সময়ের প্রতিবিম্ব-অসাম্প্রদায়িক সরকারের ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রনীতি by এবিএম মূসা
বিরোধীদলীয় জোট ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছিল। তার পরই ইসলামি নামধারী—প্রচলিত ইসলামপন্থী বলব না—৩০ ঘণ্টার হরতাল ‘পালন’ করল অথবা করাল। উভয়েই সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে, টেলিভিশনে খবর প্রচার করে গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের কল্যাণে একটি কর্মসূচি পালন করেছে।
সরকার বলছে, জনগণ হরতাল প্রত্যাখ্যান করেছে, পালনকারীরা বলছেন সফল হয়েছে।
আমার একজন পাঠক হরতাল প্রত্যাখ্যান আর সফলতার দাবির সত্যতা জানতে চাননি। তিনি শুধু জানতে চেয়েছেন, কার হরতাল কে করেছে? পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাহাত্তরে ফিরে যাওয়ার দোহাই দিয়ে কতিপয় ধারা সন্নিবেশিত বা বিলুপ্ত করা হলো। তার আগে আদালত পঞ্চম সংশোধনী পুরোপুরি না করে দায়সারাভাবে বাতিল করে কাদের খুশি করল। অপরদিকে ইসলামের জন্য মাতমকারীদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ২-ক অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল শুধু নয়, ৭-ক যোগ করে খামিরা করা হলো। এই বিধান অমান্য করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলা হলো। তাহলে দুটি হরতালের মাজেজা কী, এ যে উল্টো বুঝলি রাম! হরতাল তো করার কথা তাদের, যারা বাহাত্তরের সংবিধানের গণতান্ত্রিক বিধান বহাল রাখতে চায়, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তাদের।
এবার বিস্তারিত আলোচনায় যাব। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল নিয়ে বিরোধী দলের হরতালের যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছি না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে তো জরুরি অবস্থা আসবে হয়তো অথবা ১/১১-পরবর্তী আধা সামরিক শাসন জারি হবে। সেই সরকারের অধীনে নির্বাচন মেনে নিয়ে পরাজিত হলে সংসদ বর্জন অথবা ‘মানি না, মানি না’ বলে গাড়ি ভাঙচুর করা হবে। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হওয়ায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সমানে সমানে লড়াই হবে। এক দল ১০টি ব্যালট বাক্স ছিনতাই করলে অপর দল ২০টি পুড়িয়ে দিতে পারবে। পাল্টাপাল্টি ভোটকেন্দ্র দখল করে অবাধে সিল মারতে পারবে। জিজ্ঞেস করতে পারেন, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কী করবে? তারা হাওয়া বোঝার চেষ্টা করবে, হাঙ্গামা বাধলে আকাশের দিকে গুলি করবে নাকি সম্ভাব্য বিজয়ী দলের শক্তি বৃদ্ধি করবে—সেই বিভ্রান্তি কাটাতে মগ্ন থাকবে? এদিকে যা হওয়ার হয়ে যাবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল নিয়ে একজন চিন্তাশীল বাস্তববাদী পাঠকের এই পর্যালোচনার পর এ নিয়ে বিরোধী দলের সাংবিধানিক কোনো বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার কারণ খুঁজে পেলাম না। বরং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে উপদেশ দেব, সমভাবে কুরুক্ষেত্রের জন্য তৈরি হোন। হোন্ডা জোগাড় করুন, গুন্ডাদের প্রশিক্ষণ দিন। বিরোধী দলকে বলব, ফারুকদের এখনই শহীদ হওয়ার প্রয়োজন নেই, অপেক্ষা করুন এবং আড়াই বছর পরে মহারণের জন্য প্রস্তুতি নিন।
এবার আসি ধর্মীয় লেবাস আর নামধারীদের ছোটখাটো হরতাল নিয়ে আলোচনায়। এই উপমহাদেশ বিভক্ত হয়েছিল ধর্মাশ্রয়ী অথবা ধর্মের জিকির আর ধর্মীয় উন্মাদনার রাজনীতির বিস্তারের কারণে। সেই উন্মাদনা স্তিমিত শুধু নয়, বিস্তার রোধে আওয়ামী মুসলিম লীগের অভ্যুদয় ঘটল। আজ ৬২ বছর পরে ভাবতে বসেছি, সেই আওয়ামী লীগ কোথায়? আওয়ামী মোসলেম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ ছাঁটাই হলো। তারপর সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন, স্বৈরতন্ত্রের অবসানে গণতন্ত্রের জন্য সশস্ত্র লড়াই। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের অর্জিত অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রটির গায়ে মুসলিম পরিচয় সেঁটে দিয়েছিলেন জিয়া-এরশাদ। আওয়ামী-প্রভাবিত সরকার ক্ষমতায় ফিরে এসে এবার সেটিতে ফেলিকন গ্লু লাগিয়ে দিল। ভাগ্যের কী পরিহাস, পূর্ব বাংলার মুসলমানদের গোঁড়া ধর্মীয় চেতনা থেকে অসাম্প্রদায়িক কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ জাতিতে রূপান্তর ঘটিয়েছিল আওয়ামী লীগ। সেই দল কি ভূতের উল্টো পায়ে চলছে?
আরও বিশদ ব্যাখ্যা করি, সংবিধানে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ স্বীকৃতি বহাল রেখেছে আওয়ামী সরকার। আবার দাবি করছে, পুরোনো সেই তত্ত্ব ও আদর্শের খোলস বহাল রেখে ধর্মনিরপেক্ষতায় আস্থাও বিসর্জন দেয়নি। অদ্ভুত এই গোঁজামিল যাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত, তাঁর ধীশক্তির প্রশংসা করছি। পাকিস্তানের আদি যুগে আওয়ামী লীগ বাংলার মুসলমানদের বলেছিল, ইসলাম ধর্ম একটি ধর্মীয় বিশ্বাস, রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। এখন বলছে, এটি রাষ্ট্রীয় বিধান।
বাহাত্তরের সংবিধানে অনুচ্ছেদ ১২ যখন সংবিধিবদ্ধ করা হয়, তখন ইনটেনশন বা উদ্দেশ্য তথা স্পিরিট কী ছিল? ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা বিলোপ করা হইবে, ব্যাখ্যাটি আমার মতে সঠিক নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মের কারণে বৈষম্য করা যাবে না। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম মানে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে ইসলাম মানতে বাধ্য করা, একটি ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগ (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান। এখন তো এক ডিগ্রি বাড়িয়ে ২-ক পরিচ্ছেদে একেবারে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার। বাংলায় বলা হয়েছে, এসবই পরিত্যাজ্য, ইংরেজিতে ‘সিকিউলারিজম শ্যাল বি রিয়েলাইজড বাই এলিমিনেশন’ অর্থাৎ বিলুপ্তি ঘটিয়ে। তাহলে ২-ক পরিচ্ছেদে এরশাদের সংযোজিত ‘তবে’ অন্যান্য ধর্মও শান্তিতে পালন করা যাবে, এই ‘তবে’ মানে কী?
ইংরেজি অনুবাদ বাট কি যথার্থ? কেউ যদি বলেন, ‘বাট’ মানে ‘হাউএভার’, আরও এক ডিগ্রি বাড়িয়ে বলেন ‘ইন এডিশন’, তা হলে কী ভয়ংকর শোনাবে! ২১(১) অনুচ্ছেদ সংবিধান ও আইন মান্য করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। অর্থাৎ ‘রাষ্ট্রধর্ম’ একটি বিধান, সেই বিধান মান্য করা বাধ্যতামূলক। ‘তবে’ অন্য ধর্মও পালন করা যাবে। একদিকে রাষ্ট্রধর্ম মেনে লা-শারিক, তোমার কোনো অংশীদার বা সমতুল্য নেই বলব, আবার ‘তবে’ শব্দটির দ্বারা শিবের পূজা, মা-মেরির বন্দনা অথবা বুদ্ধের শরণকেও ‘সমমর্যাদা’ দেওয়া কি প্রবঞ্চনা নয়?
বাস্তবে ২-ক অনুচ্ছেদ ও প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহ’ যোগ এবং ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ অনুচ্ছেদ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যে সংবিধানটিতে ‘ফিরে যাব’ বলে আওয়ামী সরকারের বাগাড়ম্বর শুনেছি, আওয়ামী লীগের ৬২ বছরের বিবর্তন পর্যালোচনা করলে আমার মতো অনেকেই বুঝতে পারবেন, প্রথম দফায় ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগ, দ্বিতীয় দফায় শেখ মুজিব-তাজউদ্দীন-সৈয়দ নজরুল-কামরুজ্জামানের আওয়ামী লীগ, তৃতীয় স্তরে রাজ্জাক-তোফায়েলদের গণ-আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ আর বর্তমানের নব প্রজন্মের নতুন নেত্রীর পদানুযায়ী আওয়ামী লীগ এক নয়। যিনি রেসকোর্স ময়দানে বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না’ আর তাঁর অনুসারী পরিচয়দানকারীরা সেই আদর্শের বলয় থেকে বেরিয়ে এসেছেন কী বাসনায়, তা কি বুঝিয়ে বলতে হবে? সত্যি বলতে, এই দেশে ধর্ম-উন্মাদনার রাজনীতিকে যাঁরা রুখে দিয়েছিলেন, তাঁদেরকে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির প্রতিষ্ঠাকারী আজকের আওয়ামী লীগে খুঁজে পাই না। মওদুদিকে যাঁরা পল্টনে জনসভা করতে দেননি, তাঁদের এবং আজ যাঁরা আমিনীর সঙ্গে আপস বৈঠক করেন, তাঁদের চরিত্র ও আদর্শ এক হতে পারে না।
হয়তো বলতে পারেন, কালের ও যুগের পরিবর্তনে সমসাময়িক অবস্থার সঙ্গে আপস করতেই হবে। তাঁরা বলবেন, বর্তমান আওয়ামী লেবাসের ক্ষমতাধারীরা সেই পুরোনো আপ্তবাক্যে বিশ্বাসী, ‘ইফ ইউ ক্যান্ট বিট দেম, জয়েন দেম।’ রাজনীতি এখন আমাদের আদিকালের ক্ষয়ে যাওয়া আদর্শবাদীদের জন্য নয়। এখন আদর্শবাদ হচ্ছে ক্ষমতার লড়াই, ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার পদ্ধতি প্রবর্তন। সমাজতন্ত্র বর্তমান মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রয়োগ অবাস্তব। সমাজতন্ত্রের আদি অনুসারী সোভিয়েট রাশিয়া, তাদের অনুসারী চীন, এমনকি কিউবাও কতকাংশে মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিনের সমাজতান্ত্রিক ধারণাকে বহু আগেই ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিয়েছে। তাই তো যাঁরা বলতেন ধর্মের ‘আফিম’ খাওয়ানো হয়, সেই মেনন-ইনুরা রাষ্ট্রধর্ম কায়েমের পক্ষে ভোট দেন। আমার একটি কৌতূহল ‘হ্যাঁ’ দস্তখত দেওয়ার আগে তাঁরা কি ‘বিসমিল্লাহ’ বলেছিলেন? আসলে তাঁদের অসাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে শঠতার আবরণে ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রনীতি।
আজকের আলোচনার পঞ্চদশ সংশোধনীতে ধর্ম নিয়ে যে ‘জাগলারি’, ভোজবাজি বা মাদারির খেল দেখানো হয়েছে, তা আরও ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, রাষ্ট্র একটি নিরাকার বস্তু, রাষ্ট্রের ধর্ম মানে ইহার নাগরিক, অধিবাসী ও ভৌগোলিক সীমানায় বসবাসকারী সকল আবালবৃদ্ধবনিতা। তা হলে রাষ্ট্রধর্ম পালন একটি রাষ্ট্রীয় বিধান। এই বিধান কেউ অমান্য করলে, ইসলামি রীতিনীতিবিরোধী কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করলে, সংশোধিত ৭-ক অনুচ্ছেদের উপ-অনুচ্ছেদ-খ প্রযোজ্য হবে। ইহকালে সংশোধিত সংবিধান অমান্য করার শাস্তি চরম দণ্ড। এ রকম বিধান রয়েছে নতুন সংশোধিত ৭-ক(খ) অনুচ্ছেদে। বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধান ও উহার কোনো বিধানের (এই ক্ষেত্রে আমার ব্যাখ্যা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম পালন) প্রতি আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে তাহা রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে।’ সেই রাষ্ট্রদ্রোহের শাস্তি সর্বোচ্চ দণ্ড অর্থাৎ ফাঁসি।
এই উপ-অনুচ্ছেদটি কি যারা রাষ্ট্রধর্ম ও ‘আল্লাহর ওপর আস্থা’ রাখবে না, সেই বিধর্মীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়? তবে হ্যাঁ, আগেই বলেছি, পরবর্তী বাক্যাংশে একটি ব্যতিক্রমের দোহাই দিয়ে সংখ্যালঘুদের প্রতি প্রবঞ্চনা তথা শঠতা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মকে সমান মর্যাদা দিবে, সমানভাবে পালন নিশ্চিত করিবে।’ অর্থাৎ তাঁরা সংবিধানের বিধান মেনে (না মানলে ফাঁসি) আল্লাহকে সর্বোচ্চে স্থান দেবেন। আবার তাঁদের নিজেদের ধর্মীয় আরাধ্যকে সমমর্যাদা দেবেন? এ যে মোনাফেকি অথবা ‘শেরেক’ কি না, ইসলামি পণ্ডিতেরা সেই ব্যাখ্যা দেবেন।
এবার আলোচনা করা যাক সংবিধানের প্রস্তাবনার ওপর সংশোধনী। জিয়ার পঞ্চম সংশোধনীতে আছে, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’, যথার্থ বঙ্গানুবাদ ‘পরম দয়াময়, দয়ালু আল্লাহর নামে’। পঞ্চদশ সংশোধনীতে একটি হ্যাস চিহ্ন, ইংরেজিতে বলব অবলিক, বাংলায় ‘তথা’ যোগ করা হয়েছে ‘পরম সৃষ্টিকর্তার নামে’। তা হলে বুঝব, পঞ্চদশ সংশোধনকারীরা আল্লাহকে শুধু দয়াময় ও দয়ালু বলে ক্ষান্ত হননি, তিনি যে সৃষ্টিকর্তা, তা-ও আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আবার একটি খাড়াদণ্ড (স্ট্রোক) দিয়ে সংবিধানের বিধানে ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি করা হয়েছে। ইসলামপন্থীরা ‘আল্লাহ’কে স্মরণ করবেন, অন্য ধর্মাবলম্বীরা অন্য কোনো সৃষ্টিকর্তাকে। পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে যাঁরা লেজেগোবরে অবস্থা সৃষ্টি করেছেন, তাঁরা ইসলাম ধর্মাবলম্বী আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায় উভয়কে একটি বাক্যাংশের ভিন্নার্থ করে ধোঁকা দিয়েছেন।
ধর্মীয় ব্যাখ্যা আর দেব না। শেষ করব। বিজ্ঞ ইতিহাসবিদ লেখক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ৯ জুলাই জনকণ্ঠ পত্রিকায় লিখেছেন, ‘এরশাদ যখন অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেন, তখন শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “অষ্টম সংশোধনী বিল এ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্যই আসিয়াছে। ভবিষ্যতে সুযোগ পাইলে এই বিল বাতিল করিয়া দিব”।’ (ইত্তেফাক জুলাই ০৬, ১৯৮৮) তখন বলেছিলেন, ‘ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে লইয়া যাহারা যথেচ্ছা ব্যবহার করিতে চাহে, ধর্মকে তাহারা ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে গদি রক্ষা করিতে চাহে।’ মামুন খালেদা জিয়াকে উদ্ধৃত করেছেন পত্রিকাটির একই সংখ্যা থেকে, ‘স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম করার নামে জাতিকে বিভ্রান্ত করছে।’ মামুন লিখেছেন, ‘এখানেই শেষ নয়, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার কারণে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত হরতাল ডেকেছিল।’
এখন আমার সেই সম্মানীয় পাঠককে বলতে হয়, আপনি সঠিক প্রশ্ন করেছেন, তারা হরতাল করল না, কার হরতাল কে করল?
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
আমার একজন পাঠক হরতাল প্রত্যাখ্যান আর সফলতার দাবির সত্যতা জানতে চাননি। তিনি শুধু জানতে চেয়েছেন, কার হরতাল কে করেছে? পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাহাত্তরে ফিরে যাওয়ার দোহাই দিয়ে কতিপয় ধারা সন্নিবেশিত বা বিলুপ্ত করা হলো। তার আগে আদালত পঞ্চম সংশোধনী পুরোপুরি না করে দায়সারাভাবে বাতিল করে কাদের খুশি করল। অপরদিকে ইসলামের জন্য মাতমকারীদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ২-ক অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল শুধু নয়, ৭-ক যোগ করে খামিরা করা হলো। এই বিধান অমান্য করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলা হলো। তাহলে দুটি হরতালের মাজেজা কী, এ যে উল্টো বুঝলি রাম! হরতাল তো করার কথা তাদের, যারা বাহাত্তরের সংবিধানের গণতান্ত্রিক বিধান বহাল রাখতে চায়, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তাদের।
এবার বিস্তারিত আলোচনায় যাব। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল নিয়ে বিরোধী দলের হরতালের যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছি না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে তো জরুরি অবস্থা আসবে হয়তো অথবা ১/১১-পরবর্তী আধা সামরিক শাসন জারি হবে। সেই সরকারের অধীনে নির্বাচন মেনে নিয়ে পরাজিত হলে সংসদ বর্জন অথবা ‘মানি না, মানি না’ বলে গাড়ি ভাঙচুর করা হবে। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হওয়ায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সমানে সমানে লড়াই হবে। এক দল ১০টি ব্যালট বাক্স ছিনতাই করলে অপর দল ২০টি পুড়িয়ে দিতে পারবে। পাল্টাপাল্টি ভোটকেন্দ্র দখল করে অবাধে সিল মারতে পারবে। জিজ্ঞেস করতে পারেন, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কী করবে? তারা হাওয়া বোঝার চেষ্টা করবে, হাঙ্গামা বাধলে আকাশের দিকে গুলি করবে নাকি সম্ভাব্য বিজয়ী দলের শক্তি বৃদ্ধি করবে—সেই বিভ্রান্তি কাটাতে মগ্ন থাকবে? এদিকে যা হওয়ার হয়ে যাবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল নিয়ে একজন চিন্তাশীল বাস্তববাদী পাঠকের এই পর্যালোচনার পর এ নিয়ে বিরোধী দলের সাংবিধানিক কোনো বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার কারণ খুঁজে পেলাম না। বরং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে উপদেশ দেব, সমভাবে কুরুক্ষেত্রের জন্য তৈরি হোন। হোন্ডা জোগাড় করুন, গুন্ডাদের প্রশিক্ষণ দিন। বিরোধী দলকে বলব, ফারুকদের এখনই শহীদ হওয়ার প্রয়োজন নেই, অপেক্ষা করুন এবং আড়াই বছর পরে মহারণের জন্য প্রস্তুতি নিন।
এবার আসি ধর্মীয় লেবাস আর নামধারীদের ছোটখাটো হরতাল নিয়ে আলোচনায়। এই উপমহাদেশ বিভক্ত হয়েছিল ধর্মাশ্রয়ী অথবা ধর্মের জিকির আর ধর্মীয় উন্মাদনার রাজনীতির বিস্তারের কারণে। সেই উন্মাদনা স্তিমিত শুধু নয়, বিস্তার রোধে আওয়ামী মুসলিম লীগের অভ্যুদয় ঘটল। আজ ৬২ বছর পরে ভাবতে বসেছি, সেই আওয়ামী লীগ কোথায়? আওয়ামী মোসলেম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ ছাঁটাই হলো। তারপর সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন, স্বৈরতন্ত্রের অবসানে গণতন্ত্রের জন্য সশস্ত্র লড়াই। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের অর্জিত অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রটির গায়ে মুসলিম পরিচয় সেঁটে দিয়েছিলেন জিয়া-এরশাদ। আওয়ামী-প্রভাবিত সরকার ক্ষমতায় ফিরে এসে এবার সেটিতে ফেলিকন গ্লু লাগিয়ে দিল। ভাগ্যের কী পরিহাস, পূর্ব বাংলার মুসলমানদের গোঁড়া ধর্মীয় চেতনা থেকে অসাম্প্রদায়িক কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ জাতিতে রূপান্তর ঘটিয়েছিল আওয়ামী লীগ। সেই দল কি ভূতের উল্টো পায়ে চলছে?
আরও বিশদ ব্যাখ্যা করি, সংবিধানে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ স্বীকৃতি বহাল রেখেছে আওয়ামী সরকার। আবার দাবি করছে, পুরোনো সেই তত্ত্ব ও আদর্শের খোলস বহাল রেখে ধর্মনিরপেক্ষতায় আস্থাও বিসর্জন দেয়নি। অদ্ভুত এই গোঁজামিল যাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত, তাঁর ধীশক্তির প্রশংসা করছি। পাকিস্তানের আদি যুগে আওয়ামী লীগ বাংলার মুসলমানদের বলেছিল, ইসলাম ধর্ম একটি ধর্মীয় বিশ্বাস, রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। এখন বলছে, এটি রাষ্ট্রীয় বিধান।
বাহাত্তরের সংবিধানে অনুচ্ছেদ ১২ যখন সংবিধিবদ্ধ করা হয়, তখন ইনটেনশন বা উদ্দেশ্য তথা স্পিরিট কী ছিল? ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা বিলোপ করা হইবে, ব্যাখ্যাটি আমার মতে সঠিক নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মের কারণে বৈষম্য করা যাবে না। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম মানে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে ইসলাম মানতে বাধ্য করা, একটি ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগ (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান। এখন তো এক ডিগ্রি বাড়িয়ে ২-ক পরিচ্ছেদে একেবারে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার। বাংলায় বলা হয়েছে, এসবই পরিত্যাজ্য, ইংরেজিতে ‘সিকিউলারিজম শ্যাল বি রিয়েলাইজড বাই এলিমিনেশন’ অর্থাৎ বিলুপ্তি ঘটিয়ে। তাহলে ২-ক পরিচ্ছেদে এরশাদের সংযোজিত ‘তবে’ অন্যান্য ধর্মও শান্তিতে পালন করা যাবে, এই ‘তবে’ মানে কী?
ইংরেজি অনুবাদ বাট কি যথার্থ? কেউ যদি বলেন, ‘বাট’ মানে ‘হাউএভার’, আরও এক ডিগ্রি বাড়িয়ে বলেন ‘ইন এডিশন’, তা হলে কী ভয়ংকর শোনাবে! ২১(১) অনুচ্ছেদ সংবিধান ও আইন মান্য করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। অর্থাৎ ‘রাষ্ট্রধর্ম’ একটি বিধান, সেই বিধান মান্য করা বাধ্যতামূলক। ‘তবে’ অন্য ধর্মও পালন করা যাবে। একদিকে রাষ্ট্রধর্ম মেনে লা-শারিক, তোমার কোনো অংশীদার বা সমতুল্য নেই বলব, আবার ‘তবে’ শব্দটির দ্বারা শিবের পূজা, মা-মেরির বন্দনা অথবা বুদ্ধের শরণকেও ‘সমমর্যাদা’ দেওয়া কি প্রবঞ্চনা নয়?
বাস্তবে ২-ক অনুচ্ছেদ ও প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহ’ যোগ এবং ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ অনুচ্ছেদ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যে সংবিধানটিতে ‘ফিরে যাব’ বলে আওয়ামী সরকারের বাগাড়ম্বর শুনেছি, আওয়ামী লীগের ৬২ বছরের বিবর্তন পর্যালোচনা করলে আমার মতো অনেকেই বুঝতে পারবেন, প্রথম দফায় ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগ, দ্বিতীয় দফায় শেখ মুজিব-তাজউদ্দীন-সৈয়দ নজরুল-কামরুজ্জামানের আওয়ামী লীগ, তৃতীয় স্তরে রাজ্জাক-তোফায়েলদের গণ-আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ আর বর্তমানের নব প্রজন্মের নতুন নেত্রীর পদানুযায়ী আওয়ামী লীগ এক নয়। যিনি রেসকোর্স ময়দানে বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না’ আর তাঁর অনুসারী পরিচয়দানকারীরা সেই আদর্শের বলয় থেকে বেরিয়ে এসেছেন কী বাসনায়, তা কি বুঝিয়ে বলতে হবে? সত্যি বলতে, এই দেশে ধর্ম-উন্মাদনার রাজনীতিকে যাঁরা রুখে দিয়েছিলেন, তাঁদেরকে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির প্রতিষ্ঠাকারী আজকের আওয়ামী লীগে খুঁজে পাই না। মওদুদিকে যাঁরা পল্টনে জনসভা করতে দেননি, তাঁদের এবং আজ যাঁরা আমিনীর সঙ্গে আপস বৈঠক করেন, তাঁদের চরিত্র ও আদর্শ এক হতে পারে না।
হয়তো বলতে পারেন, কালের ও যুগের পরিবর্তনে সমসাময়িক অবস্থার সঙ্গে আপস করতেই হবে। তাঁরা বলবেন, বর্তমান আওয়ামী লেবাসের ক্ষমতাধারীরা সেই পুরোনো আপ্তবাক্যে বিশ্বাসী, ‘ইফ ইউ ক্যান্ট বিট দেম, জয়েন দেম।’ রাজনীতি এখন আমাদের আদিকালের ক্ষয়ে যাওয়া আদর্শবাদীদের জন্য নয়। এখন আদর্শবাদ হচ্ছে ক্ষমতার লড়াই, ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার পদ্ধতি প্রবর্তন। সমাজতন্ত্র বর্তমান মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রয়োগ অবাস্তব। সমাজতন্ত্রের আদি অনুসারী সোভিয়েট রাশিয়া, তাদের অনুসারী চীন, এমনকি কিউবাও কতকাংশে মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিনের সমাজতান্ত্রিক ধারণাকে বহু আগেই ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিয়েছে। তাই তো যাঁরা বলতেন ধর্মের ‘আফিম’ খাওয়ানো হয়, সেই মেনন-ইনুরা রাষ্ট্রধর্ম কায়েমের পক্ষে ভোট দেন। আমার একটি কৌতূহল ‘হ্যাঁ’ দস্তখত দেওয়ার আগে তাঁরা কি ‘বিসমিল্লাহ’ বলেছিলেন? আসলে তাঁদের অসাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে শঠতার আবরণে ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রনীতি।
আজকের আলোচনার পঞ্চদশ সংশোধনীতে ধর্ম নিয়ে যে ‘জাগলারি’, ভোজবাজি বা মাদারির খেল দেখানো হয়েছে, তা আরও ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, রাষ্ট্র একটি নিরাকার বস্তু, রাষ্ট্রের ধর্ম মানে ইহার নাগরিক, অধিবাসী ও ভৌগোলিক সীমানায় বসবাসকারী সকল আবালবৃদ্ধবনিতা। তা হলে রাষ্ট্রধর্ম পালন একটি রাষ্ট্রীয় বিধান। এই বিধান কেউ অমান্য করলে, ইসলামি রীতিনীতিবিরোধী কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করলে, সংশোধিত ৭-ক অনুচ্ছেদের উপ-অনুচ্ছেদ-খ প্রযোজ্য হবে। ইহকালে সংশোধিত সংবিধান অমান্য করার শাস্তি চরম দণ্ড। এ রকম বিধান রয়েছে নতুন সংশোধিত ৭-ক(খ) অনুচ্ছেদে। বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধান ও উহার কোনো বিধানের (এই ক্ষেত্রে আমার ব্যাখ্যা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম পালন) প্রতি আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে তাহা রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে।’ সেই রাষ্ট্রদ্রোহের শাস্তি সর্বোচ্চ দণ্ড অর্থাৎ ফাঁসি।
এই উপ-অনুচ্ছেদটি কি যারা রাষ্ট্রধর্ম ও ‘আল্লাহর ওপর আস্থা’ রাখবে না, সেই বিধর্মীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়? তবে হ্যাঁ, আগেই বলেছি, পরবর্তী বাক্যাংশে একটি ব্যতিক্রমের দোহাই দিয়ে সংখ্যালঘুদের প্রতি প্রবঞ্চনা তথা শঠতা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মকে সমান মর্যাদা দিবে, সমানভাবে পালন নিশ্চিত করিবে।’ অর্থাৎ তাঁরা সংবিধানের বিধান মেনে (না মানলে ফাঁসি) আল্লাহকে সর্বোচ্চে স্থান দেবেন। আবার তাঁদের নিজেদের ধর্মীয় আরাধ্যকে সমমর্যাদা দেবেন? এ যে মোনাফেকি অথবা ‘শেরেক’ কি না, ইসলামি পণ্ডিতেরা সেই ব্যাখ্যা দেবেন।
এবার আলোচনা করা যাক সংবিধানের প্রস্তাবনার ওপর সংশোধনী। জিয়ার পঞ্চম সংশোধনীতে আছে, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’, যথার্থ বঙ্গানুবাদ ‘পরম দয়াময়, দয়ালু আল্লাহর নামে’। পঞ্চদশ সংশোধনীতে একটি হ্যাস চিহ্ন, ইংরেজিতে বলব অবলিক, বাংলায় ‘তথা’ যোগ করা হয়েছে ‘পরম সৃষ্টিকর্তার নামে’। তা হলে বুঝব, পঞ্চদশ সংশোধনকারীরা আল্লাহকে শুধু দয়াময় ও দয়ালু বলে ক্ষান্ত হননি, তিনি যে সৃষ্টিকর্তা, তা-ও আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আবার একটি খাড়াদণ্ড (স্ট্রোক) দিয়ে সংবিধানের বিধানে ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি করা হয়েছে। ইসলামপন্থীরা ‘আল্লাহ’কে স্মরণ করবেন, অন্য ধর্মাবলম্বীরা অন্য কোনো সৃষ্টিকর্তাকে। পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে যাঁরা লেজেগোবরে অবস্থা সৃষ্টি করেছেন, তাঁরা ইসলাম ধর্মাবলম্বী আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায় উভয়কে একটি বাক্যাংশের ভিন্নার্থ করে ধোঁকা দিয়েছেন।
ধর্মীয় ব্যাখ্যা আর দেব না। শেষ করব। বিজ্ঞ ইতিহাসবিদ লেখক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ৯ জুলাই জনকণ্ঠ পত্রিকায় লিখেছেন, ‘এরশাদ যখন অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেন, তখন শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “অষ্টম সংশোধনী বিল এ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্যই আসিয়াছে। ভবিষ্যতে সুযোগ পাইলে এই বিল বাতিল করিয়া দিব”।’ (ইত্তেফাক জুলাই ০৬, ১৯৮৮) তখন বলেছিলেন, ‘ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে লইয়া যাহারা যথেচ্ছা ব্যবহার করিতে চাহে, ধর্মকে তাহারা ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে গদি রক্ষা করিতে চাহে।’ মামুন খালেদা জিয়াকে উদ্ধৃত করেছেন পত্রিকাটির একই সংখ্যা থেকে, ‘স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম করার নামে জাতিকে বিভ্রান্ত করছে।’ মামুন লিখেছেন, ‘এখানেই শেষ নয়, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার কারণে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত হরতাল ডেকেছিল।’
এখন আমার সেই সম্মানীয় পাঠককে বলতে হয়, আপনি সঠিক প্রশ্ন করেছেন, তারা হরতাল করল না, কার হরতাল কে করল?
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
No comments