মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের সুবিধাবাদী রাজনীতি by কাজী সাইদ
বাংলাদেশে মস্কোপন্থী রাজনীতি
১৯৭০ সালের নির্বাচনে জোট গঠনের আহ্বান জানাতে গিয়ে মস্কোপন্থীদের বঙ্গবন্ধুর মুখে ‘সাইনবোর্ড পাল্টানোর’ তথা আওয়ামী লীগে যোগদানের মতো অবমাননাকর পরামর্শ শুনতে হয়েছিল।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে জোট গঠনের আহ্বান জানাতে গিয়ে মস্কোপন্থীদের বঙ্গবন্ধুর মুখে ‘সাইনবোর্ড পাল্টানোর’ তথা আওয়ামী লীগে যোগদানের মতো অবমাননাকর পরামর্শ শুনতে হয়েছিল।
তখনো
তারা যেমন ঐক্যের হাল ছাড়েনি, স্বাধীন বাংলাদেশেও তেমনি তারা হালটিকে
শক্ত হাতে ধরে রেখেছিলেন। এ প্রক্রিয়ায় অসংখ্য অবমাননাকর ঘটনা থেকে
দু-একটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ’৭২ সালের ২৩ জুলাই অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের
সম্মেলনে ‘শুভেচ্ছা’ জানানোর সুযোগ পেয়েছিলেন মণি সিং ও মোজাফফর আহমদ।
কিন্তু তাদের ভাষণের আগে ও পরে উচ্চারিত ছাত্রলীগ কর্মীদের স্লেøাগানটি ছিল
মনে রাখার মতোÑ ‘মার্কসবাদে লাথি মার, মুজিববাদ কায়েম কর।’
১ জানুয়ারি ১৯৭৩। ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষপর্যায়। মস্কোপন্থী বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকার তোপখানা রোড-সংলগ্ন মার্কিন তথ্য সার্ভিস অফিসের (ইউসিস) সামনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিােভ দেখায়। পুলিশ গুলি চালালে মতিউল ও কাদের নামে দু’জন ছাত্র অকুস্থলে মারা যান। প্রাতিবাদে হরতাল ডাকা হয়। ’৭৩ এর জানুয়ারির দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে সরকারবিরোধী মিছিল বিােভে উত্তাল হয়ে ওঠে রাজধানী ঢাকা। ইউসিস ভবন কিছু দিনের জন্য বন্ধ রাখা হয়। এ ভবনের ওপর জাসদ ছাত্রলীগের প থেকে উড়িয়ে দেয়া হয় ‘ভিয়েত কং’-এর পতাকা। সফল হরতালেও বিুদ্ধ ছাত্ররা শান্ত না হওয়ায় ছাত্র ইউনিয়নের প থেকে জনসভা ডেকে বঙ্গবন্ধুর ডাকসুর আজীবন সদস্য গ্রহণ সম্পর্কিত কাগজপত্রাদি প্রকাশ্যে ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে ফেলা হয়। তখনো তাদের রাজনৈতিক সহচর হিসেবে বিবেচিত এ দলের এহেন কর্মকাণ্ড মতাসীন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতৃত্বকে বিুব্ধ করে তোলে। মুজিববাদী ছাত্রলীগ পল্টন ময়দানে সমাবেশ করে। একই সময় বায়তুল মোকাররম এলাকায় চলে ছাত্র ইউনিয়নের মশাল মিছিল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ছাত্রলীগের কর্মীরা মোজাফফর ন্যাপের অফিস ভাঙচুর করে এবং ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। ক্রেমলিনের নীতিনির্ধারকেরা সে দিন উপলব্ধি করেছিলেন, মতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে সঙ্ঘাতে না গিয়ে তাদের রাজনৈতিক সঙ্গী থাকাই উত্তম। মণি সিংহের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব সে দিন তাদের ‘হঠাৎ বিপ্লবী’ ছাত্রদের বুঝিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে মা ভিার জন্য পাঠান এবং বঙ্গবন্ধুর ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ পুনর্বহাল করে। বাংলাদেশে নিযুক্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ভ্যালেন্তিন পপভকে অপসারণ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্র দফতরের ঝানু কূটনীতিক আঁদ্রেই ফমিনকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়।
৭ মার্চ, ১৯৭৩ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৭৩টি আসনে জয়ী হয়। বাকি আসনগুলোর একটিতে জাতীয় লীগের আতাউর রহমান খান এবং স্বতন্ত্রপ্রার্থীরা জয়লাভ করলেও বামপন্থীদের ভাগ্যে একটি আসনও জোটেনি। ৮ মার্চ, ১৯৭৩। বঙ্গন্ধু এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছিলেন, বাংলাদেশে বিরোধী দল বলতে কিছুই নেই। ৯ মার্চ, ১৯৭৩। মস্কোপন্থী ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ ভট্টাচার্জ এক যৌথবিবৃতিতে সরকার দলের ভোট ডাকাতি এবং ফলাফল পাল্টে দেয়ার অভিযোগ এনে বলেন, নির্বাচনের দিন আওয়ামী লীগ জোর করে ভোটকেন্দ্র দখল করেছে, বিরোধীদলীয় পোলিং এজেন্টদের বের করে দিয়ে জাল ভোট দিয়েছে। বিবৃতিতে আরো দাবি করা হয়, ভোটডাকাতি না হলে বিরোধী দল অন্তত ৭০টি আসন লাভ করত (সূত্র : নিউ এইজ, দ্য রেড মওলানা, নবম কিস্তি, নুরুল কবির)।
নিজেদের গ্রহণীয় করার উদ্দেশ্য নিয়ে তারা ঐক্যের আহ্বান সমুন্নত রাখার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের মতো সিপিবি ও ন্যাপকে কেবল স্বাধীনতার কৃতিত্ব দিতে চেয়েছে। তাদের মতে মওলানা ভাসানী এবং সরকারবিরোধী অন্য সবাই ছিলেন স্বাধীনতার শত্র“। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মণি সিং বায়তুল মোকাররমের প্রকাশ্য সমাবেশে মওলানা ভাসানীকে ‘টুকরা টুকরা’ করতে চেয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালের ২৯ ডিসেম্বরের এই ভাষণে মণি সিংহ ঘোষণা করেন, ‘বাংলার মাটিতে ভাসানীর কবরের স্থানও জুটবে না।’ মওলানা ভাসানী তার ‘টুকরা টুকরা হইবার আগে’ শীর্ষক বিবৃতিতে একে ‘হিটলারি ঘোষণা’ আখ্যায়িত করে মণি সিংহের ‘চ্যালেঞ্জ’ গ্রহণ করেছিলেন।
আওয়ামী সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়ার পরিপ্রেেিত ’৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে গঠিত ‘ত্রিদলীয় ঐক্যজোট’-এর অঙ্গসংগঠন হিসেবে সিপিবি ও ন্যাপকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ল্েয গঠিত বাকশালেও তারা সুযোগ পেয়েছিলেন। বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপনের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে বাকশালে যোগদানের পুরস্কার হিসেবে ১১৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ’৭৪ থেকে ’৭৯ নম্বর পর্যন্ত ছয়টি সদস্যপদ জুটেছিল তাদের। বঙ্গবন্ধু ৯ এপ্রিল, ১৯৭৪ মস্কো সফরের সময় তৎকালীন রুশ কমিউনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি তাকে বাংলাদেশে একদলীয় শাসনে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন বলে শোনা যায়। সোভিয়েত সমর্থিত একটি শান্তি সংস্থা ‘দি ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিল’ বঙ্গবন্ধুকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এক নতুন নত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এ সংস্থার তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক রমেশচন্দ্র ঢাকায় এসে বাংলাদেশী এ নেতাকে প্রতিষ্ঠানটির সম্মানজনক পদক ‘জুলিও কুরি’ প্রদান করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু জোটনিরপে আন্দোলনে প্রদত্ত ভাষণে পৃথিবীকে দুই ভাগে ভাগ করেছিলেনÑ এক দিকে শোষক, অন্য দিকে শোষিত, যা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশ্বধারণার সাথে ছিল সাজুয্যপূর্ণ।
মতাসীন দলের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ মাত্র ক’দিন আগে একটি টেলিভিশন চ্যানেল টক শোতে বলেছিলেন, আমাদের মনে হয় সুবিধাবাদী হিসেবে গণ্য করা হয়, কিন্তু তারা আদর্শবাদী। জীবনের এপর্যায়ে এসে আমাদের লেনিনের নেতৃত্বে কাজ করতে হবে। তিনি আরো বলেছেন, ছাত্র ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ থেকে এসে যারা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন তারা এখন অধিকতর যোগ্য বিবেচিত হচ্ছেন। ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মতিয়া ও লেনিন তাদের আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য অভিনন্দিত হচ্ছেন। লেনিনকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত করার প্রতিক্রিয়া হিসেবে তার এসব মন্তব্য। মতাসীন দলের কেন্দ্রীয় কমিটি, প্রেসিডিয়াম, উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ সর্বত্রই এখন মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক ডাকসাইটে নেতাদের দাপট বিশেষভাবে লণীয়। তারা আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী হলেও দলীয় নীতিনির্ধারণ এবং সরকারের কর্মপন্থা নির্ধারণে তাদের প্রভাব অলঙ্ঘনীয়। মস্কোপন্থীরা এখন আওয়ামী লীগের কাঁধে সওয়ার হয়ে দলটিকে মতাচর্চায় ক্রমাগত স্বেচ্ছাচারিতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ায় এ দেশে মস্কোপন্থীদের তাত্ত্বিক রাজনীতি দারুণভাবে হোঁচট খায়। কমিউনিস্টরা সব সময়ই একদলীয় শাসনে বিশ্বাসী। আওয়ামী লীগ এবং ভারতীয় কংগ্রেস পাকিস্তান আমল থেকেই একই রাজনৈতিক আদর্শ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন অন্যতম আন্তর্জাতিক মুরব্বি সোভিয়েত ইউনিয়নের আশীর্বাদ নিয়ে ভারত পকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, যা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য ছিল প্রধান নিয়ামক। ভারতপন্থী মতাসীন আওয়ামী লীগের চেয়ে রুশপন্থী কমিউনিস্টদের এ দেশে ‘বিগব্রাদার’-সুলভ আচরণ তো নেহায়েতই স্বাভাবিক ঘটনা! বর্তমান আওয়ামী শাসনে মস্কোপন্থীদের দৌরাত্ম্য মেনে না নিয়ে তোফায়েলদের আর কী-ই বা করার আছে! সুবিধাবাদের রাজনীতিই হচ্ছে মস্কোপন্থীদের একমাত্র আদর্শ। আব্রাহাম লিংকনের সে বিখ্যাত উক্তিটি এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য “If this is coffee, please bring me some tea: But if this is tea, please bring me some coffee.” অর্থাৎ ‘এটা যদি কফি হয় দয়া করে আমাকে কিছু চা দিন, আর যদি এটা হয় চা তাহলে আমাকে কিছু কফি দিন।’হ
Kazi_sayed@yahoo.com
১ জানুয়ারি ১৯৭৩। ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষপর্যায়। মস্কোপন্থী বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকার তোপখানা রোড-সংলগ্ন মার্কিন তথ্য সার্ভিস অফিসের (ইউসিস) সামনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিােভ দেখায়। পুলিশ গুলি চালালে মতিউল ও কাদের নামে দু’জন ছাত্র অকুস্থলে মারা যান। প্রাতিবাদে হরতাল ডাকা হয়। ’৭৩ এর জানুয়ারির দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে সরকারবিরোধী মিছিল বিােভে উত্তাল হয়ে ওঠে রাজধানী ঢাকা। ইউসিস ভবন কিছু দিনের জন্য বন্ধ রাখা হয়। এ ভবনের ওপর জাসদ ছাত্রলীগের প থেকে উড়িয়ে দেয়া হয় ‘ভিয়েত কং’-এর পতাকা। সফল হরতালেও বিুদ্ধ ছাত্ররা শান্ত না হওয়ায় ছাত্র ইউনিয়নের প থেকে জনসভা ডেকে বঙ্গবন্ধুর ডাকসুর আজীবন সদস্য গ্রহণ সম্পর্কিত কাগজপত্রাদি প্রকাশ্যে ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে ফেলা হয়। তখনো তাদের রাজনৈতিক সহচর হিসেবে বিবেচিত এ দলের এহেন কর্মকাণ্ড মতাসীন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতৃত্বকে বিুব্ধ করে তোলে। মুজিববাদী ছাত্রলীগ পল্টন ময়দানে সমাবেশ করে। একই সময় বায়তুল মোকাররম এলাকায় চলে ছাত্র ইউনিয়নের মশাল মিছিল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ছাত্রলীগের কর্মীরা মোজাফফর ন্যাপের অফিস ভাঙচুর করে এবং ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। ক্রেমলিনের নীতিনির্ধারকেরা সে দিন উপলব্ধি করেছিলেন, মতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে সঙ্ঘাতে না গিয়ে তাদের রাজনৈতিক সঙ্গী থাকাই উত্তম। মণি সিংহের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব সে দিন তাদের ‘হঠাৎ বিপ্লবী’ ছাত্রদের বুঝিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে মা ভিার জন্য পাঠান এবং বঙ্গবন্ধুর ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ পুনর্বহাল করে। বাংলাদেশে নিযুক্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ভ্যালেন্তিন পপভকে অপসারণ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্র দফতরের ঝানু কূটনীতিক আঁদ্রেই ফমিনকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়।
৭ মার্চ, ১৯৭৩ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৭৩টি আসনে জয়ী হয়। বাকি আসনগুলোর একটিতে জাতীয় লীগের আতাউর রহমান খান এবং স্বতন্ত্রপ্রার্থীরা জয়লাভ করলেও বামপন্থীদের ভাগ্যে একটি আসনও জোটেনি। ৮ মার্চ, ১৯৭৩। বঙ্গন্ধু এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছিলেন, বাংলাদেশে বিরোধী দল বলতে কিছুই নেই। ৯ মার্চ, ১৯৭৩। মস্কোপন্থী ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ ভট্টাচার্জ এক যৌথবিবৃতিতে সরকার দলের ভোট ডাকাতি এবং ফলাফল পাল্টে দেয়ার অভিযোগ এনে বলেন, নির্বাচনের দিন আওয়ামী লীগ জোর করে ভোটকেন্দ্র দখল করেছে, বিরোধীদলীয় পোলিং এজেন্টদের বের করে দিয়ে জাল ভোট দিয়েছে। বিবৃতিতে আরো দাবি করা হয়, ভোটডাকাতি না হলে বিরোধী দল অন্তত ৭০টি আসন লাভ করত (সূত্র : নিউ এইজ, দ্য রেড মওলানা, নবম কিস্তি, নুরুল কবির)।
নিজেদের গ্রহণীয় করার উদ্দেশ্য নিয়ে তারা ঐক্যের আহ্বান সমুন্নত রাখার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের মতো সিপিবি ও ন্যাপকে কেবল স্বাধীনতার কৃতিত্ব দিতে চেয়েছে। তাদের মতে মওলানা ভাসানী এবং সরকারবিরোধী অন্য সবাই ছিলেন স্বাধীনতার শত্র“। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মণি সিং বায়তুল মোকাররমের প্রকাশ্য সমাবেশে মওলানা ভাসানীকে ‘টুকরা টুকরা’ করতে চেয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালের ২৯ ডিসেম্বরের এই ভাষণে মণি সিংহ ঘোষণা করেন, ‘বাংলার মাটিতে ভাসানীর কবরের স্থানও জুটবে না।’ মওলানা ভাসানী তার ‘টুকরা টুকরা হইবার আগে’ শীর্ষক বিবৃতিতে একে ‘হিটলারি ঘোষণা’ আখ্যায়িত করে মণি সিংহের ‘চ্যালেঞ্জ’ গ্রহণ করেছিলেন।
আওয়ামী সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়ার পরিপ্রেেিত ’৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে গঠিত ‘ত্রিদলীয় ঐক্যজোট’-এর অঙ্গসংগঠন হিসেবে সিপিবি ও ন্যাপকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ল্েয গঠিত বাকশালেও তারা সুযোগ পেয়েছিলেন। বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপনের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে বাকশালে যোগদানের পুরস্কার হিসেবে ১১৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ’৭৪ থেকে ’৭৯ নম্বর পর্যন্ত ছয়টি সদস্যপদ জুটেছিল তাদের। বঙ্গবন্ধু ৯ এপ্রিল, ১৯৭৪ মস্কো সফরের সময় তৎকালীন রুশ কমিউনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি তাকে বাংলাদেশে একদলীয় শাসনে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন বলে শোনা যায়। সোভিয়েত সমর্থিত একটি শান্তি সংস্থা ‘দি ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিল’ বঙ্গবন্ধুকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এক নতুন নত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এ সংস্থার তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক রমেশচন্দ্র ঢাকায় এসে বাংলাদেশী এ নেতাকে প্রতিষ্ঠানটির সম্মানজনক পদক ‘জুলিও কুরি’ প্রদান করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু জোটনিরপে আন্দোলনে প্রদত্ত ভাষণে পৃথিবীকে দুই ভাগে ভাগ করেছিলেনÑ এক দিকে শোষক, অন্য দিকে শোষিত, যা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশ্বধারণার সাথে ছিল সাজুয্যপূর্ণ।
মতাসীন দলের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ মাত্র ক’দিন আগে একটি টেলিভিশন চ্যানেল টক শোতে বলেছিলেন, আমাদের মনে হয় সুবিধাবাদী হিসেবে গণ্য করা হয়, কিন্তু তারা আদর্শবাদী। জীবনের এপর্যায়ে এসে আমাদের লেনিনের নেতৃত্বে কাজ করতে হবে। তিনি আরো বলেছেন, ছাত্র ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ থেকে এসে যারা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন তারা এখন অধিকতর যোগ্য বিবেচিত হচ্ছেন। ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মতিয়া ও লেনিন তাদের আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য অভিনন্দিত হচ্ছেন। লেনিনকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত করার প্রতিক্রিয়া হিসেবে তার এসব মন্তব্য। মতাসীন দলের কেন্দ্রীয় কমিটি, প্রেসিডিয়াম, উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ সর্বত্রই এখন মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক ডাকসাইটে নেতাদের দাপট বিশেষভাবে লণীয়। তারা আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী হলেও দলীয় নীতিনির্ধারণ এবং সরকারের কর্মপন্থা নির্ধারণে তাদের প্রভাব অলঙ্ঘনীয়। মস্কোপন্থীরা এখন আওয়ামী লীগের কাঁধে সওয়ার হয়ে দলটিকে মতাচর্চায় ক্রমাগত স্বেচ্ছাচারিতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ায় এ দেশে মস্কোপন্থীদের তাত্ত্বিক রাজনীতি দারুণভাবে হোঁচট খায়। কমিউনিস্টরা সব সময়ই একদলীয় শাসনে বিশ্বাসী। আওয়ামী লীগ এবং ভারতীয় কংগ্রেস পাকিস্তান আমল থেকেই একই রাজনৈতিক আদর্শ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন অন্যতম আন্তর্জাতিক মুরব্বি সোভিয়েত ইউনিয়নের আশীর্বাদ নিয়ে ভারত পকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, যা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য ছিল প্রধান নিয়ামক। ভারতপন্থী মতাসীন আওয়ামী লীগের চেয়ে রুশপন্থী কমিউনিস্টদের এ দেশে ‘বিগব্রাদার’-সুলভ আচরণ তো নেহায়েতই স্বাভাবিক ঘটনা! বর্তমান আওয়ামী শাসনে মস্কোপন্থীদের দৌরাত্ম্য মেনে না নিয়ে তোফায়েলদের আর কী-ই বা করার আছে! সুবিধাবাদের রাজনীতিই হচ্ছে মস্কোপন্থীদের একমাত্র আদর্শ। আব্রাহাম লিংকনের সে বিখ্যাত উক্তিটি এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য “If this is coffee, please bring me some tea: But if this is tea, please bring me some coffee.” অর্থাৎ ‘এটা যদি কফি হয় দয়া করে আমাকে কিছু চা দিন, আর যদি এটা হয় চা তাহলে আমাকে কিছু কফি দিন।’হ
Kazi_sayed@yahoo.com
No comments