দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশঃ অগ্রগতি এবং অবনতি by আবুল কালাম আজাদ
এবার কিছুটা দেরিতে গত ১৭ নভেম্বর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৮০টি দেশের ওপর ২০০৯ সালের দুর্নীতির ধারণা সূচক বা করাপশন পারসেপশন ইন্ডেক্স (সিপিআই) প্রকাশ করেছে। এবার বাংলাদেশ, পাকিস্তান, বেলারুশ ও ফিলিপাইনের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে নিচের দিক থেকে ১৩তম স্থান লাভ করেছে, সিপিআই স্কোর ২.৪ (০-১০ স্কেলে)।
গত বছর তা ছিল যথাক্রমে দশম ও ২.১। দেখা যাচ্ছে, সিপিআই স্কোর গত বছরের তুলনায় এ বছর ০.৩ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দুর্নীতি তিনধাপ কমেছে। গতবারের মতো এবছরও সোমালিয়া সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, সূচক ১.১। এখানে উল্লেখ্য, টিআই প্রতি বছর যে সিপিআই প্রকাশ করে তা তার পূর্ববর্তী একাধিক বছরের বিভিন্ন নিরপেক্ষ সংস্থার জরিপের ভিত্তিতে প্রণীত হয়।
গত জুলাই মাসে বিশ্বব্যাংক ইনস্টিটিউট ‘বিশ্বব্যাপী সুশাসন নির্দেশক-২০০৮’ প্রকাশ করেছে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের স্কোর-১.১০ (-২.৫+২.৫ স্কেলে), যা আগের বছরের-১.০৮ অপেক্ষা কমে গেছে। সোমালিয়ার স্কোর সর্বনিম্ন-১.৯০ এবং এবার নিয়ে পরপর পাঁচবার সোমালিয়া সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বিবেচিত হলো। বলা বাহুল্য, বিশ্বব্যাংক ইনস্টিটিউটের বিশ্বব্যাপী সুশাসন নির্দেশকের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের স্কোর কোনো বছরই সর্বনিম্ন ছিল না।
নভেম্বর ’০৯ মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশনের (এমসিসি) স্কোর কার্ডে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সর্বনিম্ন স্কোর সোমালিয়ার (০.০%)। বাংলাদেশের স্কোর ২৪% (০%-১০০% স্কেলে); গতবার ছিল ২৫%। অর্থাত্ গত বছরের তুলনায় এ বছর ১% অবনতি হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের ফলাফল মিশ্র।
শুরু করেছিলাম টিআইর দুর্নীতির ধারণা সূচক দিয়ে। ২০০১-এর পর থেকে দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করে আসছে। এবারসহ বাংলাদেশের তিনবার দুর্নীতির ধারণা সূচকে ০.৩ বা তার বেশি অগ্রগতি হয়েছে। প্রথমবার ২০০২ সালে। ২০০১ সালে বাংলাদেশের সূচক ছিল সর্বকালের সর্বনিম্ন ০.৪; ২০০২ সালে ০.৮ বেড়ে তা ১.২-তে দাঁড়ায়। এক বছরে কোনো দেশের সূচকে ০.৮ বৃদ্ধি নজিরবিহীন। এরপর ২০০৫ সালের ১.৭ থেকে ০.৩ বেড়ে ২০০৬ সালে বাংলাদেশের সূচক দাঁড়ায় ২.০-তে। ওই দুই বছর আমাদের মিডিয়ায় এবারের মতো তেমন ইতিবাচক উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি। গত ১৯ নভেম্বর দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচকের ওপর লিখিত প্রবন্ধে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক উল্লেখ করেছেন, ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের স্কোর দুইয়ের অধিকে উন্নীত হয়। এতে আমার মতো অনেকেই বিভ্রান্তিতে পড়েছেন। কারণ টিআইর ওয়েবসাইটে দেখা যায়, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২.২৯। ১৯৯৬-২০০১ সময়কালের সরকারের বদৌলতে তা কমে ২০০১ সালে ০.৪-তে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশের সিপিআই স্কোর ১৯৯৬ সালে ২.২৯ থেকে ২০০১ সালে ০.৪-তে নেমে যাওয়ায় সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় যে ওই সময়কালে এদেশে ব্যাপকভাবে দুর্নীতি বেড়েছিল। কিন্তু আমাদের পক্ষপাতদুষ্ট মিডিয়া ও দলকানা নাগরিক সমাজ সে সময় সুনসান নীরবতা পালন করেছে। ফলে দুর্নীতির ব্যাপকতা সম্পর্কে এদেশের জনগণ অন্ধকারে ছিল। পছন্দের দল ক্ষমতাসীন না হওয়ায় ২০০১-২০০৬ সময়কালে ওই নাগরিক সমাজ ও মিডিয়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে মহান জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছে। তা ছাড়া টিআইবি ও সুজনও দুর্নীতিবিরোধী প্রচারণা জোরদার করে। এর উপকারও পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের সিপিআই স্কোর ২০০১ সালে ০.৪ থেকে ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০০৬ সালে ২.০ এবং ২০০৯ সালে ২.৪ হয়েছে। ১৩ বছর পর ১৯৯৬ সালের স্কোর অতিক্রান্ত হলো। এই অর্জন কম কিসের? তবে এর পেছনে বিএনপি জোট সরকার ও উদ্দিনদের অসাংবিধানিক সরকারের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। আগামী বছরগুলোয় এই স্কোর ধরে রাখাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আশার কথা, বর্তমান মহাজোট সরকারের আটানব্বই শতাংশ অংশীদার আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার করা হয়েছে। ইশতেহারে বলা হয়েছে, ‘দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালী করা হবে। ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণী দিতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরের ঘুষ, দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনোপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালো টাকা ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
বর্তমান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় এক বছর হতে চলল, কিন্তু ইশতেহারে বর্ণিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো উদ্যোগই দেখা যায়নি; বাস্তবে বরং উল্টো চিত্রই জনগণ দেখতে পাচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে সংস্থাটির চেয়ারম্যানের মতে একে নখ-দন্তহীন বাঘে পরিণত করা হয়েছে। সরকারি দলের নেতা-কর্মীর শত শত দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। টেকনিক্যাল কারণে উচ্চ আদালত থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দুর্নীতিবাজ খালাস পেয়ে দম্ভ দেখাচ্ছেন। তাদের মধ্যে অনেকে আছেন যারা সম্পদ বিবরণীতে দেড়-দুই কোটি টাকার এফডিআর হিসাব গোপন করে লাখ লাখ টাকার কর ফাঁকি দিয়েছেন। গত প্রায় এক বছরেও ক্ষমতাধররা কোনো সম্পদ বিবরণী জমা দেননি। সরকারি অফিস আদালতে ঘুষ-দুর্নীতির ব্যাপকতা একটুও কমেনি। বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর অঙ্গ-সংগঠনের ক্যাডারদের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলবাজি অন্য যেকোনো সময়কে হার মানিয়েছে। সরকারি ক্রয় আইন সংশোধন করে দলীয় ক্যাডারদের টু-পাইস কামানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ঈদুল আজহায় গ্রামের বাড়ি গিয়ে গ্রামবাসীর কাছে সেই পুরনো কথাই নতুনভাবে শুনলাম। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, কাবিখা, টিআর প্রভৃতি প্রকল্পের টাকা ভাগ-বাটোয়ারার কাহিনী। সর্্বোচ্চ ৩০ ভাগ টাকার কাজ হয়; বাকি ৭০ ভাগ টাকা আমলা, রাজনীতিবিদ, ক্যাডার প্রভৃতির মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হচ্ছে। এই যখন অবস্থা তখন আগামীতে দুর্নীতির ধারণা সূচকে উন্নতির চেয়ে অবনতি হলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
দুর্নীতি একটি সামাজিক ব্যাধি। স্বাধীনতা-উত্তরকালে ধীরে ধীরে এর বিস্তার ঘটে। আশির দশক ও তত্পরবর্তিতে এটি মহামারীর রূপ ধারণ করে। এই জটিল ব্যাধি সাড়ানোর জন্য প্রতিকারমূলক ও প্রতিষেধকমূলক উভয় ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে হবে। প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দল-মত নির্বিশেষে দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা। এটি প্রতিষেধকের কাজও করবে। দুর্নীতিবাজ রুই-কাতলাদের শাস্তির বিধান করা গেলে চুনোপুঁটিরা এমনিতেই খামোশ হয়ে যাবে। এর জন্য সর্ব প্রথম প্রয়োজন স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিচার ব্যবস্থা। সরকারকেই তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কটের মাধ্যমেও দুর্নীতির প্রতিকার সম্ভব। প্রতিষেধক ব্যবস্থার মধ্যে প্রথমেই আসে নৈতিকতা। উন্নত নৈতিক চরিত্রের মানুষ দুর্নীতি ও অন্যায় কাজ থেকে শুধু নিজেই বিরত থাকেন না, অন্যদেরও বিরত থাকতে প্রভাবিত করেন। তাই দেশের নাগরিকদের নীতি-নৈতিকতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে এবং শৈশবেই তার বীজ বপন করতে হয়। এর জন্য পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের) শিক্ষকদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। নৈতিক শিক্ষার প্রধানতম মাধ্যম হচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষা। তাই প্রাথমিক পর্যায়েই ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। প্রয়োজনে প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিতে কিছু সংশোধনী আনা যেতে পারে। এরপর আসে দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণসচেতনতা।
দেশের গণমানুষকে দুর্নীতির অভিশাপ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে দুদক ও গণমাধ্যমের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তা ছাড়া টিআইবি এবং সুশাসন নিয়ে কাজ করছেন এমন সংগঠনগুলোর কর্মতত্পরতা আরো বৃদ্ধি করতে হবে। তথ্য আইনের বাস্তবায়নও দুর্নীতি কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশের জনগণ তাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে দুর্নীতিতে আর চ্যাম্পিয়ন দেখতে চায় না, চায় দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে। সরকারের হাতে আরো চার বছর সময় আছে। আর বিলম্ব না করে নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতি দমনের যে অঙ্গীকার করা হয়েছে তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া হোক, এটিই আমজনতার প্রত্যাশা।
লেখক : সাবেক সচিব
Email : azad2150@yahoo.com
No comments