একজন কবির কথা by তিতাশ চৌধুরী
সৈয়দ হায়দারের সঙ্গে আমার পরিচয় কুমিল্লায়। কর্মোপলক্ষে তিনি সেখানেই ছিলেন কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাটের সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসেবে। আমি তখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ। আমার নাম তো আগে থেকেই তিনি জানতেন। তাই আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য একদিন কলেজে গিয়েই উপস্থিত হয়েছিলেন।
আমিও কবি হিসেবে সৈয়দ হায়দারকে জানতাম, কিন্তু তার সঙ্গে এর আগে কোনোদিন দেখা হয়নি কিংবা পরিচয়ও ঘটেনি। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে একজন প্রিন্সিপালকে ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়। তবু সেদিন সৈয়দ হায়দারকে অনেক সময় দিয়েছিলাম এবং সাহিত্য ছাড়াও অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ করেছিলাম। তার সঙ্গে প্রথম আলাপেই বুঝলাম তিনি মজলিশি মানুষ। আলাপ করতে পছন্দ করেন। আলাপের ফাঁকে তিনি আবার সুন্দর করে হাসেনও। কথা কি শেষ হয়? এক সময় তিনি আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠে গেলেন। অমি যাওয়ার সময় আমার সদ্য প্রকাশিত ‘কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাস’ বইটির একটি কপি তাকে উপহার হিসেবে দিলাম। অন্য কোনো বই তখন আমার হাতের কাছে ছিল না। সপ্তাহ খানেক পর আবার তিনি একটি ম্যাগাজিন সাইজের পত্রিকা হাতে নিয়ে আমার কাছে এলেন এবং আমাকে দিলেন। পত্রিকাটির পাতা উল্টিয়ে দেখলাম তিনি তাতে একটি কলাম লিখেন এবং এবারের লেখার বিষয় ‘কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাস’। আমি সৈয়দ হায়দারের এই কাণ্ড দেখে একেবারে হতবাক। কলেজের ইতিহাস সম্পর্কে দীর্ঘ এক আলোচনা। আমি তা পাঠ করে আনন্দবোধ করি। কবি সৈয়দ হায়দারকে ধন্যবাদ জানাই। এরপর থেকে সৈয়দ হায়দারের সঙ্গে আমার হৃদ্যতা বেড়ে যায়। তিনি তখন শুধু কলেজে নয়, অবসর পেলে আমার বাসায়ও চলে আসতেন। আমরা তখন গল্প করতাম। নানা জাতের গল্প। রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য কোনো বিষয়ই বাদ পড়ত না। তার কথা বলার একটা স্টাইল আছে। তিনি কিছুক্ষণ কথা বলেই একটা হাসি দিতেন। হাসিটি মনকে স্পর্শ করত।
ভিক্টোরিয়া কলেজের বাসার একটি নাম ছিল। রবীন্দ্রনাথের একটি কাব্যের নাম পূরবী। এই পূরবীতেই যতদিন তিনি কুমিল্লায় কর্মরত ছিলেন ততদিন মাঝে মাঝে চলে আসতেন আড্ডা দেয়ার জন্য। বলতে কী, আমারও খুব লেগে গিয়েছিল তাকে। একদিন বিকেলে দেখি সৈয়দ হায়দার অনেক কাব্যগ্রন্থ নিয়ে পূরবীতে হাজির। অন্তত ১২/১৪টা কাব্যগ্রন্থ তিনি আমাকে উপহার দিলেন। এর দুই-একটি গ্রন্থ ভারত থেকেও বের হয়েছে দেখলাম। আমি বিস্ময়ে অবাক হলাম এই ভেবে যে অতগুলো কাব্যগ্রন্থ রচয়িতা হয়েও তার কোনো অহংবোধ ছিল না। বলতে কী তিনি ছিলেন একজন সাধারণ মানুষের মতো। তার চলনে বলনে কখনও কবিভাব পরিলক্ষিত হয় না। কী কী বই তিনি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন? কোনো সুখবর নেই, ভুলগুলো নাড়া দেয়, ধ্বংসের কাছে আছি, প্রতিপদে সীমান্ত, ভাঙলে মাটির মতো, পাতা থেকে পাখি, কাছে থেকে প্রবাসিনী, নেহাই, উত্তরবঙ্গ, কে বিতর্কিত কে তর্কাতীত, অরিষ্ট দু’জন দু’জনকে, বয়স যখন দিচ্ছে তাড়া, ছিন্নভিন্ন, সূত্র, আগদুয়ারী, আঁধারের শেষ ভালোবাসি ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। আমি বইগুলো পেয়ে দারুণ খুশি হয়েছিলাম। অবসর সময়ে তার কাব্যগুলো পড়ি। একদিন, দু’দিন—এভাবে পড়তে পড়তে শেষ করে ফেলি। হঠাত্ মনে উদয় হলো বইগুলো যখন পড়েই ফেলেছি, তখন এ সম্পর্কে একটু লিখেই ফেলি। অবশেষে তার কাব্যগুলো নিয়ে একটি প্রবন্ধ দাঁড় করালাম। তারপর ‘জনকণ্ঠে’ পাঠিয়ে দিলাম। ‘জনকণ্ঠে’র সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন তখন কবি নাসির আহমেদ। তিনি লেখাটি সৈয়দ হায়দারের এক জন্মদিনে তার সাহিত্য পাতায় ছেপে দিলেন। লেখাটি বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। সৈয়দ হায়দার তো আমার এই লেখাটি পাঠ করে খুশিতে কেঁদেই ফেললেন। কবি আতাহার খানও লেখাটার প্রশংসা করলেন। কী লিখেছিলাম? লিখেছিলাম ‘কবি হায়দার সহজ, খোলামেলা, প্রাণবন্ত মানুষ। তিনি কবিতা লেখেন ঠাহর করা কঠিন। তিনি যেমন ধীরপদে আত্মবিশ্বাস নিয়ে হাঁটেন, তেমনি ধীরলয়ে কথা বলেন। কখনও কখনও কোনো ঘটনার আকস্মিক উন্মোচনে নৌকোর দাঁড় বাওয়া শব্দের মতোন ছলাত্ ছলাত্ করে ওঠেন। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ। আবার কথার বুনন শুরু হয়—ঠিক তার কবিতার মতন। কোনো একটি জায়গায় এসে তিনি আবার থামেন; যেমন তার কবিতা। তারপর পাশের জানালা খুলে যতটুকু দেখা যায় তার চিত্রই আঁকেন তিনি তার কবিতায়। দেখার বাইরের অংশটুকু কবিতার সান্ধ্য ভাষায়ও পরাবাস্তবতার সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায়। ফলে তার কবিতায় অনেক ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হয়। আমরা তার ভিন্নমাত্রা ও আঙ্গিকের কবিতা পাঠ করে আনন্দ উপভোগ করি। পরিপার্শ্ব তথা নিজের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই কবিতা লেখেন তিনি। তার কবিতার তার ভ্রমণের বিচিত্র পরিবেশ পাই।
মানুষ হিসেবেও কবি হায়দার প্রথম শ্রেণীর। মনের গহনে কোনো জ্যামিতিক জটিলতা নেই, যেমন নেই তার কবিতায়। কবি হায়দার মানুষ হিসেবেও রোমান্টিক। রোমাঞ্চ তিনি কবিতায় ধারণ করেছেন অবলীলায় অসাধারণভাবে। তার অনেক কবিতায় আছে রোমান্টিকতার আগুন। যে আগুন পাঠককে এবং পাঠকের মনকেও পোড়ায়। এ পোড়ানোর ভেতরই বোধ করি কবি হায়দারের কবিতার সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়।’ এই কবি হায়দারই আজ গুরুতর অসুস্থ। এ কথা ভাবতেই মনের ভেতর এক ধরনের কষ্টের, এক ধরনের ব্যথা-বেদনার তীব্র জ্বালা শুরু হয়। কবি হায়দার নিশ্চয়ই আবার সুস্থ হয়ে উঠবেন। আমি চাই সৈয়দ হায়দার আবার কবিতা লিখতে শুরু করুক। তিনি দ্রুত সত্য ও সুন্দর হয়ে উঠুক।
লেখক : কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ ও অলক্ত সম্পাদক
No comments