ঐতিহাসিক ৭ মার্চ-বাঙালির আত্মঘোষণার দিন
২০১১ সালের মার্চ মাসের দিনগুলো অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ বিশেষভাবে স্মরণ করছে ১৯৭১ সালের মার্চের ঘটনাবলি। প্রতি বছরই ঘটা করে আমরা স্মরণ করি অগি্নঝরা মার্চের কথা_ পাকিস্তানি শাসকদের বিশ্বাসঘাতকতা, জনরায়ের প্রতি অবমাননার পাশাপাশি শপথে দৃপ্ত বাঙালির আত্মঘোষণার কথাও।
আমাদের পতাকা উত্তোলন, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি থেকে শুরু করে ৭ মার্চের ভাষণ পর্যন্ত স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠার পথে প্রতিটি পদক্ষেপকে আমরা স্মরণ করি। কিন্তু এবারের মার্চের তাৎপর্য অনেকটাই ভিন্ন। কারণ স্বাধীন জাতি হিসেবে ইতিমধ্যে আমরা অতিক্রম করেছি ৪০টি বছর। একটি জাতির জন্য ৪০ বছর খুব কম সময় নয়। জাতি গঠনের পর অগ্রযাত্রার পথে কতটুকু অর্জন ও ব্যর্থতা আমাদের, তা বিচার করার অবকাশ ৪০ বছরে হওয়া উচিত বলে অনেকে মনে করেন। তাই এবারের মার্চে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন, আশা ও অর্জনের ফারাক কতটুকু_ তা মেলানোর জন্য সবাই উন্মুখ। জাতি হিসেবে স্বাধীনতার ৪০ বছরে হিসাব মেলানোর এ আয়োজন আমাদের জন্য বিরল একটি অভিজ্ঞতা, একই সঙ্গে প্রয়োজনীয়ও বটে। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মতপ্রকাশ, উন্নয়ন, অগ্রগতির পথে আমরা কতটুকু এগোলাম, তা যদি স্পষ্ট হয় তবে আগামীর নির্দেশনা কী তা-ও স্পষ্ট হবে। জাতি হিসেবে আমরা কোন লক্ষ্য অর্জন করে স্বাধীনতার ৫০ বছরে পদার্পণ করতে চাই, তা এখনই নির্ধারিত হওয়া উচিত। ফলে মার্চের দিনগুলোকে স্মরণ করার পাশাপাশি মূল্যায়নের এ অবকাশ খুব গুরুত্বপূর্ণ বলেই বিবেচিত হচ্ছে। আজ ৭ মার্চ। এ দিন জাতির জনক বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে একটি অবিস্মরণীয় বক্তৃতার মধ্য দিয়ে জাতি হিসেবে আমাদের আত্মঅধিকারের প্রশ্নটি সবার সামনে উপস্থাপন করেছিলেন। জানিয়ে দিয়েছিলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে এক দেশে বসবাসের যে ইতিহাস তৈরি হয়েছিল, তার অন্ত ঘটতে যাচ্ছে শিগগিরই। বাঙালি স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ও আবেগী ওই ভাষণের মধ্য দিয়ে জাতি জানতে পেরেছিল, পরবর্তী করণীয় কী? আবশ্যিকভাবে, এ ভাষণের পর জাতি মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। এ নিয়ে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্কও তৈরি হয়েছে। কিন্তু ৭ মার্চের ভাষণের পর নতুন করে স্বাধীনতা ঘোষণার আনুষ্ঠানিকতা কতটুকু প্রয়োজনীয় ছিল, এ নিয়ে বিস্তর কথা পরবর্তী সময়ে হয়েছে। আশার কথা, এ সংক্রান্ত বিতর্কগুলোর অনেকটাই স্তিমিত এখন। অনেকেই মনে করেন, ৭ মার্চের মধ্য দিয়েই জাতি স্পষ্ট দিকনির্দেশনা পেয়েছিল। ফলে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ৪০ বছর পর ২০১১ সালের ৭ মার্চের দিনটিকে বিশেষভাবে পালনের প্রয়োজন আছে। ৭ মার্চে বঙ্গবল্পুব্দর বক্তৃতা ঔপনিবেশিক শাসনে পীড়িত বাঙালির মনে যে নবজাগরণের আকাঙ্ক্ষা উস্কে দিয়েছিল, নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছিল, পুরো জাতিকে একটি একক লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করতে পেরেছিল_ সেই ঐক্য, একাগ্রতা, লক্ষ্যভেদী কঠোরতা ৪০ বছর পর আমাদের অগ্রগতির পথেও প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দল-মত থাকবে, বহু মতের মানুষ বহু দিকে চালিত হবেন, এ কথা সত্য। এটিই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। কিন্তু বহু মত ও মতপার্থক্যের মধ্যেও জাতির জন্য দল-মত নির্বিশেষে কিছু লক্ষ্য ও আদর্শ স্থির হওয়া দরকার। ধ্রুবতারার মতো যা লক্ষ্য করে জাতি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। ৭ মার্চের ৪০ বছর পূর্তিতে তেমন এক ঐক্যবদ্ধ প্রত্যয়ের প্রত্যাশা করছি, যাকে অবলম্বন করে স্বাধীনতার ৫০ বছরে একটি সমৃদ্ধ, উন্নত বাংলাদেশ আমরা বাস্তবায়ন করতে পারব।
No comments