মার্কিন কংগ্রেস প্রতিনিধিদলের সফর- তৈরি পোশাকশিল্প নিয়ে ভাবমূর্তি বাড়াতে পরামর্শ
শ্রমমান ও তৈরি পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদেশের দুর্নাম রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক সাফল্য বাইরের দুনিয়ায় পৌঁছায় না।
তাই শ্রমিকস্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমালোচনার ক্ষেত্রগুলোতে দৃশ্যমান উন্নতির লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিতে হবে। এটি হলেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে উঠবে। ঢাকায় সংক্ষিপ্ত সফরের সময় এমন মত দিয়েছে মার্কিন কংগ্রেসের একটি প্রতিনিধিদল। গতকাল রোববার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় মার্কিন কংগ্রেস বাংলাদেশ সম্পর্কে এ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে। পাঁচ সদস্যের দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন মার্কিন কংগ্রেসের ওয়েজ অ্যান্ড মিন্স কমিটির চেয়ারম্যান ও রিপাবলিকান পার্টির সদস্য জ্যাক কিংসটন। পরে দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে অন্য এক আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের বাজারসুবিধা প্রাপ্তিসহ দেশের স্বার্থ সুরক্ষায় লবিস্ট নিয়োগের প্রস্তাব দেয় মার্কিন কংগ্রেসের ওই প্রতিনিধিদলটি। এরপর দলটি গতকাল একটি তৈরি পোশাক কারখানাও পরিদর্শন করেছে।প্রায় ২১ ঘণ্টার সফর শেষে প্রতিনিধিদলটি গতকাল সন্ধ্যায় দিল্লির উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক: প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা শেখ হাসিনাকে বলেছেন, এই সফরে বাংলাদেশ নিয়ে তাঁদের ইতিবাচক ধারণা জন্মেছে। সফরটি সংক্ষিপ্ত হলেও এখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে মোটামুটি তথ্যবহুল ধারণা পেয়েছেন। ঢাকায় না এলে তাঁদের এ ধারণা হতো না। কংগ্রেস প্রতিনিধিরা এ সময় প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, বাংলাদেশের শ্রমমান ও পোশাক তৈরির কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের কারণে বাইরে দুর্নাম রয়েছে। তাই এসব ক্ষেত্রে দৃশ্যমান উন্নতির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হলে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্যগাথা খুব দ্রুত বাইরে পৌঁছাবে।
বৈঠকের সময় প্রধানমন্ত্রী তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকের স্বার্থ সুরক্ষার বিষয়ে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা কংগ্রেস সদস্যদের কাছে তুলে ধরেন।
প্রতিনিধিদলের ডেমোক্রেটিক পার্টির একমাত্র প্রতিনিধি অ্যাডাম শিউ প্রধানমন্ত্রীর কাছে গত শনিবার মোহাম্মদপুরের স্মার্ট এক্সপোর্ট লিমিটেডের অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চান। প্রধানমন্ত্রী সংক্ষেপে ঘটনাটি মার্কিন কংগ্রেসের কাছে তুলে ধরেন। এরপর তিনি তাঁদের বলেন, যে কারখানায় আগুন লেগেছে, সেটি বিজিএমইএ কিংবা বিকেএমইএর সদস্য নয়। পোশাকশিল্পের শীর্ষ দুই সংস্থার বাইরে অনেক পোশাক তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। এ অবস্থায় সরকার এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে নজর রাখবে।
লবিস্ট নিয়োগে দূতিয়ালি: পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে তৈরি পোশাকশিল্পের পরিবেশ, শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতি নিয়ে কথা বলে মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধিদলটি।
মধ্যাহ্নভোজ শেষে দীপু মনি তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেন, মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশে এসে বুঝেছে, বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের যে ধারণা ছিল, তা সঠিক তথ্যভিত্তিক নয়। এখানে এসে তাদের ধারণা পাল্টেছে। কাজেই ভবিষ্যতে মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশের পক্ষে বলা তাদের জন্য সহজ হবে। এ প্রসঙ্গে মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যরা বলেন, বিভিন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্রে তাদের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে লবিস্ট নিয়োগ করে ভালো ফল পায়। লবিস্টরা পেশাগতভাবে কাজটি করে বলে একটি দেশের স্বার্থ সুরক্ষা করতে সুবিধা হয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা অব্যাহত থাকার পক্ষে মত দিয়েছেন মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যরা। কারণ, দুই দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক যে সহযোগিতা রয়েছে, তাতে এই সুবিধা অব্যাহত থাকা উচিত। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের মার্কিন বাজারে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাওয়া উচিত।
তৈরি পোশাক কারখানায় সর্বশেষ অগ্নিকাণ্ড নিয়ে প্রতিনিধিদলটি উদ্বেগ জানিয়েছে কি না, প্রশ্ন করা হলে দীপু মনি বলেন, তারা মূলত শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও ট্রেড ইউনিয়নের বিষয় নিয়ে জানতে চেয়েছে। তাদের জানানো হয়েছে, সরকার ধীরে ধীরে সব প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক অধিকার রক্ষা-সংক্রান্ত সংগঠন গঠন করছে।
প্রতিনিধিদলটি এরপর বেলা পৌনে তিনটায় বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি টিপু মুন্সীর সেপাল গার্মেন্টস পরিদর্শনে যায়। বিকেল চারটা পর্যন্ত তারা কারখানার প্রতিটি বিভাগ ঘুরে দেখে। তবে এ সময় সংবাদ সংগ্রহ করতে আসা কোনো সাংবাদিককেই ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
প্রতিনিধিদলের সঙ্গে থাকা বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রতিনিধিদল কারখানা সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। আমি মনে করি, তারা খুশি।’ বিজিএমইএর সভাপতি আরও বলেন, ‘আমরা কারাখানার অগ্নিনিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ নিয়ে কী করছি, তা তারা জানতে চেয়েছে। আমরা তাদের বলেছি, অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া তদারকিসহ অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
সফিউল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমাদের কারখানাগুলোতে উন্নত মানের অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা আছে। একেবারেই কিছু না করে আমরা দুই হাজার কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করছি না। তবে এটি সত্য, আমাদের কিছু কারখানায় সমস্যা আছে। এটি কাটিয়ে উঠতে আমরা কাজ করছি।’
শনিবার স্মার্ট গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা প্রভাবিত হবেন না বলে মন্তব্য করেন সফিউল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘তাঁরা পরিপক্ব রাজনীতিবিদ। তাঁরা কোনো ঘটনাতেই প্রভাবিত হন না।’
No comments