মহানায়কের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন by সরদার সিরাজুল ইসলাম
মহানায়কের অবস্থান নিয়ে ইতিহাসে বহু ঘটনা। কিন্তু নায়ক শত্রুর কারাগারে বন্দী, তাঁর নামে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন এবং কোনরূপ পণ না দিয়ে শত্রু সেই মহানায়ককে সসম্মানে ফেরত পৌঁছানোর ঘটনা শুধু একটিই।
সেই মহানায়ক বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সবাই জানে ২৫ মার্চ রাত দুপুরে পাকবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে আটক করে এবং মুক্ত হন ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে। তবে সেই স্বদেশ ফেরার ঐতিহাসিক ুপবিত্র দিনটির স্মরণে এই আলোচনা।বঙ্গবন্ধু যদি ১০ জানুয়ারি না ফিরতেন এই বিষয়ের ওপর প্রবীণের কিছু আবেগের বিষয় রয়েছে। ১৯৮৫ সালে স্মৃতির শহর চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধুপ্রেমী কতিপয় তরুণের উৎসাহে গঠিত বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের ব্যানারে দেশব্যাপী রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়। দু’টি রচনা যার একটি বঙ্গবন্ধু যদি ১০ জানুয়ারি না ফিরতেন। অপরটি ‘বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব।’ হাজারখানেক প্রতিযোগী এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। যার মধ্যে প্রথমটিতে মুনিম কুমার বাড়ৈই এবং অপরটিতে জানে আলম উভয়েই প্রথম পুরস্কার স্বর্ণপদক পান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাছ থেকে ২৫ জানুয়ারি ১৯৮৯ চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে। (সেই আয়োজনে এই লেখককে উৎসাহ ও সক্রিয় সমর্থনের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে কৃতজ্ঞতা)। ড. মুনিম কুমার বাড়ৈই এর স্বর্ণপদক বিজয়ী লেখাটি জনকণ্ঠের কাছে জমা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ওপর লিখিত উক্ত প্রবন্ধটি একটি তথ্যবহুল, সুলিখিত চমৎকার প্রবন্ধ। এ নিয়ে অন্যত্র আলোচনার প্রয়োজন আছে।
বঙ্গবন্ধু আটক হওয়ার আগে স্বাধীনতার রেকর্ডকৃত ভাষণ ইপিআর এবং টিএ্যান্ডটির কাছে দিয়েছিলেন যার প্রচার তিনি শুনেছিলেন। তিনি নিশ্চিতভাবে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন যে তার ৭ মার্চের নির্দেশ পালন করার মতো প্রস্তুতি জনগণের আছে। তিনি খবর নিলেন আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ এবং অন্যরা পাক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ঢাকা-চট্টগ্রাম-ফার্মগেট-আগ্রাবাদ-ষোলশহরে এবং অন্যান্য স্থানে ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিরোধ শুরু করেছে (এই ব্যারিকেডেই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহর)। বন্দী হওয়ার আগে ৩২ নম্বরে অনেকেই গেছেন। এঁদের একজন প্রয়াত সাংবাদিক আতাউস সামাদকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ও যধাব মরাবহ ুড়ঁ ষঁফবঢ়বহফবহপব, মড় ধহফ ঢ়ৎবংবৎাব রঃ (স্বাধীনতা দিলাম রক্ষা করো)। এই বক্তব্য ছিল অসহযোগকালের ধারাবাহিকতা।
অসহযোগকালের ফলাফল শূন্য হলেও বঙ্গবন্ধু কি করতে চেয়েছিলেন তার প্রামাণ্য দলিলের চিত্র কিন্তু পরিষ্কার। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আবেদনের একটি পর্যায়ে ১৬-২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে কয়েকদফা বৈঠকও হয়। ২২-২৪ মার্চ ভুট্টো ইয়াহিয়া মুজিবও আলোচনায় মিলিত হন। এই আলোচনার সূত্র ধরে নিন্দুকরা গবেষণা করেন যে মুজিব আপোস করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুজিবের আলোচনার লক্ষ্য ছিল একটিই তা হচ্ছে ইয়াহিয়ার কাছ থেকে বিনা রক্তপাতে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা আদায় করা। ইয়াহিয়া খান ২৬ মার্চ ’৭১ সন্ধ্যায় করাচি থেকে বেতার টিভিতে প্রচারিত ভাষণে স্পষ্টভাবে বলেন, “শেখ মুজিব এবং তাঁর উপদেষ্টারা এক পাকিস্তানের ভিত্তিতে কোন মীমাংসায় না এসে প্যারালাল সরকার চালিয়ে আমার (ইয়াহিয়া) কাছ থেকে একটি ঘোষণা আদায় করতে চেয়েছিলেন যা ফেডারেশনের পরিবর্তে কনফেডারেশন এবং সামরিক আইন প্রত্যাহার। এসব পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ নামে আলাদা একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
ইয়াহিয়ার ভাষণ যে মিথ্যা ছিল না তার প্রমাণ রয়েছে ২৩ মার্চ ’৭১ প্রকাশিত ঢাকার ইংরেজী ‘দৈনিক দি পিপল-’এ প্রকাশিত প্রখ্যাত আইনজীবী এ, কে, ব্রোহির বিবৃতি থেকে। প্রসঙ্গত, এ. কে. ব্রোহি তখন ঢাকায় এসেছিলেন ইয়াহিয়াকে আইনগত সহযোগিতা প্রদানের জন্য। মুজিব যখন ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য চাপ সৃষ্টি করে চলছিলেন অপরদিকে ভুট্টোও পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতা পাওয়ার জন্য উদগ্রীব সে মুহূর্তে আলাদাভাবে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতা মুজিব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতা ভুট্টোর কাছে হস্তান্তরে আইনগত জটিলতা আছে কিনা সে বিষয়ে ইয়াহিয়া এ কে ব্রোহির মতামত চেয়ে পাঠান। এ কে ব্রোহি এ বিষয়ে লিখিত মতামত প্রদান করেন। ইংরেজীতে দেয়া মতামতের বঙ্গানুবাদ নিম্নরূপ : নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ছিল সংবিধান প্রণয়নের পরে। কিন্তু সে পর্যায়ে পর্যন্ত অপেক্ষা না করে সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং গণ-প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হন্তান্তরের কোন আইনগত প্রতিবন্ধকতা আছে কি-না এ বিষয়ে আমার মতামত চাওয়া হয়েছে। ‘জাস্টিস পয়েন্ট অব নিড্’ থেকে বিষয়টি বিবেচনায় এনে একথা বলা সঙ্গত যে, এ ধরনের ক্ষমতা হস্তান্তরে কোন আইনগত জটিলতা নেই। রাষ্ট্র ক্ষমতার সর্বময় অধিকর্তা ইয়াহিয়া খান এই মর্মে ঘোষণা দিতে পারেন যে, তিনি আর রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করবেন না। (চলবে)
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
No comments