জননী সাহসিকা-এক প্রত্যয়ী, সংগ্রামী মায়ের মুখ

মুনীর চৌধুরী শিক্ষা ও পেশাগত জীবনে বামপন্থী রাজনীতি ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অনিয়মের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠস্বর সবসময়ই গর্জে উঠত। আর এটাই ছিল শাসকশ্রেণীর সবচেয়ে ভয়ের কারণ। মুনীর চৌধুরীকে দমিয়ে রাখতে তটস্থ থাকতেন তারা।


১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনেও তাঁর উজ্জ্বল ভূমিকার কথা সবারই জানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষক থাকা অবস্থায় একই বিভাগের শিক্ষার্থী লিলি চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। প্রথাগত সমাজব্যবস্থা ও সমকালীন রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান থাকার কারণে তাঁকে যেসব ভোগান্তি পোহাতে হতো তার ঢেউ আছড়ে পড়ত পরিবারেও। সে সময় পরিবারে নানা ধরনের ঝড়-ঝাপটা সামলাতে হতো লিলি চৌধুরীকে। পরিস্থিতিই তাঁকে অভ্যস্ত করে তুলেছিল বৈরী পরিবেশে কীভাবে চলতে হয়। অনেক সময় এমনও হয়েছে, স্বামীকে ধরে নিয়ে জেলে রাখা হয়েছে। এ সময় তিনি শক্ত হাতে পরিবারও সামলেছেন, আবার স্বামীকে ফিরিয়ে আনতে ছুটেছেন এখানে সেখানে। এমনও হয়েছে সম্মান বা স্নাতকোত্তর দুই পরীক্ষার চূড়ান্ত পর্বে সন্তানকে গর্ভে নিয়েই পরীক্ষা দিয়েছেন। আবার সেই পরীক্ষাতে ঠিকমতো উতরেও গেছেন। মোটকথা, লিলির সংসার-জীবনের শুরু থেকেই চলতে হয়েছে বন্ধুর পথ ধরে।
১৯৭১ সালের কথা। মুনীর চৌধুরী দেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করতেই সদা ব্যস্ত। স্বামী আর সন্তানদের নিয়ে উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে লিলির। ততক্ষণে পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর রাজাকার, আলবদরদের তালিকায় উঠে গেছে মুনীর চৌধুরীর নাম। ১৪ ডিসেম্বর, দেশের স্বাধীতার এক অন্তিম মুহূর্ত যখন। ঠিক তখনই অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় মুনীর চৌধুরীকও।
বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। অনেকবারই তাঁকে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় মা বিচলিত হলেও ধরে নিয়েছিলেন বাবা আবার ফেরত আসবেন। কিন্তু মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে একে একে প্রায় সব বুদ্ধিজীবীদের লাশ পাওয়া গেলেও বাবার লাশ পাওয়া গেল না। মিলল না কোনো খোঁজও। মা আমাদের তিন ভাইকে নিয়ে যেন দিশেহারা হয়ে পড়লেন। একদিকে বাবাকে খুঁজে না পাওয়ার কষ্ট, আর অন্যদিকে পরিবার ও সন্তানদের মানুষ করার তাগিদ। অনেকটা থমকে গেলেন তিনি।
বাবাকে হারানোর পর মায়ের বাস্তব কঠিন পরিস্থিতির কথা বলছিলেন তাঁদের ছোট ছেলে আসিফ মুনীর তন্ময়। তাঁর সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তিনি অবস্থান করছেন যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। উচ্চশিক্ষা নেওয়ার জন্য সেখানে আছেন তিনি। বাবা হারানোর পর সন্তানদের নিয়ে মায়ের কষ্টের কথাগুলো শোনা গেল মুুঠোফোনে।
দেশ স্বাধীনের পর লিলির বড় ছেলে আশফাক মুনীর মিশুক তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মেজো ছেলে আহমেদ মুনীর ভাষণ ও ছোট ছেলে তখন স্কুলের ছাত্র। শহীদ বুদ্ধিজীবীর পরিবার হওয়ার কারণে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাসায় থাকার ব্যবস্থা হলো। ছেলেদের মানুষের মতো মানুষ করে তুলতে হবে, এই চিন্তাই তখন ঘুরপাক খাচ্ছিল লিলি চৌধুরীর মাথায়। নিজেকে ভালো চাকরি করতে হবে, সন্তানদের ভালোভাবে পড়াতে হবে, দুই পথেই একসঙ্গে হাঁটা শুরু করলেন লিলি। সন্তানদের ঠিকমতো পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি গ্রন্থাগার বিজ্ঞান ও ফরাসি ভাষায় ডিপ্লোমা ডিগ্রি নেন। অভিনয়েও লিলির দক্ষতা ছিল। স্কুলজীবন থেকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অভিনয়ের হাতেখড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকেই ঢাকা বেতারে নাটক করেছেন নিয়মিতভাবে সত্তরের দশক পর্যন্ত। কণ্ঠ, স্পষ্ট সংলাপ উচ্চারণ ও বিশিষ্ট বাচনভঙ্গির জন্য বেতার, টেলিভিশন, মঞ্চ—এ তিন মাধ্যমেই অভিনয়ের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন। সেটাও চলতে থাকল তখন। সন্তানেরাও একে একে বড় হতে থাকল।
বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর আমরা যাদের খুব কাছের মানুষ ভাবতাম, বিপদের দিনে যাদের পাশে পাব বলে ভাবতাম, তারা আমাদের পাশে নেই, ফলে মা অনেকটাই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে ছিলেন। কিন্তু শত বিপদের দিনেও তিনি কারও কাছে হাত পাতেননি। একাই লড়ে গেছেন আমাদের নিয়ে। এক অকৃত্রিম মমতার বাঁধনে আমাদের আগলে রেখেছেন তাঁর বুকে। মা নিজে নিজেই সব বাধা-বিপত্তি সামলেছেন। ছেলেদের নিয়ে মায়ের কষ্টের সেই দিনগুলোতে আবার ফিরে গেলেন আসিফ মুনীর। ১৯৭৮ সালে বড় ছেলের চাকরি হলে সংসারের চাপ কিছুটা কমে লিলির। অন্য দুই সন্তানকে উচ্চশিক্ষিত করার কাজে তিনি ব্যস্ত থাকতেন। মেজো ছেলে আহমেদ মুনীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে এখন সিয়েরা লিয়নে শান্তি মিশনে আছেন। ছোট ছেলেও একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করেছেন।
মুনীর চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকা অবস্থায় অন্যান্য শিক্ষকদের সঙ্গে ঢাকার বনানীতে অল্প কিছু জমি কিনেছিলেন সে সময়। তিনি নিখোঁজ হওয়ার পর লিলি নিজেই এই জমি বুঝে নিয়েছেন। হাউস বিল্ডিং লোন নেওয়া, বাড়ির ডিজাইন সংগ্রহ করাসহ বাড়ির কাজ করার জন্য এখানে সেখানে ছোটাছুটি করেছেন একাই। লক্ষ্য একটাই, সন্তানদের যেন থাকতে কষ্ট না হয়।
বাবাকে হারানোর পর মা এখনো ভাবেন একদিন তিনি ঠিকই ফিরে আসবেন। এখনো কেন তিনি আসছেন না! এটা নিয়ে মা সবসময়ই কষ্টে থাকতেন। কিছুদিন আগে এই কষ্টের সঙ্গে যোগ হলো বড় ভাইকে হারানোর কষ্ট।
মা এখন বনানীর বাসায় থাকেন, তাঁর বয়সও হয়েছে। দূরে বসে থেকে মায়ের অভাব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে মায়ের মধুমাখা মুখখানি সবসময় মনে পড়ে। মা যে কীভাবে আচলের মধ্যে আমাদের আগলে রাখতেন, তা এখন ভালোভাবে বুঝতে পারি। মুঠোফোনের ওপাশ থেকে কাঁপা কাঁপা গলায় আসিফের মুখের কথাগুলো শোনা যায়। তাঁর কথা কানে বাজতে বাজতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক প্রত্যয়ী, সংগ্রামী মায়ের মুখ।
মোছাব্বের হোসেন

No comments

Powered by Blogger.