জলবায়ু বিপন্নতা সূচক-বিশ্ব সম্প্রদায় আরও উদ্যোগী হোক
জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিপন্নতার সর্বশেষ সূচকে বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার বিষয়টি উদ্বেগজনক হলেও আকস্মিক নয়। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন এইড প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনেও জলবায়ু পরিবর্তন ও ক্ষুধা মোকাবেলায় বাংলাদেশ পঞ্চম বিপন্ন দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল।
বস্তুত গত কয়েক বছর ধরে বৈশ্বিক এই বিপদ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে আমরা এ বিষয়েই বিশ্ব নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে আসছি। ঝুঁকি বিশ্লেষণ সংক্রান্ত বিশেষায়িত ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান ম্যাপলক্রফট প্রণীত এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেল বা আইপিসিসি পর্যালোচিত নতুন প্রতিবেদনটিতে তারই স্বীকৃতি মিলল। এই ইস্যুতে বাংলাদেশে তৎপর বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আরও আগে থেকে বলে আসছিল যে, শুধু ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে নয়, জনসংখ্যার ঘনত্বও বাংলাদেশকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে কেবল হাতিয়া তলিয়ে গেলেই আমাদের দেশে মালদ্বীপের চেয়ে বেশি মানুষ উদ্বাস্তু হবে। গোটা নেপালে যে পরিমাণ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কেবল উপকূলীয় অঞ্চলেই আমাদের সে পরিমাণ অধিবাসী রয়েছে। পরের দিকে অবশ্য সরকার ও বিশেষজ্ঞ মহল থেকে এমন দাবি অনুৎসাহিত করা হয়েছিল যে, এতে করে 'সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ' দেশের দাবিদার অন্যান্য দেশের সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিযোগিতা তৈরি হতে পারে। এমন দাবি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণের দায়ও বর্তাতে পারে আমাদের ওপর। ম্যাপলক্রফটের এই প্রতিবেদনের পর বিষয়টি নিয়ে আর বিতর্কের অবকাশ থাকবে না বলে প্রত্যাশা। এখন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ও তহবিলে বাংলাদেশের দাবি বিশেষভাবে বিবেচিত হবে আশা করা যায়। তবে কী কারণে বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠানটি বিপন্নতা সূচকে বাংলাদেশকে শীর্ষস্থানে রেখেছে, তাও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে আমাদের। বিশেষ সুবিধা গ্রহণের পাশাপাশি দায়িত্বশীলতার পরিচয়ও দিতে হবে। ম্যাপলক্রফটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দারিদ্র্যের চরম মাত্রা, উচ্চ কৃষিনির্ভরতা, জলবায়ুতে অনুমিত পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের নিম্ন সামর্থ্যই বাংলাদেশকে বিপন্নতা সূচকে বাংলাদেশকে শীর্ষস্থানে নিয়ে গেছে। আমরা জানি, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় বাংলাদেশের রয়েছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায়ও বাংলাদেশের নীতিগত প্রস্তুতি বিশ্বে উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। উন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম নাপা (ন্যাশনাল এডাপটেশন প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন) এবং ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি পেপার তৈরি করতে পেরেছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় যে বিপুল ব্যবহারিক ও কারিগরি আয়োজন জরুরি, তা পরিচালনায় বাংলাদেশের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন ম্যাপলক্রফটের প্রতিবেদনের আগেও উঠছে। আমরা মনে করি, এই সন্দেহ নিরসনে আমাদের আরও আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ যে ঝুঁকির মুখে পড়েছে, তাতে আমাদের অবদান নেই বললেই চলে। কিন্তু অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে বসে থাকা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যেই নিজস্ব অর্থায়নে গৃহীত প্রকল্পগুলোতে সর্বোচ্চ দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে বিশ্বের কাছে প্রমাণ করতে পারে যে আমাদের সামর্থ্য নিয়ে সন্দেহ অমূলক। আমাদের ঝুঁকি আমরাই কাটিয়ে উঠতে পারি। প্রয়োজন কেবল বিশ্ব সম্প্রদায়ের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা। ম্যাপলক্রফটের প্রতিবেদনের পর বিশ্ব সম্প্রদায় সে বিষয়ে আরও উদ্যোগী হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
No comments