সুভাষ দত্তের চলে যাওয়া by মমতাজউদদীন আহমদ
কিছুদিন আগে সুভাষদাও চলে গেলেন। বড় সাধ ছিল তাঁকে ডিঙিয়ে আগে চলে যাব। সুভাষদা সুযোগটা দিলেন না। স্কয়ারের পুরস্কার নিতে যখন হাজির হলাম, তখন কাঁটায় কাঁটায় ৪টা। প্রেসক্লাবের দোতলায় মঞ্চ। আগে এসে গেছেন সুভাষ দত্ত। পাশে আমার জন্য চেয়ার খালি।
বললেন, আপনার জন্য রেখে দিয়েছি। সুভাষ দত্ত আর আমাকে আজীবন কর্মযোগ্যতার জন্য স্কয়ার এক লাখ করে টাকা দিচ্ছে। সঙ্গে ক্রেস্ট ও সার্টিফিকেট তো আছেই।
সুভাষ দত্তের কৃতিত্ব চলচ্চিত্র, আমার কাজ নাটক। পুরস্কার নিয়ে সুভাষ দত্ত বললেন, আমার স্নেহভাজন ভাইটিকে পুরস্কার দিয়ে ভালো কাজ হয়েছে। সুভাষ দত্তের কথা শুনে আমি ফুলেফেঁপে গেলাম।
আমার বেলা এলে বললাম, সুভাষ দত্তকে কোনোভাবে হারাতে পারব না। তবে লম্বায় আমি দীর্ঘ, ওখানেই তাঁর হার। সুভাষদা মৃদুকণ্ঠে প্রতিবাদের মতো বললেন, আমি যে বয়সে দীর্ঘ, সেটা তো কম নয়। বললাম, কেবল বয়সে নয়, মেধা ও গুণে আপনি সেরা। সিনেমার পরেই প্রয়োগ শিল্পে নাটক আসে বলে, তাঁরা বাধ্য হয়ে আমার নাম পুরস্কারে আপনার পাশে জুড়ে দিয়েছে। আমার লাভ হলো এক লাখ টাকা। তবে আজ শেষ কথাটা তাদের সামনে বলে যাই, এখন মরণে আপনাকে আমি ডিঙিয়ে যাব। সুভাষদা সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, আমি প্রাণমন ভরে আশীর্বাদ করছি, যেন আপনার হার হয়।
সত্যি আমি হেরে গেলাম। ১৭ নভেম্বর সুভাষদা চলে গেলেন। সাধুসন্তের জীবন তাঁর। তাত্তি্বক জীবনযাপন করতেন। খুব সামান্য তাঁর খাদ্য। ভেজিটেবল আর ফলমূল। বাসা থেকে কৌটোয় করে আনতেন। আমরা বসে বসে কোর্মাপোলাও খাচ্ছি, সুভাষদা এককোণে গিয়ে চুপিসারে তাঁর খাদ্য খাচ্ছেন। বড় মায়া হতো। যে লোকটা এত এত ভালো কাজ করলেন, এত এত নির্মল স্বচ্ছ ছবি বানালেন, সেই লোক এত সামান্য খেয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। লোকটা খুব কঞ্জুস নাকি।
সুভাষ দত্ত, ছবি করার জন্য আমার গল্প কিনলেন। সব টাকা তৎক্ষণাৎ পরিশোধ করে বললেন, ওজর করবেন না। যারা টাকা দিয়ে ছবি বানায়, তারা লেখকের আর নির্মাতার টাকা দিতে বড় গড়িমসি করে। যা পান, নগদ নিয়ে নেন। তবে আপনার কাহিনীর সারটুকু নেব কিন্তু তার ওপর মেলা দলাইমলাই হবে। আপত্তি আছে নাকি? বললাম, আপনার নির্মাণগুণের ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস। তবে একটা আশঙ্কা, কাহিনীকার হিসেবে আমার নামটা অক্ষুণ্ন থাকবে তো।
সুভাষ দত্ত বললেন, সন্দেহ জেগেছে কেন? বললাম, চিত্রনাট্য কাহিনী আমার কিন্তু টেলআপে আমার নাম খুঁজে পাইনি, এমন ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে।
সুভাষ দত্ত বললেন, আপনাকে না দেখিয়ে আমি টেলআপ ফাইনাল করব না।
হোটেল পূর্বাণীতে পরের সিটিং হলো। সুভাষ দত্ত আমার জন্য উপাদেয় খাদ্যের অর্ডার দিলেন, নিজের জন্য খুললেন কৌটা। গল্পের বিস্তারের জন্য কাহিনীর মধ্যে দুইটা উপকাহিনীর সংযোজন পরিকল্পনা দিলেন। ছায়াছবির জন্য এমন উপকাহিনীর বড় প্রয়োজন। সুভাষ দত্ত বললেন, যদি পছন্দ হয়, কাহিনী দুটি সংযোগ করে স্ক্রিপ্টটা চূড়ান্ত করে দিন। আর যদি ভালো না লাগে, ছেড়ে দিন, আমিই বানিয়ে নেব।
আমার বিপরীত স্রোত টেলিভিশন নাটক দেখে সুভাষ দত্ত কাহিনীর জন্য নাটকটির স্বত্ব কিনে নিয়েছিলেন। সুভাষ দত্তের সঙ্গে ফিল্ম সেন্সর বোর্ডে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। সেন্সর বোর্ডে প্রথম দিন গিয়ে ভড়কে গেলাম। ছবির প্রযোজকরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। সহাস্যে বিনয়ের সঙ্গে হাত মেলালেন, দেখবেন স্যার বলে সম্ভাষণ করলেন। একসঙ্গে বসে আমি আর সুভাষ দত্ত ছবি দেখলাম। বিবেচনার জন্য বৈঠক, মতামত নেওয়া হচ্ছে। আমার তো অন্য রকম মেজাজ। বললাম, এ কেমন ছবি! মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। এমন অদ্ভুত সিনেমা কে বানায়? সুভাষ দত্ত বললেন, এমনিই সব দেখে যেতে হবে, যখন সেন্সর বোর্ডের সদস্য হয়েছেন।
সেদিনের পরে সেন্সর বোর্ডে আর যাইনি। আগের দিন শিঙ্গাড়া, মিষ্টি আর কলা খেয়েছি। আর সেসব খাবার শখ হয়নি।
সুভাষ দত্ত, আলমগীর কবির আর জহির রায়হানদের ছবি দেখেছি। যতই দেখেছি, বিহ্বল হয়েছি। নির্মাতার কৌশল, গল্প বলার শিল্প ও অভিনয় টেনে আনার সৌকর্য দেখে আনন্দ পেয়েছি। সুভাষ দত্তের যে কয়টি ছবি দেখলাম, সবই অন্য রকম। ভিন্ন রুচির ব্যাপার। 'বসুন্ধরা', 'আলিঙ্গন', 'কাগজের নৌকা', 'অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী' ছবিগুলো এখনো চোখে লেগে আছে। শিল্পের জন্য শ্রদ্ধা না থাকলে, বিষয়ের নির্বাচনে তীক্ষ্নতা না থাকলে তেমন ছবি করা যায় না। আলাউদ্দিন আল আজাদের তেইশ নম্বর তৈলচিত্র উপন্যাসের কাহিনীর গভীরতায় না পৌঁছলে 'বসুন্ধরা' নির্মাণ করা যায় না। আয়না ও অবশিষ্ট দুই খাতের ভিন্ন কাহিনীকে একই সূত্রে বেঁধে রাখার শক্ত কাজটি সহজে করে দিয়েছেন সুভাষ দত্ত।
নিজে অভিনয়শিল্পী ছিলেন, তাই তাঁর ছবির কুশীলবরা অভিনয়ে অমনোযোগী থাকতে পারেনি। সত্যজিৎ রায়ের মতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কাজ আদায় করে ছেড়েছেন। সুভাষ দত্ত বাংলাদেশের সিনেমাকে অল্পদিনের মধ্যে যৌবন শক্তিতে উদ্ভাসিত করেছেন। সুতরাং এর মতো এমন প্রাণময় উজ্জ্বল প্রেমকাহিনী তিনি কোথা থেকে সংগ্রহ করলেন, তাই যখন ভাবি তখন বিস্ময় জাগে।
সুভাষ দত্তের সঙ্গে একসঙ্গে একটানা এক মাস একই কক্ষে বসে গুনাগুনতি ৮০টি বাংলাদেশের ছায়াছবি দেখেছি। জাতীয় পুরস্কারের জন্য তিন বছর ধরে জমে থাকা ছবি দেখতে হয়েছে। আমার আর সুভাষ দত্তের মতের অমিল খুব বেশি হয়নি, যখন ছবি শেষে নম্বর ছকে নম্বর দিলাম, দু-একটি ক্ষেত্রে আমার কড়াকড়ি চিন্তাকে নম্র করার জন্য সুভাষদা তাঁর শান্ত ধারণাকে প্রয়োগ করেছেন। কথা খুব বেশি বলতেন না। তবে দু-একটা যা বলতেন, তাই বড় হয়ে উঠত আমাদের কাছে। সুভাষ দত্ত বয়সে, গুণে ও অভিজ্ঞতায় আমাদের শ্রদ্ধেয়। সেই শ্রদ্ধেয়র আসন থেকে মতামতের সংযত বিশ্বাস দিয়েই আমাদের সবাইকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতেন।
সুভাষ দত্ত আরো কাজ করতে চাইতেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ছবি করার। কিন্তু বয়সের ভারে আর বেদনার ঘায়ে দুর্বল ছিলেন বলে আর একবার এফডিসি চত্বরে যেতে সাহস করেননি।
সিনেমার এখনকার বাণিজ্যিক রুচির মহারোগের মধ্যে গা ছেড়ে দিলে সুভাষ দত্তকে বড় কষ্ট পেয়ে মরতে হতো।
এ ভালোই হলো। ঘুমের মধ্যে নীরবে চলে গেলেন ৮২ বছর বয়সে। এমনি ঘুমের মধ্যে ৮৮ বছর বয়সে চলে গেছেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নট ও নির্মাতা চার্লি চ্যাপলিন।
আমাকে একটা দুঃখ দিয়েই গেলেন সুভাষদা। বড় আশা ছিল মরণের ব্যাপারে তাঁকে টপকে আগে চলে যাব। তা যেতে দিলেন কই সাধু সুভাষ দত্ত। বাংলার শুদ্ধ ছবির নির্মাতা সর্ববিষয়ে জ্যেষ্ঠতা ধরে রাখার কৌশল জানতেন।
বাংলাদেশের ছায়াছবি তাঁর অভাবে শেষ হয়ে গেল, তেমন কথা একবারও বলব না। ছবি হবেই, নতুন ছবি। কিন্তু 'পথের পাঁচালী' যেমন আর হবে না, তেমনি 'সুতরাং' আর কেউ বানাবে না। 'আলিঙ্গন' ছবির গানটি আজ কানে বাজে, 'দিগন্ত ছাড়িয়ে দু'হাত বাড়িয়ে ডেকে নিতে চায় কে যেন আমায়'- তেমন আহ্বানেই সুভাষ দত্ত চলে গেলেন অনন্তলোকে। সেখানে কোনো একটি ছবির জন্য সুভাষ দত্ত রং-তুলি নিয়ে বসবেন, তা তাঁর প্রিয় বিধাতা জানে। খালি আমার বুকে বাজে সুভাষদা বারবার আমাকে হার মানতে বাধ্য করলেন। যদি তাঁর মতো ঘুমের মধ্যেই নীরবে চলে যেতে পারি- আনন্দের পরিসীমা থাকবে না।
লেখক : নাট্যকার, অভিনেতা
সুভাষ দত্তের কৃতিত্ব চলচ্চিত্র, আমার কাজ নাটক। পুরস্কার নিয়ে সুভাষ দত্ত বললেন, আমার স্নেহভাজন ভাইটিকে পুরস্কার দিয়ে ভালো কাজ হয়েছে। সুভাষ দত্তের কথা শুনে আমি ফুলেফেঁপে গেলাম।
আমার বেলা এলে বললাম, সুভাষ দত্তকে কোনোভাবে হারাতে পারব না। তবে লম্বায় আমি দীর্ঘ, ওখানেই তাঁর হার। সুভাষদা মৃদুকণ্ঠে প্রতিবাদের মতো বললেন, আমি যে বয়সে দীর্ঘ, সেটা তো কম নয়। বললাম, কেবল বয়সে নয়, মেধা ও গুণে আপনি সেরা। সিনেমার পরেই প্রয়োগ শিল্পে নাটক আসে বলে, তাঁরা বাধ্য হয়ে আমার নাম পুরস্কারে আপনার পাশে জুড়ে দিয়েছে। আমার লাভ হলো এক লাখ টাকা। তবে আজ শেষ কথাটা তাদের সামনে বলে যাই, এখন মরণে আপনাকে আমি ডিঙিয়ে যাব। সুভাষদা সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, আমি প্রাণমন ভরে আশীর্বাদ করছি, যেন আপনার হার হয়।
সত্যি আমি হেরে গেলাম। ১৭ নভেম্বর সুভাষদা চলে গেলেন। সাধুসন্তের জীবন তাঁর। তাত্তি্বক জীবনযাপন করতেন। খুব সামান্য তাঁর খাদ্য। ভেজিটেবল আর ফলমূল। বাসা থেকে কৌটোয় করে আনতেন। আমরা বসে বসে কোর্মাপোলাও খাচ্ছি, সুভাষদা এককোণে গিয়ে চুপিসারে তাঁর খাদ্য খাচ্ছেন। বড় মায়া হতো। যে লোকটা এত এত ভালো কাজ করলেন, এত এত নির্মল স্বচ্ছ ছবি বানালেন, সেই লোক এত সামান্য খেয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। লোকটা খুব কঞ্জুস নাকি।
সুভাষ দত্ত, ছবি করার জন্য আমার গল্প কিনলেন। সব টাকা তৎক্ষণাৎ পরিশোধ করে বললেন, ওজর করবেন না। যারা টাকা দিয়ে ছবি বানায়, তারা লেখকের আর নির্মাতার টাকা দিতে বড় গড়িমসি করে। যা পান, নগদ নিয়ে নেন। তবে আপনার কাহিনীর সারটুকু নেব কিন্তু তার ওপর মেলা দলাইমলাই হবে। আপত্তি আছে নাকি? বললাম, আপনার নির্মাণগুণের ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস। তবে একটা আশঙ্কা, কাহিনীকার হিসেবে আমার নামটা অক্ষুণ্ন থাকবে তো।
সুভাষ দত্ত বললেন, সন্দেহ জেগেছে কেন? বললাম, চিত্রনাট্য কাহিনী আমার কিন্তু টেলআপে আমার নাম খুঁজে পাইনি, এমন ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে।
সুভাষ দত্ত বললেন, আপনাকে না দেখিয়ে আমি টেলআপ ফাইনাল করব না।
হোটেল পূর্বাণীতে পরের সিটিং হলো। সুভাষ দত্ত আমার জন্য উপাদেয় খাদ্যের অর্ডার দিলেন, নিজের জন্য খুললেন কৌটা। গল্পের বিস্তারের জন্য কাহিনীর মধ্যে দুইটা উপকাহিনীর সংযোজন পরিকল্পনা দিলেন। ছায়াছবির জন্য এমন উপকাহিনীর বড় প্রয়োজন। সুভাষ দত্ত বললেন, যদি পছন্দ হয়, কাহিনী দুটি সংযোগ করে স্ক্রিপ্টটা চূড়ান্ত করে দিন। আর যদি ভালো না লাগে, ছেড়ে দিন, আমিই বানিয়ে নেব।
আমার বিপরীত স্রোত টেলিভিশন নাটক দেখে সুভাষ দত্ত কাহিনীর জন্য নাটকটির স্বত্ব কিনে নিয়েছিলেন। সুভাষ দত্তের সঙ্গে ফিল্ম সেন্সর বোর্ডে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। সেন্সর বোর্ডে প্রথম দিন গিয়ে ভড়কে গেলাম। ছবির প্রযোজকরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। সহাস্যে বিনয়ের সঙ্গে হাত মেলালেন, দেখবেন স্যার বলে সম্ভাষণ করলেন। একসঙ্গে বসে আমি আর সুভাষ দত্ত ছবি দেখলাম। বিবেচনার জন্য বৈঠক, মতামত নেওয়া হচ্ছে। আমার তো অন্য রকম মেজাজ। বললাম, এ কেমন ছবি! মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। এমন অদ্ভুত সিনেমা কে বানায়? সুভাষ দত্ত বললেন, এমনিই সব দেখে যেতে হবে, যখন সেন্সর বোর্ডের সদস্য হয়েছেন।
সেদিনের পরে সেন্সর বোর্ডে আর যাইনি। আগের দিন শিঙ্গাড়া, মিষ্টি আর কলা খেয়েছি। আর সেসব খাবার শখ হয়নি।
সুভাষ দত্ত, আলমগীর কবির আর জহির রায়হানদের ছবি দেখেছি। যতই দেখেছি, বিহ্বল হয়েছি। নির্মাতার কৌশল, গল্প বলার শিল্প ও অভিনয় টেনে আনার সৌকর্য দেখে আনন্দ পেয়েছি। সুভাষ দত্তের যে কয়টি ছবি দেখলাম, সবই অন্য রকম। ভিন্ন রুচির ব্যাপার। 'বসুন্ধরা', 'আলিঙ্গন', 'কাগজের নৌকা', 'অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী' ছবিগুলো এখনো চোখে লেগে আছে। শিল্পের জন্য শ্রদ্ধা না থাকলে, বিষয়ের নির্বাচনে তীক্ষ্নতা না থাকলে তেমন ছবি করা যায় না। আলাউদ্দিন আল আজাদের তেইশ নম্বর তৈলচিত্র উপন্যাসের কাহিনীর গভীরতায় না পৌঁছলে 'বসুন্ধরা' নির্মাণ করা যায় না। আয়না ও অবশিষ্ট দুই খাতের ভিন্ন কাহিনীকে একই সূত্রে বেঁধে রাখার শক্ত কাজটি সহজে করে দিয়েছেন সুভাষ দত্ত।
নিজে অভিনয়শিল্পী ছিলেন, তাই তাঁর ছবির কুশীলবরা অভিনয়ে অমনোযোগী থাকতে পারেনি। সত্যজিৎ রায়ের মতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কাজ আদায় করে ছেড়েছেন। সুভাষ দত্ত বাংলাদেশের সিনেমাকে অল্পদিনের মধ্যে যৌবন শক্তিতে উদ্ভাসিত করেছেন। সুতরাং এর মতো এমন প্রাণময় উজ্জ্বল প্রেমকাহিনী তিনি কোথা থেকে সংগ্রহ করলেন, তাই যখন ভাবি তখন বিস্ময় জাগে।
সুভাষ দত্তের সঙ্গে একসঙ্গে একটানা এক মাস একই কক্ষে বসে গুনাগুনতি ৮০টি বাংলাদেশের ছায়াছবি দেখেছি। জাতীয় পুরস্কারের জন্য তিন বছর ধরে জমে থাকা ছবি দেখতে হয়েছে। আমার আর সুভাষ দত্তের মতের অমিল খুব বেশি হয়নি, যখন ছবি শেষে নম্বর ছকে নম্বর দিলাম, দু-একটি ক্ষেত্রে আমার কড়াকড়ি চিন্তাকে নম্র করার জন্য সুভাষদা তাঁর শান্ত ধারণাকে প্রয়োগ করেছেন। কথা খুব বেশি বলতেন না। তবে দু-একটা যা বলতেন, তাই বড় হয়ে উঠত আমাদের কাছে। সুভাষ দত্ত বয়সে, গুণে ও অভিজ্ঞতায় আমাদের শ্রদ্ধেয়। সেই শ্রদ্ধেয়র আসন থেকে মতামতের সংযত বিশ্বাস দিয়েই আমাদের সবাইকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতেন।
সুভাষ দত্ত আরো কাজ করতে চাইতেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ছবি করার। কিন্তু বয়সের ভারে আর বেদনার ঘায়ে দুর্বল ছিলেন বলে আর একবার এফডিসি চত্বরে যেতে সাহস করেননি।
সিনেমার এখনকার বাণিজ্যিক রুচির মহারোগের মধ্যে গা ছেড়ে দিলে সুভাষ দত্তকে বড় কষ্ট পেয়ে মরতে হতো।
এ ভালোই হলো। ঘুমের মধ্যে নীরবে চলে গেলেন ৮২ বছর বয়সে। এমনি ঘুমের মধ্যে ৮৮ বছর বয়সে চলে গেছেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নট ও নির্মাতা চার্লি চ্যাপলিন।
আমাকে একটা দুঃখ দিয়েই গেলেন সুভাষদা। বড় আশা ছিল মরণের ব্যাপারে তাঁকে টপকে আগে চলে যাব। তা যেতে দিলেন কই সাধু সুভাষ দত্ত। বাংলার শুদ্ধ ছবির নির্মাতা সর্ববিষয়ে জ্যেষ্ঠতা ধরে রাখার কৌশল জানতেন।
বাংলাদেশের ছায়াছবি তাঁর অভাবে শেষ হয়ে গেল, তেমন কথা একবারও বলব না। ছবি হবেই, নতুন ছবি। কিন্তু 'পথের পাঁচালী' যেমন আর হবে না, তেমনি 'সুতরাং' আর কেউ বানাবে না। 'আলিঙ্গন' ছবির গানটি আজ কানে বাজে, 'দিগন্ত ছাড়িয়ে দু'হাত বাড়িয়ে ডেকে নিতে চায় কে যেন আমায়'- তেমন আহ্বানেই সুভাষ দত্ত চলে গেলেন অনন্তলোকে। সেখানে কোনো একটি ছবির জন্য সুভাষ দত্ত রং-তুলি নিয়ে বসবেন, তা তাঁর প্রিয় বিধাতা জানে। খালি আমার বুকে বাজে সুভাষদা বারবার আমাকে হার মানতে বাধ্য করলেন। যদি তাঁর মতো ঘুমের মধ্যেই নীরবে চলে যেতে পারি- আনন্দের পরিসীমা থাকবে না।
লেখক : নাট্যকার, অভিনেতা
No comments