সময়ের প্রতিধ্বনি-সোনিয়া চাইলে বাংলাদেশকে নিয়েই এগোতে পারে ভারত by মোস্তফা কামাল

যদি প্রশ্ন করা হয়, এ মুহূর্তে ভারতে সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষটি কে? জবাবে যে কেউ বলবেন, সোনিয়া গান্ধী। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীর তালিকায়ও তাঁর নাম রয়েছে। তিনি ক্ষমতায় নেই, কিন্তু ক্ষমতা তাঁর পদতলে গড়াগড়ি খায়। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্ব ও কৌশলের কারণে পর পর দুবার এনডিএ জোট শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে।


ভারতীয় রাজনীতির জটিল ও কুটিল মারপ্যাঁচের খেলায় সোনিয়া বাজিমাত করেই চলেছেন। ভারতের জাঁদরেল রাজনীতিকরাও তাঁর কাছে হার মানছেন। প্রতিমুহূর্তেই তিনি কৌশল আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছেন। ছেলে রাহুল গান্ধীকে তৈরি করছেন নিজের মতো করে।
২০০৪ সালে বিজেপি (ভারতীয় জনতা পার্টি) জোটকে পরাজিত করে সোনিয়ার নেতৃত্বাধীন এনডিএ (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স) বিজয় লাভ করে। তখন সোনিয়া গান্ধীর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়া ছিল সময়ের ব্যাপার। ঠিক সেই মুহূর্তে হিন্দুত্ববাদের ধ্বজাধারী বিজেপি 'বিদেশিনী' ইস্যুতে মাঠ গরমের চেষ্টা করল। তারা মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারণা চালাল যে, কোনো বিদেশিনী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন না। যদিও ১৯৮৩ সালেই সোনিয়া ইতালীয় পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। সেই থেকে তিনি সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় নাগরিক।
তার পরও বিরোধীদের সমালোচনা সহ্য করতে হলো তাঁকে। তিনি বিরোধীদের সমালোচনা গ্রহণ করলেন এবং স্থির করলেন, প্রধানমন্ত্রীর পদ তিনি নেবেন না। এর আগেও, ১৯৯১ সালে সোনিয়ার স্বামী রাজীব গান্ধী নিহত হওয়ার পর সোনিয়া গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসানোর ব্যাপক চেষ্টা-তদবির হয়েছিল। কংগ্রেসের তৎকালীন নেতারা বারবার তাঁর কাছে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হননি। পরে নরসিমা রাওকে প্রধানমন্ত্রী করা হলো। সোনিয়া থাকলেন রাজনীতির আড়ালে।
২০০৪ সালে সোনিয়ার নেতৃত্বাধীন জোটের বিপুল বিজয়ের পরও প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ না করায় সোনিয়ার জনপ্রিয়তা ও ভাবমূর্তি যেন আকাশ ছুঁয়ে গেল। তিনি যে নির্লোভ, নির্মোহ হতে পারেন_তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। সেই সঙ্গে ভারতীয় রাজনীতিকদের শিখিয়ে দিলেন, একেই বলে রাজনীতি। যিনি ত্যাগ করতে জানেন না, তিনি আবার কিসের রাজনীতিক! যদিও আমাদের উপমহাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিই হচ্ছে ভোগের, ত্যাগের নয়। ক্ষমতায় থেকে যতভাবে, যত ধরনের সুযোগ নেওয়া যায় তা রাজনীতিকরা নিয়ে থাকেন। সোনিয়া এর ব্যতিক্রম বলেই ভারতের মতো দেশে শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছেন। এখনো সোনিয়া গান্ধীর জনপ্রিয়তায় এতটুকুও ভাটা পড়েনি। তাঁকে বিপদে ফেলতে ভারতে নানামুখী ষড়যন্ত্র হলেও তিনি সেগুলো সামলাতে সচেষ্ট রয়েছেন। তিনি সরকারে নেই, তবু তিনি সর্বত্র বিরাজমান। তিনি পেছন থেকে সরকারকে সঠিক পথে চলার দিকনির্দেশনা দেন। কখনো কখনো নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে সরকারকে আগলে রাখছেন।
আমরা সোনিয়ার রাজনৈতিক জীবনের দিকে একটু দৃষ্টি দিতে পারি। রাজনীতিতে তাঁর যাত্রা খুব বেশি দিনের নয়। ইতালীয় বংশোদ্ভূত সোনিয়া ক্যামব্রিজে পড়ার সুবাদে ১৯৬৫ সালে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে পরিচিত হন। ১৯৬৮ তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। ওই বছরই তিনি ভারতে চলে আসেন। রাজীব ভারতীয় এয়ারলাইন্সের পাইলট ছিলেন। রাজনীতির চৌহদ্দির মধ্যেও তিনি এবং সোনিয়া আসেননি। আগ্রহও প্রকাশ করেননি কোনোদিন। ১৯৮০ সালে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন রাজীবের ভাই সঞ্জয় গান্ধী। সঞ্জয়ই মূলত মায়ের হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছিলেন। তাঁর অকালমৃত্যুর পরও রাজীব রাজনীতিতে আসতে চাননি।
১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর ইন্দিরা গান্ধী নিহত হওয়ার পর রাজীব গান্ধী রাজনীতিতে আসেন অনেকটা বাধ্য হয়েই। কারণ তিনি ছাড়া তখন হাল ধরার মতো কেউ ছিলেন না। তখনো সোনিয়া রাজনীতির ধারেকাছে আসেননি। তিনি প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। কিংবা বিদেশ সফরে যেতেন। রাজীব নিহত হওয়ার পরও তাঁকে রাজনীতিতে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি রাজনীতিতে আসতে রাজি হননি। কংগ্রেস যখন মারাত্মকভাবে ক্ষতবিক্ষত, সাংগঠনিকভাবে দুর্বল এবং বিভ্রান্ত ও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিল; তখন, অর্থাৎ ১৯৯৭ সালে তিনিও স্বামী রাজীবের মতো কংগ্রেসের হাল ধরেন বাধ্য হয়েই। ১৯৯৮ সালেই তিনি কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। পরের বছরই তিনি লোকসভায় বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন। বিজেপির অটল বিহারি বাজপেয়ি হন প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কংগ্রেসের হাল ধরে আছেন সোনিয়া গান্ধী। একই সঙ্গে তিনি গান্ধী পরিবারের ঐতিহ্য কাঁধে বহন করছেন নিষ্ঠার সঙ্গে।
গান্ধী পরিবারের সঙ্গে শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ইন্ধিরা গান্ধী অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি তখন সমর্থন এবং সহযোগিতা না দিলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এত সহজে সম্ভব হতো কি না সন্দেহ। মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল লাখ লাখ বাংলাদেশি। তাদের আশ্রয় ও খাদ্য সাহায্য দিয়েছিল ইন্দিরা গান্ধী সরকার। অগণিত মুক্তিযোদ্ধা ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যৌথভাবে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার পরই দ্রুততম সময়ের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনেই ইন্দিরা গান্ধী ভূমিকা রাখেননি; তিনি তখন সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। আবার যখন বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় সৈন্যদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রসঙ্গ এল তখনো ইন্দিরা গান্ধী কালক্ষেপণ না করে বঙ্গবন্ধুর মত অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিলেন।
ভারতের সেই ভূমিকাকে বাংলাদেশের জনগণ সব সময় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। সেই ভূমিকার জন্য ভারতের কাছে বাংলাদেশ কৃতজ্ঞতা জানায়। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইন্দিরা গান্ধীর সেই ঐতিহাসিক ভূমিকার স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে। ইন্দিরা গান্ধীকে বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করতে সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে। ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে সেই সম্মাননা গ্রহণ করবেন তাঁরই পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধী। তিনি অটিস্টিক শিশুদের বিশেষ সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদানের জন্য ২৫ জুলাই ঢাকায় আসছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
আমরা জানি, গান্ধী ও শেখ পরিবারের মধ্যে ঐতিহাসিক সেই সম্পর্কের ধারাবাহিকতা এখনো বিরাজমান। ভারতের শাসনক্ষমতা যেমন এখন গান্ধী পরিবারের হাতে; বাংলাদেশের শাসনক্ষমতাও শেখ মুজিব পরিবারের হাতে। দুই পরিবারের সুসম্পর্ক দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে। দু্ই পরিবার আন্তরিকভাবে চাইলেই দুই দেশের সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই এই সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। হাতছাড়া করা উচিত হবে না।
ঢাকায় শেখ হাসিনা ভারতের ক্ষমতাসীন জোটের নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক করবেন। বৈঠকে দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিশ্চয়ই তোলা হবে। এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা তিস্তার পানি বণ্টন, সীমানা চিহ্নিতকরণ ও সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, বাণিজ্য ঘাটতি দূর করতে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পেতে সোনিয়া গান্ধীর সহযোগিতা চাইতে পারেন। দুই দেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সিদ্ধান্তগুলো দশকের পর দশক ধরে ঝুলে আছে। ৪০ বছর পরও যদি অমীমাংসিত সমস্যাগুলো ঝুলে থাকে, আর কবে সেগুলোর সমাধান হবে? গান্ধী ও শেখ পরিবারের যে পারিবারিক বন্ধন রয়েছে তা যদি দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে প্রভাব ফেলতে না পারে তাহলে আর কোনোদিনই সমস্যার সমাধান হবে না।
আমরা মনে করি, সোনিয়া গান্ধী চাইলে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখতে পারেন। ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে সহযোগিতা দিয়েছিলেন বলেই বাংলাদেশ দ্রুত স্বাধীন হয়েছিল। এখন বাংলাদেশের সমৃদ্ধি অর্জনে তাঁর পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধী সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। আমরা বিশ্বাস করি, সোনিয়া গান্ধী উদ্যোগ নিলেই দুই দেশের অমীমাংসিত সমস্যা দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে শুধু সোনিয়া গান্ধীর দিকনির্দেশনা দরকার। তাঁর নির্দেশনা নিশ্চয়ই ভারত সরকার অবহেলা কিংবা অমান্য করবে না। ঢাকায় তিনি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করলে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং তা বাস্তবায়নের ব্যাপারে গুরুত্ব দেবেন।
আমরা এও জানি, গান্ধী ও শেখ পরিবারের সুসম্পর্কের ইতিবাচক প্রভাবেই দুই দেশের মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিরাজ করছে। কিন্তু এই সুসম্পর্ক যদি দুই দেশের স্বার্থে কাজেই না লাগল তাহলে আর এর কী মূল্য থাকল? পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি যা-ই বলুন, এখনই ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া বর্তমান সরকারের জন্য খুবই কঠিন। দিলি্লতে প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের যে বৈঠক হয়েছিল সেখানে শুধু ভারত নয়, নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট বিনিময় প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে ভারতকে আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আগে ভারতকেই হাত খুলে বাংলাদেশকে কিছু দিতে হবে।
ভারত এককভাবে নয়, বাংলাদেশকে নিয়েই অগ্রসর হতে চায়_সেটা বোঝাতে হবে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও যাতে ভারতীয় মনোভাব উপলব্ধি করতে পারে। তবে এটা ঠিক, সোনিয়া গান্ধী চাইলে বাংলাদেশকে নিয়েই ভারত এগোতে পারে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.