বীণা সিক্রি-পুরনো তবু যেন নতুন প্রতিবেশী

গামী ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের ফল সম্পর্কে এখনই আঁচ করা যায়। এর ফল হবে সুদূরপ্রসারী, এমনো চিন্তা করছেন কেউ কেউ। বিশ্লেষকরা এই সফরকে সত্তরের দশকের উল্লেখযোগ্য দুটি সফরের সঙ্গে তুলনা করছেন। তার একটি ছিল, ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঢাকা সফর এবং দ্বিতীয়টি পরবর্তীকালে ১৯৭৪ সালের মে মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের ভারত সফর।


এই তুলনা করার পেছনে কিছু যুক্তি আছে। প্রায় ৪০ বছরের দীর্ঘ একটা ফাঁক রয়েছে দেশ দুটির মধ্যে। আমাদের দুটি দেশের নেতারা উপলব্ধি করেছেন, একুশ শতকে এসে সেই অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করতে হবে। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করার পর থেকে তা শুরু হয়েছিল। আশা করা যাচ্ছে, ৬ সেপ্টেম্বর এই সফরকালে সীমান্ত চিহ্নিতকরণ চুক্তি হবে, ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি সংক্রান্ত সমস্যাগুলোরও নিষ্পত্তি হবে। সেই সঙ্গে ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে দুটি দেশের ঘনিষ্ঠতা আরো দৃঢ়তর হবে। ১৯৭৪ সালের মে মাসে স্বাক্ষরিত এই চুক্তিটি মূলত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত চুক্তি নামে পরিচিত।
একইভাবে বাণিজ্য এবং ট্রানজিট বিষয়েও সিদ্ধান্ত হবে। ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ইন্দিরা গান্ধীর ঢাকা সফরের সময় দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ ঘোষণায় তা উল্লেখ করা হয়েছিল। দুই দেশের সীমান্ত বাণিজ্য এবং ট্রানজিটের বিষয়টি নীতিগতভাবে ওই সময় মেনে নেওয়া হয়েছিল। এর কয়েক দিন পর, ১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ, ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ওই চুক্তিতে নৌপথ, সড়কপথ ও রেলপথে ট্রানজিটের বিষয়টির স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। এর কয়েক মাস পর, ১৯৭২ সালের নবেম্বর মাসে, ভারত-বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপথে ট্রানজিট ও বাণিজ্য প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। বাণিজ্যের প্রয়োজনে ট্রানজিট রীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই। ১৯৬৫ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে সেই চুক্তি বাধাগ্রস্ত হয়। সেই বাধা কিন্তু পরবর্তীকালে শতভাগ নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীকালে আমাদের নেতাদের মাধ্যমে এর মোড় ঘুরতে থাকে। ১৯৯৯ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ির সফরের পর থেকে ঢাকা-কলকাতা বাস সার্ভিস চালু হয়। তার দুই বছর পর, ২০০১ সালের জুলাই মাসে, ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস চালু হয়। ২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা-কলকাতা ট্রেন সার্ভিস চালু হয় দীর্ঘ ৪৩ বছর বিরতির পর, যা মৈত্রী (বন্ধুত্ব) ট্রেন নামে পরিচিত হয়।
২০১০ এবং ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের সফরের মাধ্যমে উভয় দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এবং নেপাল ও ভুটানকেও ট্রানজিট কানেকটিভিটির আওতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রও তৈরি হচ্ছে। এতে করে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর-পূর্ব ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপাল উপ-আঞ্চলিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। প্রকৃতিগতভাবে এই অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশ ট্রানজিট ও পরিবহন সুবিধাপ্রাপ্ত একটি দেশ। এই সুযোগ গ্রহণ করার মাধ্যমে তাদের দেশের অভ্যন্তরে অনেক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে, যাতে দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হবে। এখন ঢাকায় বিআইএমএসটিইসি সচিবালয় প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়নের ব্যাপারে শেখ হাসিনার সুস্পষ্ট আন্তরিকতা রয়েছে।
ভারতের এই মুহূর্তেই এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়ার যে কথা আছে, তা বাস্তবায়ন করার বিষয়টি চিন্তা করা উচিত। এটা তো আগেই প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের পর এই বিষয়টি দ্রুত কার্যকর হয়ে যাবে বলে আশা করা যায়।
মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের মাধ্যমে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের ব্যাপারে ইতিবাচক ফল প্রত্যাশা করছে ঢাকা। এর মধ্যে রয়েছে নদীর পানির হিস্যা এবং ভারতের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশের বিষয়টি নিশ্চিত করা। যাতে করে ভারতের সঙ্গে দেশটির বাণিজ্য বৈষম্য হ্রাস পেতে পারে। বাংলাদেশের জনগণ এই সফরের ফল সম্পর্কে নিশ্চয়ই সুবিবেচনা করবে। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীদ্বয় তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টন বিষয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন। এটা অবশ্যই আশা করা যায়, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ বাণিজ্য সুবিধা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে।
সফরকালে ১০ কিংবা তার বেশি সমঝোতা স্মারক ও প্রটোকল স্বাক্ষর হওয়ার কথা। তার জন্য উভয়পক্ষের দুই দল বিশেষজ্ঞ অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। আশা করা যায়, তা সফল হবে। বাংলাদেশের প্রচার মাধ্যমে এতদ্বিষয়ে বেশকিছু তথ্যসংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে তা আরো উন্নত করার জন্য কাজ করতে পারে।
শেখ হাসিনা তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে অত্যন্ত সাহসী কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। তাঁর গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর অধিকাংশই তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ ছিল। সে ইশতেহার তাঁকে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনে দিয়েছিল। শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন, তাঁর দেশটি ধর্মনিরপেক্ষ নীতিতে আস্থাশীল থাকবে। আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করবে। শেখ হাসিনা ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন, যারা বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করত। তাঁর এই পদক্ষেপ ভারত সরকারের হাতকে শক্তিশালী করেছে এবং এর মাধ্যমে ভারত সরকার ওসব গ্রুপের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ পেয়েছে। মনমোহন সিং নিশ্চয়ই এই সফরকালে ওই বিষয়টি মাথায় রাখবেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভারত কোনো ইস্যু ছিল না। সুতরাং এখন শেখ হাসিনাকে ভারতপন্থী কিংবা বেগম খালেদা জিয়াকে ভারতবিরোধী বলার তেমন কোনো সুযোগ নেই। বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপি এবং জামায়াত চীনপন্থী হওয়ার কারণে মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর যাতে হেয় প্রতিপন্ন হয়, তা চাইতে পারে।
দুটি দেশের সম্পর্ককে আরো উন্নত করা এবং উভয়ের স্বার্থ সমুন্নত রাখার জন্য উভয় দেশের বাণিজ্য প্রতিনিধিদের ঘন ঘন সফর করার প্রয়োজন আছে। দুই দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে প্রচারমাধ্যমও বড় ভূমিকা পালন করে। মনে রাখতে হবে, ভারতের পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বড় স্বার্থ জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সঙ্গে। সেদিকটি বিবেচনায় রাখতে হবে।
লেখক : ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন।
ডেকান ক্রনিক্‌ল্‌ থেকে ভাষান্তর : মোস্তফা হোসেইন

No comments

Powered by Blogger.