যুক্তি তর্ক গল্প-রাজনীতি কি ক্ষমতার চোরাবালিতেই ডুববে? by আবুল মোমেন
সাধারণ মানুষ একান্তভাবেই দেশের ভালো চায়। তাই তারা আশাভঙ্গের মধ্যেও নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়। দেশের অবস্থা নিয়ে তাদের মনে সন্তুষ্টিও নেই, স্বস্তিও নেই। এর প্রভাব পড়ে সাধারণজনের দৃশ্যমান রাজনৈতিক আচরণে। ১৯৯১ থেকে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত চারটি সাধারণ নির্বাচনেই তারা সরকার পরিবর্তন করেছে। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে সাধারণত এমনটা দেখা যায় না।
ব্রিটেনে টনি ব্লেয়ার প্রায় ১২ বছর আর তাঁর শ্রমিক দল পর পর তিন মেয়াদে দেশ শাসন করেছে। তাঁর আগে রক্ষণশীল দলের মার্গারেট থ্যাচারও দীর্ঘ সময় দেশ শাসন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে গত শতাব্দীতে অধিকাংশ প্রেসিডেন্টই দুই মেয়াদে শাসন করেছেন, এক মেয়াদকে বিপর্যয় হিসেবেই গণ্য করা হয়।
ফলে আমাদের দেশে যা ঘটছে তাকে জনগণের মনের অস্বস্তি, অশান্তি ও অস্থিরতার প্রকাশ হিসেবেই ধরা যায়। জনগণ সরকারের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শাসনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুণগত পরিবর্তন প্রত্যাশা করছে। বারবার সরকারে পরিবর্তন ঘটিয়ে জনগণ যুগপৎ তাদের হতাশা ও প্রত্যাশার জানান দিচ্ছে—হতাশা বিদায়ী সরকারের প্রতি, আর প্রত্যাশা বিজয়ী নতুন সরকারের কাছে। আগামী নির্বাচনের সময় আমাদের এই গণতান্ত্রিক অস্থিরতার দুই যুগ পূর্ণ হবে। কিন্তু জনগণের প্রাপ্তির কী হলো? না, জনগণ সেদিক থেকে এখনো হতাশার মধ্যেই হাবুডুবু খাচ্ছে।
জনগণ যে বারবার পরিবর্তন চেয়েছে তা নিশ্চয়ই কেবল সরকারের পরিবর্তন নয়। মানুষের কাম্য হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন। দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আদর্শগত তফাত অবশ্যই আছে এবং তার গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষত আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিচার করলে পুরো পাকিস্তান আমল জুড়ে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে, শেষে রীতিমতো সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে পাকিস্তান ও তার ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। এটা ইতিহাসের একটি বড় অর্জন এবং গৌরবময় অধ্যায় নিঃসন্দেহে। এই উত্তরণের মাধ্যমে অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি। কিন্তু পঁচাত্তরের পর থেকে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে এবং বিএনপি ও জাতীয় পার্টির দীর্ঘ শাসনামলের যে রাজনীতি, তা জনগণের এই রাজনৈতিক অঙ্গীকারকে কবর দিয়ে ফিরে পাকিস্তানি ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিভিত্তিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু করে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আদর্শিক বিচ্যুতির এখান থেকেই শুরু। রাষ্ট্রকে প্রত্যাখ্যাত রাজনীতির পথে ফিরিয়ে নেওয়ার কাজটিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন জিয়াউর রহমান। প্রত্যক্ষ সামরিক শাসন ও ছদ্ম নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের মাধ্যমে জিয়া ও এরশাদ এবং পরে গণতান্ত্রিক আমলে বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতির মাধ্যমে পাকিস্তানপন্থী রাজনীতি তথা মুসলিম লীগের রাজনীতির শক্তিশালী ধারা বাংলাদেশে তৈরি হলো। এই রাজনীতির মূল ধারক দল বিএনপি, এ ছাড়া জাতীয় পার্টি এবং কিছু ইসলামি দল তো রয়েছেই।
এর বিরুদ্ধে আদর্শিক রাজনীতি অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাজনীতি চলেছে আওয়ামী লীগকে সামনে রেখে কিছু প্রগতিশীল দলের সমন্বয়ে। কিন্তু পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। সারা বিশ্বে সমাজতন্ত্রের পতন এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির রমরমার ফলে আদর্শিক রাজনীতি ভীষণ রকম কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।
আমাদের দেশে দেখি অবৈধ পথে ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসকেরা বৈধতার জন্য নানা ধূর্ত পন্থার আশ্রয় নিয়েছেন এবং টাকা-পয়সা, ক্ষমতাবিত্তের ভাগবাটোয়ারার মাধ্যমে রাজনীতিকে চরমভাবে কলুষিত করেছেন। ক্ষমতার সংগ্রামে লিপ্ত থাকা আওয়ামী লীগের পক্ষে এই কলুষ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব ছিল না। এখানেই বাংলাদেশের রাজনীতির জটিল সংকট ও সমীকরণটা বোঝার রয়েছে।
মোটা দাগে বলা যায়, বিএনপি ধারণ করছে আদর্শচ্যুত প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি এবং দুর্নীতিসহ ক্ষমতার নানা কলুষ ও বিকারগ্রস্ত রাজনীতি। এদের সময় অসাম্প্রদায়িক জাতি হিসেবে আমাদের বিকাশ সংকটগ্রস্ত হয়, জেএমবি-হিযবুত তাহিররসহ জঙ্গি ইসলামি শক্তির উত্থান ঘটে, সৌদি-পাক-চীন অক্ষ অধিকতর সক্রিয় হয় এবং সেই সঙ্গে টেন্ডারবাজি, দখলদারি ও হাওয়াভবনীয় বিকার ও কলুষ চলতে থাকে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বঙ্গবন্ধুর খুনি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্ভব হয়, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরে আসে, বাঙালি সংস্কৃতির চর্চাসহ অসাম্প্রদায়িক বাতাবরণে মুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। কিন্তু সেই সঙ্গে টেন্ডারবাজি, দখলদারিসহ সাম্প্রতিক রাজনীতির কলুষ যথারীতি বহাল থাকে।
এর ফলে বিএনপি নিয়ে সমস্যা উভয় দিকেই, মোটা দাগে যাকে আমরা বলতে পারি আদর্শচ্যুত রাজনীতি ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের সমস্যা। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে সমস্যা মূলত একটিই—মোট দাগে দুর্নীতি, যা টেন্ডারবাজি, দখলদারি, অনিয়ম, অদক্ষতা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
না, দিনে দিনে রাজনৈতিক সংকট আরও একটু জটিল ও গভীর হয়েছে। কেবল দুর্নীতি নয়, গণতান্ত্রিক বিকাশ দারুণভাবে ব্যাহত হয়ে রাজনীতি বিত্তবৈভব অর্জন এবং ক্ষমতাবান হওয়ার মাধ্যমে ক্রমে কায়েমি স্বার্থের আস্তানা হয়ে পড়েছে। একদিকে নেতৃত্ব কেন্দ্রীভূত ও স্থবির হয়ে পড়েছে, আর অন্যদিকে অর্থ ও ক্ষমতাকে ঘিরে উপদলীয় কোন্দলে দলগুলো জর্জরিত। দলীয় রাজনীতিকে অগণতান্ত্রিক স্থবিরতা ও অবক্ষয়ের মধ্যে রেখে গণতন্ত্রের বিকাশ কীভাবে সম্ভব? বরং আমরা দেখছি আদর্শের বুলি ঠিক রেখেও আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ধর্মের আমদানি করতে হয়েছে, ধর্মবাদী রাজনীতি ও এজেন্ডার সঙ্গে আপোস করতে হচ্ছে, রাজনীতিতে বিত্তবান ও কালো টাকা-অবৈধ টাকার প্রাধান্য মানতে হয়, অবৈধ অস্ত্র ও মাস্তানির উৎপাত সহ্য করতে হয়, সামরিক বাহিনীকে তোয়াজের রাজনীতিও মানতে হয়। এভাবে দেশের রাজনৈতিক বাতাবরণটি গুমোট, অস্বচ্ছ এবং ক্ষয়িষ্ণু আজ। এর ভেতর থেকে গণতন্ত্রের রাজনীতির বিকাশ এক কঠিন সাধনা। এর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে না আওয়ামী লীগ, বরং নানা রকম আপস ও কৌশল অবলম্বন করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইছে। ফলে রাজনীতিতে চেতনাগত উত্তরণের কোনো প্রক্রিয়া বাকি থাকল না।
ফলে দিনে দিনে রাজনীতি যখন আদর্শ ও দর্শনহীন হয়ে নিছক ক্ষমতা অর্জনের বাহনমাত্র হয়ে পড়ে, তাতে রাজনীতিবিদদের বাস্তব ও কূটবুদ্ধির পরিচয় হয়তো পাওয়া যায়; কিন্তু প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, মহত্ত্ব কিংবা অন্যান্য উচ্চতর মানবিক গুণাবলির প্রয়োজন পড়ে না। এভাবে আজ রাজনীতি কোনো উচ্চ ভাব, আদর্শ বা দর্শনকে ধারণ করছে না, কেবল ক্ষমতাকে ঘিরে ক্ষুদ্র স্থূল লক্ষ্য অর্জনের প্রক্রিয়া হয়ে পড়েছে। ফলে রাজনীতিতে ভিড় বাড়ছে ব্যবসায়ী ও অন্যান্য উচ্চাভিলাষী ভাগ্যান্বেষীদের; হারিয়ে যাচ্ছেন উচ্চ আদর্শ ও চিন্তার মানুষজন। আজ দেশের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির মূল কাণ্ডারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ভাষায় স্বাধীন মতাবলম্বী বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী ব্যক্তিবর্গের সমালোচনা করেন, তাতে শঙ্কিত না হয়ে পারি না। ইতিহাস কি তাঁকে এই সমালোচনা থেকে মুক্তি দেবে যে প্রগতির রাজনীতিতে নেতৃত্বে যখন তিনি, তখন তাতে ক্রমাগত কমেছে প্রগতিচেতনার বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের অংশগ্রহণ। আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধুর আমলে ঠিক উল্টোটি ঘটেছিল—ক্রমেই তাঁর সূচিত রাজনীতিতে প্রগতিচেতনার অগ্রসর মানুষ যুক্ত হয়েছে এবং দেশ তাতে লাভবান হয়েছে।
রাজনীতিতে যখন এভাবে চেতনার ও চিন্তার অগ্রগতি ঘটে, তখনই সমাজ বদলের বা দেশে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের বড় ঘটনা ঘটতে পারে। বায়ান্ন থেকে এভাবেই আমাদের ইতিহাস এগিয়েছে। আর আজ অনেককাল ধরে আমরা যে জাতি ও দেশ হিসেবে এক জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছি, এমনকি পিছিয়ে পড়ছি অনেক ক্ষেত্রে, তার কারণ রাজনীতি আর উচ্চ আদর্শ, দর্শন ও অগ্রসর ভাবনাকে লালন ও ধারণ করছে না। হ্যাঁ লিঙ্কন, গান্ধী, বঙ্গবন্ধু, ম্যান্ডেলার প্রদর্শিত পথ থেকে আমরা বিচ্যুত হয়েছি। তাই বারবার সরকার পরিবর্তন করেও দেশের, মানুষের জীবনে প্রকৃত পরিবর্তন আনতে পারছি না।
চিন্তার অগ্রগতি ছাড়া, পুরোনো বাতিল চিন্তা ছাড়িয়ে নতুন বর্ধিষ্ণু চিন্তার জন্য পথ করে দিতে না পারলে সমাজ এগোবে না। যে যা-ই ভাবুক, শেষ পর্যন্ত রাজনীতি তো ক্ষমতার জন্য নয়, ক্ষমতায় যেতে হবে মানুষের, জাতির, দেশের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য।
আদর্শহীন ক্ষমতার রাজনীতি পাঁকের মতো, চোরাবালির মতো। এর শেষ পরিণতি করুণ মৃত্যু।
ভোগবিলাসের ক্ষমতা ও প্রবণতা বাড়লেই মানুষ এগোয় না, রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদ চিন্তায় এগোলেই কেবল প্রকৃত অগ্রগতি হতে পারে, এভাবে ব্যক্তি ও সমাজের, জাতি ও দেশের তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি ঘটতে পারে এবং যেটুকু এগোবে তা ধরে রাখতে পারবে।
শেখ হাসিনাকে ভাবতে হবে, তিনি কি বর্তমানকালের ধারায় গা ভাসাবেন, নাকি সাহস করে বাবার পথেই অগ্রসর হবেন। আমার ধারণা, সে ভাবনায় উজ্জীবিত হয়ে সেভাবে করণীয় নির্ধারণের এটাই শেষ সময়। এরপর বড্ড দেরি হয়ে যাবে। দিশেহারা দেশ নৈরাজ্যে ডুবে যেতে পারে। তার রূপ কেমন হবে সেটা কেউ বলতে পারে না। তবে ভালো যে হবে না, ভয়াবহ কিছু ঘটবে, সে আশঙ্কা সবার মনেই আছে। সেটা কারও কাম্য হতে পারে না।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
ফলে আমাদের দেশে যা ঘটছে তাকে জনগণের মনের অস্বস্তি, অশান্তি ও অস্থিরতার প্রকাশ হিসেবেই ধরা যায়। জনগণ সরকারের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শাসনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুণগত পরিবর্তন প্রত্যাশা করছে। বারবার সরকারে পরিবর্তন ঘটিয়ে জনগণ যুগপৎ তাদের হতাশা ও প্রত্যাশার জানান দিচ্ছে—হতাশা বিদায়ী সরকারের প্রতি, আর প্রত্যাশা বিজয়ী নতুন সরকারের কাছে। আগামী নির্বাচনের সময় আমাদের এই গণতান্ত্রিক অস্থিরতার দুই যুগ পূর্ণ হবে। কিন্তু জনগণের প্রাপ্তির কী হলো? না, জনগণ সেদিক থেকে এখনো হতাশার মধ্যেই হাবুডুবু খাচ্ছে।
জনগণ যে বারবার পরিবর্তন চেয়েছে তা নিশ্চয়ই কেবল সরকারের পরিবর্তন নয়। মানুষের কাম্য হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন। দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আদর্শগত তফাত অবশ্যই আছে এবং তার গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষত আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিচার করলে পুরো পাকিস্তান আমল জুড়ে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে, শেষে রীতিমতো সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে পাকিস্তান ও তার ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। এটা ইতিহাসের একটি বড় অর্জন এবং গৌরবময় অধ্যায় নিঃসন্দেহে। এই উত্তরণের মাধ্যমে অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি। কিন্তু পঁচাত্তরের পর থেকে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে এবং বিএনপি ও জাতীয় পার্টির দীর্ঘ শাসনামলের যে রাজনীতি, তা জনগণের এই রাজনৈতিক অঙ্গীকারকে কবর দিয়ে ফিরে পাকিস্তানি ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিভিত্তিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু করে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আদর্শিক বিচ্যুতির এখান থেকেই শুরু। রাষ্ট্রকে প্রত্যাখ্যাত রাজনীতির পথে ফিরিয়ে নেওয়ার কাজটিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন জিয়াউর রহমান। প্রত্যক্ষ সামরিক শাসন ও ছদ্ম নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের মাধ্যমে জিয়া ও এরশাদ এবং পরে গণতান্ত্রিক আমলে বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতির মাধ্যমে পাকিস্তানপন্থী রাজনীতি তথা মুসলিম লীগের রাজনীতির শক্তিশালী ধারা বাংলাদেশে তৈরি হলো। এই রাজনীতির মূল ধারক দল বিএনপি, এ ছাড়া জাতীয় পার্টি এবং কিছু ইসলামি দল তো রয়েছেই।
এর বিরুদ্ধে আদর্শিক রাজনীতি অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাজনীতি চলেছে আওয়ামী লীগকে সামনে রেখে কিছু প্রগতিশীল দলের সমন্বয়ে। কিন্তু পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। সারা বিশ্বে সমাজতন্ত্রের পতন এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির রমরমার ফলে আদর্শিক রাজনীতি ভীষণ রকম কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।
আমাদের দেশে দেখি অবৈধ পথে ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসকেরা বৈধতার জন্য নানা ধূর্ত পন্থার আশ্রয় নিয়েছেন এবং টাকা-পয়সা, ক্ষমতাবিত্তের ভাগবাটোয়ারার মাধ্যমে রাজনীতিকে চরমভাবে কলুষিত করেছেন। ক্ষমতার সংগ্রামে লিপ্ত থাকা আওয়ামী লীগের পক্ষে এই কলুষ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব ছিল না। এখানেই বাংলাদেশের রাজনীতির জটিল সংকট ও সমীকরণটা বোঝার রয়েছে।
মোটা দাগে বলা যায়, বিএনপি ধারণ করছে আদর্শচ্যুত প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি এবং দুর্নীতিসহ ক্ষমতার নানা কলুষ ও বিকারগ্রস্ত রাজনীতি। এদের সময় অসাম্প্রদায়িক জাতি হিসেবে আমাদের বিকাশ সংকটগ্রস্ত হয়, জেএমবি-হিযবুত তাহিররসহ জঙ্গি ইসলামি শক্তির উত্থান ঘটে, সৌদি-পাক-চীন অক্ষ অধিকতর সক্রিয় হয় এবং সেই সঙ্গে টেন্ডারবাজি, দখলদারি ও হাওয়াভবনীয় বিকার ও কলুষ চলতে থাকে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বঙ্গবন্ধুর খুনি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্ভব হয়, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরে আসে, বাঙালি সংস্কৃতির চর্চাসহ অসাম্প্রদায়িক বাতাবরণে মুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। কিন্তু সেই সঙ্গে টেন্ডারবাজি, দখলদারিসহ সাম্প্রতিক রাজনীতির কলুষ যথারীতি বহাল থাকে।
এর ফলে বিএনপি নিয়ে সমস্যা উভয় দিকেই, মোটা দাগে যাকে আমরা বলতে পারি আদর্শচ্যুত রাজনীতি ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের সমস্যা। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে সমস্যা মূলত একটিই—মোট দাগে দুর্নীতি, যা টেন্ডারবাজি, দখলদারি, অনিয়ম, অদক্ষতা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
না, দিনে দিনে রাজনৈতিক সংকট আরও একটু জটিল ও গভীর হয়েছে। কেবল দুর্নীতি নয়, গণতান্ত্রিক বিকাশ দারুণভাবে ব্যাহত হয়ে রাজনীতি বিত্তবৈভব অর্জন এবং ক্ষমতাবান হওয়ার মাধ্যমে ক্রমে কায়েমি স্বার্থের আস্তানা হয়ে পড়েছে। একদিকে নেতৃত্ব কেন্দ্রীভূত ও স্থবির হয়ে পড়েছে, আর অন্যদিকে অর্থ ও ক্ষমতাকে ঘিরে উপদলীয় কোন্দলে দলগুলো জর্জরিত। দলীয় রাজনীতিকে অগণতান্ত্রিক স্থবিরতা ও অবক্ষয়ের মধ্যে রেখে গণতন্ত্রের বিকাশ কীভাবে সম্ভব? বরং আমরা দেখছি আদর্শের বুলি ঠিক রেখেও আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ধর্মের আমদানি করতে হয়েছে, ধর্মবাদী রাজনীতি ও এজেন্ডার সঙ্গে আপোস করতে হচ্ছে, রাজনীতিতে বিত্তবান ও কালো টাকা-অবৈধ টাকার প্রাধান্য মানতে হয়, অবৈধ অস্ত্র ও মাস্তানির উৎপাত সহ্য করতে হয়, সামরিক বাহিনীকে তোয়াজের রাজনীতিও মানতে হয়। এভাবে দেশের রাজনৈতিক বাতাবরণটি গুমোট, অস্বচ্ছ এবং ক্ষয়িষ্ণু আজ। এর ভেতর থেকে গণতন্ত্রের রাজনীতির বিকাশ এক কঠিন সাধনা। এর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে না আওয়ামী লীগ, বরং নানা রকম আপস ও কৌশল অবলম্বন করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইছে। ফলে রাজনীতিতে চেতনাগত উত্তরণের কোনো প্রক্রিয়া বাকি থাকল না।
ফলে দিনে দিনে রাজনীতি যখন আদর্শ ও দর্শনহীন হয়ে নিছক ক্ষমতা অর্জনের বাহনমাত্র হয়ে পড়ে, তাতে রাজনীতিবিদদের বাস্তব ও কূটবুদ্ধির পরিচয় হয়তো পাওয়া যায়; কিন্তু প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, মহত্ত্ব কিংবা অন্যান্য উচ্চতর মানবিক গুণাবলির প্রয়োজন পড়ে না। এভাবে আজ রাজনীতি কোনো উচ্চ ভাব, আদর্শ বা দর্শনকে ধারণ করছে না, কেবল ক্ষমতাকে ঘিরে ক্ষুদ্র স্থূল লক্ষ্য অর্জনের প্রক্রিয়া হয়ে পড়েছে। ফলে রাজনীতিতে ভিড় বাড়ছে ব্যবসায়ী ও অন্যান্য উচ্চাভিলাষী ভাগ্যান্বেষীদের; হারিয়ে যাচ্ছেন উচ্চ আদর্শ ও চিন্তার মানুষজন। আজ দেশের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির মূল কাণ্ডারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ভাষায় স্বাধীন মতাবলম্বী বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী ব্যক্তিবর্গের সমালোচনা করেন, তাতে শঙ্কিত না হয়ে পারি না। ইতিহাস কি তাঁকে এই সমালোচনা থেকে মুক্তি দেবে যে প্রগতির রাজনীতিতে নেতৃত্বে যখন তিনি, তখন তাতে ক্রমাগত কমেছে প্রগতিচেতনার বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের অংশগ্রহণ। আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধুর আমলে ঠিক উল্টোটি ঘটেছিল—ক্রমেই তাঁর সূচিত রাজনীতিতে প্রগতিচেতনার অগ্রসর মানুষ যুক্ত হয়েছে এবং দেশ তাতে লাভবান হয়েছে।
রাজনীতিতে যখন এভাবে চেতনার ও চিন্তার অগ্রগতি ঘটে, তখনই সমাজ বদলের বা দেশে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের বড় ঘটনা ঘটতে পারে। বায়ান্ন থেকে এভাবেই আমাদের ইতিহাস এগিয়েছে। আর আজ অনেককাল ধরে আমরা যে জাতি ও দেশ হিসেবে এক জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছি, এমনকি পিছিয়ে পড়ছি অনেক ক্ষেত্রে, তার কারণ রাজনীতি আর উচ্চ আদর্শ, দর্শন ও অগ্রসর ভাবনাকে লালন ও ধারণ করছে না। হ্যাঁ লিঙ্কন, গান্ধী, বঙ্গবন্ধু, ম্যান্ডেলার প্রদর্শিত পথ থেকে আমরা বিচ্যুত হয়েছি। তাই বারবার সরকার পরিবর্তন করেও দেশের, মানুষের জীবনে প্রকৃত পরিবর্তন আনতে পারছি না।
চিন্তার অগ্রগতি ছাড়া, পুরোনো বাতিল চিন্তা ছাড়িয়ে নতুন বর্ধিষ্ণু চিন্তার জন্য পথ করে দিতে না পারলে সমাজ এগোবে না। যে যা-ই ভাবুক, শেষ পর্যন্ত রাজনীতি তো ক্ষমতার জন্য নয়, ক্ষমতায় যেতে হবে মানুষের, জাতির, দেশের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য।
আদর্শহীন ক্ষমতার রাজনীতি পাঁকের মতো, চোরাবালির মতো। এর শেষ পরিণতি করুণ মৃত্যু।
ভোগবিলাসের ক্ষমতা ও প্রবণতা বাড়লেই মানুষ এগোয় না, রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদ চিন্তায় এগোলেই কেবল প্রকৃত অগ্রগতি হতে পারে, এভাবে ব্যক্তি ও সমাজের, জাতি ও দেশের তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি ঘটতে পারে এবং যেটুকু এগোবে তা ধরে রাখতে পারবে।
শেখ হাসিনাকে ভাবতে হবে, তিনি কি বর্তমানকালের ধারায় গা ভাসাবেন, নাকি সাহস করে বাবার পথেই অগ্রসর হবেন। আমার ধারণা, সে ভাবনায় উজ্জীবিত হয়ে সেভাবে করণীয় নির্ধারণের এটাই শেষ সময়। এরপর বড্ড দেরি হয়ে যাবে। দিশেহারা দেশ নৈরাজ্যে ডুবে যেতে পারে। তার রূপ কেমন হবে সেটা কেউ বলতে পারে না। তবে ভালো যে হবে না, ভয়াবহ কিছু ঘটবে, সে আশঙ্কা সবার মনেই আছে। সেটা কারও কাম্য হতে পারে না।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments