চলে গেলেন নাট্যকার সাঈদ আহমদ
আনত্মর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নাট্যকার সাঈদ আহমদ আর নেই। বৃহস্পতিবার ভোর ৫টা ৩০ মিনিটে রাজধানীর ল্যাব এইড হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিলস্নাহি...রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।
নিঃসনত্মান এই নাট্যব্যক্তিত্ব স্ত্রী, আত্মীয়স্বজন, গুণগ্রাহী ও অসংখ্য নাট্যশিষ্য রেখে গেছেন। তাঁর মৃতু্যর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই নাট্যাঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। অনেকেই ছুটে যান হাসপাতালে। নাট্যাঙ্গনের শিল্পী-কলাকুশলীসহ সর্বসত্মরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য দুপুর ২টায় তাঁর লাশ আনা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে শেষবারের মতো তাকে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সকলে। এ সময় উপস্থিত সকলের চোখেমুখে ছিল বেদনার ছায়া। প্রিয়জন হারানোর শোক সামলাতে না পেরে অনেকের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রম্নধারা। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তাঁকে আজিমপুর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। আগামী রবিবার মরহুমের লালমাটিয়া বাসায় কুলখানি অনুষ্ঠিত হবে। তাঁর মৃতু্যতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা শোক প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর শোকবার্তায় জানান, সাঈদ আহমদ বাংলা নাটকের বিকাশে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। তাঁর মৃতু্যতে নাট্যজগতের যে ৰতি হলো তা সহজে পূরণ হবার নয়।সাঈদ আহমদ বেশ কিছুদিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। গত বছর ২৩ জুলাই হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে ল্যাব এইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে নানান পরীৰা-নিরীৰার পর ইকোকার্ডিওগ্রাম করা হয়। তাতে তাঁর হার্টের করোনারি ধমনীতে রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ধরা পড়ে। যাতে তাঁর শ্বাসকষ্টে সমস্যা দেখা দেয়। হার্ট ঠিকমতো পাম্পিং না করার কারণে তাঁকে দশ দিন ল্যাব এইডের আইসিইউতে রাখা হয়। শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে সে সময় তিনি বাসায় ফিরে যান। কয়েক মাস পর আবারও অসুস্থ হলে গত ৩১ ডিসেম্বর হাসপাতালে ভর্তি হন। মৃতু্যর আগ পর্যনত্ম সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন।
সাঈদ আহমদের জন্ম ঢাকায়, ১৯৩১ সালের ১ জানুয়ারি। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনত্মর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন তিনি। এরপর ১৯৫৬ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েট সম্পন্ন করেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব ছিলেন। ঢাকা বিশবিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের শিৰকও ছিলেন। শিৰা জীবন চলাকালীন (১৯৫৪-১৯৫৬) তিনি বিবিসিতে কাজ করেছেন। এ ছাড়া ব্রাজিল, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, হল্যান্ড, হংকং, ভারত, জাপান, মালয়েশিয়া, মরক্কো, নরওয়ে, থাইল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও থিয়েটার একাডেমীতে তিনি পড়িয়েছেন। তাঁর উলেস্ন-খযোগ্য নাট্যগ্রন্থ হচ্ছে প্রতিদিন একদিন, কালবেলা, মাইলপোস্ট, তৃষ্ণায়, শেষ নবাব। উলেস্নখযোগ্য প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে দ্য থিং মাইল পোস্ট, সারভাইবাল, আর্ট ইন বাংলাদেশ, ফাইভ পেইন্টার অব বাংলাদেশ, কনটেম্পোরারি আর্ট, কনটেম্পোরারি গ্রাফিক আর্টস অব বাংলাদেশ। প্রকৃতির শক্তির বিরম্নদ্ধে মানুষ কিভাবে লড়াই করে টিকে থাকে_তা তাঁর লেখায় স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। তাঁর নাটক ইংরেজী, ফারসী, জার্মান ও ইতালিয়ান ভাষাতে অনূদিত হয়েছে।
দুপুরে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, শিল্পী কাইয়ূম চৌধুরী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আতিকুল হক চৌধুরী, শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক কামাল লোহানী, সৈয়দ হাসান ইমাম, রামেন্দু মজুমদার, আতাউর রহমান, মামুনুর রশীদ, লিয়াকত আলী লাকী, ঝুনা চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক প্রমুখ। এ ছাড়া পররাষ্ট্র সচিব মিজারম্নল কায়েম ও সংস্কৃতি সচিব হেদায়েত উলস্নাহ মামুনও উপস্থিত ছিলেন। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার পৰ থেকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের। এ সময় তিনি বলেন, সাঈদ আহমদের মতো বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে হারিয়ে আমরা শোকাহত। তাঁর বিদেহী আত্মার শানত্মি কামনা করছি। সৈয়দ শামসুল হক বলেন, সাঈদ আহমদ দেশের বিমূর্ত নাট্যচর্চায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতো মানুষের মৃতু্যর সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর আলোও যেন কমে আসছে। ক্রমে সব কিছু হয়ে উঠছে অন্ধকারাচ্ছন্ন। অর্ধশিৰিত মানুষের হাতে পড়ে আমাদের সংস্কৃতি কলুষিত হচ্ছে। কিন্তু এটা হতে দেয়া যায় না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে স্মরণ করে তিনি সবাইকে আলোর দিকে ফিরে আসার আহ্বান জানান। কামাল লোহানী বলেন, সাঈদ আহমদ ছিলেন বিশ্ব সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, এর সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতিকেও যুক্ত করেছেন। দেশের নাট্যচর্চায় নতুন ধারা তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর মৃতু্যতে আমরা আমাদের সংস্কৃতির একজন সত্যিকারের অভিভাবক হারালাম। সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, সাঈদ আহমদের কালবেলা, মাইলপোস্ট নাটকগুলো এদেশের ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে থাকবে। বিশ্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর যে অগাধ পা-িত্য, তা দিয়ে তিনি আমাদের নাট্যাঙ্গন তথা সমগ্র সংস্কৃতি অঙ্গনকে আলোকিত করে গেছেন। মফিদুল হক বলেন, অসাধারণ এক মানুষ ছিলেন সাঈদ আহমদ। পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন তিনি। মামুনুর রশীদ বলেন, আধুনিক নাটক তাঁর ছোঁয়ায় যতটা সমৃদ্ধ হয়েছে, তা সহজে ভোলার নয়। অভিভাবকের মতো তিনি আমাদের নাট্যাঙ্গনকে এতদিন পাহারা দিয়েছেন। শহীদ মিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগ, শিল্পকলা একাডেমী, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, জাতীয় কবিতা পরিষদ, নজরম্নল ইনস্টিটিউট, পদাতিক নাট্য সংসদসহ অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠন ফুল নিয়ে সাঈদ আহমদকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসে।
এই গুণী নাট্যব্যক্তিত্ব ১৯৭৫ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৭৬ সালে সুফি মোতাহার হোসেন পুরস্কার ও ১৯৯৩ সালে ফ্রেঞ্চ লিজিয়োঁ দ্য অনার পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া মুনীর চৌধুরী পুরস্কারও পান তিনি। সাঈদ আহমদের বড় ভাই নাজির আহমদ বিবিসির প্রথম বাঙালী কর্মকর্তা। তাঁর আরেক বড় ভাই হামিদুর রহমান জাতীয় শহীদ মিনারের রূপকার।
শোক প্রকাশ
আনত্মর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নাট্যকার, গবেষক ও সাবেক সচিব সাঈদ আহমদের মৃতু্যতে পৃথকভাবে আরও শোক প্রকাশ করেন তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট প্রমোদ মানকিন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। এ ছাড়া বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলা একাডেমী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, শেফা-উল-মূলক হাকীম হাবিব-উর-রহমান ফাউন্ডেশন ও ঈশ্বরগঞ্জ আজিজুর রহমান স্মৃতি নাট্য সংসদ।
No comments