নৌ-প্রটোকলে ট্রানজিট মাশুল নেওয়ার পক্ষে এনবিআর by জাহাঙ্গীর শাহ
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার নৌ-প্রটোকলের আওতায় ট্রানজিট-সুবিধা ব্যবহারের ক্ষেত্রে মাশুলের আরোপের পক্ষে মত দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পাশাপাশি অবকাঠামো না থাকায় আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার করে ট্রানজিট দেওয়া আপাতত বন্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি নৌ-প্রটোকলটি পর্যবেক্ষণ করে সরকারের কাছে এসব মতামত দিয়েছে এনবিআর। ইতিমধ্যে এই পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন নৌ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত আগামী ৩১ মার্চ দুই দেশের মধ্যকার ।নৌ-প্রটোকলের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। প্রটোকলটির মেয়াদ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে নৌ মন্ত্রণালয়। আর এমন প্রেক্ষাপটে এনবিআর নৌ-প্রটোকলটির ওপর মতামত দিয়েছে। নৌ-প্রটোকলের কোন কোন অংশে সংশোধন করা হতে পারে সেই বিষয়ে চলতি সপ্তাহেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসবে নৌ মন্ত্রণালয়।
চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে নৌ-প্রটোকলের ওপর তাদের পর্যবেক্ষণ ও মতামত নৌ মন্ত্রণালয়ে পাঠায় এনবিআর। এতে মূলত পাঁচটি বিষয়ের ওপর মতামত দেওয়া হয়েছে।
নৌ-প্রটোকলের আওতায় এত দিন বিনা মাশুলে ট্রানজিট নেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু এনবিআর নতুন করে মাশুল আরোপের পক্ষে মত দিয়েছে। প্রতি টনে ৫৮০ টাকা হিসাবে কাস্টমস-সংক্রান্ত মাশুল নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
ট্রানজিটের আওতায় পরিবাহিত পণ্যের জন্য ট্রানজিট প্রদানকারী দেশ পণ্যের ওপর কোনো শুল্কারোপ করতে পারে না। তবে পণ্যবাহী যানবাহন দেশে ও দেশ থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ প্রশাসনিক ও প্রক্রিয়াকরণের সেবা প্রদানের বিপরীতে মাশুল নিতে পারে। তারই আলোকে কাস্টমস-সংক্রান্ত মাশুলের সুপারিশ করা হয়েছে।
কাস্টমস-সংক্রান্ত মাশুল নির্ধারণের ক্ষেত্রে কাগজপত্র প্রক্রিয়াকরণ, ট্রানশিপমেন্ট, স্ক্যানিং, মার্চেন্ট ওভারটাইম, নিরাপত্তা, প্রহরা ও আইসিটি মাশুল বিবেচনায় আনা হয়েছে।
অন্যদিকে ট্রানজিট পণ্যের সমপরিমাণ শুল্ক ব্যাংক গ্যারান্টি হিসাবে রাখার পক্ষেও মত দিয়েছে এনবিআর। সংস্থাটি বলছে, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও এই ধরনের চর্চা হয়।
আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহার করে স্থলপথে আখাউড়া স্থলবন্দর হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় ভারতীয় পণ্য নেওয়ার সুযোগটিও আপাতত কার্যকর না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এই পথটিতে এখনো ট্রানজিট উপযোগী অবকাঠামো গড়ে না ওঠাই এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া নৌ-প্রটোকলের ২৩(২) অনুচ্ছেদটি আপাতত বিলোপ করার সুপারিশ করেছে এনবিআর। এই অনুচ্ছেদে ট্রানশিপমেন্টের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
বেশি ড্রাফটসম্পন্ন (পণ্যবাহী জাহাজের যে অংশ পানির নিচে থাকে) জাহাজ থেকে পণ্য ড্রাফটসম্পন্ন জাহাজে পণ্য স্থানান্তর কিংবা কম ড্রাফটসম্পন্ন জাহাজ থেকে বেশি ড্রাফটসম্পন্ন জাহাজে পণ্য স্থানান্তর করে এই সুবিধাটি ব্যবহূত হতে পারে। এনবিআর তা আপাতত বন্ধ রাখার পক্ষে।
উল্লেখ্য, নাব্যতা সংকটের কারণে এই অনুচ্ছেদের সুযোগ নিয়ে প্রথমবারের মতো ভারতীয় জাহাজ লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর পণ্যগুলো আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে ছোট ছোট জাহাজে করে সম্প্রতি করিমগঞ্জ দিয়ে ভারতে নেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে নৌ-প্রটোকলে জকিগঞ্জের শেরপুর পর্যন্ত নৌপথে নিয়ে তিন-চার কিলোমিটার সড়কপথে সীমান্ত পর্যন্ত পণ্য নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এই পথটি কখনো ব্যবহার করেনি ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। তাই এই সুযোগটি বাতিল করার সুপারিশ করেছে এনবিআর।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলেছেন, সরকার যেহেতু ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে, আর তাতে মাশুল নেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে তাই নৌ-প্রটোকলের আওতায় মাশুল নেওয়া উচিত। তাঁরা আরও বলেন, বিশ্ব প্রেক্ষাপটে এখন যেকোনো ধরনের ট্রানজিট ব্যবস্থায় প্রদানকারী দেশ মাশুল নিয়ে থাকে। আর পর্যাপ্ত অবকাঠামো আছে এমন পথেই ট্রানজিট দেওয়া হয়।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ নৌপথ অতিক্রম ও বাণিজ্য প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। এর আওতায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নৌপথে ভারত পণ্য আনা-নেওয়া করে থাকে। এ জন্য নদী খননসহ বছরে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা দেয় ভারত।
প্রতি দুই বছর পর পর এই চুক্তিটি নবায়ন করা হয়। তবে গতবছর চুক্তিটি এক বছরের জন্য নবায়ন করা হয়। দুই বছরের পরিবর্তে এক বছর নবায়নের পেছনে কারণ ছিল, বর্তমান সরকার বৃহত্তর আঙ্গিকে ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে।
আবার ১৯৮০ সালে স্বাক্ষরিত দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য চুক্তির আওতায় নৌ-প্রটোকলটি পরিচালিত হয়। আর বাণিজ্য চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১ এপ্রিল। বাণিজ্য চুক্তিটি নবায়ন না করলে নৌ-প্রটোকল কার্যকর করা সম্ভব হবে না।
ইতিমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য চুক্তি নবায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রসঙ্গত প্রতি তিন বছর অন্তর এই চুক্তিটি নবায়ন করা হয়। সর্বশেষ ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে চুক্তিটি নবায়ন করেছে।
নৌ-প্রটোকল সম্পর্কে নৌ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ আলাউদ্দিন গতকাল টেলিফোনে প্রথম আলোকে জানান, দুই দেশের বাণিজ্য চুক্তির নবায়ন করা হবে কি না, তার ওপর নির্ভর করছে নৌ-প্রটোকলের ভবিষ্যৎ। চুক্তিটি নবায়ন সম্পর্কে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে নৌ মন্ত্রণালয়।
এনবিআরের পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, পর্যবেক্ষণ মতামতটি এখনো তাঁর হাতে এসে পৌঁছেনি। তবে নৌ-প্রটোকল সংশোধন বা নবায়নের বিষয়ে সব পক্ষের মতামত অবশ্যই নেওয়া হবে। শিগগিরই এই সংক্রান্ত আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক ডাকা হবে বলেও তিনি জানান।
No comments