সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে বাণিজ্যিক ঋণ নয়, মিশ্র অর্থায়ন চাই by দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
পদ্মা সেতু নিয়ে দীর্ঘদিনের জটিলতার এক ধরনের নিষ্পত্তি হলো ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে। বিশ্বব্যাংককে এ সেতু নির্মাণে অর্থ জোগানোর অনুরোধ বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ফিরিয়ে নিয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের জন্য বিকল্প অর্থায়নের উৎস খোঁজার পথ উন্মুক্ত হয়ে গেল।
অন্যভাবেও বিষয়টিকে কেউ কেউ ব্যাখ্যা করতে চাইবেন_ রাজনৈতিক মনোভঙ্গির কাছে অর্থনৈতিক যৌক্তিকতার পরাজয়। আমরা দেখেছি, বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনয়ন এবং দুর্নীতির ষড়যন্ত্র বিষয়ে তদন্ত ও মামলা দায়েরের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কতিপয় পদক্ষেপের পর এক পর্যায়ে অনেকটা নজিরবিহীনভাবে প্রকল্পটি পুনরুজ্জীবিত হওয়ার পরও সরকারের ভেতর একটি মহলের নানামুখী প্রবণতা প্রকাশ পেতে থাকে। এ মহলটিই আর্থ-সামাজিক এবং আঞ্চলিক কানেক্টিভিটির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পের সুষ্ঠু সমাপ্তি ঘটতে দিল না। যারা সেতু প্রকল্পের অর্থায়নে সচেষ্ট ছিলেন তারা সরকারের উচ্চ মহলের দিক থেকে প্রয়োজনীয় সমর্থন পাননি বিধায় এ রকম একটি উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত ভেস্তে গেল।
একইসঙ্গে এটাও বলতে হবে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ আপাতত অনিষ্পন্ন থেকে গেল। আপাতত এ কারণে বলা যে, দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক বলেছে_ তারা তদন্ত কাজ অব্যাহত রাখবে এবং ইতিমধ্যে যে সব মামলা দায়ের হয়েছে তা চালিয়ে যাবে। তাদের তদন্ত কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে এবং মামলার ফল নিষ্পন্ন হলে কেউ দোষী থাকলে শাস্তি পাবে_ এ প্রত্যাশা থেকে যাচ্ছে।
তাহলে এখন সামনে কী? পদ্মা সেতু প্রকল্পের ভবিষ্যৎই বা কী? এখন সরকারকে পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে গোটা প্রকল্প পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। বলা যায়, তাদের ফিরে যেতে হবে ড্রয়িং বোর্ডে। শোনা যায়, কেউ কেউ মত দিচ্ছেন_ রেলপথ বাদ দিয়ে সেতুর কাজ সম্পন্ন করা হোক। এতে ব্যয় কমবে এবং অর্থায়ন সহজ হবে। তবে এ পদক্ষেপ অবিবেচকের মতো হবে। পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ বাদবাকি এলাকার যোগাযোগ সহজ হয়ে যাবে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহজ হবে_ এটা সবাই স্বীকার করেন। একইসঙ্গে এ প্রকল্পের রয়েছে আঞ্চলিক গুরুত্ব। সেতুতে রেলপথ থাকা এ জন্য অপরিহার্য। কিন্তু ব্যয় কমানোর যুক্তিতে রেলপথ না রাখা হলে এই আঞ্চলিক সম্ভাবনা অব্যবহৃত থেকে যাবে। পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্প আমরা ঘন ঘন হাতে নিতে পারব না। চাইলেই আরেকটি সেতু নির্মাণ করা যাবে না। প্রকল্পের বর্তমান নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুফল-সম্ভাবনা বিবেচনা করে। আশা করব যে, প্রণীত নকশাটি যেহেতু বাংলাদেশ সরকারের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে, এ কারণে সেতু নির্মাণের নতুন যে কোনো উদ্যোগে সেটাই বিবেচনায় রাখা হবে। এ নকশা কয়েক বছর আগে প্রণয়ন করা হয়েছে। হয়তো নদীশাসন বা এ ধরনের কিছু কারিগরি বিষয় এখন পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়বে; কিন্তু মূল নকশায় যেন হাত না পড়ে।
সরকারের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে প্রকল্পের আর্থিক মূল্যায়ন করা। চার-পাঁচ বছর আগে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। যদি ১০ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধিও ধরি, তাহলে ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় পড়ে যাবে, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়। কোন সূত্র থেকে কত অর্থ মিলবে তার জন্য নতুন হিসাব দরকার পড়বে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে_ অর্থের উৎস। প্রকল্পের জন্য ৮০ শতাংশ অর্থের জোগান দেবে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান সরকার এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক উৎস_ এটাই নির্ধারিত ছিল। বাংলাদেশ সরকার দেবে ২০ শতাংশ। এখন ৮০ শতাংশের নতুন ডোনার খুঁজতে হবে। আমাদের রাজস্ব আয় থেকে এ অর্থ জোগান দেওয়া সম্ভব, সেটা কেউ বলতেই পারেন। কিন্তু সেটা বাস্তবসম্মত হবে বলে মনে হয় না। আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বর্তমান আকার ৫০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। পদ্মা সেতু প্রকল্প নির্মাণে দরকার পড়বে তার প্রায় অর্ধেকের মতো অর্থ। যদি ধরেও নিই যে, কয়েক বছর ধরে এ অর্থের সংস্থান করা হবে_ কিন্তু তেমনটি ঘটলে অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্প কাঁটছাট করতে হবে। অর্থাৎ আমাদের সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হবে।
কেউ কেউ বলছেন, যমুনা সেতু নিজেদের অর্থে নির্মাণ করতে পারলে পদ্মা সেতু কেন পারা যাবে না। কিন্তু নিকট অতীতের এ ঘটনা আমাদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ওই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংগঠন আইডিএ ছাড়াও জাপান এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকই দিয়েছিল সিংহভাগ অর্থের জোগান। বাংলাদেশ সরকার কয়েক বছরের চেষ্টায় যে সারচার্জ সংগ্রহ করেছিল তা ছিল ৫০০ কোটি টাকার মতো এবং গোটা প্রকল্প বাস্তবায়নে এ সূত্রে ১৪ শতাংশের মতো অর্থ মিলেছিল।
সরকার সারচার্জ বা এ ধরনের পদক্ষেপের বাইরেও দেশীয় অন্য সূত্রে পদ্মা সেতুর জন্য অর্থের সংস্থান করার উদ্যোগ নিতেই পারে। তবে সেতুটির জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই আমদানি করতে হবে এবং এ কারণে বিদেশি মুদ্রার বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখতে হবে।
কেউ কেউ বলছেন যে, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুদ এখন সর্বকালের রেকর্ড পর্যায়ে রয়েছে এবং সেটা আমরা সেতু নির্মাণে কাজে লাগাতে পারি। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে, রিজার্ভের অর্থ সরকারের কোনো মজুদ ভাণ্ডার নয়। সেখান থেকে সেতুর জন্য সরকার অর্থ গ্রহণ করতে চাইলে সেটা নিতে হবে ঋণ হিসেবে। এ জন্য সুদ ও আসলের কিস্তি বাবদ যে অর্থ ব্যয় হবে সেটা মেটাতে হবে সরকারের রাজস্ব আয় থেকে। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি, টাকার বিনিময় হার এবং সুদের হার_ তিন ধরনের চাপ সৃষ্টি হতে পারে। এর অর্থ এটা নয় যে, আর কোনো উৎস খোঁজা যাবে না। সরকারের নিজস্ব রাজস্ব ভাণ্ডার থেকে অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি ব্যক্তি সঞ্চয়কারী এবং পুঁজিবাজার থেকে বন্ড ও অন্যান্য পদ্ধতিতে টাকা সংগ্রহ সম্ভব হতে পারে। আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজার থেকেও সভরেন বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব। সরকার চাইছে এভাবে ৫০ কোটি ডলার সংগ্রহ করতে। এ চিন্তা ভালো বলতে হবে। বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক সরে গেলেও কতিপয় বড় দাতা সংস্থার কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের পদক্ষেপও সরকার নিতে পারে। তবে দুর্নীতির কথিত অভিযোগে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক চলে যাওয়ায় এ কাজ সহজ হবে বলে মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে জাপানের ভূমিকা হবে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের নিজেদের যেমন অর্থ রয়েছে, তেমনি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংককে ফের এ কাজে যুক্ত করার জন্য তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।
সেতুর জন্য ৮০ শতাংশ অর্থের যে ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে সেটা পূরণ সহজ নয় এবং এ জন্য মিশ্র অর্থায়নের বিকল্প নেই। তবে এ জন্য উচ্চহার সুদে বাণিজ্যিক অর্থায়ন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। এমনকি সরকারি পর্যায়েও এ ধরনের ঋণ সংগ্রহের চেষ্টা কাঙ্ক্ষিত নয়। এ ধরনের ঋণ কেবল ব্যয়বহুল হবে না, তার প্রভাব পড়বে সেতু ব্যবহারকারীদের ওপর এবং রক্ষণাবেক্ষণ কাজে।
আরও একটি বড় ধরনের সমস্যা সরকারের সামনে রয়েছে_ সেতুর জন্য যে নকশা হাতে রয়েছে সেটা বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান নিয়োগদান। এ ধরনের বড় অবকাঠামো নির্মাণের দক্ষ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিশ্বে হাতেগোনা কয়েকটিই রয়েছে। বিশ্বব্যাংক চলে যাওয়ার পর অর্থায়নের বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের কেউ সেতু নির্মাণে এগিয়ে আসবে বলে মনে হয় না। অর্থায়ন নিশ্চিত হয়নি, কিংবা আংশিক হয়েছে_ এমন পরিস্থিতিতে কাজ শুরু করতে কেউ যদি রাজি হয় বুঝতে হবে, ভেতরে কিছু গোলমাল রয়েছে এবং এ কারণে তাদের কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকাই কাঙ্ক্ষিত হবে।
সরকারের অন্যতম প্রধান নির্বাচনী অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণ। এরই মধ্যে অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। এ কারণে দ্রুত কাজ শুরু করার চাপ সরকারের ওপর রয়েছে। কত দ্রুত তারা এটা করতে পারে এবং এ ক্ষেত্রে কতটা দক্ষতা ও যোগ্যতা দেখাতে পারে সেটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। গত কয়েক মাসে সরকারের মধ্যে এ সেতু নিয়ে সমন্বয়ের অভাব আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। নতুন পর্যায়ে প্রস্তুতি কাজ ভালোভাবে শুরু করার জন্য এ সমন্বয়ের প্রয়োজন অনেক বেশি অনুভূত হবে। আবার দ্রুততার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে মান যেন ক্ষুণ্ন না হয়, সে বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। তাড়াহুড়ার কাজে ব্যয় বেশি পড়ে কি-না, সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে।
বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে চলে যাওয়ায় বাংলাদেশে তাদের চলমান অন্যান্য প্রকল্পের ওপর কী প্রভাব পড়বে সেটা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তারা এখন ৩০টিরও বেশি প্রকল্পের ঋণ জোগান দিচ্ছে এবং এর সুদের হার নামমাত্র। পদ্মা সেতু নিয়ে অনিশ্চয়তা চলার মধ্যেই গত বছর তারা ৯০ কোটি ডলার নতুন ঋণ মঞ্জুর করেছে। তবে এখন এটা নিশ্চিত করে বলা চলে যে, এসব চলমান প্রকল্পের ব্যয় যাতে দুর্নীতিমুক্ত হয় সেটা নিয়ে তাদের নজরদারি আরও বাড়বে। শুধু বিশ্বব্যাংক নয়, অন্যান্য দাতাও এ বিষয়ে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করতে পারে।
আমরা আশা করব যে, পদ্মা সেতু নিয়ে যা ঘটেছে তা থেকে সরকার এবং সংশ্লিষ্টরা ইতিবাচক শিক্ষা গ্রহণ করবে এবং সেতুটি নির্মাণে পরবর্তী পর্যায়ে যথাযথ যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রদর্শনের জন্য তা কাজে লাগাবে। আমাদের ওপর অনিয়ম-দুর্নীতি চেষ্টার কালিমা পড়েছে এবং সেটা দূর করার জন্য অবশ্যই সচেষ্ট হতে হবে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য :সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সম্মানিত ফেলো
একইসঙ্গে এটাও বলতে হবে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ আপাতত অনিষ্পন্ন থেকে গেল। আপাতত এ কারণে বলা যে, দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক বলেছে_ তারা তদন্ত কাজ অব্যাহত রাখবে এবং ইতিমধ্যে যে সব মামলা দায়ের হয়েছে তা চালিয়ে যাবে। তাদের তদন্ত কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে এবং মামলার ফল নিষ্পন্ন হলে কেউ দোষী থাকলে শাস্তি পাবে_ এ প্রত্যাশা থেকে যাচ্ছে।
তাহলে এখন সামনে কী? পদ্মা সেতু প্রকল্পের ভবিষ্যৎই বা কী? এখন সরকারকে পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে গোটা প্রকল্প পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। বলা যায়, তাদের ফিরে যেতে হবে ড্রয়িং বোর্ডে। শোনা যায়, কেউ কেউ মত দিচ্ছেন_ রেলপথ বাদ দিয়ে সেতুর কাজ সম্পন্ন করা হোক। এতে ব্যয় কমবে এবং অর্থায়ন সহজ হবে। তবে এ পদক্ষেপ অবিবেচকের মতো হবে। পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ বাদবাকি এলাকার যোগাযোগ সহজ হয়ে যাবে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহজ হবে_ এটা সবাই স্বীকার করেন। একইসঙ্গে এ প্রকল্পের রয়েছে আঞ্চলিক গুরুত্ব। সেতুতে রেলপথ থাকা এ জন্য অপরিহার্য। কিন্তু ব্যয় কমানোর যুক্তিতে রেলপথ না রাখা হলে এই আঞ্চলিক সম্ভাবনা অব্যবহৃত থেকে যাবে। পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্প আমরা ঘন ঘন হাতে নিতে পারব না। চাইলেই আরেকটি সেতু নির্মাণ করা যাবে না। প্রকল্পের বর্তমান নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুফল-সম্ভাবনা বিবেচনা করে। আশা করব যে, প্রণীত নকশাটি যেহেতু বাংলাদেশ সরকারের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে, এ কারণে সেতু নির্মাণের নতুন যে কোনো উদ্যোগে সেটাই বিবেচনায় রাখা হবে। এ নকশা কয়েক বছর আগে প্রণয়ন করা হয়েছে। হয়তো নদীশাসন বা এ ধরনের কিছু কারিগরি বিষয় এখন পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়বে; কিন্তু মূল নকশায় যেন হাত না পড়ে।
সরকারের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে প্রকল্পের আর্থিক মূল্যায়ন করা। চার-পাঁচ বছর আগে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। যদি ১০ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধিও ধরি, তাহলে ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় পড়ে যাবে, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়। কোন সূত্র থেকে কত অর্থ মিলবে তার জন্য নতুন হিসাব দরকার পড়বে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে_ অর্থের উৎস। প্রকল্পের জন্য ৮০ শতাংশ অর্থের জোগান দেবে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান সরকার এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক উৎস_ এটাই নির্ধারিত ছিল। বাংলাদেশ সরকার দেবে ২০ শতাংশ। এখন ৮০ শতাংশের নতুন ডোনার খুঁজতে হবে। আমাদের রাজস্ব আয় থেকে এ অর্থ জোগান দেওয়া সম্ভব, সেটা কেউ বলতেই পারেন। কিন্তু সেটা বাস্তবসম্মত হবে বলে মনে হয় না। আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বর্তমান আকার ৫০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। পদ্মা সেতু প্রকল্প নির্মাণে দরকার পড়বে তার প্রায় অর্ধেকের মতো অর্থ। যদি ধরেও নিই যে, কয়েক বছর ধরে এ অর্থের সংস্থান করা হবে_ কিন্তু তেমনটি ঘটলে অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্প কাঁটছাট করতে হবে। অর্থাৎ আমাদের সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হবে।
কেউ কেউ বলছেন, যমুনা সেতু নিজেদের অর্থে নির্মাণ করতে পারলে পদ্মা সেতু কেন পারা যাবে না। কিন্তু নিকট অতীতের এ ঘটনা আমাদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ওই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংগঠন আইডিএ ছাড়াও জাপান এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকই দিয়েছিল সিংহভাগ অর্থের জোগান। বাংলাদেশ সরকার কয়েক বছরের চেষ্টায় যে সারচার্জ সংগ্রহ করেছিল তা ছিল ৫০০ কোটি টাকার মতো এবং গোটা প্রকল্প বাস্তবায়নে এ সূত্রে ১৪ শতাংশের মতো অর্থ মিলেছিল।
সরকার সারচার্জ বা এ ধরনের পদক্ষেপের বাইরেও দেশীয় অন্য সূত্রে পদ্মা সেতুর জন্য অর্থের সংস্থান করার উদ্যোগ নিতেই পারে। তবে সেতুটির জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই আমদানি করতে হবে এবং এ কারণে বিদেশি মুদ্রার বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখতে হবে।
কেউ কেউ বলছেন যে, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুদ এখন সর্বকালের রেকর্ড পর্যায়ে রয়েছে এবং সেটা আমরা সেতু নির্মাণে কাজে লাগাতে পারি। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে, রিজার্ভের অর্থ সরকারের কোনো মজুদ ভাণ্ডার নয়। সেখান থেকে সেতুর জন্য সরকার অর্থ গ্রহণ করতে চাইলে সেটা নিতে হবে ঋণ হিসেবে। এ জন্য সুদ ও আসলের কিস্তি বাবদ যে অর্থ ব্যয় হবে সেটা মেটাতে হবে সরকারের রাজস্ব আয় থেকে। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি, টাকার বিনিময় হার এবং সুদের হার_ তিন ধরনের চাপ সৃষ্টি হতে পারে। এর অর্থ এটা নয় যে, আর কোনো উৎস খোঁজা যাবে না। সরকারের নিজস্ব রাজস্ব ভাণ্ডার থেকে অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি ব্যক্তি সঞ্চয়কারী এবং পুঁজিবাজার থেকে বন্ড ও অন্যান্য পদ্ধতিতে টাকা সংগ্রহ সম্ভব হতে পারে। আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজার থেকেও সভরেন বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব। সরকার চাইছে এভাবে ৫০ কোটি ডলার সংগ্রহ করতে। এ চিন্তা ভালো বলতে হবে। বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক সরে গেলেও কতিপয় বড় দাতা সংস্থার কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের পদক্ষেপও সরকার নিতে পারে। তবে দুর্নীতির কথিত অভিযোগে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক চলে যাওয়ায় এ কাজ সহজ হবে বলে মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে জাপানের ভূমিকা হবে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের নিজেদের যেমন অর্থ রয়েছে, তেমনি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংককে ফের এ কাজে যুক্ত করার জন্য তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।
সেতুর জন্য ৮০ শতাংশ অর্থের যে ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে সেটা পূরণ সহজ নয় এবং এ জন্য মিশ্র অর্থায়নের বিকল্প নেই। তবে এ জন্য উচ্চহার সুদে বাণিজ্যিক অর্থায়ন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। এমনকি সরকারি পর্যায়েও এ ধরনের ঋণ সংগ্রহের চেষ্টা কাঙ্ক্ষিত নয়। এ ধরনের ঋণ কেবল ব্যয়বহুল হবে না, তার প্রভাব পড়বে সেতু ব্যবহারকারীদের ওপর এবং রক্ষণাবেক্ষণ কাজে।
আরও একটি বড় ধরনের সমস্যা সরকারের সামনে রয়েছে_ সেতুর জন্য যে নকশা হাতে রয়েছে সেটা বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান নিয়োগদান। এ ধরনের বড় অবকাঠামো নির্মাণের দক্ষ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিশ্বে হাতেগোনা কয়েকটিই রয়েছে। বিশ্বব্যাংক চলে যাওয়ার পর অর্থায়নের বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের কেউ সেতু নির্মাণে এগিয়ে আসবে বলে মনে হয় না। অর্থায়ন নিশ্চিত হয়নি, কিংবা আংশিক হয়েছে_ এমন পরিস্থিতিতে কাজ শুরু করতে কেউ যদি রাজি হয় বুঝতে হবে, ভেতরে কিছু গোলমাল রয়েছে এবং এ কারণে তাদের কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকাই কাঙ্ক্ষিত হবে।
সরকারের অন্যতম প্রধান নির্বাচনী অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণ। এরই মধ্যে অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। এ কারণে দ্রুত কাজ শুরু করার চাপ সরকারের ওপর রয়েছে। কত দ্রুত তারা এটা করতে পারে এবং এ ক্ষেত্রে কতটা দক্ষতা ও যোগ্যতা দেখাতে পারে সেটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। গত কয়েক মাসে সরকারের মধ্যে এ সেতু নিয়ে সমন্বয়ের অভাব আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। নতুন পর্যায়ে প্রস্তুতি কাজ ভালোভাবে শুরু করার জন্য এ সমন্বয়ের প্রয়োজন অনেক বেশি অনুভূত হবে। আবার দ্রুততার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে মান যেন ক্ষুণ্ন না হয়, সে বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। তাড়াহুড়ার কাজে ব্যয় বেশি পড়ে কি-না, সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে।
বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে চলে যাওয়ায় বাংলাদেশে তাদের চলমান অন্যান্য প্রকল্পের ওপর কী প্রভাব পড়বে সেটা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তারা এখন ৩০টিরও বেশি প্রকল্পের ঋণ জোগান দিচ্ছে এবং এর সুদের হার নামমাত্র। পদ্মা সেতু নিয়ে অনিশ্চয়তা চলার মধ্যেই গত বছর তারা ৯০ কোটি ডলার নতুন ঋণ মঞ্জুর করেছে। তবে এখন এটা নিশ্চিত করে বলা চলে যে, এসব চলমান প্রকল্পের ব্যয় যাতে দুর্নীতিমুক্ত হয় সেটা নিয়ে তাদের নজরদারি আরও বাড়বে। শুধু বিশ্বব্যাংক নয়, অন্যান্য দাতাও এ বিষয়ে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করতে পারে।
আমরা আশা করব যে, পদ্মা সেতু নিয়ে যা ঘটেছে তা থেকে সরকার এবং সংশ্লিষ্টরা ইতিবাচক শিক্ষা গ্রহণ করবে এবং সেতুটি নির্মাণে পরবর্তী পর্যায়ে যথাযথ যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রদর্শনের জন্য তা কাজে লাগাবে। আমাদের ওপর অনিয়ম-দুর্নীতি চেষ্টার কালিমা পড়েছে এবং সেটা দূর করার জন্য অবশ্যই সচেষ্ট হতে হবে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য :সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সম্মানিত ফেলো
No comments