উত্তরাঞ্চলের বধ্যভূমি সংরক্ষণ প্রসঙ্গে by ড. তুহিন ওয়াদুদ
মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকার এখন ক্ষমতায়। মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো কার্পণ্য নেই। কিন্তু শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সরকারের উদাসীনতা চোখে পড়ার মতো। দেশমাতাকে মুক্ত করতে গিয়ে যাঁরা অকাতরে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোনো কিছু চাওয়ার অবকাশ নেই।
যে লক্ষ্য থেকে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, তাও দিনের পর দিন ক্ষয়িষ্ণু হয়ে উঠছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার কী করেছে? দেশের অবহেলিত বধ্যভূমিগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে সেই সত্য দিবালোকের মতো উদ্ভাসিত হয়। রংপুর বিভাগে যেসব বধ্যভূমি আছে, সেগুলোর প্রতি সরকারি উদ্যোগে উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ হয়নি। শুধু যে রংপুর বিভাগের জন্য এ বাস্তবতা তা নয়, এ অবস্থা সারা দেশের। রংপুরের মধ্যে সহস্রাধিক মৃত্যু একই দিনে ঘটেছে, এ রূপ বধ্যভূমির প্রতিও অবহেলা আর উপেক্ষা প্রদর্শন করা হয়েছে। রংপুরের পার্শ্ববর্তী উপজেলা বদরগঞ্জের ঝাড়ুয়ার বিলে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল যে গণহত্যা হয়েছে, সেখানে প্রায় দেড় হাজার মানুষকে একই দিনে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু সেখানেও শহীদদের নামের তালিকাসহ কোনো সৌধ নির্মিত হয়নি। শুধু তা-ই নয়, বধ্যভূমি থেকে অবাধে মাটি তুলে নিয়ে ইটখোলার কাজ চলছে। অথচ মাটি তুলতে গিয়ে শহীদদের হাড়ের বিভিন্ন অংশও পাওয়া গেছে। ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর কুড়িগ্রামের উলিপুরের হাতিয়া গণহত্যায় প্রায় ৭০০ মুক্তিকামী মানুষকে পাকিস্তানিরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। সেখানে তাঁদের স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশ্যে একটি নামফলক নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু তা অসম্পূর্ণ অবস্থায় অবহেলায় পড়ে আছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের বধ্যভূমি তো দূরের কথা, রংপুর শহর সংলগ্ন যে বধ্যভূমি আছে, সেগুলোর প্রতিও সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই।
'একাত্তর' শব্দটি আমাদের আবেগের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ সালটি আমাদের চেতনার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ সালের নারকীয় ঘটনাগুলো আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বেদনার। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে শুরু হয় ভয়াবহ নির্বিচার গণহত্যা। এরই ধারাবাহিকতায় বিজয়ের দিন পর্যন্ত পাকিস্তানি শক্তি এবং পাকিস্তানের দোসর আমাদের শত্রুশক্তি এই গণহত্যা অব্যাহত রেখেছিল। আমাদের মুখোশ বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ যত কথা ফেনিয়ে ওঠে, মুখোশটা আড়াল করলে আর সেই চেতনাসমৃদ্ধ রূপটি অবলোকন করা যায় না। তখন কেবলই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা আর ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা। সেখানে খুব অল্পই স্বাধীনতাকেন্দ্রিক মুখশ্রী। ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার নিমিত্তে আমরা যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্যবহার করছি। আমরা স্বাধীনতার চার দশকে মুক্তিযোদ্ধাদের না পেরেছি সম্মানিত করতে, না পেরেছি তাঁদের স্মৃতিচিহ্নকে অম্লান করে রাখার উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে। বর্ণনাতীত যেসব নির্মম গণহত্যা হয়েছে, আমরা কি সেই গণহত্যার স্থানগুলো চিহ্নিত করে সেখানে শহীদ হওয়া ব্যক্তিদের নামাঙ্কিত কোনো মিনার নির্মাণ করেছি? করিনি, এ কথা বললে সত্যের অপলাপ করা হয়। কিন্তু করার মাত্রা এতটাই সীমিত যে তাতে আমাদের লজ্জা ঢাকে না, বরং নির্লজ্জ রূপটাই প্রকাশ পায়। আমরা যারা স্বাধীনতা-উত্তরকালে জন্মগ্রহণ করেছি, তারা দুঃসহ দিনগুলো দেখিনি। কিন্তু দুঃসহ দিনের বর্ণনা শুনে যাদের অশ্রুসিক্ত হতে হয়, সেসব দিনের স্মৃতিচারণা শুনে যাদের শিহরিত হতে হয়, তারা যখন দেখি, মুক্তিযোদ্ধারা অবহেলিত, শহীদদের স্মৃতিচিহ্ন অম্লান করে রাখার কোনো আন্তরিক প্রচেষ্টা নেওয়া হয় না, তখন আমরা শুধু মানসিকভাবেই আহত হই না, বরং তখন আমরা নিজেদের অপরাধী মনে করি। আমাদের কাছে মনে হয়, তবে কি স্বাধীনতার চেতনা ভূলুণ্ঠিত হওয়ার পথে। '৭১-পরবর্তী সময়ে চার দশক ধরে রাষ্ট্র পর্যন্ত বাংলাদেশের বধ্যভূমি সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুঁজি করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে যারা ক্ষমতাসীন হয়েছে, তারাও সারা দেশের বধ্যভূমিগুলোকে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বিচ্ছিন্নভাবে অনেকে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তাতে হয়তো কিছু কিছু কাজ হয়েছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে তা সম্পন্ন হয়নি। রংপুর বিভাগের সব বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য এবার জন্ম হয়েছে একটি সংগঠনের। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য চৌধুরী খালেকুজ্জামান রংপুর বিভাগের সব বধ্যভূমির স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে 'রংপুর বিভাগীয় বধ্যভূমি সংরক্ষণ সমন্বয় পরিষদ' নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই সংগঠনের সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমি বধ্যভূমিগুলোর করুণ অবস্থা দেখে মর্মাহত হয়েছি। সরকার মুক্তিযুদ্ধ-সংশ্লিষ্ট এই মহান দায়িত্ব স্বাধীনতার চার দশকে পালন করেনি। তাই বলে অভিমান করে ব্যক্তিগত উদ্যোগকে দমিয়ে রাখাও সংগত হবে না। এ জন্য যেসব এলাকায় বধ্যভূমিগুলো আছে, সেগুলোকে অমরত্ব দান করার লক্ষ্যে স্থানীয়ভাবে আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চেষ্টাকে একত্র করে অন্তত একটি করে স্মৃতির মিনার নির্মাণ করতে হবে, যেখানে শহীদদের নামের তালিকা যুক্ত থাকবে। এ কথা তো ঠিক, যাঁরা এই বধ্যভূমিতে শায়িত আছেন, তাঁরা আমাদের কারো ভাই, কারো মা, কারো বাবা, কারো বোন। আমাদের বাবা-মা, ভাইবোনদের বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের ব্যক্তিগতভাবেও কোনো অংশে কম নয়। রাষ্ট্রের ভেতরকার যেকোনো কাজে আমাদের সবার দায়িত্ব রয়েছে। সেই দায়িত্ব পালন করতে হলেও আমাদের বধ্যভূমিগুলোর সংরক্ষণে সাধ্যমতো চেষ্টা প্রয়োজন। বাঙালি জাতি যত দিন বেঁচে থাকবে, তত দিন বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদের বধ্যভূমিগুলোকে। রংপুরের বধ্যভূমি সংরক্ষণ সমন্বয় পরিষদকে দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করে সারা দেশেই বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
লেখক : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
'একাত্তর' শব্দটি আমাদের আবেগের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ সালটি আমাদের চেতনার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ সালের নারকীয় ঘটনাগুলো আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বেদনার। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে শুরু হয় ভয়াবহ নির্বিচার গণহত্যা। এরই ধারাবাহিকতায় বিজয়ের দিন পর্যন্ত পাকিস্তানি শক্তি এবং পাকিস্তানের দোসর আমাদের শত্রুশক্তি এই গণহত্যা অব্যাহত রেখেছিল। আমাদের মুখোশ বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ যত কথা ফেনিয়ে ওঠে, মুখোশটা আড়াল করলে আর সেই চেতনাসমৃদ্ধ রূপটি অবলোকন করা যায় না। তখন কেবলই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা আর ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা। সেখানে খুব অল্পই স্বাধীনতাকেন্দ্রিক মুখশ্রী। ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার নিমিত্তে আমরা যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্যবহার করছি। আমরা স্বাধীনতার চার দশকে মুক্তিযোদ্ধাদের না পেরেছি সম্মানিত করতে, না পেরেছি তাঁদের স্মৃতিচিহ্নকে অম্লান করে রাখার উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে। বর্ণনাতীত যেসব নির্মম গণহত্যা হয়েছে, আমরা কি সেই গণহত্যার স্থানগুলো চিহ্নিত করে সেখানে শহীদ হওয়া ব্যক্তিদের নামাঙ্কিত কোনো মিনার নির্মাণ করেছি? করিনি, এ কথা বললে সত্যের অপলাপ করা হয়। কিন্তু করার মাত্রা এতটাই সীমিত যে তাতে আমাদের লজ্জা ঢাকে না, বরং নির্লজ্জ রূপটাই প্রকাশ পায়। আমরা যারা স্বাধীনতা-উত্তরকালে জন্মগ্রহণ করেছি, তারা দুঃসহ দিনগুলো দেখিনি। কিন্তু দুঃসহ দিনের বর্ণনা শুনে যাদের অশ্রুসিক্ত হতে হয়, সেসব দিনের স্মৃতিচারণা শুনে যাদের শিহরিত হতে হয়, তারা যখন দেখি, মুক্তিযোদ্ধারা অবহেলিত, শহীদদের স্মৃতিচিহ্ন অম্লান করে রাখার কোনো আন্তরিক প্রচেষ্টা নেওয়া হয় না, তখন আমরা শুধু মানসিকভাবেই আহত হই না, বরং তখন আমরা নিজেদের অপরাধী মনে করি। আমাদের কাছে মনে হয়, তবে কি স্বাধীনতার চেতনা ভূলুণ্ঠিত হওয়ার পথে। '৭১-পরবর্তী সময়ে চার দশক ধরে রাষ্ট্র পর্যন্ত বাংলাদেশের বধ্যভূমি সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুঁজি করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে যারা ক্ষমতাসীন হয়েছে, তারাও সারা দেশের বধ্যভূমিগুলোকে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বিচ্ছিন্নভাবে অনেকে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তাতে হয়তো কিছু কিছু কাজ হয়েছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে তা সম্পন্ন হয়নি। রংপুর বিভাগের সব বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য এবার জন্ম হয়েছে একটি সংগঠনের। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য চৌধুরী খালেকুজ্জামান রংপুর বিভাগের সব বধ্যভূমির স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে 'রংপুর বিভাগীয় বধ্যভূমি সংরক্ষণ সমন্বয় পরিষদ' নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই সংগঠনের সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমি বধ্যভূমিগুলোর করুণ অবস্থা দেখে মর্মাহত হয়েছি। সরকার মুক্তিযুদ্ধ-সংশ্লিষ্ট এই মহান দায়িত্ব স্বাধীনতার চার দশকে পালন করেনি। তাই বলে অভিমান করে ব্যক্তিগত উদ্যোগকে দমিয়ে রাখাও সংগত হবে না। এ জন্য যেসব এলাকায় বধ্যভূমিগুলো আছে, সেগুলোকে অমরত্ব দান করার লক্ষ্যে স্থানীয়ভাবে আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চেষ্টাকে একত্র করে অন্তত একটি করে স্মৃতির মিনার নির্মাণ করতে হবে, যেখানে শহীদদের নামের তালিকা যুক্ত থাকবে। এ কথা তো ঠিক, যাঁরা এই বধ্যভূমিতে শায়িত আছেন, তাঁরা আমাদের কারো ভাই, কারো মা, কারো বাবা, কারো বোন। আমাদের বাবা-মা, ভাইবোনদের বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের ব্যক্তিগতভাবেও কোনো অংশে কম নয়। রাষ্ট্রের ভেতরকার যেকোনো কাজে আমাদের সবার দায়িত্ব রয়েছে। সেই দায়িত্ব পালন করতে হলেও আমাদের বধ্যভূমিগুলোর সংরক্ষণে সাধ্যমতো চেষ্টা প্রয়োজন। বাঙালি জাতি যত দিন বেঁচে থাকবে, তত দিন বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদের বধ্যভূমিগুলোকে। রংপুরের বধ্যভূমি সংরক্ষণ সমন্বয় পরিষদকে দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করে সারা দেশেই বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
লেখক : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
No comments