ড্রর স্বপ্নভঙ্গ উল্টো হার টাইগারদের
আরিফুর রহমান বাবু, চট্টগ্রাম থেকে জেতার না হোক, ড্র করার স্বপ্ন ছিল। শুধু স্বপ্ন বলা কেন, নিজ মাটিতে টেস্ট ক্রিকেটের এক নম্বর দল ভারতের সঙ্গে টেস্ট ড্র করার সুযোগ-সম্ভাবনাও ছিল যথেষ্ট।
সে স্বপ্নের বাসত্মব রূপ দিতে দরকার ছিল শেষদিনের পুরো সময় উইকেটে টিকে থাকা। টাইগার ক্যাপ্টেন শাকিব বেশ বড় গলায় বলেছিলেন, আমরা পঞ্চম ও শেষদিন পুরো সময় ব্যাট করতে চাই। বৃহস্পতিবার সারাদিন ব্যাট করতে পারলে হার এড়িয়ে জয়ের কাছাকাছি যাওয়ারও সুযোগ চলে আসতে পারে। শাকিব সে আশায়ও ছিলেন। বলেছিলেন, সারাদিন ব্যাট করতে পারলে জিতেও যেতে পারি। টাইগার অধিনায়ককে এত আত্মবিশ্বাসী দেখে ভারতীয় মিডিয়াও অবাক হয়েছিল। বুধবার অফিসিয়াল প্রেস ব্রিফিংয়ে টেলিগ্রাফের লোকেন্দ্র প্রতাপ শাহী বলেই ফেলেন, অধিনায়ক এত আত্মবিশ্বাসী! শাকিব উত্তরে বলেছিলেন, আমিই বরং নার্ভাস। বাকিরা আরও সাহসী। শুনে ভাল লেগেছিল। মনে হচ্ছিল, সত্যিই সারাদিন ব্যাট করে ম্যাচ ড্র করে ফেলবে শাকিবের দল। কিন্তু মনে করাই সার। শেষ পর্যনত্ম ওই কথার কোনই সত্যতা মেলেনি। শাকিব যা বলেছিলেন, ব্যাটসম্যানরা তার উল্টোটা করেছেন। ধৈর্য ধরে সারাদিন উইকেটে টিকে থাকার বদলে নিজেদের ইচ্ছামতো খেলে বিপদ ডেকে এনেছেন। আর সেই না পারার ব্যর্থতায় ড্রর স্বপ্ন ভেঙ্গেছে। উল্টো ১১৩ রানের বড় হার হজম করতে হয়েছে টাইগারদের।কোন জটিলতা ছিল না। একদম সহজ হিসেব ও সমীকরণই ছিল। শাকিবরা সারাদিন উইকেটে কাটিয়ে দিতে পারলেই ম্যাচ ড্র হয়ে যেত। আর শেষদিন জিততে প্রয়োজন ছিল ৩৪৮ রান। আসল ল্য অবশ্য তারচেয়েও বড়, ৪১৫ রান। কিন্তু বুধবার চতুর্থ দিন ২ উইকেটে ৬৭ রান করে ফেলায় তা কমে ৩৪৮-এ নেমে এসেছিল। কুয়াশা কিংবা আলোর স্বল্পতায় বিঘি্নত বা বিলম্বিত না হলে সারাদিনে ৯৮ ওভার খেলা হবার কথা ছিল। হাতে ৮ উইকেট, এক নম্বর ওপেনার তামিম আর দেশের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান আশরাফুল ছিলেন ক্রিজে। যাদের দু'জনেরই টেস্ট সেঞ্চুরি আছে। সেটা ভারতের বর্তমান বোলিংয়ের চেয়ে আরও সমৃদ্ধ ও ধারালো বোলিংয়ের বিরম্নদ্ধেই। ওরা পারেন, দু'জন একসঙ্গে না হোক, একজন একটা লম্বা ইনিংস খেললেই পরাজয় এড়ানোর পথ প্রশসত্ম হবে। এর সঙ্গে শাকিব, মুশফিক আর রিয়াদরা তাল মেলাতে পারলে তো কথাই নেই। ড্র হবেই। কিন্তু সবার আগে দরকার ছিল, শেষদিন প্রথম ঘণ্টা টিকে থাকা।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে যে কোন দল সেটাই চায়। সারাদিন টিকে থাকার প্রথম রসদ ও ভিত হচ্ছে প্রথম ঘণ্টায় উইকেট না দেয়া। তাহলে যেমন নিজেদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে, তেমনি প্রতিপরে আত্মবিশ্বাসেও কিছুটা কমতি আসে। তামিম ও আশরাফুল প্রথম ঘণ্টায় টিকে থাকতে পারলে হয়ত ভারতীয়রা আরও আক্রমণাত্মক হতেন, তখন রান করার সুযোগও আসত। কিন্তু ওরা অত ভেবেচিনত্মে ব্যাট করেননি। প্রথম ঘণ্টায়ই দু'জন আউট হয়েছেন। নিজেকে মেলে ধরতে না পারা আশরাফুল অফস্টাম্পের বাইরে ক্যাচ দিলেন নবিসদের মতো। আর ভাল খেলতে খেলতেও তামিম রীতিমতো অন্যায় করে ফিরলেন। পঞ্চাশ পেরিয়ে মধ্যাহ্ন বিরতির ঠিক আট মিনিট আগে উইকেট বিসর্জন দিলেন তামিম। বোলার ছিলেন সেবাগ। এ অফস্পিনারের বলে সিস্নপে ক্যাচ দিয়ে তামিম যেভাবে ফিরলেন তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করাও ছিল কঠিন। রাউন্ড দ্য উইকেট করা সেবাগ পিচ ফেলেছিলেন অফস্টাম্পের ছয় ইঞ্চি বাইরে। আরও বেরিয়ে যাওয়া বলের পেছনে শরীর ও পা না নিয়ে জায়গায় দাঁড়িয়ে ব্যাট ছুড়লেন। পরিণতি সিস্নপে ক্যাচ। এর পর ক্যাপ্টেন শাকিব ও প্রথম ইনিংসে ভাল খেলা রিয়াদও হাঁটলেন ভুল পথে। দীর্ঘ ইনিংস খেলার বদলে শটস খেলায় বেশি মনোযোগী ছিলেন দু'জন। এর খেসারতও দিলেন। এ সব প্রতিষ্ঠিত উইলোবাজের দায়িত্বহীন ব্যাটিংয়ে জেতা অলীক কল্পনা, প্রথম সেশনেই ম্যাচ হাত থেকে বেরিয়ে গেল। তার পর অনিবার্য পরাজয়ের সামনে দাঁড়িয়ে লড়লেন মুশফিকুর রহিম। শুধু লড়লেন বলা বোধকরি কম বলা হলো। বীরের মতো বুক চিতিয়ে লড়াই করলেন এ তরম্নণ। নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে দাঁড়িয়ে সাহস, উদ্যম না হারিয়ে নিজের সেরাটাই খেললেন। তবে বড্ড দেরিতে। ওপরের দিকে তামিম, শাহরিয়ার, আশরাফুল, রকিবুল, শাকিব ও রিয়াদের অনত্মত দু'জন ওরকম দায়িত্ব নিয়ে লম্বা ইনিংস খেলতে পারলে অনায়াসে ড্র করা যেত। মুশফিকুর রহিমের দৃঢ়চেতা ব্যাটিং দলের ভাগ্য পরিবর্তন করেনি। তবে সাফল্যের ব্যক্তিগত মাইলফলক স্থাপিত হয়েছে। টেস্টে প্রথম সেঞ্চুরির দেখা মিলেছে। ১১৪ বলে ১৭ বাউন্ডারি আর এক বিশাল ছক্কায় ১০১ রানের ইনিংসটি তার এ যাবত সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস। তবে এ ইনিংসটিই যদি প্রথমবার হতো, তাহলে হয়ত চট্টগ্রাম টেস্টের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। খালি চোখে মাত্র ১ রানের কমতি মনে হলেও মুশফিক প্রথম ইনিংসে ১০১ রান করতে পারলে অতি অবশ্যই বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে এগিয়ে যেত। সেটা ৬০/৭০ রানের হতে পারত। তা হলে ভারতের ৪১৪ রানের লিড কমে সাড়ে তিন শ'র মতো হয়ে যেত। তখন পুরো ব্যাটিং এ্যাপ্রোচ হয়ত অন্যরকম হতো। ৩০১ তো হয়েছেই। বাকি কেউ একজন পঞ্চাশ করলেই অভাবনীয় কিছু হয়ে যেত। এখন বাতুলতা মনে হলেও এ ম্যাচ গত ক'দিন যারা গভীর মনোযোগে দেখেছেন, তারা নিশ্চয়ই একমত হবেন। বাংলাদেশ খেলা হাতছাড়া করেছে আসলে তৃতীয় দিন, লিড নিতে না পেরে। কাজেই মুশফিক নিজে সানত্ম্বনা খুঁজতে পারেন। কিন্তু ভবিষ্যতে জায়গামতো জ্বলে ওঠার প্রত্যয় দরকার। সময় গেলে কিন্তু সাধন হয় না। বন্দর নগরীর জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামেও হলো না।
No comments