ইয়াঙ্গুন কত দূর?-প্রতিবেশী by শেখ রোকন

বশেষে, ২০-২৫টি দেশ সফরের পর এবং দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের তিন বছরের মাথায়, এই ডিসেম্বরে মিয়ানমার যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবশ্য বেটার লেট দ্যান নেভার। এ আর নতুন কী যে বাংলাদেশের সবেধন দুটি প্রতিবেশীর একটি হলেও মিয়ানমার ঢাকাই কূটনীতিতে বরাবরই দুয়োরানী।


অনেকের মনে আছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও পৃথিবীর বহু প্রান্ত ঘুরে আসার পর তার মেয়াদের তৃতীয় বছরে বাড়ির পাশের আরশিনগরে যাওয়ার সময় পেয়েছিলেন। কারণ যা-ই হোক, দৃশ্যত নয়াদিলি্লর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যতটা ঘনিষ্ঠ, ইয়াঙ্গুনের সঙ্গে যেন ততটাই দূরত্ব। আমরা বিভিন্ন সময়ে 'লুক ইস্ট' কূটনীতির শোরগোল তুলেছি বটে, তার লক্ষ্য ছিল পর্বতমালা ও সিন্ধুর ওপারের চীন। ঘর হতে দুই পা ফেললেই মিয়ানমারের যে শিশির বিন্দু চোখে পড়ে, তা রয়ে গেছে অদেখা।
ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণ হিসেবে যে 'ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক' নৈকট্যের দোহাই দেওয়া হয়, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। একই ধরনের ঐক্য তো মিয়ানমারের সঙ্গেও রয়েছে! বাংলাদেশের উত্তর ও পশ্চিম অংশের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ কিংবা আসাম-মেঘালয়-ত্রিপুরার যে সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্তি্বক সাদৃশ্য; চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলের ক্ষেত্রেও তা পাওয়া যায়। বাঙালি মধ্যবিত্তের প্রিয় লেখক শরৎচন্দ্রের নায়ক ও নায়িকারা যেভাবে কলকাতা-রেঙ্গুন যাতায়াত করতেন, সেভাবে ঢাকা-কলকাতা যেতেন কি-না সন্দেহ রয়েছে। মধ্যযুগের বাঙালি মুসলমানি সাহিত্যেও একইভাবে বার্মা ও আরাকান সবিস্তারে উপস্থিত। কিন্তু এহ বাহ্য।
এটা কূটনৈতিক সাবালত্বের লক্ষণ হতে পারে না যে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক কিংবা নৃতাত্তি্বক সাদৃশ্য থাকলেই দু'হাত বাড়িয়ে এগিয়ে যেতে হবে আর অন্যবেলায় পিঠ দেখানোই শ্রেয়। বিশেষ করে প্রতিবেশীর ক্ষেত্রে, চান বা না চান ভেদরেখা মেনে নিয়েই যার সঙ্গে বসবাস করতে হবে, এমন বিবেচনা বিপজ্জনক। দুই প্রতিবেশীর ক্ষেত্রে বিপরীত আচরণ আরও বিপজ্জনক, বালখিল্য। দুর্ভাগ্যবশত, গত চার দশকে মিয়ানমারের ক্ষেত্রে সীমান্তের এপাশ থেকে এমন আচরণই স্পষ্ট হয়েছে। কেবল রাষ্ট্রযন্ত্র নয়, সংবাদমাধ্যম, সিভিল সোসাইটি, এমনকি সাধারণ মানুষও একই বিভ্রান্তির শিকার। ভারতের সঙ্গে তুলনা না করেও, ভৌগোলিক অবস্থানের ব্যাপারে অন্ধকারে থাকা যে কারও ঢাকায় দাঁড়িয়ে ভাবা অস্বাভাবিক নয়, মিয়ানমার হচ্ছে চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনামের চেয়েও দূরের দেশ।
মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ব যে কেবল মনস্তাত্তি্বক, তা নয়। অবকাঠামোগত যোগাযোগের ক্ষেত্রেও এ এক দুস্তর পারাবার। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ হয়ে মিয়ানমারের দিকে চলে যাওয়া একটি সড়কের নাম 'আরাকান রোড' বটে, সেটা দিয়ে কোনো রকমে সীমান্তের ওপাশের শহর গুংদুম পর্যন্ত যাওয়া যায়। পথের ধর্ম অনুযায়ী তারপরও হয়তো যাতায়াতের ব্যবস্থা আছে; কিন্তু সেটা না চলাচলের উপযোগী, না বাংলাদেশিদের জন্য অবারিত। বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার হয়ে এশিয়ান হাইওয়ে কিংবা ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়েতে যুক্ত হওয়া কিংবা আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে সড়কপথে মিয়ানমার হয়ে চীনের কুনমিং পর্যন্ত যাওয়ার লম্বা লম্বা কথাই শুধু শোনা গেছে, বাস্তবে দ্বিতীয় প্রতিবেশীটির সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ সেই ব্রিটিশ আমলের কানাগলিটিতেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে ভরসা ছিল ঢাকা-রেঙ্গুন বিমান যোগাযোগ। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের উপযুক্ত সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ২০০৬ সাল পর্যন্ত দু'দেশের মধ্যে বিমান চলাচল ছিল। তারপর সেটাও বন্ধ হয়ে পড়েছে। এখন কেউ ঢাকা থেকে মিয়ানমার যেতে চাইলে তাকে বাড়তি অর্থ, সময় ও ভোগান্তির বিনিময়ে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর বা কুয়ালালামপুর হয়ে ঘুরে যেতে হয়। গত কয়েক বছরে ইয়াঙ্গুনে বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের আকার ও সংযুক্তি অনেক বেড়েছে। একসময় কেবল দূতাবাস সংশ্লিষ্ট লোকজন থাকলেও এখন কৃষিপণ্য ও মাছের বাণিজ্যের কারণে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের যাতায়াত বেড়েছে। বেড়েছে সেখানে তৎপর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত বাংলাদেশি নাগরিকের সংখ্যা। অনেকে হয়তো জানেন না, এ দেশের অন্তত ২০টি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি তাদের তৈরি ওষুধ ও চিকিৎসা পণ্য মিয়ানমারে রফতানি করছে। তাদের প্রতিনিধিরা ইয়াঙ্গুনে থাকেন। ঢাকার সঙ্গে সরাসরি বিমান যোগাযোগে এখন যাত্রীর অভাব হবে না; কিন্তু বন্ধ রুটটি চালুর ব্যাপারে আমাদের কর্তাদের গরজ দেখা যাচ্ছে না। আবারও বলতে হয়, কেবল বাণিজ্যিক চিন্তা-ভাবনার ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেশী একটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগের নীতিনির্ধারণ পরিণত কূটনীতির লক্ষণ নয়। তাতে করে যেমন বাণিজ্যও বাড়ে না, কূটনৈতিক লাভের খাতাও শূন্য পড়ে থাকে।
বঙ্গোপসাগরের দুই কূলে থাকা দুই বন্দর চট্টগ্রাম ও ইয়াঙ্গুনের মধ্যে সামুদ্রিক যোগাযোগের সম্ভাবনা ছিল সবচেয়ে উজ্জ্বল। অথচ দু'দেশের মধ্যে মালবাহী জাহাজগুলোর বেশিরভাগই আসে সিঙ্গাপুর হয়ে। এতে সময়ের যেমন, তেমনি অর্থের ক্ষতিও হয়।
মনস্তাত্তি্বক দূরত্বের কারণে অবকাঠামোগত যোগাযোগের এই অবস্থা নাকি উল্টোটা, সেটা বিতর্কের বিষয়। তবে এ নিয়ে সন্দেহ নেই যে দু'দেশের এসব দূরত্ব কীভাবে কমানো যায়, সে ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে কথাবার্তা কম হয়নি। সেমিনারে ও সংবাদমাধ্যমে অনেক আলোচনা হয়েছে। তারপরও দূরত্ব ঘোচে না কেন? এর কারণ সম্ভবত রাজনৈতিক। ঢাকা বরাবরই মিয়ানমারের প্রতি এক অদ্ভুত রাজনৈতিক উন্নাসিকতা পোষণ করেছে। রাজনৈতিক দূরত্ব সৃষ্টিতে মিয়ানমারের অবদান যে নেই, তা বলা যাবে না; কিন্তু কূটনীতি মানে যে ব্লেম গেম নয়, যে কোনো উপায়ে নিজের স্বার্থ সুরক্ষা, সেটা তো বুঝতে হবে!
রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট এবং হালের সমুদ্রসীমা বিরোধের কথা বাদ দিলে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের অসন্তোষ তৈরির উৎস নেই বললেই চলে_ অমীমাংসিত সীমান্ত নেই, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ঝামেলা নেই, পরস্পরের প্রতি বিচ্ছিন্নতাবাদী উসকে দেওয়ার অভিযোগ নেই। তারপরও এক অদ্ভুত কারণে আমরা রাজনৈতিকভাবে মিয়ানমারকে বাঁকা চোখে দেখে এসেছি_ সেখানকার দীর্ঘমেয়াদি সামরিক শাসন। হ্যাঁ, সামরিক শাসন নিয়ে ছুৎমার্গের অধিকার গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো ভারতের নিশ্চয়ই আছে। সেই ভারতও এখন ইয়াঙ্গুনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার যাবতীয় আয়োজন নিয়ে প্রস্তুত। আর আমরা, জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের দু'দফা সামরিক শাসনাধীনে থাকার পর, মিয়ানমারের সামরিক শাসন নিয়ে কথা বলি কোন মুখে? মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কখনও কখনও আমরা স্রেফ পশ্চিমা স্বার্থ ও স্বভাবের অন্ধ অনুসরণ করেছি।
এসব অতীতের বিষয়, মিয়ানমারেও পরিবর্তন এসেছে। যেমনই হোক, নির্বাচনের মধ্যে সেখানে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী অং সাং সু চিও নতুন সরকারের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিলম্বে হলেও মিয়ানমার সফরে যাচ্ছেন। ঢাকা থেকে দীর্ঘ আলোচ্যসূচি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ আমদানি বা উৎপাদন করে আনা, কৃষিজমি বর্গা, দুই বা ত্রিদেশীয় সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা, এশিয়ান হাইওয়ে, নৌ-চুক্তির বাস্তবায়ন, সাংস্কৃতিক বিনিময়, সীমান্ত চোরাচালান রোধ, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, ভিসা জটিলতা ইত্যাদি।
বাংলাদেশ-মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় ইস্যুগুলো যদিও খুব জটিল নয়; চার দশকে জড়ো হওয়া এত সব জটিলতা এক সঙ্গে ঘুচবে_ এমনটা আশা করা বোধহয় উচিত হবে না। বরং দু'একটি বৃহৎ বিষয়ের সুরাহার মাধ্যমেই সম্পর্কের নতুন দুয়ার খুলে যাক না! যেমন বন্ধ হয়ে যাওয়া বিমান যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা খুব কঠিন নয়। বিষয়টি দ্বিপক্ষীয়ও নয়। বাংলাদেশ উদ্যোগী হলেই সপ্তাহে একটি ফ্লাইট ঢাকা-ইয়াঙ্গুন যাতায়াত করতে পারে এবং সেটা প্রধানমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরের আগেই সূচিত হোক না! তাহলেই রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়ে দেখা যাবে ইয়াঙ্গুন সত্যিই দূরে নয়।

শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.