‘সাধারণ’ ওষুধঃ অসাধারণ চিকিৎসক- তৃতীয় নয়ন by মীযানুল করীম
ঢাকার বাইরে একটি জেলায় গ্রামাঞ্চলে যাচ্ছি। জেলা সদর থেকে চাপলাম লোকাল বাসে। ছাড়ার আগেই শুরু হলো যাত্রীদের ‘ধূম্র উৎসব’।
অর্থাৎ
মহানন্দে বেপরোয়া ধূমপান। আমার ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে বোধহয় কেউ বাকি
ছিল না। কিশোর থেকে বৃদ্ধ, ধনী থেকে গরিবÑ সব যাত্রী সিগ্রেট ফুঁকছে বিপুল
উৎসাহে। গাড়ি থেমে থাকা অবস্থায় ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছিল বাসের ভেতরটা।
কেবল দু-একজন সিগ্রেট টানলে না হয় অনুরোধ করা যায় না খেতে। কিন্তু সবাই
যখন এই অপকর্মে মেতে ওঠে, তখন অসহায়ভাবে বসে থাকার বিকল্প নেই। না হয়
হলাম ‘হংস মাঝে বক যথা’, কিন্তু দম বন্ধ করে বসে থাকতে তো পারি না। এ দিকে
ধূমপানের তাণ্ডবে নাক দিয়ে ধোঁয়া ঢুকছে। চোখ জ্বালাপোড়া করছে একই কারণে।
যারা সিগ্রেট খাচ্ছে, তারা যেন ধারণাই করতে পারে না যে, কোনো
প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ যাত্রী এই ক্ষতিকর কাজটি থেকে বিরত থাকতে পারেন। সেদিন
বাস ছাড়তে দেরি হচ্ছিল; এর মধ্যে মহিলা যাত্রীদের অবস্থা ও অস্বস্তি কেমন
হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। পাশের কেউ বিড়ি-সিগ্রেট টানলে মহিলা ও শিশু,
বিশেষ করে গর্ভবতী নারীর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে, সে কথা কাউকে বলার
উপায় ছিল না।
এ তো শুধু একটি অভিজ্ঞতার খণ্ডচিত্র। সে রুটেই কেবল নয়, এমন বহু রুটের যানবাহনে ফ্রি স্টাইলে ধূমপানের উন্মত্ততা চলে অহরহ। নিত্যদিন অসংখ্য মানুষ এভাবে যক্ষ্মা ও ক্যান্সারসহ বিভিন্ন কালব্যাধি ডেকে আনছে নিজের জন্য। তেমনি পাশের মানুষটিরও ক্ষতি করছে অজান্তে।
আমার পরিচিত এক লোক তার শৈশবের একটি ঘটনা বলেছিলেন। তখন এক দিন কোত্থেকে যেন একটা সিগ্রেট পেয়েছিলেন। বড়রা ফুড়–ত ফুড়–ত টানে। সব সময় এটা দেখে ভাবলেন, না জানি কত না স্বাদের জিনিস। রাতে বুড়ি নানী ঘুমাচ্ছিলেন মশারি খাটিয়ে। শিশু নাতি সিগ্রেট ধরিয়ে নানীর মশারিতে ঢুকলেন যাতে লুকিয়ে তা খাওয়া যায়। শুয়ে সিগ্রেটে টান দিলেন। নেশার সুখটানে অচিরেই গভীর ঘুম। এ দিকে হাতের সিগ্রেট জ্বলছে। হঠাৎ নানীর আর্তচিৎকারে ঘুম ভেঙে গেলে দেখেন, মশারিতে আগুন লেগে গেছে। ওই সিগ্রেটই এর উৎস। ভাগ্য ভালো যে, সেদিন কোনো মতে নানী-নাতি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু কত লোকই তো এমন ঘটনায় হতাহত হয়েছেন, হচ্ছেন। এ দেশের একজন বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী সত্তরের দশকে মশারিতে সিগ্রেটের আগুন লেগে পুড়ে প্রাণ হারিয়েছেন।
ধূমপানও মদপানের মতো নেশা। মাদকাসক্তির সূচনা হয় বিড়ি-সিগ্রেট দিয়ে। কথায় বলেÑ ‘মানুষ প্রথমে সিগ্রেট খায়, পরে সিগ্রেট তাকে খায়।’ আমার মনে হয় বুদ্ধিমান ধূমপায়ীরাও এ কাজটি করার সময় কাণ্ডজ্ঞান, আক্কেল-আন্দাজ হারিয়ে ফেলেন। কোথায় কিভাবে ধূমপান করছেন; পাশেই কোনো রোগী, শিশু, মহিলা বা বৃদ্ধ আছেন কি না অথবা পাশের মানুষটি ধূমপান ঘৃণা করেন কি নাÑ এসব প্রায় ক্ষেত্রে তোয়াক্কা করা হয় না। এমনকি সিগ্রেটের অবশিষ্ট অংশটুকু তারা কোনো খেয়াল না করেই বে-আক্কেলের মতো যেদিকে সেদিকে ইচ্ছামতো ছুড়ে মারেন। একবার এক ব্যক্তি জানিয়েছিলেন তার ভাইয়ের বিপদের কথা। ভাইটি একটি বাসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ এক যাত্রী ছুড়ে ফেললেন সিগ্রেটের লেজ। জ্বলন্ত টুকরোটি ওই তরুণের চোখে এসে লাগে। এতে তার চোখের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছিল। এমন ঘটনার শিকার হয়ে অন্ধও হওয়া বিচিত্র নয়।
প্রকাশ্যে ধূমপানের শাস্তি ৫০ টাকা জরিমানা। যদিও ধূমপানের ভয়াবহ ক্ষতির তুলনায় এটা কিছুই না, তবুও এই নগণ্য দণ্ডটুকু পর্যন্ত কার্যকর হচ্ছে না। দু-এক জায়গায় কোনো কোনো ম্যাজিস্ট্রেট তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে দু-চারজনের জরিমানা করেছেন। এটা ব্যতিক্রম মাত্র। খোদ পুলিশ লোকজনের মাঝে ইচ্ছামতো ধূমপান করছে; আইন প্রয়োগ করবে কে? শিক্ষিত ও দায়িত্বশীল বহু নাগরিকও রাস্তাঘাটে, যানবাহনে সিগ্রেট ফুঁকছেন। অন্যদের এতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না, তা ভেবে দেখার গরজও কারো নেই।
আজকাল বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞাপনে গালভরা বুলি দেখা যায়Ñ ‘কোলাহলমুক্ত পরিবেশ, রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গন, ধূমপানমুক্ত ক্যাম্পাস।’ বাস্তবে অবস্থাটা কী? বিভিন্ন নামী-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে দেখা যায়, ভদ্রঘরের অভিজাত শিক্ষার্থীরা প্রাণপণে সিগ্রেট টেনে শেষ করায় ব্যস্ত। কারণ কাসের সময় হয়ে যাচ্ছে। গেটেই ধূম্র পান করার কাজটা সম্পন্ন করে ক্যাম্পাস ধোঁয়া থেকে মুক্ত রাখার বিষয়ে ছাত্ররা খুব সচেতন!
আমাদের শৈশবে মফস্বলে দেখতাম, একেবারে অশিক্ষিত, মুটে-মজুর শ্রেণীর কিংবা ছিন্নমূল টোকাই শিশু-কিশোররাই বিড়ি-সিগ্রেট টানে। এটাকে বড় ধরনের বেয়াদবি বা মন্দকাজ বলেও মুরব্বিরা মনে করেন। এখন দেখছি, অন্যান্য দিকের মতো এ দিক দিয়েও সমাজ বদলে যাচ্ছে। এই রাজধানীতে দেখা যায়, শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের স্কুলপড়–য়া ছেলেরা পর্যন্ত প্রকাশ্যে সিগ্রেট টানছে ‘ড্যাম কেয়ার’ ভঙ্গিতে। ‘অভিজাত’ পরিবারের শিক্ষিত তরুণীদের অনেকের ধূমপান চলছে রাস্তাঘাটেই। আমি নিজেই এই দৃশ্য দেখেছি।
এই যে এতক্ষণ ধূমপানবিরোধী এত কিছু বলেছি, এতে অনেকে অবাক হয়ে ভাববেনÑ এখন তো সংশ্লিষ্ট কোনো দিবস নেই, তবুও কেন এসব বক্তব্য ঝাড়লেন? আবার ধূম্রপূজারীরা বিরক্তির সাথে বলবেন, কোটি কোটি মানুষ যা করছে, তার সমালোচনা করে এসব প্যাঁচাল পাড়ছেন কেন?
কারণ হলো, যে মানুষটি আজীবন এই জাতিকে সজাগ ও সতর্ক করতে চেয়েছেন ধূমপানের নীরব ঘাতক সম্পর্কে, তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। নিশ্চয়ই সবাই বলবেন, সেই ‘তিনি’ আর কেউ ননÑ জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর ডা: নুরুল ইসলাম। ভাবছি, যেখানে দেশে ধূমপানের মাত্রা কমেছে বলে মনে হয় না এবং দেশী-বিদেশী নতুন নতুন ব্র্যান্ডের সিগারেটের বাজার বাড়ছে, সে ক্ষেত্রে নুরুল ইসলামরা সফল হলেন কই? তাহলে কেন তিনি অন্তত অর্ধশতাব্দী ধরে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে চাইলেন? আসলে তিনি একা তো এই অসাধ্য সাধন করতে পারেন না। কিন্তু জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়ে ধূমপানের বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম করে গেছেন দশকের পর দশক।
ছোটবেলায় শুনেছি, সিভিল সার্ভিস বা সুপিরিয়র সার্ভিসের ক্যাডারদের চাকরির আগে ট্রেনিং দেয়া হয় স্মার্টনেসেরও। এ জন্য যেসব কাজ শেখানো হয়, তার মধ্যে আছে সিগ্রেট কিভাবে ধরে কেমন করে খেতে হবে, সে স্টাইলও। এটা পাকিস্তানি আমলের কথা এবং ব্রিটিশ আমলের উত্তরাধিকার। এখন নিশ্চয়ই এসব করা হয় না। স্মার্ট হতে ধূমপান করতে হয় না, বরং অধূমপায়ীরাই প্রকৃত স্মার্ট ও আধুনিক। এই জরুরি আইডিয়া ও উপলব্ধি অনেকের মধ্যে এসেছে। এর কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশি যে মানুষটির নিরলস প্রয়াসের, তার নাম (প্রফেসর) নুরুল ইসলাম। বিশেষ করে নবীন প্রজন্মকে সত্যিকার আধুনিক ও স্মার্ট বানাতেই তিনি তার সবচেয়ে প্রিয় সংগঠনটির নাম দিয়েছিলেন ‘আধূনিক’। ‘আমরা ধূমপান নিবারণ করি’Ñ শব্দ চারটির আদ্যাক্ষর নিয়ে ‘আধূনিক’। কিছু দিন আগে একটি সংগঠন তরুণ-তরুণীদের নিয়ে প্রচার শুরু করেছিলÑ ‘আমরা স্মার্ট। তাই আমরা ধূমপান করি না।’ এই কার্যক্রম ব্যাপক করা এবং অব্যাহত রাখা অপরিহার্য।
প্রফেসর নুরুল ইসলাম ছিলেন দূরদর্শী। এর প্রমাণ (ক) ‘আধূনিক’ আন্দোলন, (খ) জাতীয় ওষুধনীতি ও স্বাস্থ্যনীতি, (গ) সমন্বিত চিকিৎসাব্যবস্থা, (ঘ) উচ্চশিক্ষা বিস্তারের বেসরকারি উদ্যোগ।
যখন ধূমপানবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, তখন অনেকেই অবাক হয়ে ভেবেছেনÑ ‘দেশে কত বড় বড় সমস্যা, আর উনি নেমেছেন সিগ্রেট ফুঁকার বিরুদ্ধে।’ ধূমপানকে নেশা বলে মনে করা হতো না। মানুষের ধারণা ছিল, ‘মদ খাওয়া না হয় খারাপ, মুখ থেকে সামান্য ধোঁয়া ছাড়লে কার কী ক্ষতি।’ এখন যক্ষ্মার সাথে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগের মহামারী দেখে বোঝা যায়, ডা: নুরুল ইসলামের কতখানি দূরদৃষ্টি ছিল। বারডেম প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ডা: মোহাম্মদ ইব্রাহিম যখন এই প্রতিষ্ঠান গড়ায় নামলেন, তখন অনেক চিকিৎসক পর্যন্ত তার অগ্রাধিকারবোধ নিয়ে ব্যঙ্গ-রসিকতা করতেন। আশির দশকের মাঝামাঝি বারডেম ভবনের তলা যখন বাড়ছে, তখন একজন চিকিৎসক আমাকে বলেছিলেন, ‘এ দেশের মানুষের মারাত্মক রোগ হিসেবে ডায়াবেটিসের নাম অনেক পরে। অথচ ইব্রাহিম সাহেব তা নিয়ে মাতামাতি করছেন।’
এখন প্রমাণিত হচ্ছে ইব্রাহিমের দূরদর্শিতা। ওই চিকিৎসক ‘আঁতের ডাক্তার’। নিশ্চয়ই আন্ত্রিক রোগের চেয়ে ডায়াবেটিসের রোগী বহুগুণ বেশি। ডা: নুরুল ইসলামের ‘আধূনিক’ নিয়েও বহু আধুনিক মানুষ প্রথমে ভ্রƒ কুঁচকিয়ে ভেবেছিলেন, সিগ্রেট নিয়ে তিনি বাড়াবাড়ি করছেন। সময় প্রমাণ করেছে, ধূমপান মানে বিষপান; ধূমপান মানে প্রতি বছর লাখ লাখ লোকের অদৃশ্য খুনি।
ডা: নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের চিকিৎসক ছিলেন। সেই সূত্রে অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তির সাথে তার ঘনিষ্ঠতা যেমন ছিল, তেমনি ছিলেন তাদের সম্পর্কে ব্যাপক অভিজ্ঞতার অধিকারী। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ করে বইও লিখেছেন। এটি শেখ হাসিনার বিগত শাসনামলে প্রকাশিত হয়। তবে ডা: নুরুল ইসলাম রাজনীতিতে যেমন জড়াননি, তেমনি বিশেষ কোনো দলের অন্ধ অনুসারীও ছিলেন না। কর্মক্ষেত্রে তিনি উদারতা ও নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতেন। উগ্রতা, সঙ্কীর্ণতা ও মতান্ধতা থেকে ছিলেন দূরে।
প্রফেসর নুরুল ইসলামের এই উদারতার একটি বড় প্রমাণ চিকিৎসার বিশেষ কোনো সিস্টেমের প্রতি অন্ধ মোহ না থাকা। আজকের বিশ্বে আর শুধু অ্যালোপ্যাথির একচেটিয়া রাজত্ব নেই। দীর্ঘ দিন মনে করা হয়েছে, মডার্ন মেডিসিন মানেই শুধু বিশেষ একটি সিস্টেম। এখন সেই সাথে স্বীকৃত হয়েছে হোমিওপ্যাথি, ইউনানি ও আয়ুর্বেদীয় পদ্ধতিও। নিশ্চয়ই বিভিন্ন কারণে অ্যালোপ্যাথির প্রাধান্য রয়েছে এবং তা থাকবে বলে ধরে নেয়া যায়। তবে অন্য তিনটি পদ্ধতি বা সিস্টেমের প্রতি অবজ্ঞা-উন্নাসিকতার অবসান ঘটছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আন্তর্জাতিকভাবে সমন্বিত চিকিৎসাব্যবস্থাকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে বিশেষ করে দুই দশক ধরে। এর পেছনে রয়েছে প্রফেসর নুরুল ইসলামের মতো প্রাজ্ঞ ও জনকল্যাণব্রতী ব্যক্তিদের বিরাট অবদান। পাশের দেশ ভারতে সমন্বিত চিকিৎসা সরকারি স্বীকৃতি পেলেও আমাদের দেশে এখনো সরকারিভাবে একাধিক সিস্টেম কার্যত চালু হয়নি।
নিকট অতীতেও ‘অ্যালোপ্যাথি বনাম হোমিওপ্যাথি’ শত্রুতার প্রাদুর্ভাব ছিল প্রকট। অ্যালোপ্যাথরা হোমিওপ্যাথদের অবৈজ্ঞানিক ও হাস্যকর পন্থার অনুসারী মনে করে পুরো সিস্টেমকেই নাকচ করে দিতেন। ‘এটা মিসকিনের দেশের ফকিরি চিকিৎসা’ বলে ব্যঙ্গ করা হতো। এর বিপরীতে হোমিওপ্যাথির ভক্তরা বিদ্রƒপ করে বলতেন, ‘আলুপাতি (অ্যালোপ্যাথি) খামু, না কলাপাতি খামু?’ বাস্তবে কোনো সিস্টেমেই নেই শত ভাগ রোগের চিকিৎসা। সর্বরোগহর ধন্বন্তরী মহৌষধ হওয়ার দাবি কোনো ‘প্যাথি’র করার যুক্তি নেই। অথচ বিশ্বে মানুষ বাড়ছে; বাড়ছে ব্যাধি। চিকিৎসাবিজ্ঞান এগিয়েছে। তেমনি নতুন নতুন জটিল রোগ যেন মানবজাতির এই অগ্রগতিকে চ্যালেঞ্জ করছে। কয়েক শ’ কোটি মানবসন্তানের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য তাই প্রয়োজন একাধিক সিস্টেমের সমন্বিত ব্যবস্থা। বিশেষ কোনো সিস্টেমের প্রতি মোহ এক ধরনের সঙ্কীর্ণতা ও বাস্তববোধহীনতার পরিচায়ক।
প্রফেসর নূরুল ইসলাম এই অনস্বীকার্য বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেন অনেক বছর আগেই। জীবনের শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত সমন্বিত চিকিৎসাব্যবস্থার লক্ষ্যে অ্যালোপ্যাথির পাশাপাশি ইউনানি ও হোমিওপ্যাথিসহ বিভিন্ন সিস্টেমের যুগোপযোগী উন্নয়ন এবং বিকাশ ও প্রয়োগ কামনা করেছেন। হামদর্দকে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি হামদর্দ বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান ছিলেন। ইউনানি এই প্রতিষ্ঠানের ফাউন্ডেশন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমেও তার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
প্রসঙ্গক্রমে অন্তত আরো দু’জন খ্যাতনামা চিকিৎসকের নাম নিতে হয় সমন্বিত চিকিৎসাব্যবস্থার কথা বলতে গেলে। একজন হলের মরহুম প্রফেসর বদরুল আলম, অন্যজন মরহুম হাকিম হাফেজ আজীজুল ইসলাম। হোমিওপ্যাথির জনক, জার্মানির হ্যানেমান অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক হয়েও পরে হোমিওপ্যাথ হিসেবে আজীবন চিকিৎসা করেছিলেন। তেমনি বাংলাদেশের ডা: বদরুল আলম সরকারি অ্যালোপ্যাথিক প্রতিষ্ঠানের উঁচুপর্যায়ের কর্মকর্তা হয়েও পরে হোমিওপ্যাথ হিসেবে বিপুল পরিচিতি অর্জন করেছেন। আর হাফেজ আজীজুল ইসলাম ছিলেন বিখ্যাত ইউনানি বিশেষজ্ঞ এবং হাবিবিয়া তিব্বিয়া কলেজের অধ্যক্ষ। তাদের মতো চিকিৎসা ব্যক্তিত্বও প্রফেসর নুরুল ইসলামের একই ভূমিকায় সমন্বিত চিকিৎসার আইডিয়া ও সিস্টেমের গুরুত্ব তুলে ধরার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
আমি একাধিকবার গিয়েছি ডা: নুরুল ইসলামের চেম্বারে। কোনো সময়ে নিজে রোগী হিসেবে, কখনো বা অন্য রোগী নিয়ে। তখন তাকে কাছ থেকে দেখেছি, আরো জেনেছি তার সম্পর্কে। তিনি অন্যান্য চিকিৎসকের মতো সপ্তাহের বেশির ভাগ দিনে রোগী দেখতেন না। সপ্তাহে দু-তিন দিন রোগী দেখলেও একনাগাড়ে বহু রোগী দেখার অভ্যাস ছিল না তার। তিনি সীমিতসংখ্যক রোগী দেখতেন ধীরে সুস্থে। রোগীকে সময় দিতেন। তার কথা শুনতেন মনোযোগ দিয়ে। অন্তরঙ্গ শুভাকাক্সী হিসেবে ঘনিষ্ঠভাবে আলাপ করে সব জেনে নিয়ে পরামর্শ দিতেন। আমি ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রফেসর পর্যায়ের ‘নামকরা’ প্রবীণ ডাক্তারকে দেখেছি, লম্বা তালিকামাফিক রোগী দেখা শেষ করতে গিয়ে সময় দেন মাত্র ৫-৭ মিনিট করে। তার ব্যস্তসমস্তভাব আর অমনোযোগ দেখে রোগী নিজের সমস্যার কথা বলার সাহস ও উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। এমন কি, ব্যস্ততার কারণ না থাকলেও কোনো কোনো সিনিয়র চিকিৎসক রোগীর জন্য যথেষ্ট সময় দেন না কিংবা পরিচয় দেন না আন্তরিকতার। নুরুল ইসলাম সাহেব এসব ত্রুটি থেকে ছিলেন মুক্ত। অনেক ডাক্তার রোগীকে অহেতুক ঘোরান, যেমন অনেক উকিল মক্কেলকে দিনের পর দিন ঘুরিয়ে মজা পান। এতে ফির নামে তাদের আয়রোজগার বাড়ে। অথচ সেই রোগী কিংবা মক্কেলের বিষম দুর্ভোগের কথা ভেবে দেখেন না। কোনো রোগীর চিকিৎসা মেডিসিন ছাড়া অন্য বিষয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ওপর নির্ভর করছে দেখলেই ডা: নুরুল ইসলাম তাকে সেখানে ‘রেফার’ করতেন। নিজে ভাব দেখাতেন না সবজান্তার। তিনি শুধু পেশাগত কাজে ব্যস্ত থাকতেন না, এর বাইরে ধূমপান নিরোধ ও শিক্ষা বিস্তারসহ সমাজসেবামূলক নানা কার্যক্রমে তার ছিল সম্পৃক্ততা। তার আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি চিকিৎসায় ওষুধের ওপর বেশি জোর দিতেন না। দূর-দূরান্ত থেকে বহু জটিল ও পুরনো রোগী তার কাছে আসতেন। অনেকেরই দীর্ঘ দিনের প্রত্যাশা থাকত তাকে নিজের রোগের কথা খুলে বলার। আমাদের দেশে ছোট-বড়, সিনিয়র-জুনিয়র, জিপি কিংবা স্পেশালিস্ট নির্বিশেষে ডাক্তারেরা সাধারণত একগাদা ওষুধের লিস্ট আর মেডিক্যাল টেস্টের তালিকা রোগী বা তার সঙ্গীর হাতে ধরিয়ে দেন। মানুষেরও এমন ধারণা আছে, যিনি যত ডিগ্রিধারী বড় ডাক্তার, তিনি তত দামি ও দুর্লভ ওষুধপত্রের তালিকা দেবেন যা হবে সমানুপাতিক দৈর্ঘ্যরে। ডা: নুরুল ইসলাম ওষুধের পাশাপাশি রোগীর অভ্যাস ও জীবনাচারকেও খুব গুরুত্ব দিতেন। তাই তার ডিগ্রির তালিকা এবং অভিজ্ঞতার মেয়াদ দীর্ঘ হলেও প্রেসক্রিপশন হতো সাধারণত হ্রস্ব। কোনো কোনো ডাক্তার এমন সব দামি ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন, যেগুলোর নাম উচ্চারণের মতো কিনতে পাওয়াও কঠিন। ঢাকার বড় বড় মেডিসিন মার্কেটে খুঁজেও হদিস মেলে না সে ওষুধের। প্রফেসর নুরুল ইসলাম নিজের আর্থিক প্রসারের চেয়ে দেশে স্বাস্থ্যসেবার প্রসারকে বড় করে দেখতেন। এ জন্য তাকে বলতে হয় ‘সাধারণ ওষুধ দেয়া অসাধারণ চিকিৎসক’।
মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তির দিক দিয়েও প্রফেসর নুরুল ইসলাম ছিলেন আদর্শস্থানীয়। তার পিতা মরহুম সৈয়দুর রহমান ছিলেন সাধারণ স্কুলশিক্ষক। ছোটবেলায় বাবাকে হারানোর পর মা-ই তাকে মানুষ করার গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। মায়ের প্রতি তার অপার শ্রদ্ধার নিদর্শন ঢাকায় ৬৩, সেন্ট্রাল রোডের বাড়িটি। ল্যাবএইড হাসপাতালের অল্প পূর্ব দিকে, সায়েন্স ল্যাবরেটরির উত্তর পাশের বাড়িটিতে কিছু গাছপালা দিয়েছে সবুজ ছায়া। গেটে নাম লেখা গুলমেহের। এই বাড়িতেই ডা: নুরুল ইসলাম জীবন কাটিয়ে গেলেন। এখানেই তার বাসা, চেম্বার এবং তার প্রতিষ্ঠিত ভার্সিটির ঢাকা অফিস। ‘আধূনিক’ সংগঠনটির কার্যালয়ও এখানেই থাকার কথা। মরহুম নুরুল ইসলাম চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এলাকায় যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেছেন, এখানে দেশী-বিদেশী শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনা করছেন। এর একটি হলও মায়ের নামে। সেই গুলমেহের হলের সামনে ডা: নুরুল ইসলাম গত ২৫ জানুয়ারি হয়েছেন চিরশয্যায় শায়িত।
প্রফেসর নুরুল ইসলাম ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্ব। তার দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ, ভূমিকা ছিল স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ। তিনি চিকিৎসক হিসেবে ওষুধের বোঝা না চাপিয়ে অল্প কয়েকটি ওষুধ প্রেসক্রাইব করতেন। তা-ও বেশির ভাগ কম দামি ও সহজপ্রাপ্য। চিকিৎসার এই ধরন এবং চিকিৎসাপদ্ধতির ব্যাপারে ভিন্নধর্মী দৃষ্টিভঙ্গির মতো নিজের নামের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। ‘নূরুল’ না লিখে লিখতেন ‘নুরুল’।
৩১ মে ধূমপানবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। এ উপলক্ষে ‘আধূনিক’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। আর ডা: নুরুল ইসলাম প্রতি বছর পত্রিকায় লিখতেন নিবন্ধ। নয়া দিগন্তে লেখা পাঠাতেন সেদিন ছাপানোর জন্য। এবারো দিনটি আসবে, কিন্তু আর কোনো দিন তিনি লেখা পাঠাবেন না।
প্রফেসর নুরুল ইসলাম বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশ ও জাতির জন্য অনেক অবদান রেখে গেছেন। এখন তাকে কাজের মাধ্যমে স্মরণ করা আমাদের দায়িত্ব। শুধু মৃত্যুদিবস পালন কোনো কাজে আসে না। তার স্মরণে কোনো মেডিক্যাল কলেজ বা ভার্সিটিতে ‘চেয়ার’ প্রতিষ্ঠা, গবেষণাবৃত্তি প্রদান, পদক ও পুরস্কার প্রবর্তন, ভবনের নামকরণ প্রভৃতি প্রস্তাব এসেছে। এগুলো করা যেতে পারে অবশ্যই। অনেকেই মনে করেন তার মতো চিকিৎসক, শিক্ষাব্রতী, গবেষক, সমাজসেবী, সংগঠক, লেখক ও কর্মবীরের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য সবার কিছু করণীয় আছে। ধূমপানসহ তামাক সেবনের বদ-অভ্যাস দূরীকরণ, জাতীয় স্বাস্থ্য এবং ওষুধনীতির বাস্তবায়ন, সমন্বিত চিকিৎসাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং মানসম্মত উচ্চশিক্ষার প্রসার যেদিন নিশ্চিত হবে, সেদিন সম্ভব হবে প্রফেসর নুরুল ইসলামের অবদানের যথার্থ মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি।
এ তো শুধু একটি অভিজ্ঞতার খণ্ডচিত্র। সে রুটেই কেবল নয়, এমন বহু রুটের যানবাহনে ফ্রি স্টাইলে ধূমপানের উন্মত্ততা চলে অহরহ। নিত্যদিন অসংখ্য মানুষ এভাবে যক্ষ্মা ও ক্যান্সারসহ বিভিন্ন কালব্যাধি ডেকে আনছে নিজের জন্য। তেমনি পাশের মানুষটিরও ক্ষতি করছে অজান্তে।
আমার পরিচিত এক লোক তার শৈশবের একটি ঘটনা বলেছিলেন। তখন এক দিন কোত্থেকে যেন একটা সিগ্রেট পেয়েছিলেন। বড়রা ফুড়–ত ফুড়–ত টানে। সব সময় এটা দেখে ভাবলেন, না জানি কত না স্বাদের জিনিস। রাতে বুড়ি নানী ঘুমাচ্ছিলেন মশারি খাটিয়ে। শিশু নাতি সিগ্রেট ধরিয়ে নানীর মশারিতে ঢুকলেন যাতে লুকিয়ে তা খাওয়া যায়। শুয়ে সিগ্রেটে টান দিলেন। নেশার সুখটানে অচিরেই গভীর ঘুম। এ দিকে হাতের সিগ্রেট জ্বলছে। হঠাৎ নানীর আর্তচিৎকারে ঘুম ভেঙে গেলে দেখেন, মশারিতে আগুন লেগে গেছে। ওই সিগ্রেটই এর উৎস। ভাগ্য ভালো যে, সেদিন কোনো মতে নানী-নাতি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু কত লোকই তো এমন ঘটনায় হতাহত হয়েছেন, হচ্ছেন। এ দেশের একজন বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী সত্তরের দশকে মশারিতে সিগ্রেটের আগুন লেগে পুড়ে প্রাণ হারিয়েছেন।
ধূমপানও মদপানের মতো নেশা। মাদকাসক্তির সূচনা হয় বিড়ি-সিগ্রেট দিয়ে। কথায় বলেÑ ‘মানুষ প্রথমে সিগ্রেট খায়, পরে সিগ্রেট তাকে খায়।’ আমার মনে হয় বুদ্ধিমান ধূমপায়ীরাও এ কাজটি করার সময় কাণ্ডজ্ঞান, আক্কেল-আন্দাজ হারিয়ে ফেলেন। কোথায় কিভাবে ধূমপান করছেন; পাশেই কোনো রোগী, শিশু, মহিলা বা বৃদ্ধ আছেন কি না অথবা পাশের মানুষটি ধূমপান ঘৃণা করেন কি নাÑ এসব প্রায় ক্ষেত্রে তোয়াক্কা করা হয় না। এমনকি সিগ্রেটের অবশিষ্ট অংশটুকু তারা কোনো খেয়াল না করেই বে-আক্কেলের মতো যেদিকে সেদিকে ইচ্ছামতো ছুড়ে মারেন। একবার এক ব্যক্তি জানিয়েছিলেন তার ভাইয়ের বিপদের কথা। ভাইটি একটি বাসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ এক যাত্রী ছুড়ে ফেললেন সিগ্রেটের লেজ। জ্বলন্ত টুকরোটি ওই তরুণের চোখে এসে লাগে। এতে তার চোখের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছিল। এমন ঘটনার শিকার হয়ে অন্ধও হওয়া বিচিত্র নয়।
প্রকাশ্যে ধূমপানের শাস্তি ৫০ টাকা জরিমানা। যদিও ধূমপানের ভয়াবহ ক্ষতির তুলনায় এটা কিছুই না, তবুও এই নগণ্য দণ্ডটুকু পর্যন্ত কার্যকর হচ্ছে না। দু-এক জায়গায় কোনো কোনো ম্যাজিস্ট্রেট তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে দু-চারজনের জরিমানা করেছেন। এটা ব্যতিক্রম মাত্র। খোদ পুলিশ লোকজনের মাঝে ইচ্ছামতো ধূমপান করছে; আইন প্রয়োগ করবে কে? শিক্ষিত ও দায়িত্বশীল বহু নাগরিকও রাস্তাঘাটে, যানবাহনে সিগ্রেট ফুঁকছেন। অন্যদের এতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না, তা ভেবে দেখার গরজও কারো নেই।
আজকাল বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞাপনে গালভরা বুলি দেখা যায়Ñ ‘কোলাহলমুক্ত পরিবেশ, রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গন, ধূমপানমুক্ত ক্যাম্পাস।’ বাস্তবে অবস্থাটা কী? বিভিন্ন নামী-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে দেখা যায়, ভদ্রঘরের অভিজাত শিক্ষার্থীরা প্রাণপণে সিগ্রেট টেনে শেষ করায় ব্যস্ত। কারণ কাসের সময় হয়ে যাচ্ছে। গেটেই ধূম্র পান করার কাজটা সম্পন্ন করে ক্যাম্পাস ধোঁয়া থেকে মুক্ত রাখার বিষয়ে ছাত্ররা খুব সচেতন!
আমাদের শৈশবে মফস্বলে দেখতাম, একেবারে অশিক্ষিত, মুটে-মজুর শ্রেণীর কিংবা ছিন্নমূল টোকাই শিশু-কিশোররাই বিড়ি-সিগ্রেট টানে। এটাকে বড় ধরনের বেয়াদবি বা মন্দকাজ বলেও মুরব্বিরা মনে করেন। এখন দেখছি, অন্যান্য দিকের মতো এ দিক দিয়েও সমাজ বদলে যাচ্ছে। এই রাজধানীতে দেখা যায়, শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের স্কুলপড়–য়া ছেলেরা পর্যন্ত প্রকাশ্যে সিগ্রেট টানছে ‘ড্যাম কেয়ার’ ভঙ্গিতে। ‘অভিজাত’ পরিবারের শিক্ষিত তরুণীদের অনেকের ধূমপান চলছে রাস্তাঘাটেই। আমি নিজেই এই দৃশ্য দেখেছি।
এই যে এতক্ষণ ধূমপানবিরোধী এত কিছু বলেছি, এতে অনেকে অবাক হয়ে ভাববেনÑ এখন তো সংশ্লিষ্ট কোনো দিবস নেই, তবুও কেন এসব বক্তব্য ঝাড়লেন? আবার ধূম্রপূজারীরা বিরক্তির সাথে বলবেন, কোটি কোটি মানুষ যা করছে, তার সমালোচনা করে এসব প্যাঁচাল পাড়ছেন কেন?
কারণ হলো, যে মানুষটি আজীবন এই জাতিকে সজাগ ও সতর্ক করতে চেয়েছেন ধূমপানের নীরব ঘাতক সম্পর্কে, তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। নিশ্চয়ই সবাই বলবেন, সেই ‘তিনি’ আর কেউ ননÑ জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর ডা: নুরুল ইসলাম। ভাবছি, যেখানে দেশে ধূমপানের মাত্রা কমেছে বলে মনে হয় না এবং দেশী-বিদেশী নতুন নতুন ব্র্যান্ডের সিগারেটের বাজার বাড়ছে, সে ক্ষেত্রে নুরুল ইসলামরা সফল হলেন কই? তাহলে কেন তিনি অন্তত অর্ধশতাব্দী ধরে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে চাইলেন? আসলে তিনি একা তো এই অসাধ্য সাধন করতে পারেন না। কিন্তু জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়ে ধূমপানের বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম করে গেছেন দশকের পর দশক।
ছোটবেলায় শুনেছি, সিভিল সার্ভিস বা সুপিরিয়র সার্ভিসের ক্যাডারদের চাকরির আগে ট্রেনিং দেয়া হয় স্মার্টনেসেরও। এ জন্য যেসব কাজ শেখানো হয়, তার মধ্যে আছে সিগ্রেট কিভাবে ধরে কেমন করে খেতে হবে, সে স্টাইলও। এটা পাকিস্তানি আমলের কথা এবং ব্রিটিশ আমলের উত্তরাধিকার। এখন নিশ্চয়ই এসব করা হয় না। স্মার্ট হতে ধূমপান করতে হয় না, বরং অধূমপায়ীরাই প্রকৃত স্মার্ট ও আধুনিক। এই জরুরি আইডিয়া ও উপলব্ধি অনেকের মধ্যে এসেছে। এর কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশি যে মানুষটির নিরলস প্রয়াসের, তার নাম (প্রফেসর) নুরুল ইসলাম। বিশেষ করে নবীন প্রজন্মকে সত্যিকার আধুনিক ও স্মার্ট বানাতেই তিনি তার সবচেয়ে প্রিয় সংগঠনটির নাম দিয়েছিলেন ‘আধূনিক’। ‘আমরা ধূমপান নিবারণ করি’Ñ শব্দ চারটির আদ্যাক্ষর নিয়ে ‘আধূনিক’। কিছু দিন আগে একটি সংগঠন তরুণ-তরুণীদের নিয়ে প্রচার শুরু করেছিলÑ ‘আমরা স্মার্ট। তাই আমরা ধূমপান করি না।’ এই কার্যক্রম ব্যাপক করা এবং অব্যাহত রাখা অপরিহার্য।
প্রফেসর নুরুল ইসলাম ছিলেন দূরদর্শী। এর প্রমাণ (ক) ‘আধূনিক’ আন্দোলন, (খ) জাতীয় ওষুধনীতি ও স্বাস্থ্যনীতি, (গ) সমন্বিত চিকিৎসাব্যবস্থা, (ঘ) উচ্চশিক্ষা বিস্তারের বেসরকারি উদ্যোগ।
যখন ধূমপানবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, তখন অনেকেই অবাক হয়ে ভেবেছেনÑ ‘দেশে কত বড় বড় সমস্যা, আর উনি নেমেছেন সিগ্রেট ফুঁকার বিরুদ্ধে।’ ধূমপানকে নেশা বলে মনে করা হতো না। মানুষের ধারণা ছিল, ‘মদ খাওয়া না হয় খারাপ, মুখ থেকে সামান্য ধোঁয়া ছাড়লে কার কী ক্ষতি।’ এখন যক্ষ্মার সাথে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগের মহামারী দেখে বোঝা যায়, ডা: নুরুল ইসলামের কতখানি দূরদৃষ্টি ছিল। বারডেম প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ডা: মোহাম্মদ ইব্রাহিম যখন এই প্রতিষ্ঠান গড়ায় নামলেন, তখন অনেক চিকিৎসক পর্যন্ত তার অগ্রাধিকারবোধ নিয়ে ব্যঙ্গ-রসিকতা করতেন। আশির দশকের মাঝামাঝি বারডেম ভবনের তলা যখন বাড়ছে, তখন একজন চিকিৎসক আমাকে বলেছিলেন, ‘এ দেশের মানুষের মারাত্মক রোগ হিসেবে ডায়াবেটিসের নাম অনেক পরে। অথচ ইব্রাহিম সাহেব তা নিয়ে মাতামাতি করছেন।’
এখন প্রমাণিত হচ্ছে ইব্রাহিমের দূরদর্শিতা। ওই চিকিৎসক ‘আঁতের ডাক্তার’। নিশ্চয়ই আন্ত্রিক রোগের চেয়ে ডায়াবেটিসের রোগী বহুগুণ বেশি। ডা: নুরুল ইসলামের ‘আধূনিক’ নিয়েও বহু আধুনিক মানুষ প্রথমে ভ্রƒ কুঁচকিয়ে ভেবেছিলেন, সিগ্রেট নিয়ে তিনি বাড়াবাড়ি করছেন। সময় প্রমাণ করেছে, ধূমপান মানে বিষপান; ধূমপান মানে প্রতি বছর লাখ লাখ লোকের অদৃশ্য খুনি।
ডা: নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের চিকিৎসক ছিলেন। সেই সূত্রে অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তির সাথে তার ঘনিষ্ঠতা যেমন ছিল, তেমনি ছিলেন তাদের সম্পর্কে ব্যাপক অভিজ্ঞতার অধিকারী। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ করে বইও লিখেছেন। এটি শেখ হাসিনার বিগত শাসনামলে প্রকাশিত হয়। তবে ডা: নুরুল ইসলাম রাজনীতিতে যেমন জড়াননি, তেমনি বিশেষ কোনো দলের অন্ধ অনুসারীও ছিলেন না। কর্মক্ষেত্রে তিনি উদারতা ও নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতেন। উগ্রতা, সঙ্কীর্ণতা ও মতান্ধতা থেকে ছিলেন দূরে।
প্রফেসর নুরুল ইসলামের এই উদারতার একটি বড় প্রমাণ চিকিৎসার বিশেষ কোনো সিস্টেমের প্রতি অন্ধ মোহ না থাকা। আজকের বিশ্বে আর শুধু অ্যালোপ্যাথির একচেটিয়া রাজত্ব নেই। দীর্ঘ দিন মনে করা হয়েছে, মডার্ন মেডিসিন মানেই শুধু বিশেষ একটি সিস্টেম। এখন সেই সাথে স্বীকৃত হয়েছে হোমিওপ্যাথি, ইউনানি ও আয়ুর্বেদীয় পদ্ধতিও। নিশ্চয়ই বিভিন্ন কারণে অ্যালোপ্যাথির প্রাধান্য রয়েছে এবং তা থাকবে বলে ধরে নেয়া যায়। তবে অন্য তিনটি পদ্ধতি বা সিস্টেমের প্রতি অবজ্ঞা-উন্নাসিকতার অবসান ঘটছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আন্তর্জাতিকভাবে সমন্বিত চিকিৎসাব্যবস্থাকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে বিশেষ করে দুই দশক ধরে। এর পেছনে রয়েছে প্রফেসর নুরুল ইসলামের মতো প্রাজ্ঞ ও জনকল্যাণব্রতী ব্যক্তিদের বিরাট অবদান। পাশের দেশ ভারতে সমন্বিত চিকিৎসা সরকারি স্বীকৃতি পেলেও আমাদের দেশে এখনো সরকারিভাবে একাধিক সিস্টেম কার্যত চালু হয়নি।
নিকট অতীতেও ‘অ্যালোপ্যাথি বনাম হোমিওপ্যাথি’ শত্রুতার প্রাদুর্ভাব ছিল প্রকট। অ্যালোপ্যাথরা হোমিওপ্যাথদের অবৈজ্ঞানিক ও হাস্যকর পন্থার অনুসারী মনে করে পুরো সিস্টেমকেই নাকচ করে দিতেন। ‘এটা মিসকিনের দেশের ফকিরি চিকিৎসা’ বলে ব্যঙ্গ করা হতো। এর বিপরীতে হোমিওপ্যাথির ভক্তরা বিদ্রƒপ করে বলতেন, ‘আলুপাতি (অ্যালোপ্যাথি) খামু, না কলাপাতি খামু?’ বাস্তবে কোনো সিস্টেমেই নেই শত ভাগ রোগের চিকিৎসা। সর্বরোগহর ধন্বন্তরী মহৌষধ হওয়ার দাবি কোনো ‘প্যাথি’র করার যুক্তি নেই। অথচ বিশ্বে মানুষ বাড়ছে; বাড়ছে ব্যাধি। চিকিৎসাবিজ্ঞান এগিয়েছে। তেমনি নতুন নতুন জটিল রোগ যেন মানবজাতির এই অগ্রগতিকে চ্যালেঞ্জ করছে। কয়েক শ’ কোটি মানবসন্তানের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য তাই প্রয়োজন একাধিক সিস্টেমের সমন্বিত ব্যবস্থা। বিশেষ কোনো সিস্টেমের প্রতি মোহ এক ধরনের সঙ্কীর্ণতা ও বাস্তববোধহীনতার পরিচায়ক।
প্রফেসর নূরুল ইসলাম এই অনস্বীকার্য বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেন অনেক বছর আগেই। জীবনের শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত সমন্বিত চিকিৎসাব্যবস্থার লক্ষ্যে অ্যালোপ্যাথির পাশাপাশি ইউনানি ও হোমিওপ্যাথিসহ বিভিন্ন সিস্টেমের যুগোপযোগী উন্নয়ন এবং বিকাশ ও প্রয়োগ কামনা করেছেন। হামদর্দকে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি হামদর্দ বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান ছিলেন। ইউনানি এই প্রতিষ্ঠানের ফাউন্ডেশন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমেও তার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
প্রসঙ্গক্রমে অন্তত আরো দু’জন খ্যাতনামা চিকিৎসকের নাম নিতে হয় সমন্বিত চিকিৎসাব্যবস্থার কথা বলতে গেলে। একজন হলের মরহুম প্রফেসর বদরুল আলম, অন্যজন মরহুম হাকিম হাফেজ আজীজুল ইসলাম। হোমিওপ্যাথির জনক, জার্মানির হ্যানেমান অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক হয়েও পরে হোমিওপ্যাথ হিসেবে আজীবন চিকিৎসা করেছিলেন। তেমনি বাংলাদেশের ডা: বদরুল আলম সরকারি অ্যালোপ্যাথিক প্রতিষ্ঠানের উঁচুপর্যায়ের কর্মকর্তা হয়েও পরে হোমিওপ্যাথ হিসেবে বিপুল পরিচিতি অর্জন করেছেন। আর হাফেজ আজীজুল ইসলাম ছিলেন বিখ্যাত ইউনানি বিশেষজ্ঞ এবং হাবিবিয়া তিব্বিয়া কলেজের অধ্যক্ষ। তাদের মতো চিকিৎসা ব্যক্তিত্বও প্রফেসর নুরুল ইসলামের একই ভূমিকায় সমন্বিত চিকিৎসার আইডিয়া ও সিস্টেমের গুরুত্ব তুলে ধরার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
আমি একাধিকবার গিয়েছি ডা: নুরুল ইসলামের চেম্বারে। কোনো সময়ে নিজে রোগী হিসেবে, কখনো বা অন্য রোগী নিয়ে। তখন তাকে কাছ থেকে দেখেছি, আরো জেনেছি তার সম্পর্কে। তিনি অন্যান্য চিকিৎসকের মতো সপ্তাহের বেশির ভাগ দিনে রোগী দেখতেন না। সপ্তাহে দু-তিন দিন রোগী দেখলেও একনাগাড়ে বহু রোগী দেখার অভ্যাস ছিল না তার। তিনি সীমিতসংখ্যক রোগী দেখতেন ধীরে সুস্থে। রোগীকে সময় দিতেন। তার কথা শুনতেন মনোযোগ দিয়ে। অন্তরঙ্গ শুভাকাক্সী হিসেবে ঘনিষ্ঠভাবে আলাপ করে সব জেনে নিয়ে পরামর্শ দিতেন। আমি ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রফেসর পর্যায়ের ‘নামকরা’ প্রবীণ ডাক্তারকে দেখেছি, লম্বা তালিকামাফিক রোগী দেখা শেষ করতে গিয়ে সময় দেন মাত্র ৫-৭ মিনিট করে। তার ব্যস্তসমস্তভাব আর অমনোযোগ দেখে রোগী নিজের সমস্যার কথা বলার সাহস ও উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। এমন কি, ব্যস্ততার কারণ না থাকলেও কোনো কোনো সিনিয়র চিকিৎসক রোগীর জন্য যথেষ্ট সময় দেন না কিংবা পরিচয় দেন না আন্তরিকতার। নুরুল ইসলাম সাহেব এসব ত্রুটি থেকে ছিলেন মুক্ত। অনেক ডাক্তার রোগীকে অহেতুক ঘোরান, যেমন অনেক উকিল মক্কেলকে দিনের পর দিন ঘুরিয়ে মজা পান। এতে ফির নামে তাদের আয়রোজগার বাড়ে। অথচ সেই রোগী কিংবা মক্কেলের বিষম দুর্ভোগের কথা ভেবে দেখেন না। কোনো রোগীর চিকিৎসা মেডিসিন ছাড়া অন্য বিষয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ওপর নির্ভর করছে দেখলেই ডা: নুরুল ইসলাম তাকে সেখানে ‘রেফার’ করতেন। নিজে ভাব দেখাতেন না সবজান্তার। তিনি শুধু পেশাগত কাজে ব্যস্ত থাকতেন না, এর বাইরে ধূমপান নিরোধ ও শিক্ষা বিস্তারসহ সমাজসেবামূলক নানা কার্যক্রমে তার ছিল সম্পৃক্ততা। তার আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি চিকিৎসায় ওষুধের ওপর বেশি জোর দিতেন না। দূর-দূরান্ত থেকে বহু জটিল ও পুরনো রোগী তার কাছে আসতেন। অনেকেরই দীর্ঘ দিনের প্রত্যাশা থাকত তাকে নিজের রোগের কথা খুলে বলার। আমাদের দেশে ছোট-বড়, সিনিয়র-জুনিয়র, জিপি কিংবা স্পেশালিস্ট নির্বিশেষে ডাক্তারেরা সাধারণত একগাদা ওষুধের লিস্ট আর মেডিক্যাল টেস্টের তালিকা রোগী বা তার সঙ্গীর হাতে ধরিয়ে দেন। মানুষেরও এমন ধারণা আছে, যিনি যত ডিগ্রিধারী বড় ডাক্তার, তিনি তত দামি ও দুর্লভ ওষুধপত্রের তালিকা দেবেন যা হবে সমানুপাতিক দৈর্ঘ্যরে। ডা: নুরুল ইসলাম ওষুধের পাশাপাশি রোগীর অভ্যাস ও জীবনাচারকেও খুব গুরুত্ব দিতেন। তাই তার ডিগ্রির তালিকা এবং অভিজ্ঞতার মেয়াদ দীর্ঘ হলেও প্রেসক্রিপশন হতো সাধারণত হ্রস্ব। কোনো কোনো ডাক্তার এমন সব দামি ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন, যেগুলোর নাম উচ্চারণের মতো কিনতে পাওয়াও কঠিন। ঢাকার বড় বড় মেডিসিন মার্কেটে খুঁজেও হদিস মেলে না সে ওষুধের। প্রফেসর নুরুল ইসলাম নিজের আর্থিক প্রসারের চেয়ে দেশে স্বাস্থ্যসেবার প্রসারকে বড় করে দেখতেন। এ জন্য তাকে বলতে হয় ‘সাধারণ ওষুধ দেয়া অসাধারণ চিকিৎসক’।
মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তির দিক দিয়েও প্রফেসর নুরুল ইসলাম ছিলেন আদর্শস্থানীয়। তার পিতা মরহুম সৈয়দুর রহমান ছিলেন সাধারণ স্কুলশিক্ষক। ছোটবেলায় বাবাকে হারানোর পর মা-ই তাকে মানুষ করার গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। মায়ের প্রতি তার অপার শ্রদ্ধার নিদর্শন ঢাকায় ৬৩, সেন্ট্রাল রোডের বাড়িটি। ল্যাবএইড হাসপাতালের অল্প পূর্ব দিকে, সায়েন্স ল্যাবরেটরির উত্তর পাশের বাড়িটিতে কিছু গাছপালা দিয়েছে সবুজ ছায়া। গেটে নাম লেখা গুলমেহের। এই বাড়িতেই ডা: নুরুল ইসলাম জীবন কাটিয়ে গেলেন। এখানেই তার বাসা, চেম্বার এবং তার প্রতিষ্ঠিত ভার্সিটির ঢাকা অফিস। ‘আধূনিক’ সংগঠনটির কার্যালয়ও এখানেই থাকার কথা। মরহুম নুরুল ইসলাম চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এলাকায় যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেছেন, এখানে দেশী-বিদেশী শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনা করছেন। এর একটি হলও মায়ের নামে। সেই গুলমেহের হলের সামনে ডা: নুরুল ইসলাম গত ২৫ জানুয়ারি হয়েছেন চিরশয্যায় শায়িত।
প্রফেসর নুরুল ইসলাম ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্ব। তার দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ, ভূমিকা ছিল স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ। তিনি চিকিৎসক হিসেবে ওষুধের বোঝা না চাপিয়ে অল্প কয়েকটি ওষুধ প্রেসক্রাইব করতেন। তা-ও বেশির ভাগ কম দামি ও সহজপ্রাপ্য। চিকিৎসার এই ধরন এবং চিকিৎসাপদ্ধতির ব্যাপারে ভিন্নধর্মী দৃষ্টিভঙ্গির মতো নিজের নামের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। ‘নূরুল’ না লিখে লিখতেন ‘নুরুল’।
৩১ মে ধূমপানবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। এ উপলক্ষে ‘আধূনিক’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। আর ডা: নুরুল ইসলাম প্রতি বছর পত্রিকায় লিখতেন নিবন্ধ। নয়া দিগন্তে লেখা পাঠাতেন সেদিন ছাপানোর জন্য। এবারো দিনটি আসবে, কিন্তু আর কোনো দিন তিনি লেখা পাঠাবেন না।
প্রফেসর নুরুল ইসলাম বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশ ও জাতির জন্য অনেক অবদান রেখে গেছেন। এখন তাকে কাজের মাধ্যমে স্মরণ করা আমাদের দায়িত্ব। শুধু মৃত্যুদিবস পালন কোনো কাজে আসে না। তার স্মরণে কোনো মেডিক্যাল কলেজ বা ভার্সিটিতে ‘চেয়ার’ প্রতিষ্ঠা, গবেষণাবৃত্তি প্রদান, পদক ও পুরস্কার প্রবর্তন, ভবনের নামকরণ প্রভৃতি প্রস্তাব এসেছে। এগুলো করা যেতে পারে অবশ্যই। অনেকেই মনে করেন তার মতো চিকিৎসক, শিক্ষাব্রতী, গবেষক, সমাজসেবী, সংগঠক, লেখক ও কর্মবীরের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য সবার কিছু করণীয় আছে। ধূমপানসহ তামাক সেবনের বদ-অভ্যাস দূরীকরণ, জাতীয় স্বাস্থ্য এবং ওষুধনীতির বাস্তবায়ন, সমন্বিত চিকিৎসাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং মানসম্মত উচ্চশিক্ষার প্রসার যেদিন নিশ্চিত হবে, সেদিন সম্ভব হবে প্রফেসর নুরুল ইসলামের অবদানের যথার্থ মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি।
No comments