বিভক্তি নয়, ডিসিসিকে শক্তিশালী করুন-সাক্ষাৎকার by সাদেক হোসেন খোকা
সাক্ষাৎকার গ্রহণ :লোটন একরাম সমকাল : আপনি প্রায় ১০ বছর ডিসিসির মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন। সরকার সম্প্রতি 'ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন' ও 'ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন' নামে আলাদা দুটি সিটি করপোরেশন করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
সাদেক হোসেন খোকা : সম্প্রতি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ডিসিসিকে দু'ভাগ করার সিদ্ধান্তে আমি বিস্মিত ও হতবাক হয়েছি। ডিসিসিকে বিভক্ত করতে কেউ কোনো দাবি না তুললেও সরকার একতরফাভাবে এ সিদ্ধান্তটি নিয়েছে। এমনকি এ বিষয়ে ঢাকা মহানগরের সরকারদলীয় সাংসদ এবং কাউন্সিলররাও কোনো আবেদন করেননি। তারপরও হঠাৎ করে সরকারের এরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাই না। আমার মনে হয়, দেশ পরিচালনায় সরকারের নানা ব্যর্থতার কারণে এ অপরিপকস্ফ সিদ্ধান্তটি নেওয়া হতে পারে। মহাজোট সরকারের পৌনে তিন বছরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, শেয়ার কেলেঙ্কারি, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস সংকট, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, গুপ্তহত্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় বিএনপির রোডমার্চ ও জনসভাগুলোতে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যাপক সাড়া দেওয়ায় সরকারের নীতিনির্ধারক মহল ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। সরকারের সার্বিক ব্যর্থতা আড়াল রাখতে শুধু ডিসিসিকে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ও প্রয়োজনীয়।
সমকাল : সরকার বলছে, ঢাকায় বর্তমানে জনসংখ্যা এক কোটিরও বেশি। একটি সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে নগরবাসীর কাঙ্ক্ষিত সুবিধা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এ কারণেই ডিসিসিকে দু'ভাগ করা হয়েছে। এ যুক্তি কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
সাদেক হোসেন খোকা : জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ডিসিসিকে বাড়তি কোনো পদক্ষেপ নিতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আভাস-ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি। জনসংখ্যার দোহাই দিয়ে ডিসিসিকে দু'ভাগ করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ডিসিসির সঙ্গে ঢাকার মানুষের আবেগ-অনুভূতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য জড়িত রয়েছে। রাজনৈতিক কারণে সরকার তা কেটে ফেলার চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগের নেতা সাবেক মেয়র মরহুম মোহাম্মদ হানিফ সাহেব বিভিন্ন সেবা সংস্থাগুলোকে ডিসিসির অধীনে এনে 'মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্ট' গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন। ডিসিসিকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অধীনে নেওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি। অনেক সময় তাৎক্ষণিকভাবে বড় ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু একটি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সব মন্ত্রণালয় ও দফতরের মধ্যে সমন্বয় করে দ্রুত সিদ্ধান্ত দেওয়া সম্ভব হয় না। এ বিষয়গুলো চিন্তায় না এনেই হঠাৎ করে বিভক্তির বিষয়টি আজগুবি চিন্তা ছাড়া আর কিছু নয়। আসলে ডিসিসির মাধ্যমে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সহায়তা দরকার। পৃথিবীর বড় শহরগুলোতে এ ধরনের দুটি প্রশাসনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ওই শহরগুলো যে আইন দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে তা অনুকরণ করে ডিসিসিকে একীভূত রেখেই উত্তম সেবার মান নিশ্চিত করা যেতে পারে।
সমকাল : স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, সিটি করপোরেশন ভাগ করে সমস্যা আরও বাড়বে, কমবে না। বিশেষজ্ঞদের এ বক্তব্য সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
সাদেক হোসেন খোকা : বিশেষজ্ঞরা সঠিক মূল্যায়নই করেছেন। সেবা খাতগুলোর সঙ্গে ডিসিসির সমন্বয় না থাকার কারণে এগুলো নাগরিকদের প্রকৃত সেবা দিতে পারছে না। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, সেবা নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশন ভাগ করার কোনো প্রয়োজন নেই, সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে 'সমন্বয়' থাকলেই ভালো সেবা দেওয়া সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের এ অভিমত পুরোপুরি সঠিক।
সমকাল : ডিসিসির ১৮তম বোর্ডসভার সিদ্ধান্তগুলো কি বাস্তবায়ন হচ্ছে?
সাদেক হোসেন খোকা : বোর্ডসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বুধবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীকে ডিসিসিকে বিভক্তি না করার অনুরোধ জানিয়ে একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলররা। এতে একজন মেয়রের অধীনে ৪ জন ডেপুটি মেয়রের পদ সৃষ্টি করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তাছাড়া অঞ্চলভিত্তিক জনপ্রতিনিধিদের মধ্য থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে আঞ্চলিক চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করার সুপারিশ করা হয়েছে। নগরীর অন্যান্য সেবা সংস্থাগুলোকেও ডিসিসির অধীনে আনার প্রস্তাব রয়েছে।
সমকাল : আগামী ডিসেম্বর নাগাদ সিটি করপোরেশন আইনের সংশোধন জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিসিসি বিলুপ্ত হবে। সরকার দুটি সিটিতে ১২০ দিনের জন্য প্রশাসক নিয়োগ দেবে। এ সময়ের মধ্যে নতুন নির্বাচন হবে_ আইনে এ বিধান রাখা হয়েছে?
সাদেক হোসেন খোকা : আমি আবারও বলছি, ডিসিসিকে বিলুপ্ত করে দুটি করপোরেশন করা একেবারেই সঠিক হবে না। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিদলীয় কাউন্সিলর, বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা জোরালো বক্তব্য রাখছেন। আশা করি, সরকার জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে অবস্থান পরিবর্তন করবে। ফলে ১২০ দিনের মধ্যে প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত কার্যকর করারও কোনো প্রয়োজন পড়বে না।
সমকাল : আগামী বছরের প্রথম দিকে ডিসিসির নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আপনি কি আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন?
সাদেক হোসেন খোকা : আমার দল বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী দল। ডিসিসির মেয়র পদে নির্বাচন করার মতো একাধিক যোগ্য ব্যক্তি রয়েছেন। সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হলে বিএনপির পক্ষ থেকে কেউ না কেউ প্রার্থী হবেন।
সমকাল : ডিসিসির মেয়ররা দীর্ঘদিন ধরে মন্ত্রীর পদমর্যাদা পেয়ে আসছেন। দু'ভাগ হওয়ার পর নতুন মেয়রদের প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
সাদেক হোসেন খোকা : আমি আশা করি, ঐতিহ্যবাহী ডিসিসি কোনোভাবেই পশ্চাদ্মুখী হবে না। আমার মনে হয়, বাস্তবতা উপলব্ধি করে সরকার যে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে_ তা থেকে সরে আসবে। সে ক্ষেত্রে ডিসিসির মেয়রের পদ পূর্ণ মন্ত্রী থেকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় নেমে আসার কোনো প্রশ্ন উঠবে না।
সমকাল : গত কয়েক বছর ডিসিসি নাগরিক সেবা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্ত্রিসভায় পাঠানো প্রস্তাবে বলা হয়। সরকারের এ বক্তব্য যদি সঠিক হয়, দীর্ঘদিন মেয়রের দায়িত্ব পালন করায় আপনার ওপরও এর দায়দায়িত্ব পড়ে?
সাদেক হোসেন খোকা : মন্ত্রিসভায় পাঠানো প্রস্তাবটি পুরোপুরি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করা হয়েছে। সুতরাং ওই প্রস্তাবটির সপক্ষে কোনো না কোনো অজুহাত দাঁড় করাতেই হবে। তাছাড়া নাগরিক সেবা হয়তো শতভাগ নিশ্চিত করা যায়নি। তার কারণ হলো_ শতভাগ সেবা নিশ্চিত করার মতো সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ডিসিসিকে গড়ে তোলা হয়নি। সরকার পানি ঘোলা না করে সর্বজনীন দাবিতে সাড়া দিয়ে ডিসিসিকে যত বেশি শক্তিশালী করবে, তত বেশি নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
সমকাল : বিভক্ত করলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কপোরেশনের আওতায় ৫৬টি এবং উত্তরের আওতায় থাকবে ৩৬টি ওয়ার্ড। এতে অভিজাত এলাকাগুলো উত্তরে পড়ায় রাজস্ব আদায়ে দক্ষিণের সঙ্গে বড় ধরনের ব্যবধান তৈরি হতে পারে কি?
সাদেক হোসেন খোকা : হ্যাঁ, এতে দুটি অংশের মধ্যে আয়-ব্যয়ের বৈঠম্যের সৃষ্টি হবে। এমনকি করপোরেশনের প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক খরচও দ্বিগুণ হবে। এ ছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদায়ন ও অবসরকালীন সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক জটিলতা দেখা দেবে, যা নিরসনে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হবে। ডিসিসিকে দ্বিখণ্ডিত করার সিদ্ধান্তে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের ঋণে আন্তর্জাতিক কনসালট্যান্টের মাধ্যমে সীমানা সমীক্ষা চালানো হয়। ওই সময় মন্ত্রিসভায় অন্যান্য দেশের মতো এককেন্দ্রিক কর্তৃপক্ষ (ইউনিটারি অথরিটি) প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অনুমোদন করা হয়। সাম্প্রতিক মন্ত্রিসভার বৈঠকের সিদ্ধান্ত ওই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাংঘর্ষিকও বটে। সুতরাং হঠাৎ করে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সিদ্ধান্তের আগে আরও ব্যাপকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা উচিত।
সমকাল : ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সীমানা বড় রাখার যুক্তি হিসেবে ভবিষ্যতে উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকা সম্প্রসারণের কথা বলছে সরকার। ভবিষ্যতে দক্ষিণে আর সম্প্রসারণের কোনো সুযোগ নেই বলা হচ্ছে। আপনি কী বলেন?
সাদেক হোসেন খোকা : একটি সিটি করপোরেশন রেখেও উত্তর দিকে নগর সম্প্রসারণ করা যাবে।
সমকাল : ঢাকা বিভাগকে দুটি বিভাগ করার পরিকল্পনা থেকে ডিসিসিকে দু'ভাগ করা হয়েছে বলেও জানা গেছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
সাদেক হোসেন খোকা : আমার মনে হয় না ঢাকা বিভাগকে দুটি বিভাগ করার পরিকল্পনা থেকে ডিসিসিকে বিভক্ত করার কোনো সম্পর্ক আছে। এটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে করা হয়েছে।
সমকাল : সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে ভবিষ্যতে কোনো মামলা-মোকদ্দমা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে কি? যাতে নির্বাচন আরও পিছিয়ে যেতে পারে?
সাদেক হোসেন খোকা : ডিসিসিকে দু'ভাগ করলে এর সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করাতে এবং কাজের উপযোগী করতে ১২-২০ বছর সময় লাগবে। সীমানা নিয়ে বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হবে। এমনকি এ নিয়ে বহু মামলা-মোকদ্দমা হতে পারে। এতে করে নির্বাচন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যেতে পারে।
সমকাল : আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে কোনো সমস্যা হয়েছে কি? হলে সে সম্পর্কে বলুন।
সাদেক হোসেন খোকা : অর্পিত দায়িত্ব অনুযায়ী আইন-কানুনের বাইরে আমি কোনো ক্ষমতা প্রয়োগ করিনি। দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে খুবই সচেতন থেকেছি। সে কারণে কোনো সরকারের সঙ্গেই আমাকে বড় মাপের কোনো বিরোধ ও বিভ্রান্তির মুখোমুখি হতে হয়নি। তাছাড়া স্থানীয় সরকারের ধারণাটি দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হয়নি। আমি একটা দলের সমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হতে পারি। তবে সজাগ থেকে যে কোনো দলের সরকার এবং সব দলের কাউন্সিলরদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করেছি। দায়িত্ব পালনকালে আওয়ামী লীগের কারও সঙ্গে আমার কোনো দূরত্ব সৃষ্টি হয়নি। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল কাজ করা। দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, সম্মিলিতভাবে একাট্টা হয়ে কাজ করছি। আমার দল, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার_ কারও সঙ্গে বড় মাপের তেমন কোনো সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়নি। তবে ডিসিসিতে সরকারের সহযোগিতা বেশ কমে এসেছে।
সমকাল : দায়িত্ব পালনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর কাছ থেকে কেমন সহযোগিতা পাচ্ছেন?
সাদেক হোসেন খোকা : দায়িত্ব পালনকালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সবসময় সুসম্পর্ক রেখে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন আইনের বিধিবিধান অনুযায়ী আমি কাজ করার চেষ্টা করেছি।
সমকাল : রাজধানী ঢাকা মেগাসিটি। বিশ্বজুড়ে এ ধরনের শহরকে 'কাউন্টি' ঘোষণা করা হয়। কাউন্টির অধীনে আলাদা স্বশাসিত সিটি নামে ঢাকাকে কেন সে দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে না।
সাদেক হোসেন খোকা : হ্যাঁ, নাম যাই হোক_ বিশ্বের বড় শহরগুলোর মতোই একটি কর্তৃপক্ষের অধীনে ঢাকা শহরকে রাখা উচিত। এ ক্ষেত্রে ডিসিসি 'মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্টের' অধীনে পরিচালিত হলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে অনেকের সঙ্গে আমিও একমত। লন্ডন, নিউইয়র্ক এমনকি পাশের দেশ ভারতের নয়াদিলি্ল বা হাতের কাছের কলকাতায়ও একটি সিটি করপোরেশন এবং একজন মেয়র রয়েছেন।
সমকাল : এ মুহূর্তে ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য রাখার লক্ষ্যে কী সব পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন?
সাদেক হোসেন খোকা : ভবিষ্যৎ বংশধরদের কথা চিন্তা করে ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য করতে আগামী একশ' বছরের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ঢাকার জনসংখ্যা ও পরিধি বৃদ্ধির বিষয়টি মাথায় রেখে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এই ক্রমবিকাশমান মহানগরীকে বাসযোগ্য হিসেবে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাই বুড়িগঙ্গা থেকে শীতলক্ষ্যার পাড় ঘেঁষে কেরানীগঞ্জ থেকে সাভার হয়ে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত আগামী দিনের জন্য একটি পরিকল্পিত ঢাকা মহানগরীর মাস্টার প্ল্যান তৈরিতে এখন থেকেই কাজ শুরু করা দরকার। এ কাজে দেশি বিশেষজ্ঞসহ প্রয়োজনে বিদেশি কনসালট্যান্ট নিয়োগের মাধ্যমে মাস্টার প্ল্যানের রূপরেখা চূড়ান্ত করতে হবে। বিশেষ করে পুরান ঢাকার অতীতের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন শহর গড়তে হবে।
এ মুহূর্তে রাজধানীর অন্যতম প্রধান সমস্যা যানজট নিরসনসহ জলাবদ্ধতা নিরসনে পয়ঃনিষ্কাশন, রাস্তাঘাট মেরামত, পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস সমস্যার সমাধান, মশা নিধন, শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশে খেলার মাঠ, গাড়ি পার্কিং, কমিউনিটি সেন্টার, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির ব্যাপারে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
সমকাল : মেয়র হিসেবে যেসব ব্যর্থতা আপনাকে পীড়া দেয় সেগুলো সম্পর্কে কিছু বলুন?
সাদেক হোসেন খোকা : এই মহানগরীতে বহু সেবা সংস্থা, বিভাগ-দফতর-অধিদফতর থাকলেও নগরবাসী বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, আইন-শৃঙ্খলা, রাস্তাঘাট, যানজট, মশা, পরিচ্ছন্নতাসহ স্বাস্থ্য, পয়ঃপ্রণালি, পরিকল্পনা ও নকশা ইত্যাদি বিষয়ে ডিসিসি তথা মেয়রের কার্যকর ভূমিকা আশা করেন। অথচ আমাদের দুর্বল সাংগঠনিক কাঠামো ও সরকারের উচ্চ মহলের মনোযোগের অভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছি না। ডিসিসির আকার, আয়তন, সমস্যা, সীমাবদ্ধতা বৃদ্ধি পেলেও এর সাংগঠনিক শক্তি মোটেও বৃদ্ধি পায়নি। ডিসিসির ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে নাগরিকদের অনেক সেবার শতভাগ নিশ্চিত করতে পারিনি_ তা আমাকে পীড়া দেয়। ডিসিসিকে যদি আলাদা সত্তা হিসেবে না দেখা হয়, কিংবা তার নিজস্ব স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি মীমাংসা করা না হয়, তাহলে সমস্যাগুলোর ত্বরিত সমাধান করা সম্ভব নয়।
সমকাল : আপনার চোখে মেয়র হিসেবে সাফল্য কী?
সাদেক হোসেন খোকা : সীমিত ক্ষমতার মধ্যে আমি সাধ্য অনুযায়ী নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি। ২০০২ সালে আমার দায়িত্বভার গ্রহণকালীন সময়ে ডিসিসির ৬৩১ কোটি টাকা দেনার দায় ছাড়াও নগরীর প্রায় সব রাস্তাঘাটের অবস্থা ছিল একেবারে বিধ্বস্ত। তখন আর্বজনা অপসারণে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন না করার কারণে নাগরিক পরিবেশ বিষিয়ে উঠেছিল। রাস্তায় বাতির অভাবে নগরজুড়ে ছিল অন্ধকার। মশার সীমাহীন উপদ্রব ও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের ফলে শতাধিক প্রাণহানির পাশাপাশি অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল। জনগণ ছিল আতঙ্কগ্রস্ত। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সিটি করপোরেশন নিয়ে নগরবাসী, দাতা সংস্থা কিংবা সরকারের মধ্যে আস্থাহীনতা বা হতাশার সৃষ্টি হয়। বিগত বছরগুলোতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা দিয়ে সে অবস্থার পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছি। ইতিমধ্যে ডিসিসির গৃহীত ঋণের পুরোটাই পরিশোধ করতে সমর্থ হয়েছি।
সমকাল : সরকার বলছে, ঢাকায় বর্তমানে জনসংখ্যা এক কোটিরও বেশি। একটি সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে নগরবাসীর কাঙ্ক্ষিত সুবিধা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এ কারণেই ডিসিসিকে দু'ভাগ করা হয়েছে। এ যুক্তি কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
সাদেক হোসেন খোকা : জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ডিসিসিকে বাড়তি কোনো পদক্ষেপ নিতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আভাস-ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি। জনসংখ্যার দোহাই দিয়ে ডিসিসিকে দু'ভাগ করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ডিসিসির সঙ্গে ঢাকার মানুষের আবেগ-অনুভূতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য জড়িত রয়েছে। রাজনৈতিক কারণে সরকার তা কেটে ফেলার চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগের নেতা সাবেক মেয়র মরহুম মোহাম্মদ হানিফ সাহেব বিভিন্ন সেবা সংস্থাগুলোকে ডিসিসির অধীনে এনে 'মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্ট' গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন। ডিসিসিকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অধীনে নেওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি। অনেক সময় তাৎক্ষণিকভাবে বড় ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু একটি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সব মন্ত্রণালয় ও দফতরের মধ্যে সমন্বয় করে দ্রুত সিদ্ধান্ত দেওয়া সম্ভব হয় না। এ বিষয়গুলো চিন্তায় না এনেই হঠাৎ করে বিভক্তির বিষয়টি আজগুবি চিন্তা ছাড়া আর কিছু নয়। আসলে ডিসিসির মাধ্যমে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সহায়তা দরকার। পৃথিবীর বড় শহরগুলোতে এ ধরনের দুটি প্রশাসনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ওই শহরগুলো যে আইন দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে তা অনুকরণ করে ডিসিসিকে একীভূত রেখেই উত্তম সেবার মান নিশ্চিত করা যেতে পারে।
সমকাল : স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, সিটি করপোরেশন ভাগ করে সমস্যা আরও বাড়বে, কমবে না। বিশেষজ্ঞদের এ বক্তব্য সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
সাদেক হোসেন খোকা : বিশেষজ্ঞরা সঠিক মূল্যায়নই করেছেন। সেবা খাতগুলোর সঙ্গে ডিসিসির সমন্বয় না থাকার কারণে এগুলো নাগরিকদের প্রকৃত সেবা দিতে পারছে না। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, সেবা নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশন ভাগ করার কোনো প্রয়োজন নেই, সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে 'সমন্বয়' থাকলেই ভালো সেবা দেওয়া সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের এ অভিমত পুরোপুরি সঠিক।
সমকাল : ডিসিসির ১৮তম বোর্ডসভার সিদ্ধান্তগুলো কি বাস্তবায়ন হচ্ছে?
সাদেক হোসেন খোকা : বোর্ডসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বুধবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীকে ডিসিসিকে বিভক্তি না করার অনুরোধ জানিয়ে একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলররা। এতে একজন মেয়রের অধীনে ৪ জন ডেপুটি মেয়রের পদ সৃষ্টি করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তাছাড়া অঞ্চলভিত্তিক জনপ্রতিনিধিদের মধ্য থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে আঞ্চলিক চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করার সুপারিশ করা হয়েছে। নগরীর অন্যান্য সেবা সংস্থাগুলোকেও ডিসিসির অধীনে আনার প্রস্তাব রয়েছে।
সমকাল : আগামী ডিসেম্বর নাগাদ সিটি করপোরেশন আইনের সংশোধন জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিসিসি বিলুপ্ত হবে। সরকার দুটি সিটিতে ১২০ দিনের জন্য প্রশাসক নিয়োগ দেবে। এ সময়ের মধ্যে নতুন নির্বাচন হবে_ আইনে এ বিধান রাখা হয়েছে?
সাদেক হোসেন খোকা : আমি আবারও বলছি, ডিসিসিকে বিলুপ্ত করে দুটি করপোরেশন করা একেবারেই সঠিক হবে না। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিদলীয় কাউন্সিলর, বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা জোরালো বক্তব্য রাখছেন। আশা করি, সরকার জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে অবস্থান পরিবর্তন করবে। ফলে ১২০ দিনের মধ্যে প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত কার্যকর করারও কোনো প্রয়োজন পড়বে না।
সমকাল : আগামী বছরের প্রথম দিকে ডিসিসির নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আপনি কি আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন?
সাদেক হোসেন খোকা : আমার দল বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী দল। ডিসিসির মেয়র পদে নির্বাচন করার মতো একাধিক যোগ্য ব্যক্তি রয়েছেন। সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হলে বিএনপির পক্ষ থেকে কেউ না কেউ প্রার্থী হবেন।
সমকাল : ডিসিসির মেয়ররা দীর্ঘদিন ধরে মন্ত্রীর পদমর্যাদা পেয়ে আসছেন। দু'ভাগ হওয়ার পর নতুন মেয়রদের প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
সাদেক হোসেন খোকা : আমি আশা করি, ঐতিহ্যবাহী ডিসিসি কোনোভাবেই পশ্চাদ্মুখী হবে না। আমার মনে হয়, বাস্তবতা উপলব্ধি করে সরকার যে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে_ তা থেকে সরে আসবে। সে ক্ষেত্রে ডিসিসির মেয়রের পদ পূর্ণ মন্ত্রী থেকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় নেমে আসার কোনো প্রশ্ন উঠবে না।
সমকাল : গত কয়েক বছর ডিসিসি নাগরিক সেবা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্ত্রিসভায় পাঠানো প্রস্তাবে বলা হয়। সরকারের এ বক্তব্য যদি সঠিক হয়, দীর্ঘদিন মেয়রের দায়িত্ব পালন করায় আপনার ওপরও এর দায়দায়িত্ব পড়ে?
সাদেক হোসেন খোকা : মন্ত্রিসভায় পাঠানো প্রস্তাবটি পুরোপুরি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করা হয়েছে। সুতরাং ওই প্রস্তাবটির সপক্ষে কোনো না কোনো অজুহাত দাঁড় করাতেই হবে। তাছাড়া নাগরিক সেবা হয়তো শতভাগ নিশ্চিত করা যায়নি। তার কারণ হলো_ শতভাগ সেবা নিশ্চিত করার মতো সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ডিসিসিকে গড়ে তোলা হয়নি। সরকার পানি ঘোলা না করে সর্বজনীন দাবিতে সাড়া দিয়ে ডিসিসিকে যত বেশি শক্তিশালী করবে, তত বেশি নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
সমকাল : বিভক্ত করলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কপোরেশনের আওতায় ৫৬টি এবং উত্তরের আওতায় থাকবে ৩৬টি ওয়ার্ড। এতে অভিজাত এলাকাগুলো উত্তরে পড়ায় রাজস্ব আদায়ে দক্ষিণের সঙ্গে বড় ধরনের ব্যবধান তৈরি হতে পারে কি?
সাদেক হোসেন খোকা : হ্যাঁ, এতে দুটি অংশের মধ্যে আয়-ব্যয়ের বৈঠম্যের সৃষ্টি হবে। এমনকি করপোরেশনের প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক খরচও দ্বিগুণ হবে। এ ছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদায়ন ও অবসরকালীন সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক জটিলতা দেখা দেবে, যা নিরসনে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হবে। ডিসিসিকে দ্বিখণ্ডিত করার সিদ্ধান্তে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের ঋণে আন্তর্জাতিক কনসালট্যান্টের মাধ্যমে সীমানা সমীক্ষা চালানো হয়। ওই সময় মন্ত্রিসভায় অন্যান্য দেশের মতো এককেন্দ্রিক কর্তৃপক্ষ (ইউনিটারি অথরিটি) প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অনুমোদন করা হয়। সাম্প্রতিক মন্ত্রিসভার বৈঠকের সিদ্ধান্ত ওই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাংঘর্ষিকও বটে। সুতরাং হঠাৎ করে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সিদ্ধান্তের আগে আরও ব্যাপকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা উচিত।
সমকাল : ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সীমানা বড় রাখার যুক্তি হিসেবে ভবিষ্যতে উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকা সম্প্রসারণের কথা বলছে সরকার। ভবিষ্যতে দক্ষিণে আর সম্প্রসারণের কোনো সুযোগ নেই বলা হচ্ছে। আপনি কী বলেন?
সাদেক হোসেন খোকা : একটি সিটি করপোরেশন রেখেও উত্তর দিকে নগর সম্প্রসারণ করা যাবে।
সমকাল : ঢাকা বিভাগকে দুটি বিভাগ করার পরিকল্পনা থেকে ডিসিসিকে দু'ভাগ করা হয়েছে বলেও জানা গেছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
সাদেক হোসেন খোকা : আমার মনে হয় না ঢাকা বিভাগকে দুটি বিভাগ করার পরিকল্পনা থেকে ডিসিসিকে বিভক্ত করার কোনো সম্পর্ক আছে। এটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে করা হয়েছে।
সমকাল : সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে ভবিষ্যতে কোনো মামলা-মোকদ্দমা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে কি? যাতে নির্বাচন আরও পিছিয়ে যেতে পারে?
সাদেক হোসেন খোকা : ডিসিসিকে দু'ভাগ করলে এর সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করাতে এবং কাজের উপযোগী করতে ১২-২০ বছর সময় লাগবে। সীমানা নিয়ে বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হবে। এমনকি এ নিয়ে বহু মামলা-মোকদ্দমা হতে পারে। এতে করে নির্বাচন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যেতে পারে।
সমকাল : আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে কোনো সমস্যা হয়েছে কি? হলে সে সম্পর্কে বলুন।
সাদেক হোসেন খোকা : অর্পিত দায়িত্ব অনুযায়ী আইন-কানুনের বাইরে আমি কোনো ক্ষমতা প্রয়োগ করিনি। দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে খুবই সচেতন থেকেছি। সে কারণে কোনো সরকারের সঙ্গেই আমাকে বড় মাপের কোনো বিরোধ ও বিভ্রান্তির মুখোমুখি হতে হয়নি। তাছাড়া স্থানীয় সরকারের ধারণাটি দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হয়নি। আমি একটা দলের সমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হতে পারি। তবে সজাগ থেকে যে কোনো দলের সরকার এবং সব দলের কাউন্সিলরদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করেছি। দায়িত্ব পালনকালে আওয়ামী লীগের কারও সঙ্গে আমার কোনো দূরত্ব সৃষ্টি হয়নি। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল কাজ করা। দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, সম্মিলিতভাবে একাট্টা হয়ে কাজ করছি। আমার দল, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার_ কারও সঙ্গে বড় মাপের তেমন কোনো সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়নি। তবে ডিসিসিতে সরকারের সহযোগিতা বেশ কমে এসেছে।
সমকাল : দায়িত্ব পালনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর কাছ থেকে কেমন সহযোগিতা পাচ্ছেন?
সাদেক হোসেন খোকা : দায়িত্ব পালনকালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সবসময় সুসম্পর্ক রেখে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন আইনের বিধিবিধান অনুযায়ী আমি কাজ করার চেষ্টা করেছি।
সমকাল : রাজধানী ঢাকা মেগাসিটি। বিশ্বজুড়ে এ ধরনের শহরকে 'কাউন্টি' ঘোষণা করা হয়। কাউন্টির অধীনে আলাদা স্বশাসিত সিটি নামে ঢাকাকে কেন সে দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে না।
সাদেক হোসেন খোকা : হ্যাঁ, নাম যাই হোক_ বিশ্বের বড় শহরগুলোর মতোই একটি কর্তৃপক্ষের অধীনে ঢাকা শহরকে রাখা উচিত। এ ক্ষেত্রে ডিসিসি 'মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্টের' অধীনে পরিচালিত হলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে অনেকের সঙ্গে আমিও একমত। লন্ডন, নিউইয়র্ক এমনকি পাশের দেশ ভারতের নয়াদিলি্ল বা হাতের কাছের কলকাতায়ও একটি সিটি করপোরেশন এবং একজন মেয়র রয়েছেন।
সমকাল : এ মুহূর্তে ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য রাখার লক্ষ্যে কী সব পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন?
সাদেক হোসেন খোকা : ভবিষ্যৎ বংশধরদের কথা চিন্তা করে ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য করতে আগামী একশ' বছরের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ঢাকার জনসংখ্যা ও পরিধি বৃদ্ধির বিষয়টি মাথায় রেখে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এই ক্রমবিকাশমান মহানগরীকে বাসযোগ্য হিসেবে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাই বুড়িগঙ্গা থেকে শীতলক্ষ্যার পাড় ঘেঁষে কেরানীগঞ্জ থেকে সাভার হয়ে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত আগামী দিনের জন্য একটি পরিকল্পিত ঢাকা মহানগরীর মাস্টার প্ল্যান তৈরিতে এখন থেকেই কাজ শুরু করা দরকার। এ কাজে দেশি বিশেষজ্ঞসহ প্রয়োজনে বিদেশি কনসালট্যান্ট নিয়োগের মাধ্যমে মাস্টার প্ল্যানের রূপরেখা চূড়ান্ত করতে হবে। বিশেষ করে পুরান ঢাকার অতীতের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন শহর গড়তে হবে।
এ মুহূর্তে রাজধানীর অন্যতম প্রধান সমস্যা যানজট নিরসনসহ জলাবদ্ধতা নিরসনে পয়ঃনিষ্কাশন, রাস্তাঘাট মেরামত, পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস সমস্যার সমাধান, মশা নিধন, শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশে খেলার মাঠ, গাড়ি পার্কিং, কমিউনিটি সেন্টার, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির ব্যাপারে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
সমকাল : মেয়র হিসেবে যেসব ব্যর্থতা আপনাকে পীড়া দেয় সেগুলো সম্পর্কে কিছু বলুন?
সাদেক হোসেন খোকা : এই মহানগরীতে বহু সেবা সংস্থা, বিভাগ-দফতর-অধিদফতর থাকলেও নগরবাসী বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, আইন-শৃঙ্খলা, রাস্তাঘাট, যানজট, মশা, পরিচ্ছন্নতাসহ স্বাস্থ্য, পয়ঃপ্রণালি, পরিকল্পনা ও নকশা ইত্যাদি বিষয়ে ডিসিসি তথা মেয়রের কার্যকর ভূমিকা আশা করেন। অথচ আমাদের দুর্বল সাংগঠনিক কাঠামো ও সরকারের উচ্চ মহলের মনোযোগের অভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছি না। ডিসিসির আকার, আয়তন, সমস্যা, সীমাবদ্ধতা বৃদ্ধি পেলেও এর সাংগঠনিক শক্তি মোটেও বৃদ্ধি পায়নি। ডিসিসির ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে নাগরিকদের অনেক সেবার শতভাগ নিশ্চিত করতে পারিনি_ তা আমাকে পীড়া দেয়। ডিসিসিকে যদি আলাদা সত্তা হিসেবে না দেখা হয়, কিংবা তার নিজস্ব স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি মীমাংসা করা না হয়, তাহলে সমস্যাগুলোর ত্বরিত সমাধান করা সম্ভব নয়।
সমকাল : আপনার চোখে মেয়র হিসেবে সাফল্য কী?
সাদেক হোসেন খোকা : সীমিত ক্ষমতার মধ্যে আমি সাধ্য অনুযায়ী নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি। ২০০২ সালে আমার দায়িত্বভার গ্রহণকালীন সময়ে ডিসিসির ৬৩১ কোটি টাকা দেনার দায় ছাড়াও নগরীর প্রায় সব রাস্তাঘাটের অবস্থা ছিল একেবারে বিধ্বস্ত। তখন আর্বজনা অপসারণে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন না করার কারণে নাগরিক পরিবেশ বিষিয়ে উঠেছিল। রাস্তায় বাতির অভাবে নগরজুড়ে ছিল অন্ধকার। মশার সীমাহীন উপদ্রব ও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের ফলে শতাধিক প্রাণহানির পাশাপাশি অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল। জনগণ ছিল আতঙ্কগ্রস্ত। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সিটি করপোরেশন নিয়ে নগরবাসী, দাতা সংস্থা কিংবা সরকারের মধ্যে আস্থাহীনতা বা হতাশার সৃষ্টি হয়। বিগত বছরগুলোতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা দিয়ে সে অবস্থার পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছি। ইতিমধ্যে ডিসিসির গৃহীত ঋণের পুরোটাই পরিশোধ করতে সমর্থ হয়েছি।
No comments