চারদিক-মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক
আগামীকাল শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশই চিকিৎসক। তাদের নিয়ে রচিত একটা সুন্দর বইয়ের কথা লিখছি। বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ প্রণীত সাহিত্যপ্রকাশ প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য বই। রচনার প্রসাদগুণে এবং তথ্যের উপস্থাপনায় বইটি পাঠকের মননের জায়গা ছুঁয়ে যায়।
বইটি শুধু একদল পেশাজীবী মানুষের স্বাধীনতার সপক্ষে থাকার বিবরণ মাত্র নয়, স্বাধীনতার মতো বিশাল অর্জনে তাঁদের জীবনদান মূর্ত করে রাখে ইতিহাসের পৃষ্ঠা। এই ইতিহাস আগামী প্রজন্মের জন্য সোনালি অক্ষর। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বইটিকে সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ। শুধু সংখ্যাগত পরিমাপ মাত্র নয়, এতে এসেছে স্বাধীনতার জন্য শহীদ ডাক্তারদের অঙ্গীকারের কথা। শহীদদের কথা বলতে গিয়ে স্বজনেরা বলেছেন হূদয় নিংড়ানো কষ্টের কথা, বলেছেন স্বাধীনতার জন্য তাঁরা যে জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন তার কথা।
প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার এই বইয়ের শুরু হয়েছে ‘জবাবদিহি’ শিরোনাম দিয়ে। ছোট ছোট শিরোনামে লেখক চমৎকারভাবে এই বইয়ের সম্পাদনার কথা বলেছেন। পাশাপাশি এসেছে ইতিহাস, কীভাবে কাজটি করলেন তার কথা ইত্যাদি। শিরোনামগুলো এমন: কেন শুধু শহীদ চিকিৎসক, কারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক, শহীদ চিকিৎসকদের সন্ধানে, এ মনিহার আমায় নাহি সাজে, আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাওনি, যারা গণহত্যা করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক পশু সেইসব পশুদের, চিহ্ন তব পড়ে আছে তুমি হেথা নাই, আলোকের এই ঝর্নাধারায় ধুইয়ে দাও।
এসব শিরোনামের এক জায়গায় তিনি বলেছেন, জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী ডাক্তারসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা নিরপেক্ষ। তাঁরা আক্রমণের শিকার হবেন না। এই পরিপেক্ষিতে শহীদ ডা. শামসুদ্দীন আহমদের কথা বলেছেন। তিনি সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার ছিলেন। একদিন হাসপাতালে যাওয়ার সময় তাঁর চাচা তাঁর হাত ধরে হাসপাতালে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু ডা. শামসুদ্দীন বলেছিলেন, ‘এখনই আমাদের সবচেয়ে বড়ো প্রয়োজন। তা ছাড়া জেনেভা কনভেনশনের শর্ত অনুযায়ী হাসপাতালে যুদ্ধ বা রক্তক্ষয় হওয়ার কথা নয়।’ পাকিস্তানি সেনারা ওয়ার্ডে ঢুকে সবাইকে ধরে এনে গুলি করে। প্রসঙ্গের সূত্র ধরে লেখক গণহত্যাকারীদের বিচারের কথা বলেছেন। ‘বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে এটা অভূতপূর্ব বা ব্যতিক্রমী কোনো বিষয় হবে না।...বিষয়টি প্রতিশোধপরায়নতা নয়, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার, মানবাধিকার সংরক্ষণের বিষয়।’ এভাবে এ বই পাঠকের কাছে নানা তথ্য পৌঁছে দেয়। পাঠককে সচেতন করে তোলার কাজটি করে।
বইটির পরবর্তী অধ্যায়ের শিরোনাম ‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক’। এই অধ্যায়ে ৬৮ জন চিকিৎসকের উল্লেখ করেছেন। তিনি তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি ফর্ম তৈরি করেন। একই সঙ্গে স্বজনদের কাছ থেকে তাঁর লেখা চিঠি, ডায়েরি ইত্যাদি পাওয়ার চেষ্টা করেন। প্রতিটি ভুক্তি খুব গুছিয়ে সাজানো হয়েছে। শহীদদের ছেলেমেয়েদের কথাও তিনি বিবরণ দিয়েছেন। পড়তে পড়তে মনে হয়েছে এভাবে ইতিহাসকে তিনি এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে নিয়ে এসেছেন। যেন সবাই শতকষ্টে বলবে, আমরা তোমাদের ভুলব না।
পরের অধ্যায় ‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মেডিকেল ছাত্র’। যুদ্ধের সময়ে ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও রংপুর মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত ছাত্রদের শহীদ হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। এঁদের জীবনবৃত্তান্তও একইভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে। প্রত্যেক শহীদের সঙ্গে নিকটাত্মীয় যারা শহীদ হয়েছেন তাঁদের উল্লেখও আছে।
বইয়ের পরিশিষ্ট অংশটিও নানা শিরোনামে বিভক্ত। এই অংশে তিনি নানা কিছু অন্তর্ভুক্ত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ যেসব চিকিৎসকের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি তার তালিকা দিয়েছেন। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত চিকিৎসকদের নামের উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) ঢাকার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ শহীদ চিকিৎসকদের অনেকের নাম সঠিকভাবে উৎকীর্ণ হয়নি। যেসব নামে ভুল আছে সেগুলো সংশোধন করে সংযোজন করা হয়েছে। তিনি ৬৯ জন শহীদ চিকিৎসকের নাম সংশোধন করেছেন। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এই বইয়ের তালিকার সংশোধন অনুযায়ী বিএমএ কার্যালয়ের স্মৃতিফলক সংশোধন অবশ্য করণীয় কাজ। এই তালিকায় যেসব শহীদ চিকিৎসকের নাম সংযোজিত হয়নি ডা. বায়জীদ তেমন একটি তালিকা এই বইয়ে যুক্ত করেছেন। আছে আর্মি মেডিকেল কোরের শহীদ চিকিৎসকদের নামের তালিকা; তিনি তাঁদের শেষ কর্মস্থলের উল্লেখ করেছেন। বইটিকে পূর্ণাঙ্গ করার জন্য জীবনকোষের সম্ভাব্য সবদিক তুলে ধরার চেষ্টা কছেন সম্পাদক। একটি গবেষণাকর্মের নিয়মগুলো অনুসরণ করার চেষ্টা করা হয়েছে এই বইয়ে।
বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ পেশায় চিকিৎসক। তিনি এই বইয়ের কাজটি করেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। ২০০৯ সালে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় জেন্ডার ও উন্নয়ন কোষ গন্থটি। এই বইয়ের স্বাস্থ্য অধ্যায়ের অধিকাংশ ভুক্তি রচনা করেন বায়জীদ। তখনই তাঁর নিষ্ঠা এবং কাজের প্রতি আগ্রহ আমাকে মুগ্ধ করে। দেখেছি প্রতিটি যুক্তি তিনি কত যত্ন নিয়ে লিখেছেন। সে সময়ে তিনি বর্তমান বইটি নিয়েও কাজ করছিলেন। এই বইয়ের প্রকাশ আমার জন্য তাই গভীর আনন্দের। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের জন্য তাঁকে জানাই অভিনন্দন।
ইতিহাসের সঠিক উপাদান ধারণ করে রাখেন গবেষক-সম্পাদক-লেখক। আগামী প্রজন্মের জন্য ইতিহাস ধরে রাখার দায়িত্ব বর্তমানের গবেষকের। বায়জীদের বইটি আগামী দিনের গবেষকের রেফারেন্সের কাজ করবে। এটি শুধু প্রত্যাশা নয়, এটি ইতিহাস রচনার সত্য। বইটির শেষ প্রচ্ছদে আছে লেখকের একটি গান।
সেলিনা হোসেন: কথাসাহিত্যিক।
প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার এই বইয়ের শুরু হয়েছে ‘জবাবদিহি’ শিরোনাম দিয়ে। ছোট ছোট শিরোনামে লেখক চমৎকারভাবে এই বইয়ের সম্পাদনার কথা বলেছেন। পাশাপাশি এসেছে ইতিহাস, কীভাবে কাজটি করলেন তার কথা ইত্যাদি। শিরোনামগুলো এমন: কেন শুধু শহীদ চিকিৎসক, কারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক, শহীদ চিকিৎসকদের সন্ধানে, এ মনিহার আমায় নাহি সাজে, আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাওনি, যারা গণহত্যা করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক পশু সেইসব পশুদের, চিহ্ন তব পড়ে আছে তুমি হেথা নাই, আলোকের এই ঝর্নাধারায় ধুইয়ে দাও।
এসব শিরোনামের এক জায়গায় তিনি বলেছেন, জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী ডাক্তারসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা নিরপেক্ষ। তাঁরা আক্রমণের শিকার হবেন না। এই পরিপেক্ষিতে শহীদ ডা. শামসুদ্দীন আহমদের কথা বলেছেন। তিনি সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার ছিলেন। একদিন হাসপাতালে যাওয়ার সময় তাঁর চাচা তাঁর হাত ধরে হাসপাতালে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু ডা. শামসুদ্দীন বলেছিলেন, ‘এখনই আমাদের সবচেয়ে বড়ো প্রয়োজন। তা ছাড়া জেনেভা কনভেনশনের শর্ত অনুযায়ী হাসপাতালে যুদ্ধ বা রক্তক্ষয় হওয়ার কথা নয়।’ পাকিস্তানি সেনারা ওয়ার্ডে ঢুকে সবাইকে ধরে এনে গুলি করে। প্রসঙ্গের সূত্র ধরে লেখক গণহত্যাকারীদের বিচারের কথা বলেছেন। ‘বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে এটা অভূতপূর্ব বা ব্যতিক্রমী কোনো বিষয় হবে না।...বিষয়টি প্রতিশোধপরায়নতা নয়, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার, মানবাধিকার সংরক্ষণের বিষয়।’ এভাবে এ বই পাঠকের কাছে নানা তথ্য পৌঁছে দেয়। পাঠককে সচেতন করে তোলার কাজটি করে।
বইটির পরবর্তী অধ্যায়ের শিরোনাম ‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক’। এই অধ্যায়ে ৬৮ জন চিকিৎসকের উল্লেখ করেছেন। তিনি তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি ফর্ম তৈরি করেন। একই সঙ্গে স্বজনদের কাছ থেকে তাঁর লেখা চিঠি, ডায়েরি ইত্যাদি পাওয়ার চেষ্টা করেন। প্রতিটি ভুক্তি খুব গুছিয়ে সাজানো হয়েছে। শহীদদের ছেলেমেয়েদের কথাও তিনি বিবরণ দিয়েছেন। পড়তে পড়তে মনে হয়েছে এভাবে ইতিহাসকে তিনি এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে নিয়ে এসেছেন। যেন সবাই শতকষ্টে বলবে, আমরা তোমাদের ভুলব না।
পরের অধ্যায় ‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মেডিকেল ছাত্র’। যুদ্ধের সময়ে ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও রংপুর মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত ছাত্রদের শহীদ হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। এঁদের জীবনবৃত্তান্তও একইভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে। প্রত্যেক শহীদের সঙ্গে নিকটাত্মীয় যারা শহীদ হয়েছেন তাঁদের উল্লেখও আছে।
বইয়ের পরিশিষ্ট অংশটিও নানা শিরোনামে বিভক্ত। এই অংশে তিনি নানা কিছু অন্তর্ভুক্ত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ যেসব চিকিৎসকের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি তার তালিকা দিয়েছেন। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত চিকিৎসকদের নামের উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) ঢাকার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ শহীদ চিকিৎসকদের অনেকের নাম সঠিকভাবে উৎকীর্ণ হয়নি। যেসব নামে ভুল আছে সেগুলো সংশোধন করে সংযোজন করা হয়েছে। তিনি ৬৯ জন শহীদ চিকিৎসকের নাম সংশোধন করেছেন। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এই বইয়ের তালিকার সংশোধন অনুযায়ী বিএমএ কার্যালয়ের স্মৃতিফলক সংশোধন অবশ্য করণীয় কাজ। এই তালিকায় যেসব শহীদ চিকিৎসকের নাম সংযোজিত হয়নি ডা. বায়জীদ তেমন একটি তালিকা এই বইয়ে যুক্ত করেছেন। আছে আর্মি মেডিকেল কোরের শহীদ চিকিৎসকদের নামের তালিকা; তিনি তাঁদের শেষ কর্মস্থলের উল্লেখ করেছেন। বইটিকে পূর্ণাঙ্গ করার জন্য জীবনকোষের সম্ভাব্য সবদিক তুলে ধরার চেষ্টা কছেন সম্পাদক। একটি গবেষণাকর্মের নিয়মগুলো অনুসরণ করার চেষ্টা করা হয়েছে এই বইয়ে।
বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ পেশায় চিকিৎসক। তিনি এই বইয়ের কাজটি করেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। ২০০৯ সালে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় জেন্ডার ও উন্নয়ন কোষ গন্থটি। এই বইয়ের স্বাস্থ্য অধ্যায়ের অধিকাংশ ভুক্তি রচনা করেন বায়জীদ। তখনই তাঁর নিষ্ঠা এবং কাজের প্রতি আগ্রহ আমাকে মুগ্ধ করে। দেখেছি প্রতিটি যুক্তি তিনি কত যত্ন নিয়ে লিখেছেন। সে সময়ে তিনি বর্তমান বইটি নিয়েও কাজ করছিলেন। এই বইয়ের প্রকাশ আমার জন্য তাই গভীর আনন্দের। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের জন্য তাঁকে জানাই অভিনন্দন।
ইতিহাসের সঠিক উপাদান ধারণ করে রাখেন গবেষক-সম্পাদক-লেখক। আগামী প্রজন্মের জন্য ইতিহাস ধরে রাখার দায়িত্ব বর্তমানের গবেষকের। বায়জীদের বইটি আগামী দিনের গবেষকের রেফারেন্সের কাজ করবে। এটি শুধু প্রত্যাশা নয়, এটি ইতিহাস রচনার সত্য। বইটির শেষ প্রচ্ছদে আছে লেখকের একটি গান।
সেলিনা হোসেন: কথাসাহিত্যিক।
No comments