স্মৃতির পাতায় ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারি by তোফায়েল আহমেদ
আজ থেকে ৪১ বছর আগে ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের লায়ালপুরের মিয়ানওয়ালি কারাগারে দীর্ঘ ২৮৮ দিন কারারুদ্ধ থাকার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন।
সেদিন থেকে জাতীয় জীবনে ‘জাতির জনকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস’ প্রতিবছর সগৌরবে পালিত হয়ে আসছে। আমাদের জাতীয় জীবনে মহিমাপূর্ণ এ দিবসটি বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দীদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায়’ উত্তরণের বিজয়ের পরিপূর্ণ দীপ্তিতে ভাস্বর। জেলের মধ্যে কবর খুঁড়ে কবরের পাশে দাঁড় করিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বলা হয়েছিল, ‘কবরে যেতে চান, না প্রধানমন্ত্রিত্ব চান।’ তিনি ঘৃণাভরে প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, ‘কবরের ভয় আমাকে দেখায়ো না। আমি তো জানি, তোমরা আমাকে ফাঁসি দেবে। এবং আমি এও জানি, বাংলার দামাল ছেলেরা হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারে। সেই বাঙালী জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’ তিনি সেদিন মিনতি করে বলেছিলেন, ‘আমাকে হত্যা করে এই কবরে না, এই লাশটি আমার বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও। যে বাংলার আলো-বাতাসে আমি বর্ধিত হয়েছি সেই বাংলার মাটিতে আমি চিরনিদ্রায় শায়িত থাকতে চাই।’যেদিন বিশ্ব জনমতের চাপে বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর নিরলস প্রচেষ্টায় পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্তি লাভ করেন, সেদিনটি ছিল ৮ জানুয়ারি। পিআইএ’র একটি বিশেষ বিমানে বঙ্গবন্ধু লন্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দরে পৌঁছান। পাকিস্তানের লায়ালপুরের মিয়ানওয়ালী কারাগারের বন্দীদশা থেকে মুক্তি লাভ করার আগে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কুচক্রী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নানারূপ ছলচাতুরি করেন। কিন্তু বাংলার মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল প্রগাঢ় ভালবাসা আর অসীম আস্থা। আর এই আস্থা ও আত্মবিশ্বাসের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে মুক্তি পাওয়ার আগ মুহূর্তেও তিনি ভুট্টোর ষড়যন্ত্র ও ছলনায় ভুলেননি। শেষ মুহূর্তে ভুট্টো একব্যাগ দলিলপত্র নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি হয়ে বলেছিলেন, একটি যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে। যাতে লেখা ছিল, ‘জনাব ভুট্টো ও জনাব শেখ মুজিবের মধ্যে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক বিষয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে।’ বঙ্গবন্ধু চিরাচরিত প্রথায় নীরব থেকে এ ধরনের বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেন। অসহিষ্ণু কণ্ঠে উত্তেজিত হয়ে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ‘এ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করবেন না কেন? এতে তো দোষের কিছু নেই।’ বঙ্গবন্ধুর একটিই উত্তর, ‘কারণ, মুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি কিছু স্বাক্ষর করব না।’ প্রত্যুত্তরে ভুট্টো তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘কিন্তু এখন তো আপনি মুক্ত। আমার বিমান অপেক্ষা করছে, আপনার যেখানে খুশি আপনাকে নিয়ে যাবে এখন এই মুহূর্তে!’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তাহলে কি আমি ঢাকা যেতে পারি?’ ভুট্টো বললেন, ‘না অন্য কোথাও।’ বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘জনাব ভুট্টো, না বলবার হৃদয়-বিদারক শক্তি নিঃসন্দেহে আপনার আছে।’ তখন ভুট্টো কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘না বলার যথেষ্ট কারণ আছে। পাকিস্তানী বিমানের ভারতের উপর দিয়ে উড়বার অনুমতি নেই। ভারতের আকাশ সীমায় আপনার বিমানকে গুলি করে নামাতে পারে। সেটা নিশ্চয় খুব সাংঘাতিক ব্যাপার হবে। সে ক্ষেত্রে আমরা আমাদের বিমানটিকেও খোয়াব। সেটিও সাংঘাতিক ক্ষতির কারণ হবে আমাদের জন্য। আপনার নিরাপত্তার বিষয়ে আমার এতসব ভাবনার জন্য অন্তত কিছুটা কৃতিত্ব পেতে পারি। ঢাকা ছাড়া অন্য যেকোন জায়গায় আপনি যেতে পারেন।’ তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তাহলে আমি লন্ডন যেতে চাই।’ এভাবেই মুক্তি পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায় অনুযায়ী লন্ডন যাত্রা স্থির হয়। বিমান হতে অবতরণের পর বঙ্গবন্ধুকে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তারা তাঁকে লন্ডনের হোটেল ক্লারিজেসে নিয়ে যান। লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর আগমন সংবাদে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী ফেলে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে ছুটে এলে বঙ্গবন্ধু তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর কুশলাদি ও তাঁর স্বাস্থ্যের খোঁজ-খবর নেন।
লন্ডনে পৌঁছেই বঙ্গবন্ধু প্রিয় সহকর্মীদের ফোন করেছিলেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ মুজিবনগর সরকারের সকলের সঙ্গেই কথা বলেছেন। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রথম প্রশ্নটি করেছিলেন, ‘হ্যালো তাজউদ্দীন, আমি এখন সাংবাদিকদের দ্বারা পরিবেষ্টিত, আমি তাদের কাছে কি বলব? আমার প্রিয় দেশবাসী কেমন আছে? পাকিস্তানী সামরিক জান্তা আমার দেশবাসীদের হত্যা করেছে।’ জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘বর্বর পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে এবং অসংখ্য লোককে দেশছাড়া করেছে। সব রকমের দুঃখ-কষ্ট সত্ত্বেও বাংলাদেশের জনসাধারণ আপনার নেতৃত্বে অবিচল আস্থা রেখে প্রিয় মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে অস্ত্র ধারণ করে। নেতার প্রতি তাদের অগাধ ভালবাসা ও আস্থা রয়েছে। তারা আপনার আগমন প্রতীক্ষা করছে।’ সেদিন আমারও সৌভাগ্য হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার। দীর্ঘদিন পর প্রিয় নেতার সঙ্গে কথা বলার সেই ক্ষণটি আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে আছে। তারপর আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় ভাবি বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের সঙ্গে কথা বলে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা সকলেই বেঁচে আছো তো?’ সকলের অতি আদরের ৭ বছরের ছোট্ট রাসেল তাঁর পিতাকে আবেগাপ্লুত স্বরে প্রশ্ন করেছিল, ‘তুমি কবে আসবে? ওরা আমাদের খুব কষ্ট দিয়েছে।’ সন্ধ্যায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কুশলাদি বিনিময়ের পর ভারতে সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতির অনুরোধ জানান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তার কথা উল্লেখ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নিকট বঙ্গবন্ধু গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বলেন, ‘আমি আপনার নিকট একান্ত কৃতজ্ঞ।’ প্রত্যুত্তরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আসলে আমরাই আপনার নিকট কৃতজ্ঞ। কারণ আপনিই আপনার দেশবাসীকে প্রেরণা যুগিয়েছেন।’ এরপর লন্ডন থেকে ঢাকা ফেরার পথে দিল্লীতে সাময়িক যাত্রা বিরতির জন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত অনুরোধে বঙ্গবন্ধু সম্মতি প্রদান করেন।
লন্ডনে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বাংলার জনগণের কাছে ফিরে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে বলেছিলেন, ‘আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে রাজি নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।’ জনগণের জন্যই নিবেদিত ছিল তাঁর রাজনীতি ও কর্মসূচী। বাংলার মানুষের প্রতি ভালবাসা সম্পর্কে তিনি তাঁর বক্তৃতায় সবসময় বলতেন, ‘আমাকে মোনেম খান কাবু করতে পারেনি, এমনকি আইয়ুব খানও পারেনি কিন্তু আমাকে দুর্বল করে দিয়েছে আপনাদের এই অকুণ্ঠ ভালবাসা। আপনারা দোয়া করবেন যেন আপনাদের এই ভালবাসার মর্যাদা দিতে পারি।’ বাংলার মানুষের প্রতি ভালবাসার মর্যাদা তিনি রক্ত দিয়ে পরিশোধ করে গেছেন। কবিগুরুর ভাষায়, “আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা এ জীবন, সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে, মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে।’
এরপর পালাম বিমান বন্দরে দিল্লীর জনসাধারণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে এক অভূতপূর্ব রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। বিমানবন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও উর্ধতন কর্মকর্তাগণ। পালাম বিমানবন্দরে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর কমেট জেটটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অবতরণ করলে তাঁর সম্মানে ২১বার তোপধ্বনি করা হয়। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পর পূর্বেই উপস্থিত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ তাঁকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বলেন, ‘আপনার জন্য আমি গর্বিত। ভারত ও বাংলাদেশের মানুষ আপনার জন্য গর্ব অনুভব করে। শেখ মুজিবকে আমাদের মাঝে পেয়ে ভারতের জনগণ আজ আনন্দে আত্মহারা। শেখ সাহেব তাঁর জনগণকে নতুন জীবন দান করেছেন। তাঁর স্বাধীনতার স্বপ্ন আজ সার্থক। শারীরিকভাবে তিনি বন্দী ছিলেন কিন্তু তাঁর স্বপ্ন ও সাধকে বাস্তবায়িত করতে বাংলার জনগণ তাঁরই অনুপ্রেরণায় স্বাধীনতার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।’ ভারতীয় সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ পরিদর্শনের আগে বঙ্গবন্ধু ভারতীয় মন্ত্রিসভার সকল সদস্য ও অন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে করমর্দন করেন। এই সময় উভয় দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়। সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতিকালে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে ভারতবাসীর উদ্দেশে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতায় বলেন, ‘আমার জন্য এটা পরম সন্তোষের মুহূর্ত। বাংলাদেশে যাবার পথে আমি আপনাদের মহতী দেশের ঐতিহাসিক রাজধানীতে যাত্রাবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছি এ কারণে যে, আমাদের জনগণের সবচেয়ে বড় বন্ধু ভারতের জনগণ এবং আপনাদের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী যিনি কেবল মানুষের নন, মানবতারও নেতা। তাঁর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের কাছে এর মাধ্যমে আমি আমার ন্যূনতম ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারব।’
অবশেষে আমাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে লন্ডন থেকে দিল্লী হয়ে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর কমেট বিমানটি ঢাকার আকাশ সীমায় দেখা দিতেই জনসমুদ্র উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। দুপুর ১-৫১ মিনিটে বিমানবন্দরে বিমানটি অবতরণ করে। বিমানের সিঁড়ি বেয়ে জাতির জনক তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে ৩১বার তোপধ্বনি করে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি সম্মান জানানো হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। চারদিক থেকে তাঁর উপর পুষ্পবৃষ্টি হতে থাকে। বাংলাদেশ সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী রাষ্ট্রপ্রধানকে গার্ড অব অনার প্রদর্শন করে। মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু সালাম গ্রহণ করেন। এ সময় বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী, লে. কর্নেল শফিউল্লাহ্ এবং বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র সে. লেফটেন্যান্ট শেখ কামাল জাতির জনকের পাশে ছিলেন। মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী গার্ড অব অনার পরিচালনা করেন। গার্ড অব অনার পরিদর্শনের পর বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দরে উপস্থিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ঢাকায় বিদেশী মিশনের সদস্যবৃন্দ ও অন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে করমর্দন করেন। আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বিমান বন্দরে উপস্থিত মিত্রবাহিনীর পদস্থ সামরিক অফিসার, বাংলাদেশ সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাগণ ছাড়াও বাংলাদেশে বিদেশী মিশনের রাষ্ট্রদূতগণ উপস্থিত ছিলেন। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সুদৃশ্য তোরণ, বাংলাদেশের পতাকা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি দিয়ে সজ্জিত রাজপথের দু’পাশে দাঁড়ানো জনসমুদ্র পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পৌঁছলাম তখন বিকাল সাড়ে ৪টা। অর্থাৎ কুর্মিটোলা বিমানবন্দর থেকে ময়দান পর্যন্ত আসতে সময় লেগেছে ২ ঘণ্টা ৩৯ মিনিট। নেতাকে নিয়ে যখন মঞ্চে আরোহণের আগ পর্যন্ত চতুর্দিকে করতালি আর জয়বাংলা সেøাগানে মুখরিত কানায়-কানায় পরিপূর্ণ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সেদিন কোন সীমানা ছিল না, ছিল না তিল ধারণের ঠাঁই। আমি মঞ্চের ‘পরে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে সেদিন গগনবিদারী সেøাগান তুলেছিলাম, ‘আমার নেতা তোমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব।’ এই সেই ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ’৭১-এর ৭ মার্চের মঞ্চে জাতির জনকের পাশে থেকে শুনেছিলাম তাঁর বজ্রকণ্ঠের ডাক, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ’৭১-এর ৩ জানুয়ারি এই পবিত্র উদ্যানে তিনি আমাদের শপথ বাক্য পাঠ করিয়ে বলেছিলেন, ‘৬ দফা ও ১১ দফা আজ আমার নয়, আমার দলেরও নয়। এ আজ বাংলার জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে বাংলার মানুষ তাঁকে জ্যান্ত সমাধিস্থ করবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও। ’৭০-এর ৭ জুন, এই উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের প্রথম নির্বাচনী সমাবেশ। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে এবং তাঁরই নির্দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে সাধারণ এক কর্মী হিসেবে আওয়ামী লীগে যোগদান করি। আর ’৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি, তথাকথিত লৌহমানব আইয়ুব খানের কারাগারে দীর্ঘ ৩৩ মাস আটক থাকা বঙ্গবন্ধু মুজিবকে কারামুক্ত করে ১০ লক্ষাধিক জনতার সম্মতি নিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলাম। সেদিন সদ্য ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি পাওয়া জাতির জনক বাংলার মানুষকে কথা দিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনাদের অধিকার রক্ষায় প্রয়োজনে জীবন দিতে আমি প্রস্তুত’। সভামঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু ধানম-ির ১৮ নং বাড়িতে গেলেন। যেখানে পরিবারের সদস্যবৃন্দ অবস্থান করছিলেন। সেই বাড়ির সামনে আর একটি বাড়ি তখন তাঁর জন্য রাখা হয়েছিল। কেননা ধানম-ির ৩২ নং বাসভবনটি শত্রুবাহিনী এমনভাবে তছনছ করে দিয়েছিল যে বসবাসের অনুপযুক্ত ছিল। ১১ জানুয়ারি প্রিয় সহকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন এবং আবু সাইদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি করলেন। ১৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু আমাকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় তাঁর রাজনৈতিক সচিব করেন। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় সংসদীয় গণতন্ত্র।
এবারের ১০ জানুয়ারি এমন এক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উদযাপিত হচ্ছে যখন স্বাধীন বাংলাদেশে ’৭১-এর মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনতার মহাসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে স্বীয় অঙ্গীকারের কথা ব্যক্ত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে সর্বদা লক্ষ্য করেছি তাঁর মুখাবয়ব জুড়ে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ পেত তা ছিল অকপট। কপটতা ছিল তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন, ‘গত পঁচিশে মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাসে বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এসব কুকীর্তির বিচার করতে হবে।’ ১৫ আগস্টের ঘাতকের বুলেট সে কাজ সমাপ্ত করতে দেয়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল। আমরা জাতির জনকের কাছ থেকে নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রের দীক্ষা পেয়েছি। সুষ্ঠু ও আইনানুগ প্রক্রিয়ায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে জাতীয় ইতিহাসকে কলঙ্কমুক্ত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিগত সরকারের সময় তারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন ছিল। আজ আমরা তাদের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছি। বিরোধীদের সঙ্গে আমাদের প্রধান পার্থক্য আমরা ইতিহাসের নিকট অঙ্গীকারাবদ্ধ। আজ জাতির জনকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের স্মরণীয় এই ঐতিহাসিক দিনটিতে কেবলই মনে পড়ে ৭ মার্চের ভাষণের শেষাংশটি “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” রাজনৈতিক মুক্তি আমাদের অর্জিত হয়েছে। আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, সংবিধান, জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা পেয়েছি। বহু ত্যাগের বিনিময়ে পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্র পেয়েছি। কিন্তু জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে আর তাঁর ভালবাসার হতদরিদ্র দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে আমরা যেকোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত।
দীর্ঘ ২৬ বছরের নানা তাললয়ে চলে আসা স্বৈশাসনের অবসানে এবারের মহান বিজয় দিবস এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে যুদ্ধাপরাীধদের বিচার কার্য ত্বরান্বিত করতে সারা দেশে যে জনজোয়ার বিশেষ করে নবপ্রজন্মের চেতনায় যে উদ্দীপনা দেখেছি তা অভূতপূর্ব। সমগ্র জাতি যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মহতী আকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত ঠিক তখন এই বিচার প্রক্রিয়া বানচাল করতে শুরু হয়েছে ষড়যন্ত্র। সকলে মিলে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে।
লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, সভাপতি, শিল্প মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। tofailahmed69@gmail.com
No comments