জননী সাহসিকা-আমৃত্যু এক সংগ্রাম

পুরোদস্তুর গৃহিণী ছিলেন কোহিনূর বেগম। কোনো দিন ভাবেননি বাড়ির বাইরে কাজ করার কথা। সেই মানুষটিকেই একসময় বেঁচে থাকার প্রয়াসে বাড়ির বাইরে পা ফেলতে হয় কাজের খোঁজে। অবশেষে ছোটখাটো যা হোক জুটেও যায় একটা নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে।


কাজটা ছোট হতে পারে, কিন্তু মহৎ। যুদ্ধের পর বিপর্যস্ত সমাজে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের শিকার হয়ে ভেঙে ও মুষড়ে পড়া নারীদের সহমর্মিতা ও সহানুভূতি জানানোর কাজ, তাঁদের কথা শোনা, তাঁদের পাশে থাকা—এই। অন্যকে সান্ত্বনা দেন তিনি। কিন্তু তাঁকে সান্ত্বনা কে দেবে? কে বোঝাবে, যার পথ চেয়ে তিনি বসে আছেন, তিনি আর ফিরছেন না কোনো দিনই। ঘাতকেরা তাঁকেও যে মেরে ফেলেছে।
শহীদ সাংবাদিক নিজামুদ্দীন আহমদের স্ত্রী কোহিনূর বেগমের ভেতরে আমৃত্য এক বিশ্বাস ছিল, তাঁর স্বামী বেঁচে আছেন। একদিন না একদিন ঠিক ফিরে আসবেন। ‘অগণিত লাশের মধ্যে বাবাকে খুঁজে না পাওয়ায় মায়ের ধারণা ছিল, তিনি হয়তো বেঁচে আছেন। কোথাও আটকা পড়েছেন। একদিন ঠিক ফিরে আসবেন। আসলে শুধু মায়ের না, আমাদের সবারই এমন একটা বিশ্বাস ছিল।’ বলছিলেন সাংবাদিক নিজামুদ্দীন আহমদ ও কোহিনূর বেগম দম্পতির প্রথম সন্তান সামানা নিজাম সিলভী। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টা জর্জিয়া-প্রবাসী সিলভী বলছিলেন তাঁর বাবার অবর্তমানে মায়ের নতুন সংগ্রামের কথা।
সাংবাদিক নিজামুদ্দীন আহমদের সঙ্গে কোহিনূর বেগমের বিয়ে হয় ১৯৬০ সালের দিকে। তখন তিনি সদ্য ম্যাট্রিক পাস করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগ থেকে পাস করলেও শুরু থেকেই সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেন নিজামুদ্দীন আহমদ। মর্নিং পোস্ট, অবজারভারসহ বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করেছেন। ইউপিআই, এএফপি, বিবিসির সঙ্গে কাজ করেছেন। পিপিআইয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিবিসির সংবাদদাতা হিসেবে বিভিন্ন খবর সংগ্রহ করে পাঠাতেন। সেই মানুষটিকে স্বাধীনতার ঠিক চার দিন আগে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনীর এদেশীয় দোসররা। সেদিন থেকেই সব হাসি মুছে গিয়েছিল মিসেস নিজামুদ্দীনের।
‘সেদিন ১২ ডিসেম্বর। দুপুরবেলা সবাই একসাথে খাওয়ার জন্য বসেছি মাত্র। তখন আমরা লক্ষ্মীবাজারের রোকনপুর এলাকায় নানা-নানির সঙ্গে একসাথে থাকতাম। ছোট মামা সদ্য বিদেশ থেকে ট্রেনিং নিয়ে ফিরেছেন। এ উপলক্ষে গরুর মাংস রান্না হয়েছে। সবাই খেতে বসতে যাচ্ছে মাত্র। এমন সময় দরজায় সজোরে ধাক্কা। দরজা খুলেই দেখা গেল মুখে রুমাল বাঁধা একদল লোক। হুড়মুড় করে খাবারঘর পর্যন্ত চলে আসে। এরপর তারা বাবাকে ধরে নিয়ে যায়।’
যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হয়। কোথাও নিজামুদ্দীন সাহেবের কোনো খোঁজ মেলে না।
সিলভী নিজাম বলেন, ‘তখন তো আমরা অনেক ছোট। আমি মাত্র থ্রিতে পড়ি। আমার ছোট বোন শারমীন রীমা কিংবা ছোট ভাই শাফাকাত নিজাম বাপ্পী কেউই তখনো স্কুলে যায় না। এমন একটা সময় আম্মার ভেঙে পড়া দেখে যেন আমরাই ম্যাচিউরড হয়ে গেলাম। নানি, খালাম্মা আমাদের বোঝাতেন, তখন আমরা এমনভাবে চলতাম, যেন আম্মার মনটা ভালো থাকে।’
এরপর শোক সামলে শুরু হয় বাস্তবতার সঙ্গে বোঝাপড়া। কোহিনূর বেগম তখন তাঁর ভাইদের কাছ থেকে যথেষ্ট সহায়তা পাচ্ছিলেন। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনেই তাঁকে রোজগারের পথ দেখতে হয়। তিনি যোগ দেন উইমেন রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে। বহু দিন সেখানে কাজ করেন।
এরপর বুদ্ধিজীবী পরিবারের জন্য সরকারের বরাদ্দ দেওয়া বাড়িতে উঠে আসেন ’৭২-৭৩ সালের দিকে। রোকনপুর ছেড়ে আসার সময় সবাইকে বলে আসেন, তাঁর স্বামী ফিরে এলে যেন তাঁকে ইস্কাটনের নতুন বাড়ির ঠিকানাটা দেওয়া হয়। দরজায় কেউ কড়া নাড়লেই বহু দিন চমকে উঠতেন, ভাবতেন, এই বুঝি তিনি এলেন।
সিলভী নিজাম বলছিলেন, শান্ত, স্থির নীরবতার আড়ালে মানসিক এক অস্থিরতাও দেখা যেত মায়ের। ঠিকমতো খেতেন না। প্রায়ই রোজা রাখতেন। কম ঘুমাতেন।
কোহিনূর বেগমের তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে ছোট ছেলে ব্যবসায়ী শাফাকাত নিজাম বাপ্পী এখন দেশে রয়েছেন। মাঝখানে নব্বইয়ের দশকে এই পরিবারটির ওপর নেমে আসে আরেক ভয়ানক বিপর্যয়। সাংবাদিক নিজামুদ্দীনের মেয়ে সদ্য বিবাহিত শারমীন রীমাকে ঊননব্বই সালে হত্যা করে তাঁর স্বামী মনির হোসেন।
‘এই আঘাত আম্মাকে আর বাঁচতে দেয়নি।’ বলছেন সিলভী নিজাম। বাপ্পী নিজাম বলেন, ‘তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে যে মানুষটির পুরো জগৎ, সেখানে আকস্মিক এই আঘাত তাঁর অবশিষ্ট বিশ্বাস, ভরসা, বেঁচে থাকার প্রেরণা একেবারে নষ্ট করে দেয়। এরপর তিনি আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে পড়েন। একটা সময় আম্মিকে মোটামুটি জোর করে আবার পুনর্বাসন কেন্দ্রের কাজে পাঠানো হয়। ব্যস্ততার মধ্যে যেন কষ্টটা ভুলে থাকেন।’ বলেন সিলভী।
এরপর ১৯৯৩ সালে রীমার হত্যাকারী মুনিরের ফাঁসির কিছুদিন পরে ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর তিনি মারা যান।
সিলভি নিজাম কথাগুলো বলতে বলতে কষ্টের তীব্র অনুভতি লুকাতে গিয়েও পারেন না। বলা হয় না, সংগ্রামী সেই নারীর আসলে পরাজয় হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পর নতুন যে জীবনযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সেটাও ছিল আরেক মুক্তিযুদ্ধ, কেউ যার খবর রাখেনি।
শায়লা রুখসানা

No comments

Powered by Blogger.