মহান বিজয় দিবসঃ গ্রামীণ মুক্তিযোদ্ধারা অবহেলিত কেন
আজ ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে পর্যুদস্ত হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আজকের দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল। এর মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে প্রায় খালি হাতে মুক্তিকামী কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা যেভাবে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, তা ছিল কল্পনাতীত। এভাবে যাদের আত্মদান ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, সেই দুঃসাহসী জনগণ, জানা-অজানা শহীদ ও ক্ষতিগ্রস্তদের এবং রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রতি সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানানোর দিন আজ। পাকিস্তানের দীর্ঘ ২৪ বছরের শোষণ, বঞ্চনা ও সম্পদ পাচারের ফলে সৃষ্ট আঞ্চলিক বৈষম্য ও অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রামে রূপ নেয়। এই দীর্ঘ সংগ্রামে যারা অংশ নিয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের ভূমিকার কথাও আজ স্মরণ করা প্রয়োজন।
স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ ৩৮ বছর পর আজকের বিজয় দিবসে শুধু অতীত স্মৃতিচারণ করলে চলবে না, এই সময়কালে স্বাধীনতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে, সেটাও ভেবে দেখতে হবে। যে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য ও অধিকারহীনতার বিরোধিতা থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা—এতদিন পরও স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণ সেসব থেকে মুক্তি পায়নি। সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে। জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয়নি। বিগত সরকারগুলো অন্য অনেক ক্ষেত্রে সাফল্যের দাবিদার হলেও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি চোখে পড়ে না। একদলীয় শাসন, সামরিক শাসন, স্বৈরশাসন ও সেনা-সমর্থিত জরুরি শাসনের যাঁতাকলে জাতি নিষ্পিষ্ট হয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়েছে, জেল-জুলুম-হত্যার শিকার হতে হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী হিসেবে অনেকের চরম উন্নতি ঘটলেও সামগ্রিকভাবে দেশ-জাতি তথা জনগণের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি। গত বছর যখন আমরা মহান বিজয় দিবস উদযাপন করি, তখন দেশ সেনা-সমর্থিত জরুরি শাসনে পিষ্ট হতে থাকলেও বহু প্রতীক্ষিত জাতীয় নির্বাচন ছিল অত্যাসন্ন। সে নির্বাচন হয়েছে। দেশ এখন জরুরি শাসন থেকে মুক্ত। তারপরও এখন আগের চেয়ে ভালো আছি, সে কথা মুক্তকণ্ঠে বলতে পারছি কই! বরং এরই মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ নগ্নভাবে দেখা গেছে। কিছু রাজনৈতিক নেতা ও তথাকথিত সুশীল সমাজের বড় একটা অংশ যে ওই বিদেশিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল, তাও স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। সেই মেলানো হাত এখন আর একত্রে নেই, তেমন লক্ষণ দৃশ্যমান নয়। এরা সম্মিলিতভাবেই বাংলাদেশকে একটা ব্যর্থরাষ্ট্র প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশকে জঙ্গিদের অভয়ারণ্য প্রমাণের চেষ্টার সঙ্গে সরকারের কারও কারও দুঃখজনক সম্পৃক্ততা আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। এদের কর্মকাণ্ড আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য বড় হুমকি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, কথায় নয় কাজে লাগিয়ে এই কুচক্রীদের অপচেষ্টা রুখতে হবে। আজ বিজয় দিবসে জনগণের কাছে আমাদের আবেদন, তারা যেন একাত্তরের মতো এই সঙ্কট সন্ধিক্ষণেও দেশের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে সতর্ক থাকেন।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের লালিত আকাঙ্ক্ষা ছিল দেশ-জাতি ও জনগণের কাঙ্ক্ষিত উন্নতি। এ প্রসঙ্গে আমরা অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। একাত্তর সালে ও পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা চাকরিরত ছিলেন, তারা বিভিন্নভাবে কিছুটা হলেও পুরস্কৃত হয়েছেন। কিন্তু যারা ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ, বিশেষ করে কৃষকের সন্তান, সেই সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা কোনো পুরস্কারের আশা করেননি। অনেকে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নেয়ার কথাও চিন্তা করেননি। স্বাধীন দেশটা ভালোভাবে চলবে, এমন উন্নতি হবে যাতে সাধারণ মানুষের জীবনও উন্নত হয়ে উঠবে—এমনটাই ছিল তাদের আশা। মুক্তিযুদ্ধে এই কৃষক-জনতার অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগের ঔজ্জ্বল্য অন্যদের চেয়ে বেশি হলেও এখন পর্যন্ত তাদের ন্যূনতম আকাঙ্ক্ষার পূরণ হয়নি। জাতির এই সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই এখন ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, অবহেলা ও বঞ্চনার অসহায় শিকার। বিজয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতায় তাদের কথা প্রায় সবাই ভুলে থাকেন। এই পটভূমিতে সবার প্রতি আমাদের আবেদন, আসুন, সবাই মিলে এমন একটা বাংলাদেশ গড়ে তুলি যেখানে মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছিলেন এবং হাসিমুখে সব ভার বহন করেছিলেন, জীবন সায়াহ্নে এসে তারা বা তাদের পরিবার-পরিজন যেন কিছুটা হলেও নিজেদের আত্মত্যাগ, আত্মদানের কথা ভেবে পরিতৃপ্তি লাভ করতে পারে।
No comments