দেখার ভেতরে বাইরে দেশ ও স্বাতন্ত্র্য by মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান


দেশে এক সময় ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। জানি না এ কথা বর্তমান প্রজন্মের কতজনের মনে রেখাপাত করে, কতজনের কাছে গৌরবের। সেই আন্দোলন সংগ্রামের পর্যায়ে উপনীত হয়। সেই সংগ্রামে আমরা নিরস্ত্র ছিলাম, তবে নিরস্ত ছিলাম না। প্রতিপক্ষ, যারা আমাদের ভাষার অধিকার দিতে চায়নি, তারা ছিল সশস্ত্র।
তারপরও আমরা ছিলাম বীর, তারা ছিল কাপুরুষ। আমরা অকুতোভয়ে গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছিলাম, আর কাপুরুষরা সেই অগ্রসরতাকে ঠেকাতে না পেরে গুলি ছুড়েছিল। আমরা রক্ত দিয়েছিলাম—প্রাণ দিয়েছিলাম। তারা প্রাণ নিয়েও আমাদের প্রতিরোধ করতে পারেনি। আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম, প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম আমাদের ভাষার মর্যাদা। এমন ঘটনা পৃথিবীতে বিরল। ভাষার জন্য ভারতের তামিলরাও প্রাণ দিয়েছিল; কিন্তু রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় তাদের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি।

আমাদের এই দেশটা স্বাধীন হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। ১৯৭১’র ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু মুক্তি সংগ্রাম-স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সংগ্রাম শব্দটির দুটি অর্থ বাংলা একাডেমী প্রকাশিত অভিধানে পাওয়া যায়। ‘যুদ্ধ’ এবং ‘প্রচেষ্টা’। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার পরপরই কোনো যুদ্ধ শুরু হয়নি। তাই বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ‘সংগ্রাম’কে প্রচেষ্টাই ধরতে হবে। কারণ এরপরও তিনি ইয়াহিয়া খানকে প্রেসিডেন্ট মেনে, তার সঙ্গে আলোচনার পর আলোচনা চালিয়ে যান। যুদ্ধ নিরস্ত্র অবস্থায় হয় না। উভয়পক্ষের সশস্ত্র অবস্থায় যে সংঘর্ষ, তাকেই যুদ্ধ বলা যায়, যা ঘটেছিল ’৭১-এর ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। অনেকের মতে, যেমন ম্যক্ক্যারেনহাসের ‘দ্য রেপ অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থানুযায়ী সেদিন রেসকোর্স ময়দানে যে স্বাধীনতাকামী মানুষের সমাগম হয়েছিল, তারা যুদ্ধের নির্দেশ যদি পেতেন এবং ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণে ধাবিত হতেন ‘যার কাছে যা আছে, তাই নিয়ে’, তবে বড়জোর সহস্র প্রাণের বিনিময়ে একদিনের যুদ্ধেই দেশ স্বাধীন হতে পারত। কারণ, ক্যান্টনমেন্টের বাঙালি সেনা অফিসাররাও নিঃসন্দেহে স্বাধীনতাকামীদের সঙ্গে যোগ দিতেন। একই ঘটনা ঘটত অন্যান্য ক্যান্টনমেন্টেও। সে সময় এ দেশে অবাঙালি সৈন্যের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। সাত থেকে পঁচিশ মার্চ পর্যন্ত জাহাজ এবং বিমানে করে অপ্রতিহতভাবে প্রচুর অবাঙালি সেনা আনা হয়। এই সুযোগ না দেয়া হলে ২৫ মার্চের নৃশংস গণহত্যার সুযোগ পেত না পাকিস্তান বাহিনী, শরণার্থী হতে হতো না প্রায় এক কোটি মানুষকে এবং ভারতকেও যুদ্ধে জড়াতে হতো না। যে অবস্থার সৃষ্টি হতো, তাতে হাজার মাইল দূরত্বের প্রতিকূলতা পেরিয়ে এসে যুদ্ধ করা সম্ভব হতো না ইয়াহিয়া বাহিনীর পক্ষে। এ দেশের লাখো মাতা-ভগ্নির সম্ভ্রম যেত না। আর বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য অনুযায়ীই—ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তস্নাত হতে হতো না দেশের মাটিকে।
এমন ঘটনা ঘটতে পারত কিনা, তা নিশ্চিত করে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ নই। এমন ঘটনা ঘটলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার কী বা কেমন প্রতিক্রিয়া হতো তাও আমার ধারণার বাইরে। আমি শুধু দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্লেষকের মন্তব্য তুলে ধরলাম। বাস্তবে আমরা যা দেখেছি তা হল ন’মাস ধরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। হানাদারদের নৃশংসতা, গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া, নিরীহ মানুষের ওপর নির্যাতন ও নির্বিচার হত্যা, নারীকে ধরে নিয়ে যাওয়া ও নির্যাতন, বুদ্ধিজীবী নিধন, রাজাকার-আলবদর নামক মীরজাফর বাহিনীর জন্ম, যুদ্ধক্ষেত্রে তরুণ তাজা প্রাণ মুক্তিযোদ্ধার শাহাদাত্ বরণ, অবশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মার খেয়ে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর দিশাহারা অবস্থা ও আত্মসমর্পণ। বিজয়ী বেশে মাথা তুলে দাঁড়ানো একটি পতাকা, একটি দেশ। দেশটির নাম বাংলাদেশ। ভাষার নামে নাম। বাংলাদেশ-বাংলাভাষা। দেশটির নাম শুধু ‘বাংলা’ হলো না কেন? কেন ‘দেশ’ শব্দটি যুক্ত করা হলো ‘বাংলা’র সঙ্গে? এ কথাটি বলার জন্যই আমার এতক্ষণের দীর্ঘ ভূমিকা। না, দেশটির নাম শুধু ‘বাংলা’ না রেখে ‘বাংলাদেশ’ রাখাটা কোনো ভুল বা অসতর্কতা বা খামখেয়ালির বশে হয়নি। হয়নি কোনো অপরিণত চিন্তা থেকেও। আমাদের দেশটা বাংলাদেশ। এখানেই আমাদের স্বাতন্ত্র্য, এখানেই আমাদের আমিত্ব। স্বাধীনতাযুদ্ধের ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই ভূখণ্ড যেমন পূর্ব পাকিস্তান থাকেনি, তেমনি পূর্ববাংলাও থাকেনি। কারণ পূর্ব থাকলে পশ্চিম থাকতে হয়। যেমন পশ্চিম পাকিস্তান এবং পশ্চিম বাংলা। স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আমরা যেহেতু পূর্ব পাকিস্তান নামটি মুছে দিয়েছিলাম, সেহেতু পশ্চিম পাকিস্তান বলে কিছু আর আমাদের কাছে ছিল না, ছিল পাকিস্তান। বাংলার ক্ষেত্রে বিষয়টি অন্যরকম। পশ্চিম বাংলা বলে একটি অঞ্চল তখনও ছিল, এখনও আছে, তবে তা কোনো দেশ নয়, ভারতের একটি অংশ। তারা ভাষা সংগ্রাম করেনি, মুক্তিযুদ্ধও করেনি। এখানেই আমাদের সঙ্গে তাদের চেতনাগত, জাতিগত, সংস্কৃতিগত পার্থক্য। আমরা বাংলাদেশী, তারা ভারতীয়। এই যে স্বাতন্ত্র্যবোধ আমাদের, এর নামই স্বাধীনতা। তাই আমাদের কাছে এপার বাংলা ওপার বাংলা বলে কোনো শব্দ থাকতে পারে না। ১৯৪৭’র পর থেকে আমাদের অর্জন অনেক। পক্ষান্তরে বৃহত্ ভারতের মধ্যে কত আত্মবিলুপ্ত হওয়া যায় এটাই তাদের সাধনা। বাংলা নিয়ে তাদের কোনো অর্জন নেই। আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম অংশের চেতনা নিয়ে আমাদের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, ভারতীয় বঙ্গের কাছ থেকে তার কোনো কিছুই পাওয়ার বা নেয়ার নেই। কোনো সংজ্ঞাতেই তারা আমাদের কাছে অনুসরণীয় নয়; বরং তারা চাইলে আমাদের অনুসরণ করতে পারে।
লেখক : কবি, গীতিকার ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.