সুন্দরবনকে ভোট দিন by ড. গোলাম আলী ফকির
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটিও প্রাকৃতিক 'সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে সুন্দরবনকে ভোট দিন' শীর্ষক ক্যাম্পেইন প্রোগ্রাম চালু করেছে এবং এর অংশ হিসেবে ১৮ থেকে ২০ জুন ইন্টারনেটের মাধ্যমে সুন্দরবনকে সরাসরি ভোটদানের জন্য এক বিশাল উদ্যোগ নিয়েছিল। সে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান বন সংরক্ষক। বিশ্বের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান দেখার জন্য আমাদের ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, কাঠমাণ্ডু বা আগ্রায় যাওয়ার আগ্রহের অন্ত নেই।
কিন্তু হাতের কাছে স্রষ্টার অপার সৃষ্টি সুন্দরবন যে পৃথিবীর চিত্তাকর্ষক অত্যাশ্চর্য দর্শনীয় স্থানের অন্যতম, তা মনে হয় আমরা অনেকেই জানি না। আমরা সবাই জানি যে Canadian Swiss Bernard Weber-এর নেতৃত্বে এবং সুইজারল্যান্ডভিত্তিক The New 7 Wonders Foundation-এর পরিচালনায় বিশ্বের সেরা সাতটি প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য 'মষড়নধষ ঢ়ড়ষষ'-এর মাধ্যমে নির্বাচিত হতে যাচ্ছে। এই ভোট কার্যক্রম শুরু হয়েছে ২০০৭ সালে এবং সমাপ্ত হবে ২০১১ সালের ১১ নভেম্বর। বিশ্বের মোট ৪৪০টি প্রাকৃতিক দর্শনীয় স্থানের মধ্য থেকে ভোটের মাধ্যমে ২০০৯ সালের জুলাই মাসে প্রাথমিকভাবে ২৮টি স্থানকে নির্বাচন করা হয়। এই ২৮টি দেশের মধ্য থেকে ১১ নভেম্বর ২০১১ সাতটি সেরা প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হবে।
বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল ঘেঁষে বাংলাদেশ ও ভারতের ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। এ বনের ৬০ শতাংশেরও বেশি বাংলাদেশে অবস্থিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি, জীববৈচিত্র্যের অপার সম্ভার, বনজ, জলজ ও প্রাণিসম্পদের বিপুল ভাণ্ডার সুন্দরবন তার আপন মহিমা ও গরিমায় মহিমান্বিত ও গৌরবান্বিত। এ বনে রয়েছে ৪০০ প্রজাতির মাছ, কুমির, কচ্ছপ, শুশুকসহ বিচিত্র ধরনের জলজ প্রাণী। পৃথিবীর বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থলও এই সুন্দরবন। ইউএনডিপির জরিপ অনুযায়ী বর্তমানে সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ৪৪০। এই বনে ৩৭৫ প্রজাতির বেশি বন্য প্রাণী রয়েছে, যার মধ্যে ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২৯১ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া ও ৪৩ প্রজাতির মলাস্কা। নোনা পানির বৃহদাকার কুমির, বন্য শূকর, বানর, ডলফিন ও বনবিড়াল হরহামেশা দেখা যায় এই বনে। বিরল প্রজাতির অসংখ্য চিত্রাহরিণের (spotted deer) বিচরণ সুন্দরবনের সৌন্দর্যকে বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। সুন্দরবনের মূল্যবান বৃক্ষের মধ্যে রয়েছে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, কেওড়া, পশুর, সিংড়া ও খলশি। এসব প্রজাতির মধ্যে সুন্দরীগাছের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ এটি Predominant প্রজাতি। সুন্দরবনে দৃষ্টিনন্দন সুন্দরীগাছের প্রাধান্যের কারণে এই বনের নামকরণ হয়েছে সুন্দরবন। গোলপাতা ও মধু সুন্দরবনের আরেক অমূল্য সম্পদ। বস্তুত সুন্দরবন দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের লাখ লাখ মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস। সুন্দরবন বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য ঢালস্বরূপ। সিডর, আইলাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে প্রতিবছর এ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের প্রাণ রক্ষা করছে সুন্দরবনের ঘন বনরাজি।
সুন্দরবনের হৃদয়জুড়ানো নৈসর্গিক দৃশ্য, ম্যানগ্রোভ বৃক্ষের ব্যতিক্রমধর্মী গঠনবৈশিষ্ট্য ও জীববৈচিত্র্য পর্যটন শিল্পের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। প্রকৃতপক্ষে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে সুন্দরবনকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। সুন্দরবনের নদীর প্রতিটি বাঁকে, গাছের প্রতিটি শাখায়, এর পরতে পরতে যে কুমারী সৌন্দর্যের আকর্ষণ, এখানে না এলে তা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এর ভেতরে সুনসান নীরবতা, রাতের গাঢ় অন্ধকার, গা ছমছম করা রোমাঞ্চ, তার ওপর দূর থেকে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের রক্ত শীতল করা গর্জন যেন এই গহিন বনের নীরবতা ভেঙে দেয়। বিদেশিদের কাছে এ এক স্বর্গ। আমি একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। ১৯৯৪ সাল। আমি তখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুন্দরবনের জন্য একটি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ডিএফআইডির আর্থিক সহায়তায় এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে ব্রিটেন থেকে আগত একটি বিশেষজ্ঞদল সুন্দরবন পরিদর্শনে আসে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে আমি নিজে, সংশ্লিষ্ট ডিন, বিভাগীয় প্রধানরা, বিশেষজ্ঞ শিক্ষকরা এবং বন বিভাগের কর্মকর্তারা ব্রিটিশ দল নিয়ে সুন্দরবন পরিদর্শনে যাই। ডিএফআইডির বিশেষজ্ঞদলের নেতৃত্বে ছিলেন ড. টমাস। তিনি ইউরোপিয়ান কমিশনেরও (ইসি) একজন কর্মকর্তা ছিলেন। কটকায় পেঁৗছতে এখনো বেশ সময় লাগবে। পড়ন্ত বিকেল। বিশাল নদীর বুক চিরে কিছুটা ডান তীরের কেওড়ার বন ঘেঁষে আমাদের লঞ্চ ছুটে চলেছে। প্রায় এক কিলোমিটার দূরে বাঁ তীরে সুন্দরীর বন। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার দুই তীরজুড়ে কেওড়া ও সুন্দরীগাছের ত্রুটিহীন সারি। পশ্চিম দিগন্তে রক্তিম সূর্য অস্ত যাওয়ার জন্য ব্যস্ত। মনে হচ্ছে, গোলাকার একটি সোনালি থালা দূরে বিশাল নদীর মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। অস্তগামী সূর্যের সোনালি রোদ্দুর নদীর বুকে ঝিকমিক করছে এবং টেউয়ের সঙ্গে ভাসা-ডোবা খেলায় মেতেছে। পাশের কেওড়ার বনে অসংখ্য চিত্রাহরিণ কেওড়ার পাতা খাচ্ছে আর দৌড়াদৌড়ি, ছোটাছুটি করছে। কেওড়াগাছে অনেক বানর কিচিরমিচির শব্দ করছে এবং লাফিয়ে এক গাছ থেকে অন্য গাছে গিয়ে ঝুলছে। বানরগুলো পাতাসহ কেওড়াগাছের ছোট ছোট ডাল ভেঙে নিচে ফেলছে। আর হরিণ মহা আনন্দে সেগুলো খাচ্ছে। সুন্দরবনে এ দুই বন্য প্রাণীর মধ্যে এক অনন্য বন্ধুত্ব। হঠাৎ আমরা দেখতে পেলাম, সামনে নদীর মধ্যে বিশালাকার একটি কুমির একটি বড় মাছ ধরে পানির ওপর মুখ তুলে চিবোচ্ছে। সব কিছু মিলে হৃদয়জুড়ানো এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। আমরা সবাই নীরবে এ দৃশ্য উপভোগ করছি। হঠাৎ বনরানীর ডেকের সামনে বসা বিশালবপু ড. থোমাস দাঁড়িয়ে নৃত্যরত ভঙ্গিতে চিৎকার করে বলছেন, ঞযরং রং যবধাবহ. ঞযরং রং যবধাবহ. ঈড়সব ধহফ ংবব ঃযব যবধাবহ। আসলে সুন্দরবন ভূস্বর্গ। এ দৃশ্য কখনো ভোলার নয়। সুপরিকল্পনার সঙ্গে সঠিকভাবে যদি আমরা সবাই সুন্দরবনকে ভোট দিতে পারি, তাহলে সুন্দরবনকে প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের প্রথম স্থানে নির্বাচিত করা আমাদের জন্য কঠিন হবে না। ভোটগ্রহণ শেষ হতে আর বেশিদিন বাকি নেই_১০ নভেম্বর ২০১১।
বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবনকে প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে বিজয়ী করতে আমি সাতটি প্রস্তাব জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়নের জন্য উপস্থাপন করছি : ১. সুন্দরবনকে বিজয়ী করার জন্য New 7 Wonders of Nature-Gi + 44 758 900 1290 নম্বরটি টোল ফ্রি করা, যাতে বাংলাদেশের মানুষ বিনা মূল্যে ফোনের মাধ্যমে ব্যাপকসংখ্যক ভোট দিতে পারেন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং আমাদের মোবাইল ফোন কম্পানিগুলো প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখলে সুন্দরবন নিশ্চিতভাবে বিজয়ী হবে। ২. যেহেতু এখন একই মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে বারবার ভোট দেওয়া যাবে, তাই যাঁরা বিত্তবান তাঁরা মোবাইলে বেশি বেশি ভোট দিন। এভাবে এক লাখ লোক ১০০টি করে ভোট দিলে সুন্দরবন এক কোটি ভোট পেয়ে যাবে। ৩. জরুরি ভিত্তিতে দেশের সর্বস্তরের সব পেশার মানুষের ভোটিং সুবিধা নিশ্চিত করা। এ ব্যাপারে সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি, সংশ্লিষ্ট সব সংগঠন বা সংস্থাকে বাস্তবমুখী কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। ৪. ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ সব ধরনের প্রচারমাধ্যম ও সংস্থার প্রচার আরো জোরদার করতে হবে। ৫. দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল ও মাদ্রাসার প্রত্যেক ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও কর্মচারী যাতে সুন্দরবনকে ভোট দিতে পারেন, তার জন্য নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অবিলম্বে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। ৬. সুন্দরবনের একটি অংশ ভারতে অবস্থিত এবং ভারতের বিশাল জনগোষ্ঠীর এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ অত্যাবশ্যকীয়। নতুন সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে ভারতের অংশগ্রহণ সুন্দরবনকে নিশ্চিতভাবে বিজয়ী করতে পারে। এ ব্যাপারে উভয় দেশের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। ৭. বাংলাদেশে কয়েক কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করা হয়। এর নেটওয়ার্ক এখন প্রত্যন্ত গ্রামেও বিস্তৃতি লাভ করেছে। অনেকে সুন্দরবনকে ভোট দিতে চাইলেও নিয়মকানুন না জানার কারণে ভোট দিতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সব চ্যানেল যদি একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পৃথকভাবে দিনের যেকোনো একটি সময় বেছে নেয় এবং তারা যদি দেশের সব মোবাইল ফোনে একই সময় সুন্দরবনকে ভোট দেওয়ার জন্য টিভিতে প্রদর্শিত পন্থায় উপস্থাপকের সঙ্গে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করে, তাহলে কয়েক কোটি ভোট এক দিনেই সুন্দরবন পেয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি ২০ জুন ২০১১ থেকে এসএমএসের মাধ্যমে একটি মোবাইল থেকে যত খুশি সুন্দরবনকে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে। এ পর্যায়ে আমি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির সব ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে, তাঁরা যেন অন্তত গড়ে ২০০টি করে ভোট সুন্দরবনকে দেন। তাহলে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি থেকে সুন্দরবন ছয় লাখ ভোট পাবে। ২০ জুনের পর থেকে এসএমএসের মাধ্যমে স্বল্প খরচে সব কয়টি পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে সুন্দরবনকে ভোট দিলে সুন্দরবন আরো অনেক ভোট পাবে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৫২টি প্রাইভেট ও ৩৩টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকসংখ্যা তিন লাখের ওপর। তারা দেশের সবচেয়ে সচেতন অংশ। তারা প্রতিদিন একটি করে ভোট দিলেও কয়েক কোটি ভোট সুন্দরবন পাবে। এ ক্ষেত্রে সুন্দরবনের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। শিক্ষা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মাধ্যমিক স্তর ও তদূর্ধ্ব পর্যায়ে বাংলাদেশের ছাত্র ও শিক্ষকের সংখ্যা এক কোটি ১০ লাখের ওপর। আর যদি সারা দেশের কলেজ, স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী সুন্দরবনকে ভোট দেয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে এই নির্বাচনে সুন্দরবন প্রথম স্থান পেয়ে বিজয়ী হবে। তাই প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে সুন্দরবনকে ভোট দেওয়ার জন্য আমি আবারও সবার কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নতুন প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত ভোটে সুন্দরবন একটি সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
লেখক : অধ্যাপক ও ভাইস চ্যান্সেলর-ইনচার্জ এবং প্রধান উপদেষ্টা, প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে সুন্দরবনকে ভোট দিন
ক্যাম্পেইন প্রোগ্রাম, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি
বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল ঘেঁষে বাংলাদেশ ও ভারতের ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। এ বনের ৬০ শতাংশেরও বেশি বাংলাদেশে অবস্থিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি, জীববৈচিত্র্যের অপার সম্ভার, বনজ, জলজ ও প্রাণিসম্পদের বিপুল ভাণ্ডার সুন্দরবন তার আপন মহিমা ও গরিমায় মহিমান্বিত ও গৌরবান্বিত। এ বনে রয়েছে ৪০০ প্রজাতির মাছ, কুমির, কচ্ছপ, শুশুকসহ বিচিত্র ধরনের জলজ প্রাণী। পৃথিবীর বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থলও এই সুন্দরবন। ইউএনডিপির জরিপ অনুযায়ী বর্তমানে সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ৪৪০। এই বনে ৩৭৫ প্রজাতির বেশি বন্য প্রাণী রয়েছে, যার মধ্যে ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২৯১ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া ও ৪৩ প্রজাতির মলাস্কা। নোনা পানির বৃহদাকার কুমির, বন্য শূকর, বানর, ডলফিন ও বনবিড়াল হরহামেশা দেখা যায় এই বনে। বিরল প্রজাতির অসংখ্য চিত্রাহরিণের (spotted deer) বিচরণ সুন্দরবনের সৌন্দর্যকে বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। সুন্দরবনের মূল্যবান বৃক্ষের মধ্যে রয়েছে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, কেওড়া, পশুর, সিংড়া ও খলশি। এসব প্রজাতির মধ্যে সুন্দরীগাছের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ এটি Predominant প্রজাতি। সুন্দরবনে দৃষ্টিনন্দন সুন্দরীগাছের প্রাধান্যের কারণে এই বনের নামকরণ হয়েছে সুন্দরবন। গোলপাতা ও মধু সুন্দরবনের আরেক অমূল্য সম্পদ। বস্তুত সুন্দরবন দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের লাখ লাখ মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস। সুন্দরবন বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য ঢালস্বরূপ। সিডর, আইলাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে প্রতিবছর এ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের প্রাণ রক্ষা করছে সুন্দরবনের ঘন বনরাজি।
সুন্দরবনের হৃদয়জুড়ানো নৈসর্গিক দৃশ্য, ম্যানগ্রোভ বৃক্ষের ব্যতিক্রমধর্মী গঠনবৈশিষ্ট্য ও জীববৈচিত্র্য পর্যটন শিল্পের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। প্রকৃতপক্ষে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে সুন্দরবনকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। সুন্দরবনের নদীর প্রতিটি বাঁকে, গাছের প্রতিটি শাখায়, এর পরতে পরতে যে কুমারী সৌন্দর্যের আকর্ষণ, এখানে না এলে তা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এর ভেতরে সুনসান নীরবতা, রাতের গাঢ় অন্ধকার, গা ছমছম করা রোমাঞ্চ, তার ওপর দূর থেকে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের রক্ত শীতল করা গর্জন যেন এই গহিন বনের নীরবতা ভেঙে দেয়। বিদেশিদের কাছে এ এক স্বর্গ। আমি একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। ১৯৯৪ সাল। আমি তখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুন্দরবনের জন্য একটি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ডিএফআইডির আর্থিক সহায়তায় এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে ব্রিটেন থেকে আগত একটি বিশেষজ্ঞদল সুন্দরবন পরিদর্শনে আসে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে আমি নিজে, সংশ্লিষ্ট ডিন, বিভাগীয় প্রধানরা, বিশেষজ্ঞ শিক্ষকরা এবং বন বিভাগের কর্মকর্তারা ব্রিটিশ দল নিয়ে সুন্দরবন পরিদর্শনে যাই। ডিএফআইডির বিশেষজ্ঞদলের নেতৃত্বে ছিলেন ড. টমাস। তিনি ইউরোপিয়ান কমিশনেরও (ইসি) একজন কর্মকর্তা ছিলেন। কটকায় পেঁৗছতে এখনো বেশ সময় লাগবে। পড়ন্ত বিকেল। বিশাল নদীর বুক চিরে কিছুটা ডান তীরের কেওড়ার বন ঘেঁষে আমাদের লঞ্চ ছুটে চলেছে। প্রায় এক কিলোমিটার দূরে বাঁ তীরে সুন্দরীর বন। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার দুই তীরজুড়ে কেওড়া ও সুন্দরীগাছের ত্রুটিহীন সারি। পশ্চিম দিগন্তে রক্তিম সূর্য অস্ত যাওয়ার জন্য ব্যস্ত। মনে হচ্ছে, গোলাকার একটি সোনালি থালা দূরে বিশাল নদীর মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। অস্তগামী সূর্যের সোনালি রোদ্দুর নদীর বুকে ঝিকমিক করছে এবং টেউয়ের সঙ্গে ভাসা-ডোবা খেলায় মেতেছে। পাশের কেওড়ার বনে অসংখ্য চিত্রাহরিণ কেওড়ার পাতা খাচ্ছে আর দৌড়াদৌড়ি, ছোটাছুটি করছে। কেওড়াগাছে অনেক বানর কিচিরমিচির শব্দ করছে এবং লাফিয়ে এক গাছ থেকে অন্য গাছে গিয়ে ঝুলছে। বানরগুলো পাতাসহ কেওড়াগাছের ছোট ছোট ডাল ভেঙে নিচে ফেলছে। আর হরিণ মহা আনন্দে সেগুলো খাচ্ছে। সুন্দরবনে এ দুই বন্য প্রাণীর মধ্যে এক অনন্য বন্ধুত্ব। হঠাৎ আমরা দেখতে পেলাম, সামনে নদীর মধ্যে বিশালাকার একটি কুমির একটি বড় মাছ ধরে পানির ওপর মুখ তুলে চিবোচ্ছে। সব কিছু মিলে হৃদয়জুড়ানো এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। আমরা সবাই নীরবে এ দৃশ্য উপভোগ করছি। হঠাৎ বনরানীর ডেকের সামনে বসা বিশালবপু ড. থোমাস দাঁড়িয়ে নৃত্যরত ভঙ্গিতে চিৎকার করে বলছেন, ঞযরং রং যবধাবহ. ঞযরং রং যবধাবহ. ঈড়সব ধহফ ংবব ঃযব যবধাবহ। আসলে সুন্দরবন ভূস্বর্গ। এ দৃশ্য কখনো ভোলার নয়। সুপরিকল্পনার সঙ্গে সঠিকভাবে যদি আমরা সবাই সুন্দরবনকে ভোট দিতে পারি, তাহলে সুন্দরবনকে প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের প্রথম স্থানে নির্বাচিত করা আমাদের জন্য কঠিন হবে না। ভোটগ্রহণ শেষ হতে আর বেশিদিন বাকি নেই_১০ নভেম্বর ২০১১।
বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবনকে প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে বিজয়ী করতে আমি সাতটি প্রস্তাব জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়নের জন্য উপস্থাপন করছি : ১. সুন্দরবনকে বিজয়ী করার জন্য New 7 Wonders of Nature-Gi + 44 758 900 1290 নম্বরটি টোল ফ্রি করা, যাতে বাংলাদেশের মানুষ বিনা মূল্যে ফোনের মাধ্যমে ব্যাপকসংখ্যক ভোট দিতে পারেন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং আমাদের মোবাইল ফোন কম্পানিগুলো প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখলে সুন্দরবন নিশ্চিতভাবে বিজয়ী হবে। ২. যেহেতু এখন একই মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে বারবার ভোট দেওয়া যাবে, তাই যাঁরা বিত্তবান তাঁরা মোবাইলে বেশি বেশি ভোট দিন। এভাবে এক লাখ লোক ১০০টি করে ভোট দিলে সুন্দরবন এক কোটি ভোট পেয়ে যাবে। ৩. জরুরি ভিত্তিতে দেশের সর্বস্তরের সব পেশার মানুষের ভোটিং সুবিধা নিশ্চিত করা। এ ব্যাপারে সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি, সংশ্লিষ্ট সব সংগঠন বা সংস্থাকে বাস্তবমুখী কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। ৪. ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ সব ধরনের প্রচারমাধ্যম ও সংস্থার প্রচার আরো জোরদার করতে হবে। ৫. দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল ও মাদ্রাসার প্রত্যেক ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও কর্মচারী যাতে সুন্দরবনকে ভোট দিতে পারেন, তার জন্য নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অবিলম্বে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। ৬. সুন্দরবনের একটি অংশ ভারতে অবস্থিত এবং ভারতের বিশাল জনগোষ্ঠীর এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ অত্যাবশ্যকীয়। নতুন সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে ভারতের অংশগ্রহণ সুন্দরবনকে নিশ্চিতভাবে বিজয়ী করতে পারে। এ ব্যাপারে উভয় দেশের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। ৭. বাংলাদেশে কয়েক কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করা হয়। এর নেটওয়ার্ক এখন প্রত্যন্ত গ্রামেও বিস্তৃতি লাভ করেছে। অনেকে সুন্দরবনকে ভোট দিতে চাইলেও নিয়মকানুন না জানার কারণে ভোট দিতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সব চ্যানেল যদি একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পৃথকভাবে দিনের যেকোনো একটি সময় বেছে নেয় এবং তারা যদি দেশের সব মোবাইল ফোনে একই সময় সুন্দরবনকে ভোট দেওয়ার জন্য টিভিতে প্রদর্শিত পন্থায় উপস্থাপকের সঙ্গে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করে, তাহলে কয়েক কোটি ভোট এক দিনেই সুন্দরবন পেয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি ২০ জুন ২০১১ থেকে এসএমএসের মাধ্যমে একটি মোবাইল থেকে যত খুশি সুন্দরবনকে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে। এ পর্যায়ে আমি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির সব ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে, তাঁরা যেন অন্তত গড়ে ২০০টি করে ভোট সুন্দরবনকে দেন। তাহলে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি থেকে সুন্দরবন ছয় লাখ ভোট পাবে। ২০ জুনের পর থেকে এসএমএসের মাধ্যমে স্বল্প খরচে সব কয়টি পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে সুন্দরবনকে ভোট দিলে সুন্দরবন আরো অনেক ভোট পাবে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৫২টি প্রাইভেট ও ৩৩টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকসংখ্যা তিন লাখের ওপর। তারা দেশের সবচেয়ে সচেতন অংশ। তারা প্রতিদিন একটি করে ভোট দিলেও কয়েক কোটি ভোট সুন্দরবন পাবে। এ ক্ষেত্রে সুন্দরবনের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। শিক্ষা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মাধ্যমিক স্তর ও তদূর্ধ্ব পর্যায়ে বাংলাদেশের ছাত্র ও শিক্ষকের সংখ্যা এক কোটি ১০ লাখের ওপর। আর যদি সারা দেশের কলেজ, স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী সুন্দরবনকে ভোট দেয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে এই নির্বাচনে সুন্দরবন প্রথম স্থান পেয়ে বিজয়ী হবে। তাই প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে সুন্দরবনকে ভোট দেওয়ার জন্য আমি আবারও সবার কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নতুন প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত ভোটে সুন্দরবন একটি সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
লেখক : অধ্যাপক ও ভাইস চ্যান্সেলর-ইনচার্জ এবং প্রধান উপদেষ্টা, প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে সুন্দরবনকে ভোট দিন
ক্যাম্পেইন প্রোগ্রাম, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি
No comments