিউজ সার্ভিসের দেয়া একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ঐ প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছিলেন এবিএম মূসা। সেই প্রতিবেদনের হুবহু বঙ্গানুবাদ এখানে তুলে ধরা হলোÑ‘ঢাকা : পূর্ব পাকিস্তানে শৃঙ্খলা পুনর্প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে নিশ্চিত হয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় শাসনকার্য পরিচালনার জন্য বেসামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করছেন। গত সপ্তাহের শেষ দিকে পুলিশ বাহিনী সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে ঢাকায় শান্তিরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করার মাধ্যমে তাঁর পরিকল্পনার প্রথম ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মার্চ মাসে জরুরী অবস্থা ঘোষণার পর রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা দশ লাখ থেকে পাঁচ লাখে পৌঁছায়। বর্তমানে নাগরিকরা ধীরে ধীরে ফিরে আসতে শুরু করেছে। বাজারগুলো পুনরায় চালু হচ্ছে এবং সামরিক কর্মকা-ের ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত কয়েকটি অধিকতর কর্মব্যস্ত বাজারের দোকানদাররা জোড়াতালি দিয়ে তাদের দোকান পুনরায় চালু করেছে।
মফঃস্বলের বিভিন্ন এলাকায় শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব বেসরকারী কর্মকর্তা ও পুলিশের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এমন কি মুক্তিফৌজ (মুক্তিবাহিনী) যেখানে বোমা নিক্ষেপ করেছে বলা হয়, সেখানে নিয়মিত সামরিক বাহিনী কিংবা তাদের গোয়েন্দা বাহিনীর পরিবর্তে পুলিশ বাহিনী তদন্তকার্য পরিচালনা করে। ২৬ মার্চ জারি করা কারফিউ সম্পর্কিত নির্দেশ গত শুক্রবার প্রত্যাহার করা হয়।
চট্টগ্রাম, খুলনা, ময়মনসিংহ এবং কুমিল্লাসহ পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান শহরগুলো এবং ছোট ছোট শহরেও বেসামরিক কর্তৃপক্ষ শাসনভার গ্রহণ করেছে। শহরগুলোতে সামরিক অভিযান পরিচালনার পর তারা যে-সব গ্রামে আক্রমণ চালায় সেখানে স্থানীয় পুলিশ বাহিনী সেতু ও রেললাইন পাহারার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ এবং আড়াল থেকে গুলি চালানোর বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় পাহারার দায়িত্ব পালন ছাড়াও মুক্তিফৌজ কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা ধ্বংসপ্রাপ্ত সেতু, রাস্তাঘাট এবং রেললাইন মেরামত ও পুনর্নির্মাণ কাজে সামরিক বাহিনী নিয়োজিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাটের অধিকাংশ পুরোপুরি মেরামত করা হয়েছে, কিন্তু যাতায়াত ও মালপত্র পরিবহন প্রধানত নৌ-পরিচালনার ওপর নির্ভরশীল। মাসের পর মাস যে-সব লঞ্চ ও ফেরি অকেজো হয়ে পড়েছিল এবং আওয়ামী লীগের সদস্যরা যে-সব জলযান ডুবিয়ে দিয়েছিল, সেসব উদ্ধার করে নদী-পরিবহন ব্যবস্থা পুনরায় চালু করা হচ্ছে।
আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে দেশে স্বাভাবিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাঁর পরিকল্পনার আভাস দান করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে দেশের পূর্বাঞ্চলসহ প্রদেশগুলোকে বৈদেশিক সম্পর্ক, দেশরক্ষা, মুদ্রানীতি, বিদেশ-বাণিজ্য এবং বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া অন্য সব বিষয় সম্পর্কিত অধিকার প্রদানের জন্য তিনি মনস্থির করছেন।
জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আওয়ামী লীগ টিকেটে নির্বাচিত ১৬৭ সদস্যের মধ্যে আনুমানিক ২৫ জন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সহযোগিতা করবেন বলে আভাস দিয়েছেন। সামরিক সরকার প্রদত্ত ব্যাপক ক্ষমা (অ্যামনেস্টি) প্রদানের ঘোষণা জারি হওয়ার ফলে অন্য সদস্যরা উৎসাহী হয়ে উল্লিখিত ২৫ জনের সঙ্গে যোগ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
যাঁরা উল্লিখিত রাজনীতিবিদদের একত্রিত হওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা এবং পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মি. এইচ এস সোহরাওয়ার্দীর কন্যা বেগম আখতার সোলায়মান। তিনি আশা করেন, রাজনীতিবিদদের যদি প্রয়োজনীয় আশ্বাস দেয়া হয়, তা’ হলে জাতীয় পরিষদের প্রায় ১০০ জন সদস্য এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ জন সদস্যের মধ্যে ২০০ জন সহায়তা করতে রাজি হবেন। উল্লিখিত সংখ্যক সদস্যের সম্মতি পাওয়া গেলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পক্ষে বেসামরিক শাসনব্যবস্থা সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা সহজতর হবে বলে মনে হচ্ছে।
পরিষদের সদস্যপদ ত্যাগকারীদের নির্বাচনী এলাকায় তিনি প্রথমে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশদান করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কিন্তু পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি। এমন কি অনুমোদনপ্রাপ্ত সদস্যদের পুরনো পার্টির পতাকা ব্যবহার করার সম্মতিদান করা যেতে পারে। অতঃপর প্রেসিডেন্ট তাঁর সংবিধান সম্পর্কিত প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য জাতীয় সংসদে পেশ করবেন। ইতোমধ্যে দু’জন বিশেষজ্ঞ নতুন সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। তাঁরা হলেন, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রী মি. জাস্টিস্ কর্নেলিয়াস এবং প্রাক্তন এ্যাটর্নি জেনারেল ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি মন্জুর কাদির।
ঢাকার জনৈক মধ্যবিত্ত বাঙালী কেরানীর মন্তব্য থেকে পরিস্থিতি আঁচ করা যায়। তিনি বলেন: “আমরা শান্তি চাই, বাংলাদেশ না পাকিস্তান তা আমরা জানতে চাই না। (এশিয়ান নিউজ সার্ভিস)’ প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল “ পুলিশ বাহিনী ঢাকায় শান্তিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত”।
উল্লিখিত প্রতিবেদনটি লন্ডনের দ্য টাইমস পত্রিকা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, সিঙ্গাপুরের দ্য স্ট্রেট টাইমস ও ফিলিপিন্সের দি ম্যানিলা টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর এই নিউজ সার্ভিস বিলুপ্ত হয়। কার অর্থায়নে এবং কোন উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠানটি রাতারাতি ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছিল, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ হিসেবে পরিচয়দানকারী এবিএম মূসা এমন প্রতিবেদন লিখলেন কী করে? এমন একটি প্রতিবেদন লেখার পরও তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ?
তখনকার দিনের রাজনীতিক ও সাংবাদিকদের সবাই জানেন যে, ওই প্রতিবেদনটি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর এবিএম মূসা (তখন তিনি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভারের বার্তা-সম্পাদক) সামরিক কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে সপরিবারে ঢাকা থেকে বিমানযোগে হংকং হয়ে কলকাতায় উপস্থিত হন। এই প্রসঙ্গে স্মরণে রাখতে হবে, পাকিস্তানী সেনাদের নির্যাতন এড়াবার জন্য যারা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন, তারা হেঁটে বেআইনীভাবে বাংলাদেশের সীমানা পার হয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু এবিএম মূসা সপরিবারে রাজার হালে কলকাতা গিয়েছিলেন।
কলকাতা গিয়ে তিনি “ইকোনমিক টাইম্স্”-র কলকাতা অফিসের সম্পাদক জ্যোতি সেনগুপ্তের শরণাপন্ন হন। উল্লেখ্য, ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে জ্যোতি সেনগুপ্ত ঢাকায় বেশ কিছুকাল ছিলেন। ঐ সময় এবিএম মূসাসহ অনেকের সঙ্গেই তাঁর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই বন্ধুত্বের খাতিরে তিনি দমদম এয়ারপোর্টের কাছে লেকটাউন উপশহরে তাঁর বাড়ির কাছে এবিএম মূসার সপরিবারে বসবাসের জন্য মাসিক কয়েক হাজার টাকা ভাড়ায় একটি একতলা বড় বাড়ির ব্যবস্থা করে দেন। ঐ সময় কয়েক হাজার টাকা মানে অনেক টাকা, তার সঙ্গে খাওয়া এবং অন্যান্য খরচও আছে। এত টাকা মূসা সাহেবকে কারা দিয়েছিল, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি কলকাতা গিয়েছিলেন? মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময় এবিএম মূসার কলকাতায় উপস্থিত হওয়া এবং ওখানে তাঁর তৎপরতা এখানো অনেকের কাছেই রহস্যজনক বলে মনে হয়।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত এ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেছেন। যেখানে বলা হয়েছে, ঢাকা থেকে আগত জনৈক সংবাদদাতা পাকিস্তানে ফিরে যাচ্ছেন বলে গুজব শুনতে পান তিনি। এ সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সরকারের সেক্রেটারিয়েট, পররাষ্ট্র দফতরের অফিস, জয় বাংলা পত্রিকা অফিস ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গিয়ে প্রকৃত তথ্য জানার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সাক্ষাতপ্রার্থী হন সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত। প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও সাক্ষাতকারদানের সম্মতি জানান।
তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দুপুরে খাওয়ার সময় সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচার, ঢাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি ইত্যাদি সম্পর্কে অনেকক্ষণ আলাপ করেন। আলোচনাকালে হঠাৎ তিনি জানতে চাইলেন, ঢাকা থেকে আসা খ্যাতনামা সাংবাদিককে সাক্ষাতকারদানের অনুরোধ তাজউদ্দীন আহমদ কেন প্রত্যাখ্যান করেছেন?
তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে এর পরের কথাগুলোতে অনেকে চমৎকৃত হতে পারেন। সুখরঞ্জন দাসগুপ্তের এ প্রশ্নের জবাবে তাজউদ্দীন আহমদ তাঁকে বলেন, ‘কী ধরনের সাংবাদিক আপনি? ঐ সাংবাদিক একটি পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে এসেছেন। আপনি কি লক্ষ্য করেননি, কত সহজে তিনি আমাদের পররাষ্ট্র দফতরের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছেন? তাজউদ্দীন আহমদ পররাষ্ট্র দফতরের কথা উল্লেখ করার ফলে সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত নতুন প্রশ্ন করার সুযোগ পেলেন। তিনি বিশেষ করে ষড়যন্ত্রের কথা জানতে চাইলেন। তাজউদ্দীন সাহেব কিছুক্ষণ চিন্তাগ্রস্ত থেকে বললেন, ‘অপেক্ষা করুন, আমি হাত ধুয়ে এসে আপনাকে গোপন নথিপত্র সংবলিত ‘ফাইল’ দেখার সুযোগ দেব।’ হাত ধুয়ে এসে তিনি আলমারি থেকে ‘অত্যন্ত গোপনীয়’ লেখা লাল মলাটের একটি ‘ফাইল’ খুলে পৃষ্ঠাগুলো খুঁটিয়ে দেখলেন। তিনি বললেন, এই ‘ফাইল থেকে আপনি তথ্য টুকে নিতে পারেন, কিন্তু আপাতত এসব প্রকাশ করবেন না। সুখরঞ্জন দাসগুপ্তের ‘মিডনাইট ম্যাসাকার ইন ঢাকা’ বইয়ের ১২ পৃষ্ঠায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ আছে।
তাজউদ্দীন আহমদ ও সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত ঢাকা থেকে আগত সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করেননি। ১৬ জুন, ১৯৭১ লন্ডনের দ্য টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, ঐ সাংবাদিক এবিএম মূসা ছাড়া আর কেউ নন। জেনারেল এম এ জি ওসমানীও ঢাকা থেকে আগত সাংবাদিককে সাক্ষাতকার দিতে রাজি হননি। মুক্তি বাহিনীর অগ্রগতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য যে সব দেশী-বিদেশী সাংবাদিক মুজিবনগর সরকারের উদ্যোগে মুক্তাঞ্চল সফর করেন, তাদের সঙ্গে এবিএম মূসার যোগদানের ব্যাপারে জেনারেল ওসমানী নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এমন কথাও শোনা যায়, এবিএম মূসা কলকাতা যাওয়ার কিছুকাল পর তাঁর আপত্তিকর কর্মতৎপরতার কারণে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাঁর ভাড়া বাসা থেকে টাইপ মেশিন ও সংবাদ প্রেরণের অন্যান্য সরঞ্জামসহ তাঁকে নিয়ে যায়। তিন দিন পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁকে ছাড়িয়ে আনেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সব খবর রাখতেন। হিমালয়সম হৃদয়ের অধিকারী বঙ্গবন্ধুর ক্ষমা ও কৃপায় এবিএম মূসা একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন। আওয়ামী লীগের টিকেটে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন তিনি। বঙ্গবন্ধু সরকারের কাছ থেকে অনেক সুবিধা নিয়েছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে বিদেশ সফর করেছেন। তারপরও তৃপ্ত নন এবিএম মূসা। আরও বড় প্রাপ্তিযোগের আশা ছাড়তে নারাজ তিনি। ঢাকার সাংবাদিক মহলে এ কথা প্রচলিত আছে যে, বঙ্গবন্ধৃ- কন্যা শেখ হাসিনা সরকার থেকে টেলিভিশন কেন্দ্রের লাইসেন্সসহ আরো অনেক সুবিধা আদায় করতে না পারায় ক্ষিপ্ত তিনি। একাত্তরের শুরুতে তিনি যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, আবার অবতীর্ণ হয়েছেন সে ভূমিকায়। বর্তমান সরকারের অনন্য সাফল্যগুলোকে ম্লান করে বিরোধী পক্ষের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে চান। তাই এ বয়সে এসেও সত্যের অপলাপ করে চলেছেন। মুক্ত বাজারের দুনিয়ায় সংবাদও যখন বিক্রয়যোগ্য পণ্য, তখন এবিএম মূসাদের উক্তি, তা যতই সত্যের অপলাপ হোক না কেন, আলোচনার খোরাক যোগায়। কিন্তু এভাবে সত্যকে বিকৃত করলেই কি সেটা মানুষের বিশ্বাসে গেঁথে যাবে? না। এবিএম মূসাদের সে উদ্দেশ্য কোনদিন সফল হবে না। কারণ বাঙালীর মনে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান কোনদিন এবিএম মূসা কথিত ‘তৃতীয় শ্রেণী বা সারি’র নয়। বঙ্গবন্ধু বাঙালীর শীর্ষ নেতা। বাঙালীর মন ও মনন থেকে বঙ্গবন্ধুর এই রাজনৈতিক অবস্থান কেউ নষ্ট করতে পারবে না।
লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকার কর্মী, লেখক ও সাংবাদিক
nazrul@gmx.at
বাংলাদেশেও অনেকে সরাসরি শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারে বিরুদ্ধে কথা বলে থাকেন। সরকার কিংবা সরকারপ্রধানের গঠনমূলক সমালোচনা সবসময়ই কাম্য; বিশেষ করে সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয়ার জন্য মিডিয়ার ভূমিকাকে সবসময় ইতিবাচকভাবেই দেখা হয়। মানুষ মিডিয়ার ওপর আস্থা রাখতে চায়। কিন্তু অনেক মিডিয়া ও মিডিয়া-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ভাড়াটেদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে চিন্তিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। সাংবাদিক এবিএম মূসা বাংলাদেশের মিডিয়া জগতের এক পরিচিত মুখ। তাঁর ধারালো কলাম একসময় সাড়া জাগিয়েছিল। একজন সাংবাদিক-কলামিস্ট হিসেবে এবিএম মূসার পাঠকপ্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নেই। অবশ্যই তিনি সেই মাপের কলাম লেখক যিনি ‘ক্যারি দ্য রিডার্স’ বা পাঠককে টেনে নিয়ে যাওয়ার দক্ষতা অর্জন করেছেন বা সেই যোগ্যতা রাখেন। সাংবাদিক, বিশেষ করে কলামিস্টদের লেখা তাঁদের ভক্ত-পাঠকদের অনেকেই সত্য বলে জানেন। ফলে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বা এবিএম মূসাদের মতো খ্যাতিমান কলামিস্টদের লেখা নিয়ে আলোচনা হবে। তাঁদের মন্তব্য এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
বেশ কিছুদিন থেকেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে, প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবিএম মূসা তাঁর কলামে ও টেলিভিশনে প্রচারিত ‘টক-শো’তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকার সম্পর্কে যা বলছেন, তা অপপ্রচারের পর্যায়েই পড়ে। তিনি যেন বর্তমান সরকারের বিষোদগার করার কিংবা সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস নামানোর ব্রত নিয়েই মাঠে নেমেছেন। তাঁর কলাম পড়ে, বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত ‘টক-শো’তে তাঁর মন্তব্য শুনলে এমন ধারণা হওয়া একেবারেই অসম্ভব নয়। অনেকের ধারণা, বর্তমান সরকারের আমলে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের লাইসেন্স চেয়ে না পাওয়ায় এবিএম মূসা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এরপর থেকেই তিনি আওয়ামী লীগ, প্রধানমন্ত্রী ও মহাজোট সরকার সম্পর্কে প্রকাশ্য অপপ্রচারে নেমে গেছেন বলে অনেকে মনে করেন। একটা ছোট উদাহরণ দেয়া যাক। গত ৪ সেপ্টেম্বর ২০১২, একটি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত টক-শোতে তিনি বলেন, ‘এই সরকারের যাকে যেখানে দেখা যাবে তাকেই লক্ষ্য করে সেøাগান দিয়ে বলতে হবে, তুই চোর, তুই চোর।’ আশির দশকে বিটিভিতে প্রচারিত প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের দর্শকপ্রিয় একটি ধারাবাহিক নাটকের জনপ্রিয় সংলাপের অনুকরণে তিনি এই সংলাপটি জনপ্রিয় করতে চেয়েছিলেন। সফল হতে না পেরে নতুন উদ্যমে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে নতুন অপপ্রচার চালিয়েছেন। কোনটিই দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি। এবার শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারকে ছেড়ে সরাসরি তিনি আক্রমণ করে বসেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। গত ২৪ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে প্রাক্তন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান দিবসে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক আলোচনায় এবিএম মূসা বলেন, ৬-দফা প্রণয়নের সময় ‘বঙ্গবন্ধু তৃতীয় শ্রেণীর নেতা ছিলেন।’ মিডিয়াতে তাঁর বক্তব্য এভাবেই আসে। সঙ্গে সঙ্গে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে এর প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। সব মহল থেকেই এবিএম মূসার এই উক্তির প্রতিবাদে ধিক্কার জানানো হয়। ২৭ জানুয়ারি এক টেলিভিশন চ্যানেলের টক শোতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এবিএম মূসা বলেন, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এটা বললেও মানতে রাজি, তবে বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী নই। আমি বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী- এ কথা জঘন্যতম গালি দেয়ার চেয়ে বেশি বলা।’ তিনি ওই টক শোতে আরো উল্লেখ করেন, বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী হলে তিনি নাকি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘মুজিব ভাই’ শিরোনামে বই লিখতেন না। বঙ্গবন্ধু আমাকে বিটিভির ডিজি বা সংসদ সদস্য বানাতেন না, এমন কথাও বলেছেন তিনি। এবিএম মূসা বলেন, ‘সেমিনারে বঙ্গবন্ধুকে তৃতীয় শ্রেণীর নয়, তৃতীয় সারির নেতা বলেছিলাম...।’
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে এহেন বক্তব্য এবিএম মূসার মুখ থেকে বেরিয়ে আসায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। তিনি যে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। এবিএম মূসার বর্তমান কিংবা বিগতকালের সামাজিক অবস্থানের কাছে বঙ্গবন্ধু যে কোনোকালেই তৃতীয় শ্রেণীর বা সারির নেতা ছিলেন না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনে প্রথমবারের মতো মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন ১৯৫৪ সালের ১৫ মে। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার কৃষিঋণ, সমবায় ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ, কংগ্রেস, তফসিলী ফেডারেশন ও গণতন্ত্রী পার্টি- এই চার দল মিলে যে সরকার গঠন করে সে সরকারের বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প এবং দুর্নীতি দমন মন্ত্রী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
লাহোরে পাকিস্তানের সম্মিলিত বিরোধী দলের সভায় ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাঙালীর মুক্তিসনদ ৬-দফা প্রস্তাব পেশ করেন। বঙ্গবন্ধুর ৬-দফার প্রতি জনগণের বিপুল সমর্থন লক্ষ্য করে জে. আইয়ুব খানের সরকার তাঁর ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হয় এবং অবশেষে তাঁকে পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের আওতায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারারুদ্ধ করে ১৯৬৬ সালের ৮ মে। তিনি ১৯৫৪ সালে পূর্ণ মন্ত্রী, ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রধান দলের সাধারণ সম্পাদক, তিনি নিশ্চয়ই ছয়দফা আন্দোলনের সময় ‘তৃতীয় শ্রেণী’ বা এবিএম মূসা সংশোধিত ‘তৃতীয় সারি’র নেতা ছিলেন না। তাহলে এবিএম মূসার মুখ ফসকে কথাটি বেরিয়ে গেছে? না। সুবিধা না পেয়েই ক্রোধের আগুনে জ্বলছেন তিনি। সব সরকারের আমলে সব ধরনের সুবিধা ভোগ করে আসা এই সাংবাদিকের কনিষ্ঠ কন্যা আওয়ামী লীগের গত সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধু বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেষ্টারে লেখাপড়া করতে যান। সরকার বদলের পর সেই বৃত্তি বন্ধ হয়ে যায়। তাতে অনেকের উচ্চশিক্ষায় বাধা পড়লেও এবিএম মূসার কন্যার উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বিঘœ ঘটেনি। ঢাকার সাংবাদিক মহলে প্রচলিত গল্প এরকম, এবিএম মূসা মওদুদ আহমদকে হাত করে তারেক জিয়াকে বাংলার ভবিষ্যৎ তরুণ নেতৃত্ব উল্লেখ করে সংবাদপত্রে নিবন্ধ লিখে তাঁর কন্যার বৃত্তি বজায় রাখেন।
দেবতুল্য হৃদয়ের মানুষ বঙ্গবন্ধু অনেকের দোষত্রুটি ক্ষমা করেছেন। অনেককেই কাছে টেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু এবিএম মূসা কি শুরুতে ও শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর অনুসারী ছিলেন বা আছেন? তাঁকে নিয়ে অনেক গল্প চালু আছে বাজারে। কিভাবে সুবিধা আদায় করতে হয়, সে ব্যাপারে এবিএম মূসার দক্ষতা নিয়ে ঢাকার সাংবাদিক মহলে অনেক গল্প চালু আছে। যেমন মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। ১৯৭১ সালের দু-একটি ঘটনা এখানে তুলে ধরা যাক।
২৭ জানুয়ারি টেলিভিশন টক-শোতে এবিএম মূসা বলেছেন, ‘এশিয়ান নিউজ এজেন্সির চাকরি নিয়ে হংকং যাই। সেখানে গিয়ে পাকিস্তানের পাসপোর্ট ফেলে দেই। সমগ্র পূর্ব এশিয়ায় আমি বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার চালাই সে সময়।’ প্রশ্ন উঠতে পারেÑ হংকংয়ে পাসপোর্ট ফেলে দিলে তিনি সেখান থেকে কলকাতা গেলেন কী করে? বিনা পাসপোর্টে কেমন করে তিনি দুটি বিমানবন্দর অতিক্রম করলেন? এমন তো নয় যে, কারও চেহারা দেখে বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন বিভাগ বিমানে উঠতে দেয় বা কোনো দেশে ঢুকতে দেয়। তিনি আরো বলেছেন, বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার চালিয়েছেন। ঐ সময়ে তাঁর পাঠানো প্রতিবেদনই প্রমাণ করে তিনি কোন্ পক্ষ নিয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের ১৬ জুন লন্ডনের ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকায় এশিয়ান নিউজ সার্ভিসের দেয়া একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ঐ প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছিলেন এবিএম মূসা। সেই প্রতিবেদনের হুবহু বঙ্গানুবাদ এখানে তুলে ধরা হলোÑ‘ঢাকা : পূর্ব পাকিস্তানে শৃঙ্খলা পুনর্প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে নিশ্চিত হয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় শাসনকার্য পরিচালনার জন্য বেসামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করছেন। গত সপ্তাহের শেষ দিকে পুলিশ বাহিনী সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে ঢাকায় শান্তিরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করার মাধ্যমে তাঁর পরিকল্পনার প্রথম ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মার্চ মাসে জরুরী অবস্থা ঘোষণার পর রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা দশ লাখ থেকে পাঁচ লাখে পৌঁছায়। বর্তমানে নাগরিকরা ধীরে ধীরে ফিরে আসতে শুরু করেছে। বাজারগুলো পুনরায় চালু হচ্ছে এবং সামরিক কর্মকা-ের ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত কয়েকটি অধিকতর কর্মব্যস্ত বাজারের দোকানদাররা জোড়াতালি দিয়ে তাদের দোকান পুনরায় চালু করেছে।
মফঃস্বলের বিভিন্ন এলাকায় শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব বেসরকারী কর্মকর্তা ও পুলিশের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এমন কি মুক্তিফৌজ (মুক্তিবাহিনী) যেখানে বোমা নিক্ষেপ করেছে বলা হয়, সেখানে নিয়মিত সামরিক বাহিনী কিংবা তাদের গোয়েন্দা বাহিনীর পরিবর্তে পুলিশ বাহিনী তদন্তকার্য পরিচালনা করে। ২৬ মার্চ জারি করা কারফিউ সম্পর্কিত নির্দেশ গত শুক্রবার প্রত্যাহার করা হয়।
চট্টগ্রাম, খুলনা, ময়মনসিংহ এবং কুমিল্লাসহ পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান শহরগুলো এবং ছোট ছোট শহরেও বেসামরিক কর্তৃপক্ষ শাসনভার গ্রহণ করেছে। শহরগুলোতে সামরিক অভিযান পরিচালনার পর তারা যে-সব গ্রামে আক্রমণ চালায় সেখানে স্থানীয় পুলিশ বাহিনী সেতু ও রেললাইন পাহারার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ এবং আড়াল থেকে গুলি চালানোর বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় পাহারার দায়িত্ব পালন ছাড়াও মুক্তিফৌজ কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা ধ্বংসপ্রাপ্ত সেতু, রাস্তাঘাট এবং রেললাইন মেরামত ও পুনর্নির্মাণ কাজে সামরিক বাহিনী নিয়োজিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাটের অধিকাংশ পুরোপুরি মেরামত করা হয়েছে, কিন্তু যাতায়াত ও মালপত্র পরিবহন প্রধানত নৌ-পরিচালনার ওপর নির্ভরশীল। মাসের পর মাস যে-সব লঞ্চ ও ফেরি অকেজো হয়ে পড়েছিল এবং আওয়ামী লীগের সদস্যরা যে-সব জলযান ডুবিয়ে দিয়েছিল, সেসব উদ্ধার করে নদী-পরিবহন ব্যবস্থা পুনরায় চালু করা হচ্ছে।
আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে দেশে স্বাভাবিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাঁর পরিকল্পনার আভাস দান করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে দেশের পূর্বাঞ্চলসহ প্রদেশগুলোকে বৈদেশিক সম্পর্ক, দেশরক্ষা, মুদ্রানীতি, বিদেশ-বাণিজ্য এবং বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া অন্য সব বিষয় সম্পর্কিত অধিকার প্রদানের জন্য তিনি মনস্থির করছেন।
জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আওয়ামী লীগ টিকেটে নির্বাচিত ১৬৭ সদস্যের মধ্যে আনুমানিক ২৫ জন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সহযোগিতা করবেন বলে আভাস দিয়েছেন। সামরিক সরকার প্রদত্ত ব্যাপক ক্ষমা (অ্যামনেস্টি) প্রদানের ঘোষণা জারি হওয়ার ফলে অন্য সদস্যরা উৎসাহী হয়ে উল্লিখিত ২৫ জনের সঙ্গে যোগ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
যাঁরা উল্লিখিত রাজনীতিবিদদের একত্রিত হওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা এবং পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মি. এইচ এস সোহরাওয়ার্দীর কন্যা বেগম আখতার সোলায়মান। তিনি আশা করেন, রাজনীতিবিদদের যদি প্রয়োজনীয় আশ্বাস দেয়া হয়, তা’ হলে জাতীয় পরিষদের প্রায় ১০০ জন সদস্য এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ জন সদস্যের মধ্যে ২০০ জন সহায়তা করতে রাজি হবেন। উল্লিখিত সংখ্যক সদস্যের সম্মতি পাওয়া গেলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পক্ষে বেসামরিক শাসনব্যবস্থা সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা সহজতর হবে বলে মনে হচ্ছে।
পরিষদের সদস্যপদ ত্যাগকারীদের নির্বাচনী এলাকায় তিনি প্রথমে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশদান করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কিন্তু পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি। এমন কি অনুমোদনপ্রাপ্ত সদস্যদের পুরনো পার্টির পতাকা ব্যবহার করার সম্মতিদান করা যেতে পারে। অতঃপর প্রেসিডেন্ট তাঁর সংবিধান সম্পর্কিত প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য জাতীয় সংসদে পেশ করবেন। ইতোমধ্যে দু’জন বিশেষজ্ঞ নতুন সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। তাঁরা হলেন, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রী মি. জাস্টিস্ কর্নেলিয়াস এবং প্রাক্তন এ্যাটর্নি জেনারেল ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি মন্জুর কাদির।
ঢাকার জনৈক মধ্যবিত্ত বাঙালী কেরানীর মন্তব্য থেকে পরিস্থিতি আঁচ করা যায়। তিনি বলেন: “আমরা শান্তি চাই, বাংলাদেশ না পাকিস্তান তা আমরা জানতে চাই না। (এশিয়ান নিউজ সার্ভিস)’ প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল “ পুলিশ বাহিনী ঢাকায় শান্তিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত”।
উল্লিখিত প্রতিবেদনটি লন্ডনের দ্য টাইমস পত্রিকা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, সিঙ্গাপুরের দ্য স্ট্রেট টাইমস ও ফিলিপিন্সের দি ম্যানিলা টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর এই নিউজ সার্ভিস বিলুপ্ত হয়। কার অর্থায়নে এবং কোন উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠানটি রাতারাতি ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছিল, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ হিসেবে পরিচয়দানকারী এবিএম মূসা এমন প্রতিবেদন লিখলেন কী করে? এমন একটি প্রতিবেদন লেখার পরও তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ?
তখনকার দিনের রাজনীতিক ও সাংবাদিকদের সবাই জানেন যে, ওই প্রতিবেদনটি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর এবিএম মূসা (তখন তিনি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভারের বার্তা-সম্পাদক) সামরিক কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে সপরিবারে ঢাকা থেকে বিমানযোগে হংকং হয়ে কলকাতায় উপস্থিত হন। এই প্রসঙ্গে স্মরণে রাখতে হবে, পাকিস্তানী সেনাদের নির্যাতন এড়াবার জন্য যারা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন, তারা হেঁটে বেআইনীভাবে বাংলাদেশের সীমানা পার হয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু এবিএম মূসা সপরিবারে রাজার হালে কলকাতা গিয়েছিলেন।
কলকাতা গিয়ে তিনি “ইকোনমিক টাইম্স্”-র কলকাতা অফিসের সম্পাদক জ্যোতি সেনগুপ্তের শরণাপন্ন হন। উল্লেখ্য, ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে জ্যোতি সেনগুপ্ত ঢাকায় বেশ কিছুকাল ছিলেন। ঐ সময় এবিএম মূসাসহ অনেকের সঙ্গেই তাঁর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই বন্ধুত্বের খাতিরে তিনি দমদম এয়ারপোর্টের কাছে লেকটাউন উপশহরে তাঁর বাড়ির কাছে এবিএম মূসার সপরিবারে বসবাসের জন্য মাসিক কয়েক হাজার টাকা ভাড়ায় একটি একতলা বড় বাড়ির ব্যবস্থা করে দেন। ঐ সময় কয়েক হাজার টাকা মানে অনেক টাকা, তার সঙ্গে খাওয়া এবং অন্যান্য খরচও আছে। এত টাকা মূসা সাহেবকে কারা দিয়েছিল, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি কলকাতা গিয়েছিলেন? মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময় এবিএম মূসার কলকাতায় উপস্থিত হওয়া এবং ওখানে তাঁর তৎপরতা এখানো অনেকের কাছেই রহস্যজনক বলে মনে হয়।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত এ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেছেন। যেখানে বলা হয়েছে, ঢাকা থেকে আগত জনৈক সংবাদদাতা পাকিস্তানে ফিরে যাচ্ছেন বলে গুজব শুনতে পান তিনি। এ সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সরকারের সেক্রেটারিয়েট, পররাষ্ট্র দফতরের অফিস, জয় বাংলা পত্রিকা অফিস ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গিয়ে প্রকৃত তথ্য জানার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সাক্ষাতপ্রার্থী হন সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত। প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও সাক্ষাতকারদানের সম্মতি জানান।
তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দুপুরে খাওয়ার সময় সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচার, ঢাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি ইত্যাদি সম্পর্কে অনেকক্ষণ আলাপ করেন। আলোচনাকালে হঠাৎ তিনি জানতে চাইলেন, ঢাকা থেকে আসা খ্যাতনামা সাংবাদিককে সাক্ষাতকারদানের অনুরোধ তাজউদ্দীন আহমদ কেন প্রত্যাখ্যান করেছেন?
তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে এর পরের কথাগুলোতে অনেকে চমৎকৃত হতে পারেন। সুখরঞ্জন দাসগুপ্তের এ প্রশ্নের জবাবে তাজউদ্দীন আহমদ তাঁকে বলেন, ‘কী ধরনের সাংবাদিক আপনি? ঐ সাংবাদিক একটি পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে এসেছেন। আপনি কি লক্ষ্য করেননি, কত সহজে তিনি আমাদের পররাষ্ট্র দফতরের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছেন? তাজউদ্দীন আহমদ পররাষ্ট্র দফতরের কথা উল্লেখ করার ফলে সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত নতুন প্রশ্ন করার সুযোগ পেলেন। তিনি বিশেষ করে ষড়যন্ত্রের কথা জানতে চাইলেন। তাজউদ্দীন সাহেব কিছুক্ষণ চিন্তাগ্রস্ত থেকে বললেন, ‘অপেক্ষা করুন, আমি হাত ধুয়ে এসে আপনাকে গোপন নথিপত্র সংবলিত ‘ফাইল’ দেখার সুযোগ দেব।’ হাত ধুয়ে এসে তিনি আলমারি থেকে ‘অত্যন্ত গোপনীয়’ লেখা লাল মলাটের একটি ‘ফাইল’ খুলে পৃষ্ঠাগুলো খুঁটিয়ে দেখলেন। তিনি বললেন, এই ‘ফাইল থেকে আপনি তথ্য টুকে নিতে পারেন, কিন্তু আপাতত এসব প্রকাশ করবেন না। সুখরঞ্জন দাসগুপ্তের ‘মিডনাইট ম্যাসাকার ইন ঢাকা’ বইয়ের ১২ পৃষ্ঠায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ আছে।
তাজউদ্দীন আহমদ ও সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত ঢাকা থেকে আগত সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করেননি। ১৬ জুন, ১৯৭১ লন্ডনের দ্য টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, ঐ সাংবাদিক এবিএম মূসা ছাড়া আর কেউ নন। জেনারেল এম এ জি ওসমানীও ঢাকা থেকে আগত সাংবাদিককে সাক্ষাতকার দিতে রাজি হননি। মুক্তি বাহিনীর অগ্রগতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য যে সব দেশী-বিদেশী সাংবাদিক মুজিবনগর সরকারের উদ্যোগে মুক্তাঞ্চল সফর করেন, তাদের সঙ্গে এবিএম মূসার যোগদানের ব্যাপারে জেনারেল ওসমানী নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এমন কথাও শোনা যায়, এবিএম মূসা কলকাতা যাওয়ার কিছুকাল পর তাঁর আপত্তিকর কর্মতৎপরতার কারণে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাঁর ভাড়া বাসা থেকে টাইপ মেশিন ও সংবাদ প্রেরণের অন্যান্য সরঞ্জামসহ তাঁকে নিয়ে যায়। তিন দিন পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁকে ছাড়িয়ে আনেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সব খবর রাখতেন। হিমালয়সম হৃদয়ের অধিকারী বঙ্গবন্ধুর ক্ষমা ও কৃপায় এবিএম মূসা একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন। আওয়ামী লীগের টিকেটে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন তিনি। বঙ্গবন্ধু সরকারের কাছ থেকে অনেক সুবিধা নিয়েছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে বিদেশ সফর করেছেন। তারপরও তৃপ্ত নন এবিএম মূসা। আরও বড় প্রাপ্তিযোগের আশা ছাড়তে নারাজ তিনি। ঢাকার সাংবাদিক মহলে এ কথা প্রচলিত আছে যে, বঙ্গবন্ধৃ- কন্যা শেখ হাসিনা সরকার থেকে টেলিভিশন কেন্দ্রের লাইসেন্সসহ আরো অনেক সুবিধা আদায় করতে না পারায় ক্ষিপ্ত তিনি। একাত্তরের শুরুতে তিনি যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, আবার অবতীর্ণ হয়েছেন সে ভূমিকায়। বর্তমান সরকারের অনন্য সাফল্যগুলোকে ম্লান করে বিরোধী পক্ষের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে চান। তাই এ বয়সে এসেও সত্যের অপলাপ করে চলেছেন। মুক্ত বাজারের দুনিয়ায় সংবাদও যখন বিক্রয়যোগ্য পণ্য, তখন এবিএম মূসাদের উক্তি, তা যতই সত্যের অপলাপ হোক না কেন, আলোচনার খোরাক যোগায়। কিন্তু এভাবে সত্যকে বিকৃত করলেই কি সেটা মানুষের বিশ্বাসে গেঁথে যাবে? না। এবিএম মূসাদের সে উদ্দেশ্য কোনদিন সফল হবে না। কারণ বাঙালীর মনে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান কোনদিন এবিএম মূসা কথিত ‘তৃতীয় শ্রেণী বা সারি’র নয়। বঙ্গবন্ধু বাঙালীর শীর্ষ নেতা। বাঙালীর মন ও মনন থেকে বঙ্গবন্ধুর এই রাজনৈতিক অবস্থান কেউ নষ্ট করতে পারবে না।
লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকার কর্মী, লেখক ও সাংবাদিক
nazrul@gmx.at
No comments