কৃষি-কৃষকের হতাশা ও সাশ্রয়ী সেচ ব্যবস্থা by নূরুননবী শান্ত
কৃষকের কাছে সেচ যখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন সরকার উদ্বিগ্ন না হলেও কৃষির সঙ্গে জড়িত নয় এমন সাধারণ মানুষও অস্বস্তিতে ভুগছেন, বিশেষ করে যাদের চাল কিনে খেতে হয়। তাদের অনেকেই আবার নিজের সীমিত অভিজ্ঞতা পুঁজি করে চেষ্টা করে যাচ্ছেন সাশ্রয়ী সেচের নিজস্ব পদ্ধতি প্রয়োগ করতে বাংলাদেশে এখন সেচ মৌসুম চলছে।
বিদ্যুৎ ও অন্যান্য অপরিহার্য জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে প্রতিদিনের চাহিদা মেটাতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষিনির্ভর মানুষ একদিকে পেরেশান, অন্যদিকে ভবিষ্যৎ ভেবে আতঙ্কিত বোধ করছেন। এমনিতেই গত মৌসুমে ধানের সঠিক মূল্য না পেয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা। তার ওপর উত্তরাঞ্চলের অনেক এলাকাতেই পোকার আক্রমণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ধানের ফলন। এখন এ মৌসুমে অধিক মূল্যে সেচ দিতে গিয়ে দিশাহারা বোধ করছেন কৃষক। রংপুরের পীরগাছা উপজেলার আমডারা গ্রামের ক্ষুদ্র কৃষক আবদুল মতিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, 'জমিত্ পানি দিতে যায়া আবাদ-সুবাদের ওপর মন হারায়ে ফেলতেছি।' দৃশ্যত কৃষকের মনোবল ভেঙে পড়েছে। এ অবস্থায় অনেকেরই মনে হচ্ছে, কৃষি উৎপাদন কমে যাবে। সেটা যদি ঘটে, তবে আমাদের এখনকার টালমাটাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে পেঁৗছবে_ অনুমান করতেও দ্বিধা হচ্ছে।
কৃষকের কাছে সেচ যখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন সরকার উদ্বিগ্ন না হলেও কৃষির সঙ্গে জড়িত নয় এমন সাধারণ মানুষও অস্বস্তিতে ভুগছেন, বিশেষ করে যাদের চাল কিনে খেতে হয়। তাদের অনেকেই আবার নিজের সীমিত অভিজ্ঞতা পুঁজি করে চেষ্টা করে যাচ্ছেন সাশ্রয়ী সেচের নিজস্ব পদ্ধতি প্রয়োগ করতে। যেহেতু বিদ্যুৎ-ডিজেলের মূল্যের ওপর জনগণের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, তাই সেচের পানির অপচয় রোধ করার উপায় নিয়ে কত কসরতই না করছেন কৃষিনির্ভর মানুষ। কারণ জমিতে দেওয়া সেচের পানির পঞ্চাশ শতাংশই ভূমির গভীরে চুঁইয়ে ও ওপরের স্তরের বাষ্পীভবনের ফলে অপচয় হয়। এ নিয়ে একেবারে আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েছেন রংপুর ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজের রসায়নের শিক্ষক একেএম সিরাজুল ইসলাম। তিনি জানান, এ দুটি অপচয় কমানো যায় বিশেষ পদ্ধতিতে সেচ দিলে।
বিগত ছয় বছর পর্যবেক্ষণ করে সিরাজুল ইসলাম দেখেছেন, সাধারণত কৃষক সমতল জমিতে চার থেকে ছয় ইঞ্চি পানি দেন। এতে প্রতি একরে প্রতিবার সেচে কমপক্ষে পাঁচ লাখ লিটার পানি দিতে হয়। এ পরিমাণ পানির অধিক চাপের কারণে অনেক বেশি পরিমাণ পানি দ্রুত চুঁইয়ে মাটির গভীরে চলে যায়। অন্যদিকে বেশি পরিমাণ পানিতে অণুুর সংখ্যা বেশি হওয়ায় এ পানিতে সূর্যের তাপ অধিক পরিমাণে শোষিত হয়। ফলে পানির উপরিপৃষ্ঠে বাষ্পীভবনের হার দ্রুততর হয়। অর্থাৎ ফসলের জমিতে একবারে বেশি সেচ দিলে দু'ভাবেই অনিবার্য অপচয় হচ্ছে। অধিকন্তু বেশি পরিমাণ পানির চাপের কারণে মাটির পুষ্টি উপাদানও বেশি গভীরে চলে যায়, যতটা গভীরে ধানের মতো উদ্ভিদের মূল পেঁৗছে না। সিরাজুল ইসলাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন, সেচ শুরুর প্রথম ১৫ দিন সমতল জমির মাটির গুণগত তারতম্যভেদে তিন থেকে ছয় দিন অন্তর এক থেকে দেড় ইঞ্চি পরিমাণ পানি অর্থাৎ প্রতি একরে কমপক্ষে এক লাখ লিটার পানি সেচ দিলে পানির প্রাকৃতিক অপচয় অনেকটাই রোধ করা যায়। তবে ১৫ দিন পর পরবর্তী ৫০ দিন অবশ্যই দুই ইঞ্চি করে পানি দিতে হবে। স্বল্প গভীরতার পানির অনুস্রাবণ বা চুঁইয়ে মাটির গভীরে প্রবেশ করার এবং বাষ্পীভবনের পরিমাণ অনেক কম হয়। সিরাজুল ইসলাম নিজের মতো হিসাব করে দেখেছেন, কম পরিমাণ পানি সেচ দিয়ে অপচয় অর্ধেকে নামিয়ে এনে সেচের খরচ যেমন সাশ্রয় করা সম্ভব, তেমনি ফসল উৎপাদনও যথেষ্ট ভালো হয়। তবে কৃষককে সতর্ক থাকতে হবে, জমির নরম মাটিতে পায়ের চাপে সৃষ্ট ছোট ছোট গর্তে এক সুত অর্থাৎ এক ইঞ্চির আট ভাগের এক ভাগ পানি পরিলক্ষিত হলেই পরবর্তী সেচ দিতে হবে।
সিরাজুল ইসলাম দীর্ঘদিন টবে, প্রশস্ত পাত্রে ও নিজ এলাকার কৃষকের জমিতে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে সেচের খরচ অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পেরেছেন বলে দাবি করেন। সুতরাং কৃষক তাকে অনুসরণ করে সেচের পানির অপচয় রোধ করার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। সিরাজুল মনে করেন, তার পদ্ধতিতে সেচ দিলে এক বোরো মৌসুমে কেবল রংপুর অঞ্চলেই ৪০০ কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।
তবে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার আমডারা গ্রামের দরিদ্র কৃষক মনে করেন, সবকিছুর পরও জমিতে পানি ও সারের খরচ আর হয়তো তাদের সাধ্যের মধ্যে আসবে না। এখন তারা ফসল বিক্রি করে উৎপাদন খরচই তুলতে পারছেন না। তারা চান না তাদের সন্তানরাও বড় হয়ে কৃষক থাকুক। কৃষিকাজ করা আর দারিদ্র্যকে বরণ করে নেওয়া এ দেশে সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ বেঁচে থাকার প্রধান উপকরণ খাদ্যের জোগান আসে কৃষি থেকেই। মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও হতাশার সাগরে পতিত কৃষকের মনোবল ফিরিয়ে আনতে সরকারকে বিশেষভাবে ভাবতে হবে।
সেচ বিষয়ক ওয়েবসাইটগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে 'দ্য প্র্যাকটিস অব ইরিগেশন' নামে একটি রচনায় চোখ আটকে গেল। বলা হচ্ছে, ইতিহাসখ্যাত পারস্য ও মেসোপটেমিয়ার মতো সভ্যতা ধ্বংসের অন্যতম কারণ সেখানকার কৃষিকাজে সৃষ্ট সেচ সংকট। আমরা নিশ্চয় তেমন ভয়াবহতা কামনা করি না।
নূরুননবী শান্ত : গল্পকার ও কলাম লেখক
shantonabi@gmail.com
কৃষকের কাছে সেচ যখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন সরকার উদ্বিগ্ন না হলেও কৃষির সঙ্গে জড়িত নয় এমন সাধারণ মানুষও অস্বস্তিতে ভুগছেন, বিশেষ করে যাদের চাল কিনে খেতে হয়। তাদের অনেকেই আবার নিজের সীমিত অভিজ্ঞতা পুঁজি করে চেষ্টা করে যাচ্ছেন সাশ্রয়ী সেচের নিজস্ব পদ্ধতি প্রয়োগ করতে। যেহেতু বিদ্যুৎ-ডিজেলের মূল্যের ওপর জনগণের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, তাই সেচের পানির অপচয় রোধ করার উপায় নিয়ে কত কসরতই না করছেন কৃষিনির্ভর মানুষ। কারণ জমিতে দেওয়া সেচের পানির পঞ্চাশ শতাংশই ভূমির গভীরে চুঁইয়ে ও ওপরের স্তরের বাষ্পীভবনের ফলে অপচয় হয়। এ নিয়ে একেবারে আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েছেন রংপুর ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজের রসায়নের শিক্ষক একেএম সিরাজুল ইসলাম। তিনি জানান, এ দুটি অপচয় কমানো যায় বিশেষ পদ্ধতিতে সেচ দিলে।
বিগত ছয় বছর পর্যবেক্ষণ করে সিরাজুল ইসলাম দেখেছেন, সাধারণত কৃষক সমতল জমিতে চার থেকে ছয় ইঞ্চি পানি দেন। এতে প্রতি একরে প্রতিবার সেচে কমপক্ষে পাঁচ লাখ লিটার পানি দিতে হয়। এ পরিমাণ পানির অধিক চাপের কারণে অনেক বেশি পরিমাণ পানি দ্রুত চুঁইয়ে মাটির গভীরে চলে যায়। অন্যদিকে বেশি পরিমাণ পানিতে অণুুর সংখ্যা বেশি হওয়ায় এ পানিতে সূর্যের তাপ অধিক পরিমাণে শোষিত হয়। ফলে পানির উপরিপৃষ্ঠে বাষ্পীভবনের হার দ্রুততর হয়। অর্থাৎ ফসলের জমিতে একবারে বেশি সেচ দিলে দু'ভাবেই অনিবার্য অপচয় হচ্ছে। অধিকন্তু বেশি পরিমাণ পানির চাপের কারণে মাটির পুষ্টি উপাদানও বেশি গভীরে চলে যায়, যতটা গভীরে ধানের মতো উদ্ভিদের মূল পেঁৗছে না। সিরাজুল ইসলাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন, সেচ শুরুর প্রথম ১৫ দিন সমতল জমির মাটির গুণগত তারতম্যভেদে তিন থেকে ছয় দিন অন্তর এক থেকে দেড় ইঞ্চি পরিমাণ পানি অর্থাৎ প্রতি একরে কমপক্ষে এক লাখ লিটার পানি সেচ দিলে পানির প্রাকৃতিক অপচয় অনেকটাই রোধ করা যায়। তবে ১৫ দিন পর পরবর্তী ৫০ দিন অবশ্যই দুই ইঞ্চি করে পানি দিতে হবে। স্বল্প গভীরতার পানির অনুস্রাবণ বা চুঁইয়ে মাটির গভীরে প্রবেশ করার এবং বাষ্পীভবনের পরিমাণ অনেক কম হয়। সিরাজুল ইসলাম নিজের মতো হিসাব করে দেখেছেন, কম পরিমাণ পানি সেচ দিয়ে অপচয় অর্ধেকে নামিয়ে এনে সেচের খরচ যেমন সাশ্রয় করা সম্ভব, তেমনি ফসল উৎপাদনও যথেষ্ট ভালো হয়। তবে কৃষককে সতর্ক থাকতে হবে, জমির নরম মাটিতে পায়ের চাপে সৃষ্ট ছোট ছোট গর্তে এক সুত অর্থাৎ এক ইঞ্চির আট ভাগের এক ভাগ পানি পরিলক্ষিত হলেই পরবর্তী সেচ দিতে হবে।
সিরাজুল ইসলাম দীর্ঘদিন টবে, প্রশস্ত পাত্রে ও নিজ এলাকার কৃষকের জমিতে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে সেচের খরচ অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পেরেছেন বলে দাবি করেন। সুতরাং কৃষক তাকে অনুসরণ করে সেচের পানির অপচয় রোধ করার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। সিরাজুল মনে করেন, তার পদ্ধতিতে সেচ দিলে এক বোরো মৌসুমে কেবল রংপুর অঞ্চলেই ৪০০ কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।
তবে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার আমডারা গ্রামের দরিদ্র কৃষক মনে করেন, সবকিছুর পরও জমিতে পানি ও সারের খরচ আর হয়তো তাদের সাধ্যের মধ্যে আসবে না। এখন তারা ফসল বিক্রি করে উৎপাদন খরচই তুলতে পারছেন না। তারা চান না তাদের সন্তানরাও বড় হয়ে কৃষক থাকুক। কৃষিকাজ করা আর দারিদ্র্যকে বরণ করে নেওয়া এ দেশে সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ বেঁচে থাকার প্রধান উপকরণ খাদ্যের জোগান আসে কৃষি থেকেই। মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও হতাশার সাগরে পতিত কৃষকের মনোবল ফিরিয়ে আনতে সরকারকে বিশেষভাবে ভাবতে হবে।
সেচ বিষয়ক ওয়েবসাইটগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে 'দ্য প্র্যাকটিস অব ইরিগেশন' নামে একটি রচনায় চোখ আটকে গেল। বলা হচ্ছে, ইতিহাসখ্যাত পারস্য ও মেসোপটেমিয়ার মতো সভ্যতা ধ্বংসের অন্যতম কারণ সেখানকার কৃষিকাজে সৃষ্ট সেচ সংকট। আমরা নিশ্চয় তেমন ভয়াবহতা কামনা করি না।
নূরুননবী শান্ত : গল্পকার ও কলাম লেখক
shantonabi@gmail.com
No comments