মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর-ট্রানজিট সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিন by শহিদুল ইসলাম
৬ সেপ্টেম্বর ২০১১ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং প্রায় ১২০ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে দুই দিনের সফরে বাংলাদেশে আসছেন। তা নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতে হৈচৈ পড়ে গেছে। উভয় দেশের মানুষের মধ্যে আশা-নিরাশা, চাওয়া-পাওয়ার এক আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছে। ভারত একটি বিশাল দেশ। মহাদেশতুল্য। কেবল ভৌগোলিক দিক থেকে নয়, অর্থনৈতিক বিবেচনায় সারা বিশ্বে ভারত আজ ইমার্জিং টাইগার।
বাংলাদেশের জন্মে ভারত প্রত্যক্ষভাবে আমাদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। তাই ভারতের প্রতি একটি রাজনৈতিক সন্দেহ সব সময়ই এ দেশের মানুষের মনে কাজ করে। '৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিকেও অনেকেই ভারতের সঙ্গে দাসত্বের চুক্তি বলে প্রচার চালিয়েছিল। তবে আজ অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের দেশের মানুষ আজ রাজনৈতিকভাবে অনেকটাই সচেতন। তারই প্রতিফলন দেখা যায় বিভিন্ন দলের প্রতিক্রিয়ায়। তবে কিছু লেখার আগে প্রথমেই একটি ধনাত্মক দিকের কথা উল্লেখ করি। তা হলো মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকে স্বাগত জানায় প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন। সিংয়ের এ সফরকে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের সুযোগ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'ভারতের সঙ্গে আমাদের সীমানা, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ এবং পানি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমস্যা রয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে এসব সমস্যা সমাধানের সুযোগ সরকার সদ্ব্যবহার করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির এটি একটি পজিটিভ প্রতিক্রিয়া।
দুই. বিভিন্ন পত্রিকাও মনমোহন সিংয়ের সফরকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। দৈনিক স্টারের ব্যানারহেডে ছাপা হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এ সফর বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের মনে বিপুল আশার জন্ম দিয়েছে। ৬১টি পণ্য ভারতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানির পরিমাণ তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়ে এক বিলিয়ন ডলার হতে যাচ্ছে। এতে খুশি বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ। বাংলাদেশের এ দুটি প্রধান ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে একটি ভোজসভারও আয়োজন করেছে। বোঝা যায়, বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএর সদস্যরা আগামীতে ভারতের সঙ্গে আরো সুদৃঢ় সম্পর্ক আশা করছেন। দুই প্রধানমন্ত্রীর এই বৈঠকে ১১টি চুক্তি প্রটোকল এবং সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তুতি ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এগুলো হচ্ছে, তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টনে অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি, তিন বিঘার ব্যবহার, ছিটমহল ও অপদখলীয় ভূমি বিনিময় চুক্তি, সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমানা চিহ্নিতকরণে সীমান্ত প্রটোকল, ভারত থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি, বাগেরহাটে যৌথ বিনিয়োগে কয়লাভিত্তিক এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন-বিক্রয় চুক্তি, বাণিজ্য চুক্তির আওতায় বাণিজ্য উদারীকরণ তথা ভারতীয় বাজারে ৬১টি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধাবিষয়ক সমঝোতা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিরাপত্তা, বাঘসহ সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, বিটিভি ও দূরদর্শনের মধ্যে অনুষ্ঠান সম্প্রচার বিনিময় এবং দ্বিপক্ষীয় সার্বিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে কাঠামোগত চুক্তি। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গিয়েছিলেন। সেখানে একটি যৌথ ইশতেহার স্বাক্ষরিত হয়। নানা রকম আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে সে ইশতেহারে প্রদত্ত পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়ন মন্থরগতিতে এগিয়ে চলেছে বলে প্রকাশ। এবার সে বিষয়েও আলোচনা হবে এবং সে ইশতেহারের চুক্তি বাস্তবায়নের গিরাগুলো শিথিল করার ব্যবস্থা গৃহীত হবে_এমনটা আশা করা যায়। এ ছাড়া এক বিলিয়ন ডলার ঋণের আওতায় গৃহীত প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি, ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা তৈরি এবং চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারসহ বহু সমস্যা, যা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে, তা সমাধানের পথ খোঁজা হবে। এ ছাড়া সীমান্ত হাট, যা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে; দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা করিডর ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে ঢাকায় একটি যৌথ কেন্দ্র স্থাপন, বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগসহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতাসহ দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।
তিন. দৈনিক সমকাল 'তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি'কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রধান খবরে বিস্তারিত রিপোর্ট করেছে। তিস্তা প্রকল্প বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশ পানির অভাবে সেচসুবিধা পায় না। আবার বর্ষায় বাড়তি পানির তোড়ে প্রতিবছর দেখা দেয় বন্যা, ভাঙন ও শস্যহানি। ওদিকে ভারতে নানা কারণে শুষ্ক মৌসুমে সেচের জন্য বাড়তি পানি ছাড়া যায় না। অথচ বর্ষায় অতিরিক্ত পানি এলে বন্যার আশঙ্কা সত্ত্বেও পানি ছেড়ে দিতে হয়। তাই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রতিবছর এগুলো ক্রনিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। তাই ইতিমধ্যে তিস্তা প্রকল্পের চুক্তিতে ঠিক করা হয়েছে যে ভারতের জন্য ৫২ ও বাংলাদেশের জন্য ৪৮ শতাংশ পানি বণ্টিত হবে আগামী ১৫ বছরের জন্য। এ ছাড়া ফেনী নদী থেকে ৬০ কিউসেক করে পানি নেবে দুই দেশ। বাংলাদেশ-ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি কিছুতেই কমানো যাচ্ছে না। এটা বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ছিল ২৭০ কোটি ডলার। গত এক বছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানির পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধির পরও ২০১০-১১ অর্থবছরে ভারতের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১০ কোটি ডলার। কোটা প্রথার অবলুপ্তি বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে উজ্জীবিত করবে বলে মনে করেন পোশাক শিল্পের মানুষ। এবারের আলোচনায় বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করবে বলে মনে করা হচ্ছে। তাই ভারতে কোটা বৃদ্ধির জন্য অথবা কোটা তুলে দেওয়ার প্রতীক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প। ভারতে বাংলাদেশি পোশাকের চাহিদা আছে। কিন্তু কোটা প্রথা চালু থাকায় রপ্তানি বাড়ছে না। আশা করা যায়, হাসিনা-মনমোহন চুক্তি সে বাধা অপসারণ করবে।
চার. কিন্তু এবারে যে ১১টি চুক্তির কথা জানা গেল, তার মধ্যে ট্রানজিট সম্পর্কে কোনো চুক্তির কথা বলা নেই। অথচ ভারতের পক্ষ থেকে বরাবরই ট্রানজিটের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের ওপর একটা চাপ আছে। ইতিমধ্যে এটা একটা রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। সম্ভবত সে কারণেই ট্রানজিট সম্পর্কে এবার উভয়পক্ষই চুপচাপ। কিন্তু আজকের বিশ্বে যোগাযোগই উন্নয়নের অন্যতম প্রধান সোপান। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো নিজ নিজ দেশের সীমান্ত পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর জন্য খুলে দিয়েছে। পণ্য পরিবহনসহ মানুষের যাতায়াত অনেকটা সহজ হয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও পারস্পরিক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের কথা চিন্তা করছে। চিন্তা করছে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোও। লাতিন আমেরিকা এ ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তাই আমাদেরও ট্রানজিট নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। যত দেরি হবে, আমরা তত পিছিয়ে পড়ব। কিছু মানুষের নতুন কিছুর প্রতি ভয় থাকবেই। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ভারতীয় জুজুর ভয় আমাদের এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদের মজ্জাগত হয়ে গেছে। নির্বাচন এলেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। সেই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের সময় থেকেই এই রাজনৈতিক মনোভাব লক্ষ করা যায়। সে কারণেই হয়তো এবারের আলোচনা থেকে ট্রানজিট প্রসঙ্গ বাইরে রাখা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে সত্বর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা আর কত পেছনে পড়ব? মনমোহন সিংয়ের সফর নিয়ে বিএনপি যে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে, বাংলাদেশের স্বার্থ ১০০ ভাগ রক্ষা করে, আশা করি, ট্রানজিট সম্পর্কে সরকারের ওপর তারা চাপ প্রয়োগ করবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষক
দুই. বিভিন্ন পত্রিকাও মনমোহন সিংয়ের সফরকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। দৈনিক স্টারের ব্যানারহেডে ছাপা হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এ সফর বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের মনে বিপুল আশার জন্ম দিয়েছে। ৬১টি পণ্য ভারতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানির পরিমাণ তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়ে এক বিলিয়ন ডলার হতে যাচ্ছে। এতে খুশি বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ। বাংলাদেশের এ দুটি প্রধান ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে একটি ভোজসভারও আয়োজন করেছে। বোঝা যায়, বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএর সদস্যরা আগামীতে ভারতের সঙ্গে আরো সুদৃঢ় সম্পর্ক আশা করছেন। দুই প্রধানমন্ত্রীর এই বৈঠকে ১১টি চুক্তি প্রটোকল এবং সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তুতি ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এগুলো হচ্ছে, তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টনে অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি, তিন বিঘার ব্যবহার, ছিটমহল ও অপদখলীয় ভূমি বিনিময় চুক্তি, সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমানা চিহ্নিতকরণে সীমান্ত প্রটোকল, ভারত থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি, বাগেরহাটে যৌথ বিনিয়োগে কয়লাভিত্তিক এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন-বিক্রয় চুক্তি, বাণিজ্য চুক্তির আওতায় বাণিজ্য উদারীকরণ তথা ভারতীয় বাজারে ৬১টি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধাবিষয়ক সমঝোতা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিরাপত্তা, বাঘসহ সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, বিটিভি ও দূরদর্শনের মধ্যে অনুষ্ঠান সম্প্রচার বিনিময় এবং দ্বিপক্ষীয় সার্বিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে কাঠামোগত চুক্তি। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গিয়েছিলেন। সেখানে একটি যৌথ ইশতেহার স্বাক্ষরিত হয়। নানা রকম আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে সে ইশতেহারে প্রদত্ত পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়ন মন্থরগতিতে এগিয়ে চলেছে বলে প্রকাশ। এবার সে বিষয়েও আলোচনা হবে এবং সে ইশতেহারের চুক্তি বাস্তবায়নের গিরাগুলো শিথিল করার ব্যবস্থা গৃহীত হবে_এমনটা আশা করা যায়। এ ছাড়া এক বিলিয়ন ডলার ঋণের আওতায় গৃহীত প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি, ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা তৈরি এবং চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারসহ বহু সমস্যা, যা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে, তা সমাধানের পথ খোঁজা হবে। এ ছাড়া সীমান্ত হাট, যা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে; দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা করিডর ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে ঢাকায় একটি যৌথ কেন্দ্র স্থাপন, বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগসহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতাসহ দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।
তিন. দৈনিক সমকাল 'তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি'কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রধান খবরে বিস্তারিত রিপোর্ট করেছে। তিস্তা প্রকল্প বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশ পানির অভাবে সেচসুবিধা পায় না। আবার বর্ষায় বাড়তি পানির তোড়ে প্রতিবছর দেখা দেয় বন্যা, ভাঙন ও শস্যহানি। ওদিকে ভারতে নানা কারণে শুষ্ক মৌসুমে সেচের জন্য বাড়তি পানি ছাড়া যায় না। অথচ বর্ষায় অতিরিক্ত পানি এলে বন্যার আশঙ্কা সত্ত্বেও পানি ছেড়ে দিতে হয়। তাই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রতিবছর এগুলো ক্রনিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। তাই ইতিমধ্যে তিস্তা প্রকল্পের চুক্তিতে ঠিক করা হয়েছে যে ভারতের জন্য ৫২ ও বাংলাদেশের জন্য ৪৮ শতাংশ পানি বণ্টিত হবে আগামী ১৫ বছরের জন্য। এ ছাড়া ফেনী নদী থেকে ৬০ কিউসেক করে পানি নেবে দুই দেশ। বাংলাদেশ-ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি কিছুতেই কমানো যাচ্ছে না। এটা বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ছিল ২৭০ কোটি ডলার। গত এক বছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানির পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধির পরও ২০১০-১১ অর্থবছরে ভারতের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১০ কোটি ডলার। কোটা প্রথার অবলুপ্তি বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে উজ্জীবিত করবে বলে মনে করেন পোশাক শিল্পের মানুষ। এবারের আলোচনায় বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করবে বলে মনে করা হচ্ছে। তাই ভারতে কোটা বৃদ্ধির জন্য অথবা কোটা তুলে দেওয়ার প্রতীক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প। ভারতে বাংলাদেশি পোশাকের চাহিদা আছে। কিন্তু কোটা প্রথা চালু থাকায় রপ্তানি বাড়ছে না। আশা করা যায়, হাসিনা-মনমোহন চুক্তি সে বাধা অপসারণ করবে।
চার. কিন্তু এবারে যে ১১টি চুক্তির কথা জানা গেল, তার মধ্যে ট্রানজিট সম্পর্কে কোনো চুক্তির কথা বলা নেই। অথচ ভারতের পক্ষ থেকে বরাবরই ট্রানজিটের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের ওপর একটা চাপ আছে। ইতিমধ্যে এটা একটা রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। সম্ভবত সে কারণেই ট্রানজিট সম্পর্কে এবার উভয়পক্ষই চুপচাপ। কিন্তু আজকের বিশ্বে যোগাযোগই উন্নয়নের অন্যতম প্রধান সোপান। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো নিজ নিজ দেশের সীমান্ত পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর জন্য খুলে দিয়েছে। পণ্য পরিবহনসহ মানুষের যাতায়াত অনেকটা সহজ হয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও পারস্পরিক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের কথা চিন্তা করছে। চিন্তা করছে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোও। লাতিন আমেরিকা এ ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তাই আমাদেরও ট্রানজিট নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। যত দেরি হবে, আমরা তত পিছিয়ে পড়ব। কিছু মানুষের নতুন কিছুর প্রতি ভয় থাকবেই। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ভারতীয় জুজুর ভয় আমাদের এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদের মজ্জাগত হয়ে গেছে। নির্বাচন এলেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। সেই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের সময় থেকেই এই রাজনৈতিক মনোভাব লক্ষ করা যায়। সে কারণেই হয়তো এবারের আলোচনা থেকে ট্রানজিট প্রসঙ্গ বাইরে রাখা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে সত্বর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা আর কত পেছনে পড়ব? মনমোহন সিংয়ের সফর নিয়ে বিএনপি যে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে, বাংলাদেশের স্বার্থ ১০০ ভাগ রক্ষা করে, আশা করি, ট্রানজিট সম্পর্কে সরকারের ওপর তারা চাপ প্রয়োগ করবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষক
No comments