সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-অস্ত্র না অ্যালবাট্রস! by এম আবদুল হাফিজ

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার জন্য নিয়মিত পেশাদার সামরিক বাহিনীর ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে আওয়ামী নেতৃত্ব যখন জাতীয় রক্ষীবাহিনী নামক একটি দলীয় বাহিনী সৃষ্টি করে, তখনই বোঝা গিয়েছিল যে আজকের আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে অস্ত্র সজ্জিত করার পেছনে কতটা আন্তরিক।
তবে এ কথা সত্য যে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে ফেরত আনা আটাশ হাজার বিভিন্ন পদবির সেনাসদস্যদের নিয়ে একটি সামরিক বাহিনীর গোড়াপত্তন করেছিলেন কতকটা বাধ্য হয়ে। তা না হলে তখনকার অস্থিতিশীল সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই প্রশিক্ষিত জনবল অতিরিক্ত অস্বস্তির কারণ হতো। তাছাড়া এই জনবলে উচ্চপদস্থ মেধাবান অফিসার ছিলেন, যাদের বঙ্গবন্ধু সম্ভবত দেশ গঠনে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। উপরন্তু রাষ্ট্রাচারেও প্রয়োজন হয় অন্তত একটি 'সেরিমনিয়াল আর্মি'।
কিন্তু অধুনা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে এক সময়ের অবহেলিত সামরিক বাহিনীর জন্য সমরাস্ত্র ক্রয়ের প্রবণতা দেখা যায়। আমার মনে হয়, একটি বাহিনীকে রুটিন পর্যায়ে সক্রিয় রাখতেও তা প্রয়োজন হয়। সামরিক বাহিনীকে আজকাল অহরহ বেসামরিক ব্যবস্থাপনার ভূমিকায় নামানো হয়, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে ভাড়া খাটানো হয়। এসব ভূমিকায় কাজ করার যোগ্যতাপূর্ণ থাকতেও সামরিক বাহিনীকে একটি নূ্যনতম প্রশিক্ষণ দিতে হয়। তার জন্যও তো অস্ত্র, সরঞ্জামের প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া আধুনিক বিশ্বে বিভিন্ন কারণে আর্মিও হয়ে ওঠে জাতীয় রাজনীতির একটি অনুষঙ্গ। যতই তাদের অপছন্দ করি, অবস্থাবিশেষে তাদের শরণাপন্ন হতে হয়, যেমন মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিক সরকারকে হতে হচ্ছে।
তাই বেসামরিক রাজনৈতিক সরকারকেও আর্মির সঙ্গে একটি সমীকরণে পেঁৗছতে হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত মেয়াদে শেখ হাসিনা ফিল্ড মার্শালের উর্দি ও ব্যাজ পরে সামরিক মহড়া দেখতে যেতেন। তিনি প্রয়োজনের অধিক সেনা আবদার মিটিয়ে তাদের খুশি রেখেছেন, প্রকারান্তরে বিপুল পরিমাণ বাজেট ব্যবহারের ক্ষমতাসহ সামরিক বাহিনীকে কার্যত স্বায়ত্তশাসিত সংগঠনের মর্যাদা দিয়েছেন। তবু এক সময়ে উপেক্ষা ও অবহেলার দুর্নাম ঘুচিয়ে আওয়ামী লীগ কতটা সামরিক বাহিনীর প্রিয় হতে পেরেছিল তা অনির্ণীত।
বর্তমান মেয়াদে বিডিআর বিদ্রোহে সেনাবাহিনীর ৪৭ জন প্রতিশ্রুতিশীল কর্মকর্তার মৃত্যু কি সেনাসদস্যরা মেনে নিতে পেরেছেন? বিষয়টি এখনও অনিশ্চিত। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বুঝি যে, তাদের মৃত্যুর পেছনে যাদেরই বিচ্যুতি থেকে থাকুক না কেন, অনেক সামরিক ও বেসামরিক মহল এই মৃত্যুকে না মেনে নিতে পেরেছে, না তারা এ প্রসঙ্গে আওয়ামীদের প্রদত্ত ব্যাখ্যাকে বিশ্বাস করে।
সমরাস্ত্র ক্রয়ের ব্যাপারে এতক্ষণ যা বললাম, সেসবই আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধিপ্রসূত। নিন্দুকরা কিন্তু অন্য রকম কথা বলে। বিরোধীদলীয়রা কিন্তু বলছে, সমরাস্ত্র ক্রয়ে প্রচণ্ডভাবে আকর্ষণীয় 'কিক ব্যাকে'র কথা। এক বিশেষ ধরনের অস্ত্রের প্রয়োজন থাক বা না থাক, সেই অস্ত্রটি ক্রয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আর্থিক লাভের আকর্ষণটি সহজে কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। ভারতের মতো দেশেও বোফর্স কেলেঙ্কারি হয়েছে এবং তা নেহরু-গান্ধী পরিবারের সদস্যের হাত দিয়ে হয়েছিল। যদিও তা দলের স্বার্থে বা নির্বাচনী তহবিল গঠনে হয়ে থাকতে পারে, তবু তা অনৈতিক। আওয়ামী লীগের বিগত মেয়াদে মিগ-২৯ এবং কোরীয় ফ্রিগেট ক্রয়ে দুর্নীতি হয়েছিল, যার জন্য আওয়ামী 'আন্দোলনের ফসল' ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারও শেখ হাসিনাকে রেহাই দেয়নি। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। শেখ হাসিনার ভাগ্য ভালো যে, ওই সরকারের পরিচালিত নির্বাচনে তিনি জয় পেয়েছিলেন। তারপর যা হয় সরকারের অনুগত আদালত নতুন প্রভুকে খুশি করতে অতি সন্তর্পণে সেই দুর্নীতির মামলাগুলো প্রত্যাহার করেছে। অবশ্য বিএনপি জয় পেলে খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেও তাই হতো।
আওয়ামী লীগের বিগত মেয়াদেও মিগ-২৯ সুপারসনিক যুদ্ধবিমান ক্রয়কে ঘিরে প্রচুর বিতর্ক হয়েছিল। ঘোমটা পরা আমাদের প্রতিরক্ষা নীতি (যদি তা আদৌ থেকে থাকে) কখনও আলোচনায় আসেনি। আমাদের হুমকির উৎস, ভূবিন্যাস এবং সামর্থ্য বিবেচনায় তা ক্রয় করা কি সম্ভব বা উচিত তা নিয়ে সংসদেও কোনো বিতর্ক হয়নি। প্রতিরক্ষা নীতি নিয়েও কোনোদিন কোনো খোলামেলা আলোচনা হয়নি। ফলে আমরা জানিও না যে, তা আমাদের জন্য প্রযোজ্য কি-না। না হলে কী ধরনের প্রতিরক্ষা নীতি আমরা এ দেশে প্রয়োগ করব!
১৯৫৪ সালে শক্তিশালী ফরাসি বাহিনী ইন্দোচীন যুদ্ধে দিয়েন বিয়েন ফু-তে পর্যুদস্ত হয়েছিল। ওই যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় মার্কিনিরা ভিয়েতনামে এসেছিল। কিন্তু দুই যুগ যুদ্ধের পর অনেক দূতিয়ালি ও কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্যে অনেক ক্ষয়ক্ষতির পর ভিয়েতনামের দখলদাররা ক্ষতবিক্ষত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিল। ওই সময় উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রচলিত যুদ্ধের (Conventional Wa) পরিবর্তে গেরিলা কৌশলে হালকা দ্রুত এক অপ্রচলিত যুদ্ধের পক্ষে প্রবণতা দানা বেঁধে উঠেছিল। আমাদের মতো দরিদ্র দেশে সম্ভাব্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কি আমরা প্রচলিত যুদ্ধে লড়তে পারব?
ব্যয়বহুল সাঁজোয়া বহর, যুদ্ধবিমান বা যুদ্ধজাহাজ ক্রয় করার আগে জাতীয় ভিত্তিতে এই ইস্যুগুলোর ওপর ব্যাপক আলোচনা হতে পারে। আলোচনা হতে পারে অক্সিলিয়ারি ফোর্সেসের ভূমিকা ও কার্যকারিতা নিয়ে। তারপরই প্রয়োজনে হয়তোবা যুদ্ধবিমানের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে পারে। তার পূর্বেই তড়িঘড়ি এসব সমরাস্ত্রে বিপত্তি ঘটতে পারে, সেগুলো জাতির গলায় প্রবাদের আলবাট্রোসের মতো ঝুলে থাকতে পারে।
সুপারসনিক জঙ্গিবিমান উড়বার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আকাশসীমা পেরিয়ে গেলে আমাদের প্রতিবেশীরা কি সেগুলোকে অক্ষত ফিরে আসতে দেবে? মনে রাখতে হবে, আমাদের সীমান্ত এতটাই স্পর্শকাতর যে, প্রতিবেশীর সীমান্তরক্ষীরা মধ্যযুগীয় বর্বরতায় ফেলানী নামের কিশোরীকেও তাঁরকাটায় ঝুলিয়ে রাখে। কী করে আশা করব যে, একটি জলজ্যান্ত সুপারসনিক মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান অক্ষতভাবে প্রত্যাবর্তনে সক্ষম হবে?


ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ
সাবেক মহাপরিচালক
বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.