স্মরণ-সংস্কৃতি ও রাজনীতির মেলবন্ধন by মফিদুল হক
১৯৬২ থেকে ১৯৬৯_ এই সময়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছেন সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক, বাঙালি জাতির জন্যও সেটা ছিল সুদীর্ঘ পথ-পরিক্রমণ। কত কিছুই না ঘটে গেল জাতির জীবনে, কত অসংখ্য ঘটনা, নির্যাতন, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আর সবকিছু মিলে শত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জাতির কী অপরূপ
জাগরণ! এই জাগরণের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতির তিনি নেতা আর এই নেতৃত্বের পথ নির্মিত হয়েছিল বহু মানুষের, বহু ধরনের অবদানের মধ্য দিয়ে, যেখানে ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের মহিমা অপার। আর জাতীয় জাগরণের প্রয়াসকে সংহত করে তাকে গভীর ব্যঞ্জনা ও সর্বপ্লাবী আবেদন জুগিয়েছিল সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এই উভয় ক্ষেত্রে সক্রিয় ছিলেন সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক এবং সংস্কৃতি ও রাজনীতির এমন এক অসাধারণ মেলবন্ধনের পরিচয় রেখেছিলেন, যা বিশাল প্রভাব রেখে গেছে তৎকালীন তরুণ মানসে।
'৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন থেকে '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান অবধি প্রতিটি ছাত্র আন্দোলনে সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক যুক্ত ছিলেন ওতপ্রোতভাবে। বাষট্টি থেকে ঊনসত্তরের এই যাত্রাপথ মসৃণ ছিল না, বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং নেপথ্য নির্মাণ প্রয়াসের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে ঘটেছে আন্দোলনের সংহতি, জাতিসত্তার জাগরণ। সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ থেকে এই জাগরণের যে বিকাশ তার সূচনায় রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপন, ছায়ানট প্রতিষ্ঠা, সংস্কৃতি সংসদের কর্মকাণ্ড, একুশে উদযাপন, পহেলা বৈশাখ পালন ইত্যাদি বহুমুখী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তার যোগ অত্যন্ত নিবিড়, কখনও নেতৃত্বমূলক, কখনও-বা প্রেরণামূলক। জীবনের সমগ্রতার ধারণা ছাড়া জাতির বিকাশের চেতনার প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব নয় এবং তার বিরল প্রকাশ হিসেবে সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক ক্রীড়ার সঙ্গেও যোগ সদা বজায় রেখে চলেছেন, যদিও রাজনীতি তাকে সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রাখার সুযোগ সবসময়ে দেয়নি।
বড়ভাবে দেখতে গেলে সাইফউদ্দিন মানিকের ভূমিকাকে তিনভাবে আমরা চিহ্নিত করতে পারি। প্রথমত, ষাটের দশকের আন্দোলনের জোরের দিক ছিল এর ঐক্যসূত্র। নানা ধারা-উপধারায় বিভাজিত রাজনীতির বাইরে এক বিশাল ঐক্যের প্লাটফর্ম গড়ে তুলেছিল ছাত্রসমাজ এবং এই ঐক্য গড়ার তাত্তি্বক বা রাজনৈতিক ভিত্তির বাইরে অনন্য এক প্রাণময় মাত্রা যোগ করেছিলেন তিনি, তার ব্যক্তিসত্তার গুণে নেতৃমহলে যে সমঝোতা গড়ে ওঠে সেটা বিশেষ অনুকূল আবহ তৈরি করেছিল। দ্বিতীয়ত, সংগ্রামী নেতার প্রচলিত সমাজপৃথক অতিমানব ইমেজ ভেঙে প্রবলভাবে জীবনবাদী অথচ জীবনসংগ্রামী যে রূপ সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক মেলে ধরেন তা সহযাত্রী অনুগামীদের বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত করে। এ ক্ষেত্রে সংগঠনে নারীদের মর্যাদায় অভিষিক্ত করে আকৃষ্ট করার দ্বার তিনি খুলে দিয়েছিলেন। ষাটের দশকে ছাত্র-গণআন্দোলনে নারীদের ভিন্নতর ও ব্যাপকতর অংশগ্রহণ ভবিষ্যৎ অনেক অনুকূল বিকাশের পথ খুলে দিয়েছিল। তৃতীয়ত এবং সর্বোপরি, ছাত্র ইউনিয়নের সব কর্মকাণ্ডে যে সাংস্কৃতিক মাত্রা যুক্ত ছিল তার উদ্গাতা ও রূপকার হিসেবে সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিকের ছিল প্রোজ্জ্বল ভূমিকা। তার সঙ্গে পরে যুক্ত হন আরও অনেক যোগ্য সাথী ও সারথি। রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখে ছায়ানটের বর্ষ-আবাহন অনুষ্ঠানে হোসেনি দালান থেকে সজ্জিত মিছিল নিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের যোগদান ছিল এক তাৎপর্যময় প্রতীকী ঘটনা। জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক জাগরণে ছাত্রসমাজ তথা বৃহত্তর সমাজের এই সম্পৃক্তি জাতিকে মুক্তিপথের দিশা জুগিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গের বিশেষ বাস্তবতায় জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের তাৎপর্য ব্যাপকতর মাত্রা নিয়ে ফুটে ওঠে। বামপন্থার ইমেজের সঙ্গে স্বতঃসিদ্ধভাবে যে সাংস্কৃতিক প্রতিরূপ ফুটে ওঠে, একদা গণনাট্য সংঘ ছিল যার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ, তার সাফল্য ও ব্যর্থতাকে ছাপিয়ে পূর্ববঙ্গে গড়ে উঠল ষাটের অভিনব সাংস্কৃতিক আন্দোলন_ বামপন্থা হয়ে উঠল মূলধারার সংস্কৃতিচর্চার সৃজনশীল প্লাটফর্ম। এই ভিন্নতা অনুপম প্রকাশ পেয়েছে সেই তরুণের মধ্যে যিনি রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপনের ছিলেন অংশী ও কর্মী, ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। তারপর চলে গেলেন ছাত্র আন্দোলনের কাতারে এবং ছাত্রসমাজকে নিয়ে মিছিল করে প্রত্যাবর্তন করলেন বৈশাখী উৎসবে, ছায়ানটের বর্ষ-আবাহনে, যা দেখতে দেখতে হয়ে উঠল জাতিসত্তার জনগণের প্রতীক।
এমনিভাবে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে মুক্তিপিয়াসী চেতনা ও লক্ষ্য নিয়ে অনেককে সাথী করে সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক এসে পেঁৗছে ছিলেন ঊনসত্তরে, জাতিও তখন এসে পেঁৗছেছে গণঅভ্যুত্থানের দুয়ারে, আর জাতির এই পথ-পরিক্রমণের অন্যতম সারথি হিসেবে সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক অনন্যতা পেয়েছিলেন বিশাল আন্দোলনের টেউয়ের শীর্ষে পল্টনের বিশাল জনতার সামনে দাঁড়িয়ে স্বভাবসিদ্ধ সুললিত ও আন্তরিক ভাষণে 'গণঅভ্যুত্থান' শব্দটি উচ্চারণ করে, যেটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা ছিল না, এই উচ্চারণ একমাত্র তার কণ্ঠেই শোভন ও সঙ্গত ছিল। তিনি তরুণ ছাত্রনেতা হলেও যার পেছনে ছিল লাগাতার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগ্রামের পরম নিষ্ঠাবান, প্রতিভাদীপ্ত ও মানবিক ভূমিকা। সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিকের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই শ্রদ্ধার্ঘ্য।
মফিদুল হক : প্রাবন্ধিক ও
সাংস্কৃতিক সংগঠক
'৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন থেকে '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান অবধি প্রতিটি ছাত্র আন্দোলনে সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক যুক্ত ছিলেন ওতপ্রোতভাবে। বাষট্টি থেকে ঊনসত্তরের এই যাত্রাপথ মসৃণ ছিল না, বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং নেপথ্য নির্মাণ প্রয়াসের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে ঘটেছে আন্দোলনের সংহতি, জাতিসত্তার জাগরণ। সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ থেকে এই জাগরণের যে বিকাশ তার সূচনায় রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপন, ছায়ানট প্রতিষ্ঠা, সংস্কৃতি সংসদের কর্মকাণ্ড, একুশে উদযাপন, পহেলা বৈশাখ পালন ইত্যাদি বহুমুখী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তার যোগ অত্যন্ত নিবিড়, কখনও নেতৃত্বমূলক, কখনও-বা প্রেরণামূলক। জীবনের সমগ্রতার ধারণা ছাড়া জাতির বিকাশের চেতনার প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব নয় এবং তার বিরল প্রকাশ হিসেবে সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক ক্রীড়ার সঙ্গেও যোগ সদা বজায় রেখে চলেছেন, যদিও রাজনীতি তাকে সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রাখার সুযোগ সবসময়ে দেয়নি।
বড়ভাবে দেখতে গেলে সাইফউদ্দিন মানিকের ভূমিকাকে তিনভাবে আমরা চিহ্নিত করতে পারি। প্রথমত, ষাটের দশকের আন্দোলনের জোরের দিক ছিল এর ঐক্যসূত্র। নানা ধারা-উপধারায় বিভাজিত রাজনীতির বাইরে এক বিশাল ঐক্যের প্লাটফর্ম গড়ে তুলেছিল ছাত্রসমাজ এবং এই ঐক্য গড়ার তাত্তি্বক বা রাজনৈতিক ভিত্তির বাইরে অনন্য এক প্রাণময় মাত্রা যোগ করেছিলেন তিনি, তার ব্যক্তিসত্তার গুণে নেতৃমহলে যে সমঝোতা গড়ে ওঠে সেটা বিশেষ অনুকূল আবহ তৈরি করেছিল। দ্বিতীয়ত, সংগ্রামী নেতার প্রচলিত সমাজপৃথক অতিমানব ইমেজ ভেঙে প্রবলভাবে জীবনবাদী অথচ জীবনসংগ্রামী যে রূপ সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক মেলে ধরেন তা সহযাত্রী অনুগামীদের বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত করে। এ ক্ষেত্রে সংগঠনে নারীদের মর্যাদায় অভিষিক্ত করে আকৃষ্ট করার দ্বার তিনি খুলে দিয়েছিলেন। ষাটের দশকে ছাত্র-গণআন্দোলনে নারীদের ভিন্নতর ও ব্যাপকতর অংশগ্রহণ ভবিষ্যৎ অনেক অনুকূল বিকাশের পথ খুলে দিয়েছিল। তৃতীয়ত এবং সর্বোপরি, ছাত্র ইউনিয়নের সব কর্মকাণ্ডে যে সাংস্কৃতিক মাত্রা যুক্ত ছিল তার উদ্গাতা ও রূপকার হিসেবে সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিকের ছিল প্রোজ্জ্বল ভূমিকা। তার সঙ্গে পরে যুক্ত হন আরও অনেক যোগ্য সাথী ও সারথি। রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখে ছায়ানটের বর্ষ-আবাহন অনুষ্ঠানে হোসেনি দালান থেকে সজ্জিত মিছিল নিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের যোগদান ছিল এক তাৎপর্যময় প্রতীকী ঘটনা। জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক জাগরণে ছাত্রসমাজ তথা বৃহত্তর সমাজের এই সম্পৃক্তি জাতিকে মুক্তিপথের দিশা জুগিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গের বিশেষ বাস্তবতায় জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের তাৎপর্য ব্যাপকতর মাত্রা নিয়ে ফুটে ওঠে। বামপন্থার ইমেজের সঙ্গে স্বতঃসিদ্ধভাবে যে সাংস্কৃতিক প্রতিরূপ ফুটে ওঠে, একদা গণনাট্য সংঘ ছিল যার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ, তার সাফল্য ও ব্যর্থতাকে ছাপিয়ে পূর্ববঙ্গে গড়ে উঠল ষাটের অভিনব সাংস্কৃতিক আন্দোলন_ বামপন্থা হয়ে উঠল মূলধারার সংস্কৃতিচর্চার সৃজনশীল প্লাটফর্ম। এই ভিন্নতা অনুপম প্রকাশ পেয়েছে সেই তরুণের মধ্যে যিনি রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপনের ছিলেন অংশী ও কর্মী, ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। তারপর চলে গেলেন ছাত্র আন্দোলনের কাতারে এবং ছাত্রসমাজকে নিয়ে মিছিল করে প্রত্যাবর্তন করলেন বৈশাখী উৎসবে, ছায়ানটের বর্ষ-আবাহনে, যা দেখতে দেখতে হয়ে উঠল জাতিসত্তার জনগণের প্রতীক।
এমনিভাবে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে মুক্তিপিয়াসী চেতনা ও লক্ষ্য নিয়ে অনেককে সাথী করে সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক এসে পেঁৗছে ছিলেন ঊনসত্তরে, জাতিও তখন এসে পেঁৗছেছে গণঅভ্যুত্থানের দুয়ারে, আর জাতির এই পথ-পরিক্রমণের অন্যতম সারথি হিসেবে সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক অনন্যতা পেয়েছিলেন বিশাল আন্দোলনের টেউয়ের শীর্ষে পল্টনের বিশাল জনতার সামনে দাঁড়িয়ে স্বভাবসিদ্ধ সুললিত ও আন্তরিক ভাষণে 'গণঅভ্যুত্থান' শব্দটি উচ্চারণ করে, যেটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা ছিল না, এই উচ্চারণ একমাত্র তার কণ্ঠেই শোভন ও সঙ্গত ছিল। তিনি তরুণ ছাত্রনেতা হলেও যার পেছনে ছিল লাগাতার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগ্রামের পরম নিষ্ঠাবান, প্রতিভাদীপ্ত ও মানবিক ভূমিকা। সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিকের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই শ্রদ্ধার্ঘ্য।
মফিদুল হক : প্রাবন্ধিক ও
সাংস্কৃতিক সংগঠক
No comments