বিশ্ব এজতেমা আজ শুরম্ন
ফিরোজ মান্না/মোসত্মাফিজুর রহমান টিটো/নূরম্নল ইসলাম তুরাগ তীরে বিশ্ব এজতেমার মাঠ এখন প্রস্তুত। আজ শুরম্ন হচ্ছে মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ। বিশ্ব তাবলিগ জামাত আয়োজিত বিশ্ব এজতেমা।
দেশ-বিদেশের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান এতে অংশগ্রহণ করবেন। তিনদিনের বিশ্ব এজতেমা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য তাবলিগ জামাত ও সরকার সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। এজতেমা ময়দান নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এজতেমার মাঠে উপস্থিত হয়েছেন। কয়েক হাজার বিদেশী মুসলিস্ন এর আগে থেকেই এজতেমা কেন্দ্রে উপস্থিত হন। বিদেশী মুসলিস্নদের যাতে কোন অসুবিধা না হয় সেজন্য কর্তৃপৰ সুব্যবস্থা রেখেছেন। সড়ক দুর্ঘটনা ও বিভিন্ন কারণে এজতেমায় তিনজনের মৃতু্য হয়েছে।টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জামাত এজতেমায় হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মানুষের ঢল নেমেছে। পথে পথে মুসলিস্নদের কাফেলা-দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুসলিস্নরা সমবেত হচ্ছে এখানে। মাথায় এবং পিঠে শীতের কাঁথা কম্বল আর রান্নার হাঁড়ি পাতিল। আলস্নাহর দিদার লাভের জন্য তাদের শত পরিশ্রম কোন কানত্মি এনে দিচ্ছে না। পরকালের শানত্মি লাভই তাদের মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। বাসে ট্রাকে, ট্রেন ও লঞ্চে স্রোতের মতো মুসলির ঢল ছুটে এসেছে তুরাগ নদীর তীরে অবস্থিত এজতেমা ময়দানের দিকে। মানুষের এই স্রোত আজ আরও প্রবল বেগে বইবে। ধারণা করা হচ্ছে এজতেমা ময়দানে এবার ৫০ থেকে ৬০ লাখ ধর্মপ্রাণ মসুলমানের সমাবেশ ঘটবে। তিন দিনের এজতেমায় ইসলামী বয়ান হবে। ২৪ জানুয়ারি আখেরী মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে এজতেমা। এজতেমাকে ঘিরে র্যাব, পুলিশ, বিডিআরসহ বিভিন্ন সংস্থার ১৮ হাজার নিরাপত্তা কর্মী নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলেছে। তারা আকাশ, স্থল এবং নদীপথে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে। বসানো হয়েছে কোজ সার্কিট ক্যামেরা। এজতেমা ময়দানে কোথায় কি ঘটছে তা র্যাবের কন্ট্রোল রম্নম থেকে সব কিছু দেখা যাবে। নিরাপত্তা কর্মীরা সব ধরনের ঘটনা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
বিশ্ব এজতেমায় অংশ নেয়া মুসলিস্নদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুরো এজতেমা এলাকাজুড়ে নেয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। এবারও তিন সত্মরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। বিশ্ব এজতেমার মুসলিস্নদের নিরাপত্তার স্বার্থে ৩৩টি খিত্তার প্রতিটিতে মুসলিস্ন বেশে দু'জন করে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য নিয়োজিত থাকবে। এজতেমা ময়দানে যে কোন ধরনের জঙ্গী ও নাশকতামূলক কর্মকা- প্রতিরোধে প্রায় এক মাস আগে থেকেই সেখানে র্যাব ও সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে। এজতেমা ময়দানে প্রবেশকারীদের মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে পরীা করে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হবে। র্যাব সূত্রে জানা যায়, বিশ্ব এজতেমায় র্যাবের প থেকে তিন সত্মরের নিরাপত্তা দেয়া হবে। এজতেমাস্থল ও তার আশপাশের এলাকা ৫টি সেক্টরে ভাগ করে ২৬ জানুয়ারি পর্যনত্ম আট শ' র্যাব সদস্য নিরাপত্তার কাজ করবে। এ নিরাপত্তার কাজ ১৭ জানুয়ারি থেকে শুরম্ন হয়েছে। এ ছাড়া র্যাবের একটি দল হেলিকপ্টারে সর্বণিক টহলে নিয়োজিত থাকবে। এজতেমাস্থলে র্যাবের একটি প্রধান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, দু'টি সিসিটিভি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র ও ৬০টি সিসিটিভি থাকছে। এছাড়া থাকবে বেশকিছু পর্যবেণ কেন্দ্র। পোশাকধারী র্যাব সদস্যের পাশাপাশি সাদা পোশাকে গোয়েন্দা দল, ডগ স্কোয়াড, নৌটহল, মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত থাকবে। গাজীপুরের পুলিশ সুপার এস. এম মাহফুজুল হক নুরম্নজ্জামান জানান, এজতেমায়
সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রায় পুলিশ, র্যাব, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, আনসার ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রায় ১৮ হাজার সদস্য কাজ করবেন।
এদিকে চিকিৎসার জন্য টঙ্গীর ৪০ শয্যার হাসপাতালকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ ট্রমা ইউনিট, বার্ন ইউনিট, এ্যাজমা ইউনিট ও কার্ডিয়াক ইউনিট খোলা হয়েছে। জনস্বাস্থ্য অধিদফতর ও ঢাকা ওয়াসা ২৪ ঘণ্টা বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে। মুসলিস্নদের ওজু গোসলের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে। এক হাজার ৮৭২টি পাকা টয়লেট, আড়াই হাজার আধাপাকা টয়লেট এবং তিন হাজার অস্থায়ী টয়লেট স্থাপন করা হয়েছে।
অন্যদিকে, এজতেমায় দায়িত্ব পালন করতে এসে পুলিশ সদস্যসহ দু'জন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। অপরজন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। এজতেমা উপল েটঙ্গীতে ডিউটি করতে আসা রাজশাহীর পুলিশ কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার (৪৮) (কংনং-৩৬০) বুধবার রাতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তার বাড়ি নওগাঁ জেলায়। রাত পেঁৗনে ১টার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী বাটা গেইট এলাকায় রাসত্মা পারাপারের সময় সাত্তার অজ্ঞাত গাড়ির চাপায় আহত হয়। গুরম্নতর আহত সাত্তারকে পাশর্্ববতর্ী টঙ্গী হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এ ছাড়াও বিবাড়িয়া জেলার মহরম আলী (৬৫) স্টেশন রোড এলাকায় সড়ক পারাপারের সময় এবং ভোলা জেলার হাসাননগরের হাজী সালেম মিয়া (৬৫) হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন।
আজ দুপুরে এজতেমা ময়দানে লাখো মুসলিস্নর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হবে উপমহাদেশের বৃহত্তম জুমার জামাত। জুমার নামাজে ২০ থেকে ২৫ লাখ মুসলিস্ন অংশ নেবেন বলে এজতেমা আয়োজক কমিটি ধারণা করছেন। সকাল থেকে বিশ্ব এজতেমার মূল কর্মসূচী আনুষ্ঠানিকভাবে শুরম্ন হওয়ার কথা থাকলেও একদিন আগে বৃহস্পতিবার বাদ ফজর থেকেই শুরম্ন হয়েছে আম বয়ান। বয়ান তাৎণিকভাবে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে শোনানো হবে। আজ বাদ ফজর থেকে শুরম্ন হবে আনুষ্ঠানিক বয়ান। আগামী রবিবার আখেরি মোনাজাতের পূর্ব পর্যনত্ম বয়ান চলবে। তিন দিনব্যাপী ৪৪তম বিশ্ব এজতেমার আখেরী মোনাজাত রবিবার দুপুর সোয়া ১২টা থেকে যোহরের নামাজের পূর্বে যে কোন সময় অনুষ্ঠিত হবে। আখেরি মোনাজাতের দিন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রীসহ অন্য ভিআইপিগণ উপস্থিত থাকবেন।
বৃহস্পতিবার বিকেলে ধর্মপ্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট শাহজাহান মিয়া ও স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. ক্যাপ্টেন (অব) মজিবুর রহমান ফকির এজতেমা ময়দান সংলগ্ন ইবনে সিনা ও হামদর্দের ফ্রি মেডিক্যাল সেন্টার উদ্বোধন করেন। ইবনে সিনা ট্রাস্টের ডেপুটি ব্যবস্থাপনা পরিচালক রকিব উদ্দিন, জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরম্নল ইসলাম, ধর্ম সচিব আব্দুর রউফ, হামদর্দের ব্যবস্থপনা পরিচালক হাকিম মোহাম্মদ ইউসুফ, জেলা প্রশাসক কামাল উদ্দিন তালুকদার, গাজীপুরের পুলিশ সুপার এ এস এম মাহফুজুল হক নুরম্নজ্জামান, টঙ্গী পৌর মেয়র আজমত উলস্না খান এসময় মন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন। এর আগে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবু সাহেদ মোঃ আবু নাসের ইবনে সিনা ফ্রি মেডিক্যাল সেন্টার পরিদর্শন করেন। এদিকে এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এজতেমাস্থলে বিদেশী মেহমানদের নিবাস পরিদর্শন করার কথা রয়েছে।
তিন দিনব্যাপী বিশ্ব এজতেমায় শরিক হতে ইতোমধ্যে কনকনে শীত উপো করে দেশ-বিদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিস্নগণ দলে দলে এজতেমা ময়দানে জমায়েত হচ্ছেন। তাঁরা বিশাল প্যান্ডেলের অভ্যনত্মরে নিজ নিজ জেলা অনুযায়ী খিত্তায় অবস্থান নিচ্ছেন।
অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার বিদেশী মেহমান বেশি হবে। সেদিকে ল্য রেখে এজতেমা কতর্ৃপ আনত্মর্জাতিক নিবাস সমপ্রসারিত করে সাধারণ খিত্তা পর্যনত্ম বিসত্মৃত করেছেন। ২৫ হাজার বিদেশী মেহমান থাকার উপযোগী করে মাঠের উত্তর-পশ্চিম পাশে নির্মাণ করা হয়েছে অতিরিক্ত ৩টি টিনশেডসহ মোট ৮টি শেড। ভারত, পাকিসত্মান, আরব, নন-আরব ডরমেটরি হিসেবে এসবকে ভাগ করা হয়েছে। এদিকে বিভিন্ন দেশ থেকে কয়েক হাজার বিদেশী মুসলিস্ন এজতেমা ময়দানের আনত্মর্জাতিক নিবাসে এসে পেঁৗছেছেন। তিনদিনের কর্মসূচী পরিচালনার জন্য এবার আনত্মর্জাতিক নিবাসের পাশেই মূল বয়ান মঞ্চ, মাঠের পশ্চিম পাশে নামাজ মঞ্চ এবং আজানের জন্য দুই শতাধিক মোকাব্বের মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। বয়ান সুস্পষ্টভাবে শোনার জন্য দেড় শ' 'ছাতা মাইক' ব্যবহার হবে। ১৬০ একর জমির ওপর বিশাল শামিয়ানা নির্মাণের পর খুঁটি নম্বর, খিত্তা নম্বর, হালকা নম্বর বসানো হয়েছে। এজতেমা ময়দানে প্রতিবন্ধীদের আলাদা থাকার জায়গা রয়েছে। শনিবার বাদ আসর এজতেমা মাঠের মূল মঞ্চে যৌতুকবিহীন গণবিয়ে অনুষ্ঠিত হবে।
জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল বিভাগ গাজীপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী ফরহাদ হোসেন জানান, এজতেমায় আগত মুসলিস্ন-দের সুবিধার্থে ১২টি গভীর নলকূপ থেকে প্রতিদিন প্রায় ৬০ লাখ গ্যালন পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া সরকারীভাবে ৭টি দ্বিতল, একটি তিনতলা আধুনিক স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট নির্মাণ, সড়ক প্রশসত্মকরণ ও সংস্কার এবং সাত হাজার কাঁচা ও সেমিপাকা টয়লেট তৈরি করা হয়েছে। মাঠের চারপাশে ওজু ও গোসলের জন্য ১২টি চৌবাচ্চা তৈরি করা হয়েছে।
তাবলিগ জামাত সূত্র জানায়, তাবলিগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরবি্বদের কেউ কেউ বেশি বয়স্ক হওয়ায় তাঁদের অনেকেই দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তাঁরা হুইল চেয়ার দিয়ে মূল মঞ্চে ওঠার জন্য তৈরি করা হয়েছে রেম সিঁড়ি। রেম সিঁড়ি তৈরি করেছেন এমন ক'জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা রেম সিঁড়ি তৈরি করছেন তিন বছর ধরে। এর আগে রেম সিঁড়ির দরকার হয়নি।
বিশ্ব এজতেমায় যাতায়াতের জন্য রেলওয়ে বিশেষ ট্রেন, বিআরটিসি কতর্ৃপ বিশেষ বাস সার্ভিস এবং বিভিন্ন বেসরকারী বাস কোম্পানি বিশেষ সার্ভিস চালু করবে। নৌপথেও মুসলিস্নদের নির্বিঘ্নে যাতায়াতের জন্য বিশেষ লঞ্চ ও নৌকা চলাচল করবে।
রাষ্ট্রপতির বাণী
রাষ্ট্রপতি তাঁর বাণীতে বলেন, ইসলামের সুমহান আদর্শ, মানবজাতির কল্যাণ ও শানত্মি প্রতিষ্ঠার উপায়। মুসলিম উম্মাহ্র সকল সদস্যদের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামের শিৰা সম্প্রসারণে বিশ্ব এজতেমা গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এ সম্মেলনের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের সংহতি সুদৃঢ় হবে।
প্রধানমন্ত্রীর বাণী
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাণীতে বলেন, বিশ্বে এজতেমা ইসলামের সর্বজনীন শানত্মি, সহমর্মিতা ও উদারতার মর্মবাণী প্রচার ও প্রসারে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। এই ধর্মীয় সমাবেশ দেশ ও বিশ্বের সর্বসত্মরের মানুষ ও মুসলিম উম্মার ঐক্য সংহতি ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করবে। এজতেমায় আগত বিদেশী মেহমানদের মাধ্যমে আবহমানকাল ধরে আমাদের লালিত অসাম্প্রদায়িক চেতনা অকৃত্রিম সরলতা ও সহিষ্ণুতার আলোকবার্তা বিশ্ব দরবারে পেঁৗছে যাবে।
No comments