নারীর প্রতি সহিংসতা রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন চাই
বর্তমান সময়ে বিশেষ করে গত দুই মাসে গণমাধ্যমগুলো থেকে আমরা ধর্ষণসহ বিভিন্ন প্রকার নারীর প্রতি সহিংসতার খবর জানতে পারছি যা উদ্বেগজনক। কিছুদিন আগে গত ডিসেম্বর মাসে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ২০১২ উদযাপনের অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা রিলিফ ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক
আয়োজিত 'যশোর জেলার নারীর প্রতি সহিংসতার বর্তমান অবস্থা এবং আমাদের করণীয়' শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে একজন আলোচকের বক্তব্য ছিল এ রকম যে, ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সহিংসতা থাকবেই। তিনি বোঝাতে চাইছিলেন যে, এ ধরনের সহিংসতা এই সমাজ ব্যবস্থারই একটা অংশ। যশোর জেলার বর্তমান সহিংসতা পরিস্থিতির বিষয়ে আলোচনায় গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণের প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়েছিল। সেখান থেকে জানা যায়, গত সেপ্টেম্বর-নভেম্বর ২০১২ মাসে এখানে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ১৩৪টি। যার মধ্যে ছিল খুন, ধর্ষণ থেকে শুরু করে সব ধরনের সহিংসতা। এর মধ্যে ১৮টি হত্যা এবং ৭টি ধর্ষণের ঘটনা জানা যায়। ধর্ষণের শিকারদের অধিকাংশই শিশু। এই সহিংসতার তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পাওয়া যায়। এর বাইরেও প্রচুর ঘটনা লোকচক্ষুর আড়ালে-আবডালে হয়ে যাচ্ছে অথবা প্রকাশিত হচ্ছে না কোনো গণমাধ্যমে। গোলটেবিল বৈঠকটি যশোর জেলার অবস্থাকে চিহ্নিত করে অনুষ্ঠিত হলেও ঘটনাগুলো আসলে বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়। সারাদেশের পরিস্থিতির বাইরে গিয়ে একে কল্পনাও করা যায় না। আমরা কাজ করছি নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে। এই কাজ করতে গিয়ে আমরা বারবারই যে বিষয়টি উপলব্ধি করেছি যে, এই নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে প্রয়োজন রাজনৈতিক উদ্যোগ। প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন। তাছাড়া কোনোভাবেই এই সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। অধিকার নামে একটি মানবাধিকার সংস্থার এক গবেষণায় দেখা যায়, শুধু ২০০৯ সালেই ৪৫৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়। এর মধ্যে ২১১ জন পূর্ণ বয়স্ক নারী আর ২৪৩ জন শিশু। নারীর প্রতি সহিংসতার অনেকগুলো ধরনের মধ্যে এই একটির দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পারি যে, এর রূপ কত ভয়াবহ। প্রতিদিন ১.২৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন রিসার্স অ্যান্ড ট্রেনিং (নিপোর্ট) কর্তৃক ২০০৭ পরিচালিত ইধহমষধফবংয উবসড়মৎধঢ়যরপ ধহফ ঐবধষঃয ঝঁৎাবু নামক এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৬০ ভাগ নারী বিবাহিত জীবনে তার পরিবারে স্বামী কর্তৃক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। ২০০৬ সালে আইসিডিডিআরবি কর্তৃক পরিচালিত অপর এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ৫০ থেকে ৬০ ভাগ নারী বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়। নির্যাতনের শিকার নারীদের সহায়তা দানকারী একটি এনজিও ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের হিসাব মতে, নারীরা যে যৌন নিপীড়নের শিকার হয় তার ৭০ ভাগই ঘটে নিজেদের পরিবারের মধ্যে। ডঐঙ কতৃক পরিচালিত গঁষঃর-ঈড়ঁহঃৎু ঝঃঁফু ড়হ ডড়সবহ্থং ঐবধষঃয ধহফ উড়সবংঃরপ ঠরড়ষবহপব ধমধরহংঃ ডড়সবহ (২০০৫) নামক গবেষণায় জানা যায়, 'পরিবারে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় এমন নারীদের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ নারী এ সম্পর্কে অভিযোগ করেন।' এ রকমই হলো আমাদের দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র।
বাংলাদেশের দ্বিদলীয় বৃত্তের ক্ষমতা দখল এবং টিকে থাকার যে রাজনীতি তার সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে আছে এই সহিংসতার কারণগুলো। সমাজের প্রতিটি ঘটনাই রাজনীতিকরণ করা হয়। সেখানে ধর্ষণের শিকার নারী অথবা শিশু কোন রাজনৈতিক দল সমর্থিত পরিবারের আর ধর্ষক কোন রাজনৈতিক দল সমর্থিত অথবা সমর্থিত পরিবারের সেটাই এখানকার প্রধান বিবেচ্য। সব ঘটনাই এখানে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া হয় এই বর্তমান রাজনৈতিক চর্চায়। সমর্থিত দল ক্ষমতায় থাকলে অপরাধের বিচার হবে না আর ক্ষমতায় না থাকলে বিচার হবে। আবার যদি শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধীর সমর্থিত দল ক্ষমতায় আসে অথবা ক্ষমতার অংশীদার হয়, তাহলে অপরাধকে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়ে অপরাধীকে মুক্ত করা হয়। এই হলো আমাদের দেশের রাজনীতির চর্চা। অনেকেই মন্তব্য করতে পারেন, বাংলাদেশের রাজনীতির না হয় এই চিত্র, ভারতে কিংবা মিয়ানমারে ধর্ষণ হলো কেন? এর উত্তরে আমরা বলতে চাই, মিয়ানমার অথবা ভারতের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক চিত্রও আমাদের থেকে খুব একটা ভিন্ন নয়। সমাজটা নির্ভর করে রাষ্ট্র ব্যবস্থার চরিত্রের ওপর। রাষ্ট্রের চরিত্র যদি হয় নিপীড়নমূলক, তাহলে সেখানে পেরিফেরিতে যাদের অবস্থান তারা ক্ষমতাবানদের দ্বারা নির্যাতিত হবেই। তাই আমরা বলতে চাই, নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে হলে সবার আগে চাই রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন।
এমএম কবীর মামুন, শেখ নাজমুল ইসলাম, সুব্রত কুমার শর্মা
লেখকবৃন্দ : রিলিফ ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ প্রকল্পে কর্মরত
বাংলাদেশের দ্বিদলীয় বৃত্তের ক্ষমতা দখল এবং টিকে থাকার যে রাজনীতি তার সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে আছে এই সহিংসতার কারণগুলো। সমাজের প্রতিটি ঘটনাই রাজনীতিকরণ করা হয়। সেখানে ধর্ষণের শিকার নারী অথবা শিশু কোন রাজনৈতিক দল সমর্থিত পরিবারের আর ধর্ষক কোন রাজনৈতিক দল সমর্থিত অথবা সমর্থিত পরিবারের সেটাই এখানকার প্রধান বিবেচ্য। সব ঘটনাই এখানে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া হয় এই বর্তমান রাজনৈতিক চর্চায়। সমর্থিত দল ক্ষমতায় থাকলে অপরাধের বিচার হবে না আর ক্ষমতায় না থাকলে বিচার হবে। আবার যদি শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধীর সমর্থিত দল ক্ষমতায় আসে অথবা ক্ষমতার অংশীদার হয়, তাহলে অপরাধকে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়ে অপরাধীকে মুক্ত করা হয়। এই হলো আমাদের দেশের রাজনীতির চর্চা। অনেকেই মন্তব্য করতে পারেন, বাংলাদেশের রাজনীতির না হয় এই চিত্র, ভারতে কিংবা মিয়ানমারে ধর্ষণ হলো কেন? এর উত্তরে আমরা বলতে চাই, মিয়ানমার অথবা ভারতের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক চিত্রও আমাদের থেকে খুব একটা ভিন্ন নয়। সমাজটা নির্ভর করে রাষ্ট্র ব্যবস্থার চরিত্রের ওপর। রাষ্ট্রের চরিত্র যদি হয় নিপীড়নমূলক, তাহলে সেখানে পেরিফেরিতে যাদের অবস্থান তারা ক্ষমতাবানদের দ্বারা নির্যাতিত হবেই। তাই আমরা বলতে চাই, নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে হলে সবার আগে চাই রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন।
এমএম কবীর মামুন, শেখ নাজমুল ইসলাম, সুব্রত কুমার শর্মা
লেখকবৃন্দ : রিলিফ ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ প্রকল্পে কর্মরত
No comments