ক্রসফায়ার বন্ধে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশঃ উচ্চ আদালতই ভরসা


বশেষে উচ্চ আদালতকে এক পা বাড়িয়ে ক্রসফায়ার বন্ধ রাখতে যে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ জারি করতে হয়েছে সেটাকে বতৃমান সরকারের আমলে মানবাধিকার লংঘনরোধে এক বলিষ্ঠ আইনী পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা যায়। তার আগে আদালতের স্বপ্রণোদিত রুল জারি সত্ত্বেও ক্রসফায়ার বন্ধ হয়নি।
রুলের জবাব দিতে সরকার পক্ষের বারবার সময় প্রার্থনার ফাঁকে ১১ জনকে ক্রসফায়ারের বলি হতে হয়েছে। সর্বশেষ শুনানির দিন ১৪ ডিসেম্বর আবারও সময় চাওয়া হলে আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে ‘সময় দিলে তো এর মধ্যে ক্রসফায়ারে আরও ৫০ জন মানুষ হত্যা করা হবে’ মন্তব্য করেন। অবশেষে শীতকালীন ছুটির পর শুনানির পরবর্তী দিন ধার্য করে এ সময়কালে যেন কোনো ক্রসফায়ার না হয় তা নিশ্চিত করতে র্যাবের ডিজির সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। আদালতের এই ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।

এ পর্যন্ত বর্তমান সরকারের আমলেই ১৪১ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে। অথচ আওয়ামী মহাজোটের নির্বাচনী ইশতেহারে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধের অঙ্গীকার করে সব বিচারবহির্ভূত হত্যার বিচার করার কথা বলা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন, দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মেনে নেয়া যায় না, আমরা এমন হত্যাকাণ্ড সমর্থন করি না, যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটাবে তাদের বিচারের সম্মুখীন করা হবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশনের সদস্য পদ লাভের পর জাতিসংঘে অঙ্গীকার করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সরকার যে এসব অঙ্গীকার ভুলে গেছে তার প্রমাণ র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তথাকথিত ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ তালিকা।
মাদারিপুরে র্যাবের ক্রসফায়ারে দুই সহোদর নিহত হওয়ার চাঞ্চল্যকর ঘটনায় গত ১৭ নভেম্বর স্বপ্রণোদিত হয়ে সরকারের ওপর রুল জারি করে উচ্চ আদালত। তারও আগে ২১ জুন কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠনের যৌথভাবে করা রিট আবেদনের শুনানি শেষে সরকারের ওপর রুল জারি করা হয়েছিল। এসবের কোনো সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়ার কথা কেউ বলতে পারবে না। এবারে আদালত কর্তৃক অব্যাহত ক্রসফায়ারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সরকার প্রধানের বিরোধিতা সত্ত্বেও কীভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে সে প্রশ্ন তুলে বলা হয়েছে, এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে না।
উচ্চ আদালতের এই মূল্যায়ন যে বাস্তবসম্মত সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমান সরকার সব সময়ই দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। তবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক তাদের আমলে ক্রসফায়ারের ঘটনা অস্বীকার করার পাশাপাশি কোনো কোনো মন্ত্রীর বিষয়টি নিয়ে ভিন্ন মত প্রকাশ সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি করে। গত ১২ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী ক্রসফায়ার প্রসঙ্গ তুলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আত্মরক্ষার অধিকারের কথা বলেছেন। সাবেক প্রতিমন্ত্রীও অনুরূপ মন্তব্য করে ক্রসফায়ারের পক্ষে যুক্তি দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। আর নৌপরিবহনমন্ত্রী গত অক্টোবরে বিবিসি সংলাপে এবং নারায়ণগঞ্জের এক অনুষ্ঠানে পরিষ্কারভাবে বলেছেন, ক্রসফায়ার ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব নয়। ক্রসফায়ারের মাধ্যমেই একদিন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ হবে। বর্তমান বিচার ব্যবস্থায় সন্ত্রাসীদের বিচার করা সম্ভব নয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এ ধরনের বক্তব্যে তিনি আরও বলেছেন, শান্তির জন্য এনকাউন্টারে সন্ত্রাসী নিহত হলে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় না। দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এ ধরনের বক্তব্য শুধু আইনের শাসন ও মানবাধিকারের পরিপন্থী নয়, সংবিধানে প্রদত্ত সবার জন্য বিচার লাভের অধিকারের পরিপন্থীও—সেটা অস্বীকার করা যাবে না। বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে গভীর মতপার্থক্যের কথা এরপর কীভাবে অস্বীকার করা যাবে? উপর থেকে সবুজ সঙ্কেত ছাড়া র্যাব বা অন্য কারও পক্ষে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত হওয়া সম্ভব এটা বিশ্বাস করা কঠিন। এখন দেখা যাক, সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষায় উচ্চ আদালতের উদ্যোগী ভূমিকার ফলাফল কী হয়। তবে আদালতের এই উদ্যোগের প্রতি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন থাকাই স্বাভাবিক। এর ফলে দেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হবে, এ ভরসা রাখা যায়।

No comments

Powered by Blogger.